সুখাদ্যের সন্ধানে
১। সুখাদ্য, অখাদ্য কু খাদ্য এগুলোর মধ্যে কি সম্পর্ক? খাবারটা এখন শত্রু? আর হেলদি ডায়েট কি?
২। ইদানিং মানুষের রোগভোগ অনেক বেড়েছে আগের তুলনায়। এর সাথে কি খাদ্যের কোন সম্পর্ক আছে?
৩। জৈব উপায় বা প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত ফসলের বিশেষত্ব কি? সেটা কি বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় বা চেনা যায়? প্রাকৃতিক ফসল কি?
৪। মানুষ কি সুস্থ থাকতে পারে শুধুমাত্র সুখাদ্য খেয়েই?
৫। জৈব ফসলের দাম বেশি সেটা কি গরীব মানুষরা খেতে পারে না?
৬। জৈব উপায়ে ফসল চাষ করলে উৎপাদন কি কম হয়?
৭। ইদানিং গাট বায়োম নিয়ে আলোচনা করছে তার সাথে আমাদের সুস্থতার কি সম্পর্ক সেটা যদি একটু বলেন?
৮। একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে কি কি করলে তিনি সুস্থ থাকবেন বলে আপনি মনে করেন।
১। আসলে ইদানিং কালে সুখাদ্য নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। সুখাদ্য বলতে আমরা বুঝি যে খাদ্য বিষমুক্ত, যে খাবার খেলে মানুষের শরীর অসুস্থ হবে না এবং যে খাবার প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয়েছে। আর অখাদ্য, কুখাদ্য হল মানুষের খাওয়ার উপযোগী নয়। যেমন না জানা জঙ্গলের ফল না জানা সবজির পাতা এবং বিষযুক্ত ফসল। আসলে মানুষকে বিজ্ঞানের নামে শেখানো হয়েছে খাবারে বিষ মেশাতে। বিষ বলতে আমি রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং আগাছা নাশকের কথা বলতে চাইছি। যার ফলে খাবারটা এখন আমাদের কাছে শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসায়নিক উপায়ে উৎপাদিত বেশি ফসল বলতে আমরা বিষাক্ত ফসল বোঝাচ্ছি সেটা কিন্তু খাবার নয়।
ইদানিং হেলদি ডায়েট কথাটা চালু হয়েছে কিন্তু যারা চালু করেছেন বা যারা এটা বলছেন তাদের বক্তব্যের মধ্যে কখনোই প্রাকৃতিক ফসল, রান্নার পাত্র, জীবন যাপন, খাবার জল – সাবেক ফিল্টার ক্যান্ডলে পরিশোধিত জল না প্রায় খনিজ শূন্য রিভার্স অসমসিস প্রক্রিয়ায় পাওয়া জল, রান্না করার পদ্ধতি এবং কোন শ্রেনীর লবণ, বিষমুক্ত ফসল এবং মিলেটের কথা বলা নেই। মিলেট হল অল্প জলে চাষ করা দানাশস্য, প্রায় আট রকমের আছে যেমন শিয়াল লেজ,কাওন চাল, রাগী ,শ্যামা চাল, জোয়ার, বাজরা ইত্যাদি। এগুলো পুষ্টিগুণে অনেক বেশি সমৃদ্ধ এবং চাষ করতে কোন সার ও বিষ লাগেনা। সুখা জমির ফসল, কম বৃষ্টি হওয়া এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে অনেকটাই জুঝতে পারবে।
২। হ্যাঁ ইদানিং কালে মানুষের রোগভোগ আগের তুলনায় অনেক গুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু আগের থেকে খাবার অনেক বেশি সহজলভ্য, জীবন শৈলী পাল্টে গিয়েছে এবং খাবার বিষযুক্ত। আগে বিষবিহীন পরিমানে কম খাবার পাওয়া যেত।
মানে খাদ্যে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, আগাছা নাশক এবং ভারী ধাতুর অবশেষে মানুষের বিভিন্ন রোগের কারণ। তার মধ্যে ক্যান্সার অন্যতম। এছাড়া পেটের গন্ডগোল, চুল ওঠা, নার্ভের গোলযোগ, কিডনির রোগ, চামড়ার রোগ, অকাল বার্ধক্য এগুলো সবই এর মধ্যে পড়ে। আর গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী কিশোর কিশোরীদেরও এখন কিডনি রোগ দেখা দিচ্ছে এবং ডায়ালিসিস করতে হচ্ছে। এটা বড় বেদনার। তার কারণ কিন্তু খাবারে বিষের অবশেষ। এই বৈজ্ঞানিক কৃষি আমরা চেয়েছিলাম? এখন পৃথিবীর সর্বত্রই এই ঘটনা।
৩। জৈব উপায়ে চাষ করা বা প্রাকৃতিক ফসলের সাথে রাসায়নিক উপায়ে চাষ করা ফসলের বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। আর কিছু কিছু বড় বড় শপিংমলে শংশিত জৈবিক খাবার দাবার পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর দাম অনেক বেশি। আমরা যে বাজার থেকে বাজার করি সেই বাজারে আমরা অনেক পরিচিত কৃষকের থেকে কিনি বা অনেক সময় আধা শহরতলীতেও কৃষকরা সরাসরি ফসল নিয়ে আসেন। আমরা সেখান থেকে বিশ্বাসের ভিত্তিতে কিনতে পারি। এখন কলকাতা শহরতলী এবং জেলাস্তরের অনেক জৈব বিপনী হয়েছে সেখান থেকে আমরা জৈব উপায়ে উৎপাদিত ফসল কিনতে পারি। এখন অনেক মানুষের মধ্যে কিন্তু এই জৈবিক উপায়ে চাষ করার ফসলের উপর মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। জৈব কৃষিতে প্রথম দিকে ফলন কমতে পারে সেই কারনে বিক্রি দাম বেশী হতে পারে। কিন্ত ২/৩ বছর পরে ফসল উৎপাদনে কোন তারতম্য হয়না কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া। আবার অনেকে মনে করেন জৈব মানেই দাম বেশী হবে দাম স্বাভাবিক হলে ওটা জৈব নয়।
প্রাকৃতিক ফসল বলতে চাষ না করা ফসল। যেমন জঙ্গলের ঝিঙে, ধুদুল, ঘি করোলা, মাখন শীম, এক ধরনের ছোট কাঁকরোল, ১২ রকমের মেটে আলু, তরুকলা শীম, কুদরি, মহুয়ার ফুল ও তেল, বাজনা গাছের ফলের তেল, বলাঠা গাছের পাতা, তেপলেত মাদার গাছের পাতা, ধানের জমিতে হওয়া প্রায় কুড়ি ২২ রকমের শাক, বুনো ধান, বিশেষ বিছুটি (স্টিগিং নিডিল), গাঁদাল পাতা, নীম পাতা, সজনে পাতা, বক ফুল, ঢেঁকি শাক, বেতো শাক, কুদরুম বা টক ঢ্যাঁড়শ, লতা কস্তুরি (এক ধরনের পাতলা খোসা যুক্ত ঢ্যাঁড়শ) থানকুনি পাতা,শাপলা, শাপলার মূল, কান্ড-লতি, বীজ, পদ্মের ডাটা, বীজ ও মূল, তালের গুড়, তাল, খেঁজুর গুড়, তেঁতুল বিভিন্ন ধরনের কচু, কলমি শাক, ডুমুর, ডেওয়া, ভুড়ুর, করমচা, চালতা, তুঁত ফল, কেন্দু ইত্যাদি জঙ্গলের বিভিন্ন রকমের সবজি, কলা, মোচা, কাঞ্চন ফুল, বক ও কচুরিপানার ফুল, মাশরুম ও মধু। সুন্দরবনের মধু, মাছ, কাকড়া, চিংড়ি, ক্যাওড়া ফল- চাটনি হয়। সামুদ্রিক মাছ। উল্লেখ্য প্রায় ৬০ রকমের মাশরুম জঙ্গলে পাওয়া যায় মোটামুটি জুন জুলাই মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। কাড়ান ছাতু, কুড়কুড়ে ছাতু, জাম ছাতু, উই ছাতু ইত্যাদি। ওড়িষ্যা ও ঝাড়খন্ডে গরমের সময় পিঁপড়ের ডিম সংগ্রহ করা হয়। খুব উপাদেয় খাবার। উত্তর পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে কলা, লেবু, বাঁশের কোড়ক, মান্কি বিন ইত্যাদি। তাছাড়া জঙ্গলের বন্য প্রানী, পাখি, মাঠের ইঁদুর শিকার করে আদিবাসীরা খায়।
দেশজ ফসল : যে ফসলের জন্মস্থান ভারত উপমহাদেশে বা ভারত চীন অঞ্চল সেই ফসল গুলোকেই দেশজ ফসল বলা যায়। বেশীর ভাগ প্রাকৃতিক ফসলকেই দেশজ ফসল বলা যায়। যেমন ধান, কিছু মিলেট, দেশী গম (ট্রিটিকাম স্ফেরোক্কাম) , আখ, আম, বেগুন, শশা, মূলো, বরবটি, মেটে, আলু, পাট, ধুধুল, বরবটি, পটল, চিচিঙ্গা, শিম, ওল, আদা, হলুদ, চৈ ঝাল ইত্যাদি। বহু ফসল বিভিন্ন মানুষের হাত ধরে ভারতে প্রবেশ করেছে। যেমন বলিভিয়ার আলু, মেক্সিকোর লংকা, সবেদা, পেয়ারা ইত্যাদি পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতে আসে। ফুলকপি, বাধাকপি, টমাটো, বীট , গাজর, পিঁয়াজ রসুন, আপেল, মটর, লিচু, চা ইত্যাদি অন্য দেশ থেকে ভারতে আসে। বিগত ২০০০ বছরে নতুন কোন ফসল চাষের আওতায় আসেনি বা নতুন কোন প্রানী গৃহপালিত পশুর মর্যাদা পাইনি। তাহলে কৃষির উন্নতি কি হল ? দেশে প্রাকৃতিক কৃষির উপযোগী হাজার বছরের পরিক্ষিত উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাতের বীজ থাকা সত্বেও এমন জাতের ফসলের বীজ তৈরী করা হল যাতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিষ লাগবে এবং তার ফলে উপায়ে ফসলের উৎপাদন বাড়ল। উল্লেখ্য ওই আধুনিক জাতের বীজ রোগ ও পোকা সহনশীল নয় এবং এক দুই বছর অন্তর বীজ নতুন করে কিনতে হয়। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ভোগে কোন বিদেশী ফসল থাকে না। যেমন লংকা, গাজর, ফুলকপি , টমাটো ইত্যাদি।
৪। আমরা একটা প্রচলিত প্রবাদ জানি খাদ্যই পথ্য এবং খাদ্যই ওষুধ। আসলে খাদ্যের মধ্যেই বিভিন্ন রকমের ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার, শর্করা, প্রোটিন, ফ্যাট ও এন্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। এই ফসলের মধ্যে যদি রাসায়নিক বিষ চলে যায় তাহলে কিন্তু খাবারের ওষুধি গুণটা কিন্তু নষ্ট হয়ে যায় এবং হিতে বিপরীত হয় সেই কারণেই খাদ্য যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষের রোগভোগ কম। অন্তত ৯০% এর উপর রোগ বিষযুক্ত খাবারের জন্যই হয়। শুধু জৈব উপায় বা প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত ফসল খেলেই হবে না তার সাথে আমাদের জীবন যাপন, আমরা কোন পাত্রে রান্না করছি- অর্থাৎ অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে না মাটির পাত্রে, আমরা মাইক্রোওভেন ব্যবহার করছি না গ্যাসে রান্না করছি না কাঠে রান্না করছি, আমাদের খাবার-দাবারে কৃত্রিম রং ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা, খাবার দাবার বারবার বারবার গরম করছি কিনা, কোন তেলে রান্না হচ্ছে, ফাস্ট ফুড, ঠান্ডা পানীয় খাচ্ছি কিনা, অত্যধিক চিনি খাচ্ছি কিনা, সৈন্ধব লবনের পরিবর্তে অন্য কোন ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ খাচ্ছে কিনা, আমি প্রসেস করা খাবার খাচ্ছি কিনা, মদ্যপান ও ধূমপান করছি কিনা, অনেক মানসিক দুশ্চিন্তা আছে কিনা এবং শারীরিক পরিশ্রম করি কিনা, মাটিতে খালি পায়ে হাঁটাচলা করি কিনা, গায়ে রোদ লাগাই কিনা, সর্বক্ষণ এসি তে থাকি কিনা এগুলোর উপর কিন্তু শরীরের সুস্থ থাকাটা নির্ভর করছে। মনে করা হয় মানুষের রোগের কারণ খাদ্য এবং এর জন্য দায়ী।
৫। হ্যাঁ, জৈব উপায়ে উৎপাদিত ফসলের দাম অনেক ক্ষেত্রে বেশি হচ্ছে। কারণ এটার শহুরে বাজারীকরণ করা হয়েছে এবং বাজারীকরণ এবং সংশিতকরনের জন্যই দাম বেড়েছে। কিন্তু আগে যখন রাসায়নিক সার, কীটনাশক ছিল না তখন কিন্তু সবটাই ছিল জৈব উপায়ে উৎপাদিত ফসল। সেখানে সার্টিফিকেটের কোন প্রয়োজন ছিল না। এখন যেখানে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিষ ব্যবহার হচ্ছে সেখানে কেউ যদি জৈব সার দিয়ে চাষ করে এবং সেটা বলার অধিকার পেতে গেলে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে একটা সার্টিফিকেট নিতে হবে এবং সেটা তিন বছর সময় লাগে। এই কারণে ফসলের দামটা বেড়ে যায়। আবার অনেক অসাধু ব্যবসায়ী তারা সাধারণ ফসলকে জৈব ফসল বলে বিক্রি করার সুযোগটা নিয়ে মানুষকে ঠকায়। ভারতের মধ্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড়, ঝাড়খন্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চল, উত্তর পূর্বাঞ্চল যেখানে তথাকথিত এই আধুনিক কৃষিবিজ্ঞান পৌঁছায়নি সেখানে রাসায়নিক সার কীটনাশকের ব্যবহার নেই সেখানে পুরো ফসলটা কিন্তু প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ করা ফসল। যেমন ঝুমের চাষ করা ফসল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক।
৬। জৈব উপায়ে উৎপাদিত ফসলের উৎপাদন কম নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কিন্তু যারা বিতর্ক করেন তারা নিজেরা এই জৈব কৃষির কাজটা করে দেখেননি। বইয়ের পাতা থেকে উদ্ধৃত করে তারা বলেন ফলন কম, অত জৈব সার পাওয়া যাবে না ইত্যাদি। অনেকটা রাসায়নিক কৃষিকে উৎসাহ যোগানের জন্য। আসলে জৈব উপায়ে ফসল উৎপাদন করা একটা জীবনশৈলী, একটা কর্ম পদ্ধতি যার সঙ্গে চটজলদি উৎপাদন বাড়ানোর রাসায়নিক কৃষির সঙ্গে কোন মিল নেই। রাসায়নিক কৃষিতে মাটিকে জীবন্ত ধরা হয় না এবং রাসায়নিক কৃষিতে শুধুমাত্র ফসলের দানার ওজনটা দেখা হয়। মাটির স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে কিনা, মাটির কেঁচো, অনুজীব ও গরুর খাবার ঠিক পাওয়া গেল কিনা, মৌমাছি ও বন্ধু পোকা মারা পড়ল কিনা এগুলো দেখার বিষয় নয়। তাই রাসায়নিক কৃষি ব্যবস্থা সুস্থায়ী নয় এবং তার জন্য নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পরিবেশ, মাটি , জল ও ফসল দূষিত হয়েছে। মাটি অনুর্বর হয়ে পড়েছে। বেশী সার ব্যবহার করেও আগের মত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সামান্য জলজমা জমিতে আগে ধানের সাথে মাছ উৎপাদন হতো স্বাভাবিক ভাবে। ধানের উৎপাদন কম হলেও কিন্তু সম্মিলিতভাবে ধান এবং মাছের উৎপাদন এখনকার রাসায়নিক উপায়ে উৎপাদিত ধানের থেকে অনেক বেশি হয় এবং পরিবেশ ও অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক। আরেকটি বিষয় মিশ্র ফসল অনেক বেশি লাভজনক এবং মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। বেগুন, রসুন, মটর একই জমিতে করা। মানুষের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, পরিবেশের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। অনেক দেশজ ধান, সবজির জাত আছে যেগুলো কোন রাসায়নিক ছাড়াই যা ফলন দেয় সেটা রাসায়নিক সার দিয়ে আধুনিক ও সংকর জাতের ফসলের সমান। এবং পুষ্টিগুণে অনেক বেশি সমৃদ্ধ, চাষের উৎপাদন ব্যয়ও অনেক কম। জিন শস্যও বহু বিতর্কিত এবং এর উৎপাদন বাড়ানোর কোন ক্ষমতা নেই। উৎপাদন যেটা বাড়ে সেটা শংকর জাতের জন্য।
৭। গাট বায়োম নিয়ে ইদানিং এদেশে আলোচনা হচ্ছে। আসলে গাট ব্যায়াম বলতে পেটের জীবাণুকে বোঝায়। আসলে আমাদের সারা শরীর জুড়েই জীবাণু, প্রোটোজোয়া ও ভাইরাস রয়েছে। মানুষের যা কোষের সংখ্যা তার ৯০ ভাগেরই বেশি হচ্ছে এই সমস্ত অনুজীব। তাদের নিয়েই মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী বেঁচে রয়েছে। পেটের ৫০০ প্রজাতির জীবাণুর সংখ্যা প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন (এক লক্ষ কোটিতে ১ ট্রিলিয়ন) এবং ওজনে প্রায় এক কেজি ২০০ গ্রামের মত। মানুষের জিনোমের ১০০ গুন জিন আছে। কিন্তু এখন সেই পরিমাণ অনেকটাই কমে গেছে। এই জীবাণুগুলো আমাদের খাদ্যদ্রব্য হজম করতে সাহায্য করে ভিটামিন বি টুয়েলভ সংশ্লেষ করে। শরীরের ছোটখাটো রিপেয়ার তৈরি করে দেয়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি দেয় এবং ইদানিং এটাও নিয়ে চর্চা হচ্ছে এই গাট বায়োম মানুষের মুড ঠিক রাখে, ঘুম আসতে সাহায্য করে এবং মানুষের মস্তিষ্ককেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু ক্রমাগত বিষাক্ত খাবার, ফাস্টফুড, খাবারে রাসায়নিক সার, ও বিষের অবশেষ, ঘন ঘন আন্টিবায়োটিক খাওয়া এবং জীবনশৈলীর পরিবর্তনের জন্য এই গাট বায়োমের পরিবর্তন হয়েছে যার ফলে মানুষের স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং আরো বিভিন্ন রোগের শিকার হচ্ছেন। প্রয়োজন সুস্থ এবং প্রাকৃতিক খাবারে ফিরে যাওয়া যাতে এই গাট বায়োম আবার আগের অবস্থাতে ফিরে আসে। টক দই ও অনানন্য প্রাকৃতিক খাবার না খেয়ে প্রি (কোহল সন্ধান কৃত খাবার) ও প্রোবায়োটিক (জীবন্ত জীবাণু) ক্যাপসুল খেতে বলা হচ্ছে।
৮। হ্যাঁ দেখুন একজন মানুষের জীবন শুরু হচ্ছে অপ্রাকৃতিক জিনিস দিয়েই সেটা হচ্ছে সকাল বেলার টুথপেস্ট এবং টুথব্রাশ। এখনো বিহারে প্রায় ২৫ রকমের দাতন ব্যবহার করা হয়। আমরা এখন দাঁতন হয়তো ব্যবহার করতে পারব না। আমরা মাঝেমধ্যে দাতন ব্যবহার করতে পারি। চা কিন্তু শরীরের পক্ষে যতটা ভালো বলা হয় ততটা ভালো নয় কারণ চা উৎপাদন করতে ব্যাপক পরিমাণে রাসায়নিক সার ও আগাছানাশক ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে গ্লাইফোসেট এবং সেটার জন্য মানুষের কিন্তু অনেক রোগভোগ বাড়ছে কারণ চায়ের মাধ্যমে আশায় গ্লাইফোসেট শরীরে ইনসুলিন তৈরি করার পদ্ধতিকে বন্ধ করে দেয় শরীরে ট্রেশ এলিমেন্ট গ্রহণে বাধা দেয়। চায়ে থাকা ট্যানিন এই কাজটি করে। অনেক সময় শরীরে লোহার অভাব দেখা দিতে পারে। চায়ের বদলে কফি খেতে পারি। অথবা জবা ফুলের পাপড়ি /অপরাজিতা ফুলের পাপড়ি ইত্যাদি গরম জলে ভিজিয়ে রেখে সামান্য গুড় দিয়ে খেতে পারি। এতে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট আছে। কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা মুসুর এবং মটর ডালে প্রচুর পরিমাণে গ্লাইফোসেট আগাছানাশক ব্যবহার করা হয় এবং সেই আগাছা নাশক থেকেও কিন্তু আমাদের শরীরের রোগব্যাধি বাড়বে। আমাদের দেশের অনেক ডাল রয়েছে যেমন মুগ, ছোলা, অড়হর, খেসারি, বিউলি, বাকলা এগুলো খাওয়া যেতে পারে। আমাদের প্রাতরাশে আমরা চিড়ে, মুড়ি , চালভাজা, রুটি ও পান্তা ভাত খেতে পারি। চকচকে চাল একদমই নয়। আমাদের দেশীয় চাল দুধের সর, ঝিঙেশাল, বালাম, সীতা শাল ও মোটা চালের মধ্যে মরিচশাল, কেরালা সুন্দরী, বহুরূপী, লীলাবতী, লাল চালের মধ্যে সাটিয়া, হেতোমারি, লাল দুধের সর, সুগন্ধী চালের মধ্যে রাধা তিলক, লীলাবতী, কর্পুর ক্রান্তি, কালোনুনিয়া, তুলাইপাঞ্জি এবং গোবিন্দভোগ। আর কালাভাত পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে পুষ্টিকর চাল। এতে এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি ডাইবেটিক গুণ রয়েছে। এটা পায়েস করে খাওয়া যায় খিচুড়ি করে খাওয়া যায়, চাল গুঁড়ো করে আটার সাথে মিশিয়ে রুটি করে খাওয়া যায়। খাবারে সুক্ত, শাক, টক দই ইত্যাদি অন্তভুক্ত করতে হবে। বাইরের খাবার, হোটেলের খাবার এড়িয়ে যেতে পারলে ভালো হয়। বিকল্প খাবারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ফল, চিড়ে, দই কলা দিয়ে সারতে হবে।
মিলেট নিয়ে ইদানিং অনেক চর্চা হচ্ছে। মিলেট সুপার ফুট তো এই মুহূর্তে আমরা ভাত এবং রুটি ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ মিলেটে যেতে পারবো না। তবে আমরা মাঝেমধ্যে মিলেট খেতেই পারি মিলে তবে একবারের বেশি মিলেট খাওয়া হয়তো অনেকের পেটে সহ্য হবে না কারণ মিনিট হজম করার মত গাট বায়োম আমাদের শরীরে তৈরি করতে হবে। তবে কেউ যদি ১০০ গ্রামের চালের ভাত খায় তিনি কিন্তু ১০০ গ্রাম মিলেট খেতে পারবেন না। মিলেটে প্রচুর পরিমাণ এন্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইবার ও ক্যালসিয়াম আছে। সাদা চিনির পরিবর্তে যতটা পাওয়া যায় গুড় খেতে হবে এবং শাকসবজি কাটার পর খাবার সোডায় ভিজিয়ে রাখতে হবে। খাবার পাত্র কোন সময়ই মেলামাইন ও থার্মোকল প্লাস্টিক যেন না হয়। খাওয়া-দাওয়া অতি অবশ্যই সময় মত করতে হবে। বেশি রাতে খাওয়া একেবারেই উচিত নয় সবথেকে ভালো হয় রাত নটার মধ্যে খেয়ে নেওয়া। সপ্তাহে একদিন উপবাস করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। মাংস যত কম খাওয়া যায়, বিশেষত পোল্ট্রির মুরগীর মাংস।
অনুপম পাল, প্রাক্তন উপ-কৃষিঅধিকর্তা (প্রশাসন), ঝাড়গ্রাম
ধন্যবাদ sir। খুব ই তথ্য বহুল লেখা। অনেক কিছু শেখার আছে। উপকৃত হলাম।
খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,যা প্রত্যেকের জানা দরকার।