সোমবার | ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৩২
Logo
এই মুহূর্তে ::
ফ্ল্যাশব্যাক — ভোরের যূথিকা সাঁঝের তারকা : রিঙ্কি সামন্ত সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (চতুর্থ পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস মিয়ানমার সংকট, প্রতিবেশি দেশের মত বাংলাদেশকে নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সিকাডার গান’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (তৃতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (শেষ পর্ব) : উৎপল আইচ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (দ্বিতীয় পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (চতুর্থ পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (শেষ পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ প্রথম পাঠ — সায়র আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘এক মন অন্য মন’ প্রেমময়তার গাল্পিক দলিল : সৌমেন দেবনাথ আন্তন চেখভ-এর ছোটগল্প ‘গুজবেরি’ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নাগরিকবৃত্তের যন্ত্রণা (প্রথম পর্ব) : মিল্টন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (তৃতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৭তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ স্প্যানিশ ফ্লু থেকে বাঁচতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পেনে গেলেন না : অসিত দাস ভোটের হার কম, ভোটারদের উৎসাহ কম, চিন্তায় বিজেপি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (দ্বিতীয় পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৬তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়: এক বাঁধনছেঁড়া গণশিল্পী : সন্দীপন বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের আই. সি. এস এবং বইয়ে ভুল-ত্রুটি (প্রথম পর্ব) : উৎপল আইচ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৫তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রামগতপ্রাণ দাস্যভক্তির শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ হনুমানজি : রিঙ্কি সামন্ত লুইজ গ্লিক ও সাহিত্যে সমকালীনতা : সাইফুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৪তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে কি করা হচ্ছে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন সাহিত্যে যুদ্ধ, যুদ্ধে সাহিত্য : মিল্টন বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ কখনও শিমুলতলা আসেননি : জমিল সৈয়দ ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশিক বিচার : এলিজাবেথ কলস্কি (১০৩তম পর্ব) অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘বিকাশের বিয়ে’ গরমের সময়ে চোখের যত্ন না নিলে অন্ধত্ব এবং ক্যানসারের ঝুঁকিও থাকে : ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

নিজের জালেই জড়িয়ে গেলেন রানিমা? : দিলীপ মজুমদার

দিলীপ মজুমদার / ১১১ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪

কৃষ্ণনগরের রানিমা, শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে গেলেন নিজের জালে? বিদেশে ছিলেন। দেশে ফিরলেন ভালোবাসার টানে। রাজনীতির আবর্তে ছিলেন না কোনদিন। হঠাৎ জড়িয়ে গেলেন। আপনার প্রতিপক্ষ আপনার বংশের বিশ্বাসঘাতকতার কথা প্রচার করতে শুরু করলেন। আপনি চুপ করে থাকলে সে প্রচার ভোঁতা হয়ে যেত। আপনি পারলেন না চুপ করে থাকতে। আত্মপক্ষ সমর্থনে এমন কিছু বললেন, যাতে সুবিধে হয়ে গেল বিরোধীদের।

‘সমব্যর্থী’ প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন আপনাকে। আপনি তাঁকে আপনার বিরুদ্ধে প্রচারের কথা বললেন। অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বললেন, ‘আমার পূর্ব পুরুষেরা সনাতন ধর্ম রক্ষার জন্য সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল এটা কি অন্যায়? তা না হলে সনাতন ধর্ম বলে কিছু থাকত না। ’

দেখুন রানিমা, আমি কোন রাজনৈতিক দলের লোক নই। নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের বিচার করার প্রবণতা আমার নেই। আমি মনে করি না সচেতনভাবে, দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আলবর্দীর নাতি সিরাজদৌল্লা ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। সিরাজের দুরাচার, উৎকেন্দ্রিকতাও ছিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে রাজ্যরক্ষার অথবা আপন অধিকার রক্ষার প্রয়োজনে তিনি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্তাদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে স্বাধীনতা আন্দোলন যখন দানা বেঁধে উঠতে লাগল, তখন সিরাজ হয়ে উঠতে লাগলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক। বিশেষ করে সাহিত্যে। তারপরে ইতিহাসে। এ কথাও ঠিক যে ইংরেজের লেখা ইতিহাসে, ইংরেজপ্রভাবিত দেশীয়দের লেখা ইতিহাসে সিরাজকে নানাভাবে কলঙ্কিত করার চেষ্টা হয়েছে। নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধে’ আছে :

যবনের অত্যাচার করি দরশন,

বিমল হৃদয় পাছে হয় কলুষিত,

ভয়েতে নক্ষত্রমালা লুকায়ে বদন’

নীরবে ভাবিছে মেঘ হয়ে আচ্ছাদিত।

কিন্তু যত দোষ সিরাজের থাকুক না কেন, সিরাজের জন্য ‘সনাতন ধর্ম’ বিপন্ন হয়েছিল এমন কোন কথা তাঁর চরম শত্রুরাও বলেন নি। যাঁরা সিরাজের বিরুদ্ধে লিখেছেন সেই গোলাম হোসেন, স্যামুয়েল চার্লস, ইবরাত-ই-আরবাব-ই-বসর গ্রন্থের লেখক, এমন কি অমলেন্দু দে-ও। সিরাজের সভায় অনেক হিন্দু ছিলেন, সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন মীরমোহনের সঙ্গে মোহনলাল। রাজনীতিতে নবীন আপনি। আপনি হয়তো ভেবেছিলেন ‘সনাতন ধর্মে’র স্বঘোষিত প্রবক্তার কাছে সে ধর্মের বিপন্নতার কথা তুলে ধরলে, এক্সট্রা টিআরপি পাওয়া যাবে।

আপনি বলতে চেয়েছেন, মুসলমানদের হাতে হিন্দুর ‘সনাতন ধর্মে’র বিপর্যয়ের কথা। ভালো কথা। কিন্তু আপনার পূর্বপুরুষেরা স্বাথরক্ষার জন্য মুসলমান শাসকদের আশ্রয় যে নিয়েছিলেন, সে কথা তো ইতিহাসেই লেখা আছে। একটু পূর্বকথা স্মরণ করুন রানিমা। স্মরণ করুন ভবানন্দ মজুমদারের কথা। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর বাইশ বছর পরে রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় লিখছেন ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’। কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম প্রতাপাদিত্যকে জব্দ করার জন্য হাত মিলিয়েছিলেন মোগল সম্রাটের সঙ্গে। এই ঘটনায় ‘সনাতন ধর্ম’ কি আঘাত পায় নি? আসুন রাজীবলোচন কি লিখেছেন, একটু শুনে নিই :

“রাজা প্রতাপাদিত্যকে ধরিতে ঢাকার বাদসা রাজা মানসিংহকে আজ্ঞা করিলেন তুমি যাইয়া রাজা প্রতাপাদিত্যকে ধরিয়া আন তাহাতে রাজা মানসিংহ যে আজ্ঞা বলিয়া স্বীকার করিলেন পশ্চাত রাজা মানসিংহ অন্তঃকরণে বিবেচনা করিলেন রাজা প্রতাপাদিত্য বড় দুর্বত্ত আমাকে আনিতে সুবা আজ্ঞা করিলেন কিন্ত সেই দেশীয় একজন উপযুক্ত মনুষ্য পাইলে ভাল হয় ইহার পূর্বে ভবানন্দ রায় মজুমদার রাজা মানসিংহের নিকট যাতায়াত করিতেছেন তাহাতেই রাজা মানসিংহ ভবান্দ রায় মজুমদারকে জ্ঞাত ছিলেন স্মরণ হইল যে ভবানন্দ রায় মজুমদার সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত এবং গৌড়নিবাসী অতএব বঙ্গাধিকারীকে কহিয়া রায় মজুমদারকে লইব ইহাই স্থির করিয়া বঙ্গাধিকারীকে রাজা কহিলেন তোমার চাকর ভবানন্দ রায় মজুমদারকে আমাকে দেহ আমি সঙ্গে লইয়া যাইব। বঙ্গাধিকারী কহিলেন যে আজ্ঞা কিন্তু বঙ্গাধিকারীর যথেষ্ট ক্ষেদ হইল যে এমন চাকর আর কখন পাইব না কি করেন রায় মজুমদারকে আহ্বান করিয়া কহিলেন তোমাকে রাজা মানসিংহের সঙ্গে যাইতে হইল। রায় মজুমদার নিবেদনকরিলেন কোন দেশে যাইতে হইবেক তাহাতে বঙ্গাধিকারী কহিলেন গৌড়ে যশহর নগরে রাজা প্রতাপাদিত্য রাজকর বারণ করিয়াছে তাহাকে ধরিতে রাজা মানসিংহ যাইতেছেন তুমিও তাহার সহিত গমন কর যে আজ্ঞা বলিয়া রায় মজুমদার ও নব লক্ষ সৈন্য সঙ্গে করিয়া প্রতাপাদিত্য নিধন করিতে গৌড়ে প্রস্থান করিয়া দুই মাসে বালুচর গ্রামে উপস্থিত হইলেন। ….”

গৌতম বসু মল্লিক লিখেছেন, “মানসিংহের সুযোগ্য নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী ঈশা খাঁ-সহবারো ভুঁইয়ার অন্যান্য জমিদারদের পরাস্ত করতে অনেকটা সফল হলেও যশোহরের প্রতাপাদিত্য রায়কে পরাস্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না।…. বিচক্ষণ মান সিংহ বুঝেছিলেন সোজা পথে প্রতাপকে হারানো যাবে না। তাই তিনি প্রতাপের বিশ্বস্ত কয়েকজনকে জমিদারি ইত্যাদি পাইয়ে দিয়ে দলে টানলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’জন হলেন হুগলির কানুনগো দুর্গাদাস সমাদ্দার ও প্রতাপাদিত্যের কর্মচারী তথা পরবর্তীকালের বেহালার সাবর্ণ গোত্রীয় রায়চৌধুরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। এই দুর্গাদাস সমাদ্দার ১৬০৬ সাধারণাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে নদিয়ার জমিদারি ও মজুমদার উপাধি পেয়ে ভবানন্দ মজুমদার নামে পরিচিত হন।”

দেখুন রানিমা, আপনার পূর্বপুরুষ একজন হিন্দু জমিদারের (প্রতাপাদিত্য) সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন আবার একজন মুসলমান সম্রাটের কাছ থেকে গ্রহণ করছেন ইনাম।

দুই

কৃষ্ণনগরের রানিমা, আপনি ছড়া পড়েন? আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে ছড়া, প্রবাদ এসবের মধ্যে ইতিহাসের ভগ্নাংশ লুকিয়ে থাকে। আপনার পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার, যাঁর কথা ভারতচন্দ্র লিখে গেছেন তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের প্রথম খণ্ডে, তাঁকে নিয়েও একটা ছড়া আছে। ছড়া তো, তাই তার পাঠান্তরও আছে। আগে সেই ছড়াটি উল্লেখ করি। :

ইকড়ি মিকড়ি

চাম চিকড়ি

চামের কাটা মজুমদার।

ধেয়ে এল দামোদর

দামোদরের হাঁড়ি-কুঁড়ি।

দাওয়ায় বসে চাল কাঁড়ি।

চাল কাঁড়তে হল বেলা,

ভাত খাওগে দুপুরবেলা।

ভাতে পড়ল মাছি,

কোদাল দিয়ে চাঁছি।

কোদাল হল ভোঁতা

খা কামারের মাথা।

এবার এই ছড়ার অর্থ উদ্ধারের একটা চেষ্টা করা যাক :

‘ইকড়ি’ হল সংসার পরিচালনের জন্য সারাদিন খেটেখুটে পরিশ্রম করা। কিন্তু সারাদিন পরিশ্রম করেও চলে না সংসার। তখন দরকার হয় ‘মিকড়ি’র। মিকড়ি হল বাড়তি উপার্জনের চেষ্টা। তারপরে আসছে ‘চাম’। তার অর্থ রুজি-রোজগারের এলাকা। ‘চিকড়ি’ হল রুজগারের ধান্দায় ঘুরে উপার্জন ঘরে নিয়ে আসা।

কিন্তু গরিব মানুষের সমস্যা সেখানেই শেষ হয় না। এসে দাঁড়ায় ‘চামের কাটা মজুমদার’। মজুমদার আসলে একশ্রেণির রাজকর্মচারী। যারা খাজনা ও রাজস্ব আদায় করতেন। আদায়ের এই পথটা নিরিমিষ ছিল না। জোর-জবরদস্তি করা হত। নিপীড়ন হত।

সেখানেই শেষ নয়। তারপরে ‘ধেয়ে আসে দামোদর’। দামোদর কে? এরা হল ফড়ে-পাইকারের দল। চাযিরা যে ফসল তৈরি করত, কুমোররা যে মাটির জিনিস তৈরি করত, তা দামোদরেরা কম দামে কিনে নিয়ে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করত। সেসব জিনিস নেবার জন্য দামোদরেরা নিয়ে আসত ‘হাঁড়ি-কুড়ি’।

গ্রামের গরিব মানুষের বাঁচার সংগ্রাম চলতেই থাকে। চামের কাটা মজুমদার আর দামোদরের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে গ্রামের গরিব চাষি অল্প কিছু চাল বাঁচাতে পারে। তা নিয়ে ‘দাওয়ায় বসে চাল কাঁড়ি’।

চাল কাঁড়তে সময় লাগে। ‘চাল কাঁড়তে হল বেলা’। চাল না কাঁড়লে ভাত রান্না হবে কি করে? তাই ‘ভাত খাওগে দুপুরবেলা’।

সেখানেও গেরো। চামে কাটা মজুমদার আর দামোদরের হাত এড়িয়ে কিছু চাল বাঁচিয়েছিল গরিব চাষি। কিন্তু ‘ভাতে পড়ল মাছি’। মাছি আবার কে? চোরেদের কথা বলা হচ্ছে এখানে। চোরদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তারা ছুটে গেল পুলিশের কাছে। ‘কোদাল দিয়ে চাঁছি’। কোদাল হল পুলিশ বা কোতোয়াল।

হায়রে কপাল! ‘কোদাল হল ভোঁতা’। তার মানে পুলিশ বা কোতোয়াল করল না কিছুই। এগিয়ে এল না গরিব মানুষের সাহায্যে।

কোদাল তৈরি করে কামার। ‘খা কামারের মাথা’। কামার কে? উচ্চশ্রেণির সেইসব মানুষ যারা কোতোয়াল বা পুলিশ তৈরি করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। শেষমেষ তাদের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে গরিব মানুষ।

শুনলেন কৃষ্ণনগরের রানিমা? ‘চামের কাটা মজুমদার’ আপনার পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারকেই ইঙ্গিত করছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে লোকসাহিত্যবিদদের জিজ্ঞেস করুন। মুসলমানদের হাত থেকে সনাতন ধর্মকে রক্ষা করার কথা বলছেন, আবার স্বার্থরক্ষার জন্য সেই মুসলমানের হাত ধরছেন আপনার পূর্বপুরুষ। এ কেমন দ্বিচারিতা?

তিন

এবার আসা যাক রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কথায়। ভারতচন্দ্র রায় তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে কৃষ্ণচন্দ্রের সভা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন : —

নিবেদনে অবধান কর সভাজন।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভার বিবরণ।।

চন্দ্রে যবে ষোলকলা হ্রাসবৃদ্ধি পায়।

কৃষ্ণচন্দ্র পরিপূর্ণ চৌষট্টি কলায়।।

পদ্মিনী মুদয়ে আঁখি চন্দ্রেরে দেখিলে।

কৃষ্ণচন্দ্রে দেখিতে পদ্মিনী আঁখি মিলে।।

চন্দ্রের হৃদয়ে কালি কলঙ্ক কেবল।

কৃষ্ণচন্দ্রহৃদে কালী সর্বদা উজ্জ্বল।।

দুই পক্ষ চন্দ্রের অসিত সিত হয়।

কৃষ্ণচন্দ্রে দুই পক্ষ সদা জ্যোৎস্নাময়।।…

সন্দেহ নেই কৃষ্ণচন্দ্র শুধু গুণী মানুষ ছিলেন না, গুণগ্রাহীও ছিলেন। বিক্রমাদিত্য ও আকবরের মতো কৃষ্ণচন্দ্রের সভা আলোকিত করতেন নবরত্ন। সেখানে ছিলেন পুরাণবিদ পণ্ডিত গদাধর তর্কালঙ্কার, সংস্কৃতজ্ঞ কালিদাস সিদ্ধান্ত ও কন্দর্প সিদ্ধান্ত, রাজজ্যোতিষী অনুকূল বাচস্পতি, রাজবৈদ্য আয়ুর্বেদাচার্য গোবিন্দরাম, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত, সভাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়, বিদূষক গোপাল ভাঁড়। কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে কৃষ্ণনগরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।

মাত্র ১৮ বছর বয়েসে (১৭২৮ খ্রিঃ) নদিয়ার সিংহাসনে বসেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি ৭৫টি পরগণার জায়গির লাভ করেন বটে, কিন্তু নবাব সরকারের কাছে তাঁদের বিশাল ঋণ ছিল। প্রায় ২০ লক্ষ টাকা। ঋণটা খাজনার। যাকে নদিয়ার মানুষ বলত ‘বিশলাখি দায়’। ১৭৪০ সালে সিংহাসনে আরোহণ করে নবাব আলিবর্দি খান ১২ লক্ষ টাকা নজরানা ও পৈতৃক ঋণের ১০ লক্ষ টাকা দাবি করেন। সে ঋণ কৃষ্ণচন্দ্র পরিশোধ করতে পারেন নি বলে আলিবর্দি তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। এতে মনে মনে কৃষ্ণচন্দ্রের রাগ হওয়া স্বাভাবিক। আলিবর্দির পরে সিংহাসনে বসেন সিরাজদৌল্লা। অনতিবিলম্বে তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয় ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত’। যে যড়যন্ত্রে লিপ্ত হন রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, মীরজাফর, মীরণ এবং কৃষ্ণচন্দ্র রায়। ষড়যন্ত্রে অংশ গ্রহণ করেও কৃষ্ণচন্দ্র অবশ্য নিজেকে বেশ কিছুটা আড়ালে রেখেছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্র চালাচালি হচ্ছিল। ড্রেকসাহেবের এক চর তো কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মচারী ছিলেন (‘one of my emissaries from Muxadabad and who was with Rajah Kissenchund’ )।

চলুন রানিমা, এবার আমরা চলে যাই রাজীবলোচনের কাছে। তিনি লিখছেন : —

“রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় সাহেবকে যে পত্র লিখিলেন তাহার বিবরণ এই : —

“আপন মঙ্গল এবং অনেক ২ প্রকার শিষ্টাচার লিখিয়া লিখিলেন সাহেব পুনরায় আগমন করিয়া কলিকাতা অধিকার করিয়াছেন ইহাতে অমৃতাভিষিক্ত হইয়া আনন্দার্ণবে মগ্ন হইয়াছি এবং বুঝি আমারদিগের এ রাজ্য রক্ষা পাইবে। আপনকার সহিত পূর্ব্বে যে কথোপকথন হইয়াছিল সেই সকল সম্বাদ কারণ মুরসদাবাদে মনুষ্য প্রেরিত করিলাম আপনি রণসজ্জা করিয়া প্রস্তুত রাখিবেন মুরসদাবাদের সমাচার পাইলেই নিবেদন লিখিব কিন্তু পূর্বে যে নিবেদন করিয়া আসিয়াছি তাহার অন্যথা কদাচ হবে না।”

রাজীবলোচনের এই বিবরণ প্রমাণ করে যে ইস্ট ইণ্ডিয়ার কলকাতার কর্তাদের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, মুর্শিদাবাদের সংবাদের আদান-প্রদান হত। আবার শুনুন : —

“মহারাজ মুরসদাবাদের যাবদীয় সংবাদ লিখিয়া কলিকাতার সাহেবকে জ্ঞাত করাইলেন সাহেব বিস্তারিত সমাচার শুনিয়া হৃষ্ট হইয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে লিখিলেন নবাব স্রাজেরদৌলার সেনাপতি মীর জাফরালি খান নবাবি চাহিয়াছে আমিও সত্য করিলাম স্রাজেরদৌলাকে দূর করিয়া দিয়া মীর জাফরালি খানকে নবাব করিব তুমি এই সমাচার মীর জাফরালি খানকে দিলে সে যেমত উত্তর করে তাই আমাকে লিখিবা।”

তার মানে সিরাজদৌল্লার বদলে মীরফাফরকে নবাব করার ষড়যন্ত্র, আর মীরজাফরের সঙ্গে সংবাদ আদান-প্রদান চলছে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের। ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্র’ অভিনব কিছু নয়, উদ্ধত সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সলতে পাকানোও অভিনব কিছু নয়। কিন্তু রানিমা, আমার প্রশ্ন সিরাজ নামক যে মুসলমানের রাজত্বে ‘সনাতন ধর্ম’ রসাতলে যাচ্ছিল বলে আপনার ক্ষোভ, সেই ‘সনাতন ধর্ম’ আরেক মুসলমান মীরজা্ফরের হাতে কিভাবে সুরক্ষিত থাকবে? আসলে বোধহয় সনাতন ধর্মটর্ম কিছুই নয়, সিরাজ এবং তাঁর দাদুর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত রাগই কৃষ্ণচন্দ্রকে ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের’ অংশীদার করেছিল।

সনাতন ধর্মের দোহাই দিয়ে কৃষ্ণনগরের রানিমা নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩০ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন