বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বিশেষ সংখ্যার লেখা।
সেদিনও ছিল, কিন্তু আজকাল দেখি না। কোথায় তাদের আড্ডা কে জানে! বহু খোঁজার চেষ্টা করেছি। গাছের এই ডাল থেকে ওই ডাল সর্বক্ষণ চোখ রাখি। মন খারাপ হয়। বস্তুত একবার দেখতে পেলে শুধোতাম, তোদের রাগটা কীসের? কিন্তু এ প্রশ্ন মনের মধ্যেই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, কাউকে বলার সাহসও পাই না। অনেকে ভাববে নিশ্চয়ই, লোকটা পাগল হয়ে গিয়েছে। তাই নিজের মনেই বিড় বিড় করে বকছে। কাদের জন্য অপেক্ষা? কী দরকার? এত কিছু ভেবে দেখার সময় নেই। শুধু এইটুকু জানি, সকাল-বিকেল বাড়ির আনাচে-কানাচে ছাতারে পাখির কিচির মিচির শব্দ। একা নয়, দলে অন্তত বিশ-ত্রিশটা। একসঙ্গে তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে শুঁয়োপোকা ধরে, সেগুলি মহানন্দে উদরসাৎ করে। আনন্দে নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করে। বাড়ির আশপাশে যখন শুঁয়োপোকায় ভর্তি হয়ে যেত, দেখতাম ছাতারের দল এসে সেগুলি খেয়ে পরিবেশকে সুস্থ করছে। ওদের জন্যই কচি-কাঁচারা শুঁয়োপোকার হাত থেকে রেহাই পেত। এখন আর ছাতারেদের দেখি না। তাই শুঁয়োপোকার বাড়বাড়ন্ত। ছোট ছোট বিষাক্ত কীটপতঙ্গদেরও দাপাদাপি। সব মিলে বাড়ির আশপাশে চলাফেরা করাটাই কঠিন করে তুলেছে। ছাতারের সঙ্গে দেখা নেই বলে মনটা খারাপ হয়েছিল। মনকে সান্ত্বনা দিয়ে ঠিক করেছিলাম। আবার যখন দেখলাম বেশ কয়েক মাস ধরে ভাগাড়ে শকুন, কাকদের দেখা নেই। তখন মনে হয়েছিল ওরা কি আমার ওপর রাগ করল? আশপাশে চোখ খুঁজে বেড়ায় ওদের। দেখা না পেয়ে মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। শান্তি পাই না। ভাগাড়ে মরা পশু এলেই শকুনের ভিড় জমত। বড় বট, শিমূল, অর্জুন, তালগাছের ডগায় এসে বসত। তীক্ষ্ণ নজর রাখত ভাগাড়ের দিকে। এখন এ দৃশ্য ভুলতে বসেছি। কিন্তু ভাগাড়ের ময়লা ও মরা পশুগুলোর দুর্গন্ধে গোটা পাড়া ছেয়ে গেছে। উপায় নেই। দূষণ ছড়াচ্ছে। এই দূষণ রক্ষার কোনও দিকও খুঁজে পাচ্ছি না। কাকের দেখা নেই, শকুনরা আকাশ থেকে বিমানের মতো ভেসে আসবে এমন ভাবনায় ওরা জল ঢেলে দিয়েছে। ছোটবেলায় শকুন দেখতে বাইরের আকাশে চোখ রাখতাম। দূর থেকে মনে হত যেন যুদ্ধ লেগেছে। একদল বোমারু বিমান যেন ল্যান্ড করছে। আনন্দ পেতাম। তখনও বুঝিনি দূষণের হাত থেকে মানবকুলকে বাঁচাতে এদের অবতারণা। এখন এদের দেখা নেই। বাতাসে দূষণের মাত্রা বাড়বে।
তাই মনটা এখন একদম ভাল নেই। বলা যায় মনটা ভাল নেই বলে শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। তবু এরই মধ্যে কিছুটা আনন্দ দিচ্ছিল চড়াইগুলো। উঠোনে নেমে কিচিমিচির ঝগড়া, ফুডুৎ করে উড়ে যাওয়া। আর তোয়াক্কা না করে পুরনো মাটির ঘরের খড়ের চালে কিংবা মাটির দেওয়ালে এক কোণায় লুকিয়ে বাস করা। কতবার সন্ধের পর এদের হাত দিয়ে স্পর্শ করেছি। ডিমগুলো হাত দিয়ে দেখেছি। কেবল উত্তাপ পেয়েছি। সেই উত্তাপ সারাটা জীবন হৃদয়ে দাগ কেটেছে। এই চড়াই পাখিগুলোর খাবার ছিল উঠোনে মায়ের দেওয়া চাল, গম, আর দানাশস্য। কতবার মাকে দেখেছি উঠোনে শুকোতে দেওয়া চাল-গম রক্ষা করতে ওদের দিকে তেড়ে যাচ্ছে। সুযোগ পেলেই ওরা চাল-গম ছড়াতো। কিন্তু মা কখনও মারত না ওদের। মা বলতেন, এই চড়াইগুলোও আমাদের বাড়ির সদস্য। বাড়ির দুধারে বিষাক্ত কীট-পতঙ্গগুলো খেয়ে পরিষ্কার রাখত। এখন সেই চড়াইয়ের দেখা নেই। তাই মনটাকে যত শান্ত করার চেষ্টা করি, ঠিক ততটাই যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়। যতদিন যাচ্ছে ছাতারে, কাক, চিল, শকুন, চড়াইদের দেখা পাই না। কোন অচিন দেশে বাসা বেঁধেছে কে জানে! বাড়ির আনাচে-কানাচে, বারান্দায় এদের অত্যাচার নেই। অত্যাচার আছে বিষাক্ত কীট-পতঙ্গের। গাছের ডালগুলিও অপেক্ষা করে আছে ওই সমস্ত পক্ষীকুলের জন্য। দূষণের মাত্রা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে ওই সমস্ত পাখিদের স্থানও বইয়ের পাতায় গল্প আকারে ছাপা হচ্ছে। তাই ভাবি, গ্রামে-গঞ্জেও যদি পক্ষিকুল অতিষ্ঠ হয়, বাঁচার ঠিকানা যদি এরাও বদল করে, তাহলে আমরা যাব কোথায়? তাই সকাল হলেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, যদি এদের দেখা পাই। দেখা পেলে একটাই প্রশ্ন করতাম, তোমাদের ঠিকানাটা বলবে? আমিও সেখানে যেতে চাই।
প্রশ্ন জাগে পাখিদের মধ্যে কি বাড়ছে বিচ্ছেদ? কেউ জড়াচ্ছে কি পরকীয়ায়? তবে এটুকু জেনেছি পক্ষীবিদদের কাছে পাখিদের প্রেম-বিয়েও নাকি এখন আর টিকছে না। রয়্যাল সোসাইটির জার্নাল ‘দ্য প্রসিডিংস’ দাবি করেছে পাখিদের মধ্যে বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে। তার প্রধান কারণ পরিবেশে ভয়াবহ দূষণ। ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পক্ষীবিদ ড. রস ক্রেটারের মতে নিজের প্রজাতির মধ্যে ভাববিনিময়ের মাধ্যম তাই ভুলে গেছে পাখিরা। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে এখন তারা অন্য প্রজাতির গান কিংবা ডাক নকল করছে। ড. রসের মতে মনুষ্য সৃষ্ট দূষণ আর পরিবেশ বদলের যে ভয়ংকর প্রভাব আস্তে চলেছে বিশ্বজুড়ে তার সূচনা হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা আতঙ্কিত বিশ্বের ১২০০ প্রজাতির পাখিদের বিপর্যয় দেখে। পাখিদের সমাজগোষ্ঠী আর টিকে থাকতে পারছে না। কেননা, পাখিরা বাসস্থান হারাচ্ছে মনুষ্য সৃষ্ট পরিবেশ ধ্বংসের কারণে। শুধু তাই নয় পাখিরা যে গান শুনে, বুলি কিংবা ডাক শুনে সঙ্গীর কাছে ছুটে আসত, সে প্রক্রিয়ায় এখন বাধা পাচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্কের যুগে। যা বিশ্বের জন্য এক অশনি সংকেত।
প্রসঙ্গত, যখন দেখি পাখিরা বাসা বাঁধে, কিন্তু ডিম পাড়ে না। আবার ডিম পাড়লেও তাতে তা দেয় না। আশপাশে বসে কোথাও সময় কাটায়। ক’দিন পরে আর তাদের দেখা যায় না। আশঙ্কা, পাখিরা একসময় হারিয়ে যাবে না তো?
পাখিদের কলতান কি তা হলে শুধু কাব্যকথায় থেকে যাবে?
দেশের পাখিদের সংখ্যা ও তাদের পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত সর্বশেষ কেন্দ্রীয় রিপোর্ট সেই আশঙ্কার কথাই বলছে। ‘দ্য স্টেট অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস ২০২০’ শীর্ষক রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ২৫ বছরে দেশের সবথেকে বেশি দেখা পাওয়া পাখিদের সংখ্যা কমেছে বাৎসরিক ৮০% হারে, যা শুধু আশঙ্কার নয়, চরম বিপর্যয়ের নজির। শহরে এবং গ্রামাঞ্চলে নগরায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাখির বাসস্থান কমেছে দ্রুত হারে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে দূষণ ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের প্রভাব। এ ছাড়া বেআইনি ব্যবসা ও চোরাচালানের জন্য পাখি ধরা এবং পাখি শিকারের জোড়া ফলাতেও কার্যত নির্বংশ হতে চলেছে দেশের পক্ষীকূল।
উল্লেখ করা যেতে পারে পৃথিবীর আদিযুগে মানুষ যে পরিবেশে বসবাস করতো, সেখানে প্রাণিজগতের কেউ তার মিত্র ছিল না। সবাই শত্রু এবং তাদের কেউ কেউ অনেক ভয়ংকর ও প্রাণঘাতি ছিল। কেবল মাত্র পাখি তাদের ভয়ের কারণ ছিল না। বলা যায়, মানুষ প্রকৃতি থেকে দুটি বড় উপহার পেয়েছে, তার একটি হলো উদ্ভিদ আর অন্যটি হলো পাখি। পাখি, উদ্ভিদ অরণ্যকে পরিপূর্ণতা দান করেছে আর মানুষ পাখি থেকে তার বাস্তব প্রয়োজন ও বিনোদনতৃষ্ণা মিটিয়েছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পাখির মাধ্যমে তার মেধা ও কল্পনাকে বিকশিত করেছে। পাখি থেকে মানুষ উড়োজাহাজের চিন্তা ভাবনা করেছে। তাই মানুষের জীবনের সাথে পাখিদের জীবন যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আর সেই জীবন থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে পাখিরা। কোথায় এখন তাদের ঠিকানা কেউ কি বলতে পারো? আমি সেখানেই যেতে চাই।