ছোটবেলায় মা, চাচি ফুপুদের দেখতাম বেশ জমিয়ে পান খেতেন। পান সাজানোর সময় পানের খিলিতে ছোট্ট এক টুকরো খয়ের দিতে ভুলতেন না তারা। মাঝে মাঝে শখ করে পান খেতে চাইলে মা ছোট্ট একটা পান বানিয়ে দিতেন আমাকে কিন্তু তাতে খয়ের দিতেন না। তার ফলে আমার ঠোটও তেমন লাল হতো না। তাদের ধারণা ছিল খয়ের খেলে আমার দাঁত লাল হয়ে যাবে। ধারণাটা অমূলক নয় অনেকদিন ধরে পানের সাথে খয়ের খেলে দাঁত লাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে যাই হোক আমার কিন্তু সেই ছোট এক টুকরো খয়েরের দিকে বরাবরই আকর্ষণ ছিল। একদিন মায়ের অজান্তে খয়েরের একটি বড় টুকরো পান ছাড়াই মুখে পুরে দিলাম। আমার ধারণা ছিল চকোলেটের মত সুস্বাদু হবে খেতে। বলাই বাহুল্য, এর যে এত বিশ্রী তেতো স্বাদ তা জানা ছিল না। এরপর অনেকদিন বুঝিনি কেন মা চাচিদের খয়ের খেতে হয় পানের সাথে। এখন বুঝি ঐ তেতো বা কটা স্বাদটাই তাদের নেশা হয়ে গিয়েছিল। আজও মানুষ খয়েরসহ পান খেয়ে চলেছেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ভারতসহ পৃথিবীর আরও অনেক দেশে। এখন পান পাওয়া যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ টন পান রপ্তানি হচ্ছে সৌদি আরবে। সেখান থেকে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বেশির ভাগ অংশের খাদক অবশ্য আমাদের এই দক্ষিন এশিয়ার মানুষরাই।
বিশেষ এক গাছের রস থেকে তৈরি হয় পানের বিশেষ উপাদান খয়ের, যা পানের সাথে খাওয়া হয়। প্রথমে কুড়াল দিয়ে গাছের ছাল ছাড়িয়ে নেন কারিগররা। গাছের ছালসহ সাদা অংশ তুলে ফেলা হয়। ছাল ছাড়ানোর পর গাছ কেটে টুকরো টুকরো করে তৈরি করেন উড-চিপস। ১৫ বছরের গাছ খয়ের উৎপাদনের উপযোগী হয়। ভিতরের লালচে কাঠ কুচি কুচি করে কেটে বিশেষ পদ্ধতিতে তাপ দেওয়া হয়। উড চিপসগুলোকে বিশেষ ধরণের পাত্রে ভরে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। ১০-১২টি পাত্রে উড চিপস ভরে বিশেষ এক ধরণের চুলোয় অনেক সময় ধরে জ্বাল দেওয়া হয়। অনেক ক্ষণ ধরে জ্বাল দেওয়ার ফলে সিদ্ধ কাঠের টুকরো থেকে বেড়িয়ে আসে লাল রঙের নির্যাস। খয়েরের নির্যাস ভালোমত বের হওয়ার পরে ছেঁকে নেওয়া হয় এই নির্যাস। এই ছেঁকে নেওয়া নির্যাস ঢেলে দেওয়া হয় বড় চৌকোণা টিনের পাত্রে আবারও জ্বাল দেওয়ার জন্য। একটানা ৯ ঘন্টা জ্বাল দেওয়া হয়। এরপর এক সময় পরীক্ষা করে দেখা হয় নির্যাস ঘন হলো কিনা এবং জমাট বাঁধার উপযোগী হলো কিনা। ক্রমাগত জাল দিতে দিতে এক সময় জমাট বাধার উপযোগী হলে ঘন নির্যাসকে ছেকে নিয়ে বিভিন্ন পাত্রে রাখা হয় জমাট বাঁধার জন্য। দেশের বেশির ভাগ খয়েরের চাহিদা মেটায় উত্তর বঙ্গের এই কারিগররা। এই খয়েরই পানের সাথে খাই আমরা।
একাশিয়া ক্যাটেচু (Acacia catechu) বা খয়ের গাছ একটি মাঝারি আকারের কাঁটাযুক্ত গাছ। খয়ের গাছ Fabaceae বা Leguminosae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত ১৫ ফুট লম্বা হয়ে থাকে এই গাছ। গাছের ছাল গাড়ো বাদামী থেকে কালো রঙের হয়ে থাকে। ছাল লম্বা স্ট্রিপে ছিলে নেওয়া যায়। মাঝে মাঝে সরু আয়তাকার প্লেটের মত করে কেটে নেওয়া হয়। মাঝখানের সারকাঠ (Heartwood) লালচে বাদামী রঙের হয়ে থাকে। এই গাছের ডালপালা পাতলা এবং ডালপালাগুলো বাঁকানো থাকে। ডালপালা রোমশ থাকে যখন গাছের বয়স কম থাকে। বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে গাছের রোম কমে যেতে থাকে। এই গাছের পাতা সবুজ। প্রতিটি পাতার বোঁটার গোড়ায় বাকানো কাঁটা থাকে। পাতা দ্বিপক্ষল কম্পাউন্ড এবং গ্রন্থিময়। রোমযুক্ত পাতা ১০ থেকে ১৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয় এবং লম্বালম্বি সমান্তরাল দাগ করা থাকে। ফুল ছোট, সাদা অথবা হলুদ রঙের হয়ে থাকে। ফল সাধারণত মসৃণ বা এবড়ো থেবড়ো হয়ে থাকে। সেনেগালিয়া ক্যাটেচু (Senegalia catechu) আর একটি প্রজাতি যা থেকে খয়ের তৈরি হয়।
জেনেরিক নাম ‘Acacia’ এসেছে গ্রীক শব্দ ‘akis’ থেকে যার অর্থ point বা barb (কাঁটা)। গরম কালে একাশিয়া ক্যাটেচু (খয়ের) এর গাছে পাতা থাকে না। ফেব্রুয়ারি মাসে পাতা ঝরে যায় এবং আবার নতুন পাতা আসে এপ্রিলের শেষ থেকে মে পর্যন্ত। নতুন পাতার সাথে সাথে ফুলও আসে। জুলাই ও আগস্ট মাস পর্যন্ত ফুল ফুটিয়ে চলে এই গাছ। দ্রুত ফল তৈরি হয় এবং সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের দিকে ফল পরিপক্ক হয়। ফলের গায়ে লম্বা লম্বি দাগ টানা থাকে। প্রতিটি ফলে ১০ থেকে ১৫টি বীজ থাকে। এই ফল প্রথমে লালচে সবুজ থেকে বাদামী রঙ ধারণ করে। নভেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে এই ফল পেকে যায়। এর পরই ফল ফেটে যায় এবং বীজ ছড়িয়ে পড়ে। কিছু ফল গাছেই থেকে যায় এবং পোকা-মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া বীজ থেকে চারা গজিয়ে ওঠে বৃষ্টির পানি পেলে।
আদি বাস হিমালয়ের অঞ্চলে। ৫০০০ ফুট উচ্চতায় এই গাছ জন্মাতে পারে। এরা শুষ্ক এবং বাতাস বহুল আবহাওয়া পছন্দ করে। একাশিয়া ক্যাটেচু গাছগুলো পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগালেও চাষ করা হয়। ভারতের হরিয়ানাতে জন্মায় প্রাকৃতিকভাবে। খয়ের গাছের কাঠ খুব শক্ত হয় বলে রথ তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা হয়। এই কাঠ জ্বালানীর কাজে এবং বাসন পাত্র তৈরির কাজেও ব্যবহার করা হয়। এই গাছের জমাট করা শক্ত নির্যাস (khadirasara) দামি পাথরের মত ব্যবহার করা হয় গহনা তৈরিতে।
খয়ের গাছ নানা রকম ঔষধি গুনে সমৃদ্ধ। রক্তে সমস্যা, দাঁতের বিভিন্ন রকম সমস্যা, কাশি, শ্বেতী রোগ, ডাইরিয়া, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, স্প্লিনের সমস্যা, স্পীচ ডিসঅর্ডার, ইমিউন সিস্টেম ডিসঅর্ডার ইত্যাদি রোগের মহাঔষধ। ঔষধ তৈরি হয় ছাল এবং নির্যাস থেকে। খুব ভালো হারবাল ঔষধ যা দাঁতের বিভিন্ন সমস্যায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন দাঁতের অস্থিক্ষয় রোগ, গাম ইনফেকশন, পাইওরিয়া ইত্যাদি রোগে ব্যবহৃত হয়। এর আছে এনটি-মাইক্রোবিয়াল গুনাবলী। মাউথ ফ্রেশনার হিসেবে কাজ করে এবং মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। এদের প্রাকৃতিক ভাবে দাঁত পরিষ্কার করার গুণাবলী থাকার কারণে এই গাছের নরম এবং কচি ডাল হারবাল দাতন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।
রক্ত বিশুদ্ধিকরণে বিরাট ভূমিকা রাখে খয়ের গাছ এবং রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখে। অন্যান্য ওষুধের পাশাপাশি এই গাছের ওষুধ ব্যবহার করা হয় শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায়। এটা ডাইজেস্টিভ সিস্টেমের জন্য মহাঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডাইজেস্টিভ গ্লান্ডগুলোর সিক্রেশন সঠিক মাত্রায় হওয়ার জন্য এই ওষুধ ভালো কাজ করে। পাকস্থলীতে এসিডের মাত্রা রেগুলেট করে। গ্যাস্ট্রিক এবং পেপ্টিক আলসারে এই গাছের পাওডার খাওয়ানো হয় রক্ত বন্ধ করার জন্য।
রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী খয়ের শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। খয়েরের গাছ কমে যাচ্ছে। নতুন করে গাছ লাগানোর তেমন উদ্যোগ নেই। চাটঘাট, থামুর হাট, খানসামা, হরিপুর ও বীরগঞ্জ সহ রাজশাহীর নানা জনপদে এই কাজ করে চলেছে কর্মীরা। সরকারের সাহায্যের অভাবে এই শিল্পের সাথে জড়িত কর্মীরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। একসময় এই পেশার সাথে জড়িত ছিলেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। এখন তা দুই হাজারের কোটায় নেমে এসেছে। এমন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে এক সময় এই শিল্পটি দেশ থেকে হারিয়ে যাবে। ১৯৫২ সনে রাজশাহীর গোপালপুর গ্রামে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এরপর পঞ্চাশের দশকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা মানুষদের জড়িত হওয়ার ফলে এই শিল্পের বিকাশ ঘটে। স্থানীয়রাও এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এখনও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বাপ-দাদার এই ব্যবসাকে ধরে রেখেছেন কিছু কর্মী। বিদেশী আমদানিকৃত খয়েরের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে স্থানীয় কর্মীরা। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক।
Disclaimer : The purpose of this article is for education and discussion, not prescription to the patients. They need to meet qualified doctors for their safety.
সূত্রঃ mynaturalorigins.store, cpreecenvis.nic.in, commons.wikimedia.org, thehimalayancatechu.com