না এ অযোধ্যা রাম জন্মভূমি অযোধ্যা নয়, পুরুলিয়ার বিখ্যাত অযোধ্যা পাহাড়ও নয়। এ অযোধ্যা বিষ্ণুপুর থেকে সামান্য দুরে বাঁকুড়া জেলার দ্বারকেশ্বর নদের তীরে ছবির মতন সুন্দর এক গ্রাম। সে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রকৃতি, ইতিহাস, ব্যতিক্রমী রীতির মন্দির নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। এখন থেকে পঞ্চাশ বছরেরও বেশী আগে জেলার ক্ষেত্র সমীক্ষা করতে এসেছিলেন বাঁকুড়া জেলার পুরাকৃতির লেখক অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়।তখন তিনি খড়গপুর-আদ্রা রেলপথের রামসাগর স্টেশনে (বিষ্ণুপুরের পরের স্টেশন) নেমে কাঁচা রাস্তায় দ্বারকেশ্বর নদ পার হয়ে ১৩ মাইল দূরের গ্রাম অযোধ্যায় পৌঁছান। অবস্থার আজ আমুল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এখন বিষ্ণুপুর থেকে দশ কিমি দূরে সোনামুখী যাওয়ার পথে পড়ে জয়কৃষ্ণপুর। আর জয়কৃষ্ণপুর মোড় থেকে বাঁদিকের রাস্তা ধরে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার গেলেই অযোধ্যা গ্রাম।
অমিয়বাবু “ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলের এক নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলেন গ্রাম প্রান্তে”। তিনি আরও লিখছেন, “সংস্কৃত শিক্ষার একদা-বিখ্যাত এই কেন্দ্র থেকে সংগৃহীত কাব্য, ব্যাকরণ, ন্যায়, স্মৃতি, দর্শন ও জ্যোতিষের বহু পুঁথি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিষ্ণুপুর শাখায় রক্ষিত আছে। বন্দ্যোপাধ্যায় উপাধিধারী স্থানীয় জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠিত পুরাকীর্তিগুলি গ্রামের প্রধান দ্রষ্টব্য”। পঞ্চাশ বছর আগে দেখা সুবিশাল রাজবাড়ীর অনেকটাই আজ জরাজীর্ণ। সিংহ দুয়ার থেকে রাজবাড়ী সবই আজ কালের নিয়মে ধ্বংসের মুখে। তবে নহবৎখানা, পাইক বরকন্দাজ এর জন্য নির্দিষ্ট ঘর, বিভিন্ন মহল নিয়ে এক সময় যে অযোধ্যার রাজবাড়ী গমগম করতো তা আজও বুঝতে অসুবিধা হয় না। অনেক কিছু ভেঙে গেলেও এখনও কিছু কিছু পুরাকৃতি অক্ষত রয়ে গিয়েছে।
আসুন অমিয়বাবুর জবানীতে সেগুলি দেখে নেওয়া যাক। “এক বৃহৎ অঙ্গনের উত্তর সীমানায় ইটের তৈরি ও পলস্তারা- আবৃত দক্ষিণমুখী বারোটি শিবমন্দির পাশাপাশি স্থাপিত। পঞ্চরথ দেউল-রীতির এ দেবালয়গুলি দৈর্ঘ্যপ্রস্থে ১০ ফুটের বেশী নয় ও উচ্চতায় আনুমানিক ১৫ ফুট। অঙ্গনের উত্তর-পূর্ব কোণের ইটের তৈরি পশ্চিমমুখী গিরিগোবর্ধন মন্দিরটি এক অভিনব নির্মাণ-রীতির নিদর্শন, যে বিষয়ে ইতিপূর্বে কিছু বলা হয়নি। কৃষ্ণের গিরিগোবর্ধন ধারণের সুপরিচিত কাহিনীটির অনুসরণে দেবগৃহের চালা প্রচলিত কোনও পদ্ধতিতে তৈরি না ক’রে বড় বড় শিলাখণ্ডের আকারে বিস্তস্ত। মন্দিরের বিগ্রহও সাধারণত গিরিগোবর্ধনধারী কৃষ্ণ। বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী, কোতুলপুর, রাজগ্রাম প্রভৃতি স্থানেও এহেন দেবালয় দেখা যায়। মন্দিরটি উচ্চতায় প্রায় ২৫ ফুট ও দৈর্ঘ্যগ্রন্থে ১৫ ফুট”।
তিনি যেটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছিলেন তা হল উত্তর-পশ্চিম কোণের সতরো-চূড়াযুক্ত, আটকোণা রাসমঞ্চটি। যেটি বীর হম্বীর প্রতিষ্ঠিত বিষ্ণুপুরের অতুলনীয় রাসমঞ্চটি বাদ দিয়ে বাঁকুড়া জেলায় এ জাতীয় ইমারতের মধ্যে সর্ববৃহৎ হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। প্রতি দিকের দৈর্ঘ্যে প্রায় ৮ ফুট ও উচ্চতায় প্রায় ২৫ ফুট, এই রাসমঞ্চে গিরিগোবর্ধনের বিগ্রহ রাসের সময় এনে রাখা হয়। অমিয়বাবু পুরাকীর্তিগুলির কোনটিতেই প্রতিষ্ঠাফলক দেখতে পান নি। তবে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের কুলপঞ্জী থেকে জানা যায়, আনুমানিক একশো ষাট বছর আগে এ বংশের গদাধর, কৃষ্ণমোহন, রামমোহন ও লালমোহন নামে চার সহোদর তাঁদের মা রঙ্গমণির নামে রাসমঞ্চটি প্রতিষ্ঠা করেন। অন্য ইমারতগুলি একই সময়ে তাঁদের দ্বারাই নির্মিত।
১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রায় ৮ ফুট উচ্চতার এক পিতলের রথও এনারা নির্মাণ করেন। গ্রামের অন্যত্র পাথরের এক চারচালা মন্দিরের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। আমাকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখালেন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের ম্যানেজার মনোহর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়। একেবারে দক্ষিণে রয়েছে শ্রীরাধাদামোদর ও বংশীয়গোপাল জীউয়ের দোতলা মন্দির। পাশেই রয়েছে দুর্গামন্দির আর একটি বড় দালান। পেশায় স্কুল শিক্ষক মনোহরবাবু জানালেন, “আনুমানিক ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ভট্ট নারায়ণের ৩২তম অধস্তন পুরুষ হরি বন্দ্যোপাধ্যায় অযোধ্যায় আসেন। তিনিই অযোধ্যায় বসবাসকারী সমস্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বংশীয়দের আদি পুরুষ। হরি বন্দ্যোপাধ্যায়রে অধস্তন চতুর্থ পুরুষ নিমাই চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের চার পুত্র ও এক কন্যা জন্মগ্রহন করে। তারা যথাক্রমে কৃষ্ণমোহন, রামমোহন, লালমোহন, গদাধর ও কন্যা সখিমনি।
কর্মবীর রামমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এর সময় থেকে জমিদারি বংশের শুরু। জমিদারি বংশের প্রথম ও প্রধান কাণ্ডারী ছিলেন রামমোহন। তার অর্জিত অর্থের সাহায্যে বড় ভাই কৃষ্ণমোহন নতুন নতুন জমিদারী, স্বত্ত্ব কেনেন। এ কাজে তাকে সাহায্য করেন সেজ ভাই লালমোহন। জমিদারী বংশের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয় রামমোহনের আমলে। পরবর্তীকালে গদাধর বন্দ্যোপাধ্যায় জমিদারীর আরও উন্নতি করেন এবং ১৮৬০ সালে “রায় বাহাদুর” উপাধি লাভ করেন”। অন্যান্য আর সব জমিদারীর মতন এনারাও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অস্তিত্বের সঙ্কটে পরেন। যার কিছুটা ওনারা আজ কাটিয়ে উঠেছেন। সব মিলিয়ে অযোধ্যা এক সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে দ্রুত গড়ে উঠবে বলে তিনি গভীর আশাবাদী।
খুবই তথ্যপূর্ণ লেখা। জরুরি লেখা।নিজের রাজ্যকে চেনা দরকার।।
চিনলাম।জানলাম।
ধন্যবাদ
খুব ভালো লাগলো ধন্যবাদ আপনাকে। ভবিষ্যতে এই রকম পোস্ট আরো বেশি করে আপনার কাছে থেকে আশা করছি।।।।
আরো তুলে ধরার ইচ্ছা রইলো
আরো এরকম অল্প পরিচিত যায়গা তুলে ধরার ইচ্ছা রইলো
খুব ভালো হয়েছে🙏
খুবই তথ্যপূর্ন পোস্ট। পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। এরকম আরো অজানা জায়গার সন্ধান পেলে খুশী হব।
আমাদের আশেপাশে এরকম অনেক যায়গা রয়েছে এগুলিকে তুলে ধরার একটি প্রয়াস । ধন্যবাদ
নিশ্চয়ই চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ
চমৎকার।
বাঁকুড়া র অযোধ্যা কথা খুব ভালো লাগলো।
আমার এখানে ও রয়েছে অযোধ্যা।
তার পাশে বনকাটি।
মন্দিরময় অযোধ্যা বনকাটি। আমার নানাবিধ প্রবন্ধে লিখেছি এখানের কথা।
অযোধ্যা নামকরণের উৎস কি!
উত্তর ভারতীয় কোন প্রভাব!
ঠিক। আমার প্রবন্ধে লিখেছি, একাধিক অযোধ্যা আছে। বনকাটি দেখতে যাবো ।
খুব ভালো লাগল।