বৃহস্পতিবার | ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:০৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ষোড়শ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আলাউদ্দিন অল আজাদ-এর ছোটগল্প ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি বড্ড বেশি জরুরি করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকগীতি ঘাটু গান আজ অবলুপ্তির পথে : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (পঞ্চদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন হাসান আজিজুল হক-এর ছোটগল্প ‘স্বপ্নেরা দারুণ হিংস্র’ বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেদেদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের কথা : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান : শৌনক দত্ত বিশ্বপরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ত্রয়দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন নন্দিনী অধিকারীর ছোটগল্প ‘শুভ মাতৃদিবস’ গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ফ্লোরেন্স থেকে রাধানগর রেনেসাঁস ও রামমোহন’-এর মোড়ক উন্মোচন : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ১৯২১-এ কথা দিয়েও স্পেনে গেলেন না কেন রবীন্দ্রনাথ : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ : তারাপদ রায় ও তার অন্ত নাই গো নাই : প্রব্রাজিকা বেদরূপপ্রাণা পেজফোরনিউজ-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ২০২৪ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দ্বাদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন কাশ্মীরে বিজেপির প্রার্থী নেই, মোদীর সফরও বাতিল উপত্যকা ও লাদাখে : তপন মল্লিক চৌধুরী অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে অক্ষয় হোক সম্পদ সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি : রিঙ্কি সামন্ত শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (একাদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথরা কি কবিয়ালের বংশধর? : অসিত দাস নিমাই ভট্টাচার্য-এর বড়োগল্প ‘প্রাইভেট প্রাকটিশ’ উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলে নজর কাড়ল আরামবাগ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (দশম পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আমার রবীন্দ্রনাথ : লুৎফর রহমান রিটন রবীন্দ্র সাহিত্যের নতুন প্রান্ত : মিল্টন বিশ্বাস ঠাকুর কেন Tagore : অসিত দাস আরামবাগের প্রার্থী মিতালি বাগ প্রান্তিক ও নিম্ন বর্গের পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতিনিধি : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় চারশো বছর আগে থেকে মাদপুরের মইস্যা গ্রামে মা বিষহরির পুজো হয়ে আসছে : ভাস্কর মুখার্জী
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়া-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

অতীত থেকে আজ, বদলায়নি নববর্ষ : সন্দীপন বিশ্বাস

সন্দীপন বিশ্বাস / ১৫৪ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪

সেকাল

জমিদার গিন্নি সরোজিনী দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিকের আড়াল থেকে তাকালেন গোপীবল্লভের মন্দিরের দিকে। নতুন রং করা মন্দিরের উপরে বছরের প্রথম সকালের সূর্যের আলো পড়েছে। আমপাতা আর শোলার কদম ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে মন্দির। পুর-অঙ্গনারা মন্দিরে আলপনা দিয়েছেন। সকাল আটটার মধ্যে পুরোহিত আসবেন। শুরু হবে নববর্ষের পুজো। সকালে আজ তিনি পরেছেন লাল পাড় গরদের শাড়ি। কপালে সিঁদুরের টিপ ঘিরে চন্দনের বৃত্ত। গা ভরা গয়না। ওদিকে প্রস্তুত হচ্ছেন জমিদার প্রদ্যুম্নবল্লভ।

নহবত থেকে ভেসে আসা সানা‌ইয়ের সুরে ভৈরবীর আভাস। একটু পরে সরোজিনী মন্দিরে নিয়ে যাবেন গোপীবল্লভ আর রাধারানির জন্য নববর্ষে তৈরি করা সোনার গয়না। পরানো হবে কুলদেবতাদের। এবার গোপীবল্লভের জন্য তিনি নিজে পছন্দ করে বানিয়েছেন অনন্ত বাজুবন্ধ আর রাধারানির জন্য বানিয়েছেন অমৃতপাকের বালা। দেবী লক্ষ্মীর জন্য সোনার কুনকে।

জমিদার তাঁর ‘সরোজ’-এর জন্য এবার গড়ে দিয়েছেন বিল্বপত্র বাজু। কিন্তু গোপীবল্লভ নতুন গয়না অঙ্গে না তোলা পর্যন্ত তিনি সেই গয়না পরবেন না। অনেকগুলি লাল খেরোর খাতা পুজো হবে। সারা বছর তালুকের হিসাবপত্র থাকে সেইসব খাতায়। পুজোর শেষে তার উপরে সিঁদুর মাখানো মোহরের ছাপ পড়বে। প্রদ্যুম্নবল্লভ নিজের হাতে সেখানে লিখবেন ‘ওঁ শ্রীগোপীবল্লভ সহায়।’ পুণ্যাহের দিন সকাল দশটা থেকে প্রজারা আসবেন খাজনা জমা দিতে। তাঁদের হাতে মিষ্টি দেওয়া হবে। এবার ভালো ফসল হয়েছে। রাজকোষে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তাই প্রদ্যুম্নবল্লভও খুশি। দু’হাত ভরে গয়না আর অন্যান্য জিনিস কিনেছেন। কেনা হয়েছে বেলজিয়াম কোম্পানির আয়না। জমিদার গিন্নির ঘরে সেটা টাঙানো হয়েছে। বদলে ফেলা হয়েছে নাচঘরের পুরনো ঝাড়বাতি। তার বদলে লাগানো হয়েছে অসলারের ঝাড়বাতি। ঘরের কোণে বসানো হয়েছে ম্যাকেবের খু খু ঘড়ি। বদলে ফেলা হয়েছে টানা পাখাও। নববর্ষের সন্ধ্যায় সেই নতুন আর উজ্জ্বল ঝাড়বাতির নীচে বসবে নাচ ও গানের আসর। ঘুঙুরের তালে তালে আহ্বান জানানো হবে নতুন বছরকে। এবারের আসর জমাতে ঢাকা থেকে আনা হয়েছে হরিমতী বাঈজিকে। বিশেষ অনুগ্রহ পেতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কুঠিবাড়ির সাহেবদের। বিকেল থেকেই রাজবাড়ির সামনে ব্রুহাম, কেরাঞ্চি, ফিটন থেকে এক এক করে নামবেন সাহেববাবুরা। তাঁদের আপ্যায়নের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে ঢালাও খাবারের, আয়োজন করা হয়েছে মদ্যপানের। গান আর নাচের ফাঁকে আতরদানি থেকে ভৃত্যরা ছড়াবে ল্যাভেন্ডার, গোলাপ জল।

সন্ধ্যায় প্রদ্যুম্নবল্লভ পরবেন ম্যানচেস্টারের মিলে তৈরি আভূমিলম্বিত ‘নয়ন সুখ’ ধুতি, ফিনফিনে বেনিয়ান পাঞ্জাবি। দশ আঙুলে দশটা আংটি, গলায় গোট হার, হাতে থাকবে হাতির দাঁতের মীনে করা ছড়ি।

সকালে পুজোর পর প্রদ্যুম্নবল্লভ একটা সোনার মোহর তুলে দিলেন সরোজিনীর হাতে। প্রতি বছর নববর্ষের সকালে তিনি সেটা দেন। আর সরোজিনী সেটা রেখে দেন তাঁর নিজের ঠাকুর ঘরে মা লক্ষ্মীর ভাঁড়ে। সেই মোহর পরিবারের পক্ষে বড় পয়মন্ত।

সকালে পুজোর শেষে সরোজিনী দাসদাসীদের হাতে তুলে দেন নতুন ধুতি আর শাড়ি। এই দিনটা বড় ভালো লাগে তাঁর। নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় গোপীবল্লভ, রাধারানি আর লক্ষ্মীর কাছে অনেক কিছু প্রার্থনা করেন। তারপরে যান দুর্গাদালানে। সেখানেও প্রণাম করেন। অন্তর থেকে অনেক কিছু কামনা করেন। প্রদ্যুম্নবল্লভ জিজ্ঞাসা করেন, ‘বছরের প্রথম দিন, ঠাকুরের কাছে কী চাইলে সরোজ?’

সরোজিনী মুখ ফুটে সব কথা বলতে পারেন না। কী করে বলবেন, ঠাকুরের কাছে তিনি কামনা করেছেন স্বামীর সঙ্গটুকু। নাচঘরের রাত্রির অভিশাপ তাঁর জীবনে যেন বিরাট এক অপ্রাপ্তি হয়ে প্রতি রাতে ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু নববর্ষের দিন সেই সব ভেবে সরোজিনী মন ভারাক্রান্ত করতে চান না।

মন্দিরের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে তাঁর গ্রামের কথা। বাবা ছিলেন চতুষ্পাঠীর শিক্ষক। বাবার কাছেই সরোজিনীর প্রথম পাঠ। সুন্দরী মেয়ে দেখে জমিদার অনন্তবল্লভ তাঁকে পুত্রবধূ করে নিয়ে এসেছিলেন। বারো মাসে তেরো পার্বণের আবহে বড় হয়ে ওঠা সরোজিনী এই সব উৎসবের মধ্য দিয়ে যেন তাঁর শৈশব আর কৈশোরকে ফিরে পান। মনে পড়ে ছেলেবেলার নববর্ষের কথা।

এই সময় তাঁদের গ্রামে গাজনের মেলা বসত। কল্পেশ্বরের মন্দির ঘিরে বসত মেলা। ছোট সরোজিনী রোজ মেলায় যেতেন। নববর্ষের দিন তাঁদের বাড়িতে পুজো হতো। তাঁরা ভাইবোনেরা নতুন জামা পরতেন। ছোট্ট ছোট্ট হাতে নববর্ষের সকালে উঠোনে আলপনা দিতেন সরোজিনী। শঙ্খ, মাছ, ধানের ছড়া, কড়ি, কুলো কত কী আঁকতেন আলপনাতে। সব মনে পড়ে যায়। যজমানরা বাবাকে নানা উপহার সামগ্রী দিয়ে যেতেন। তার মধ্যে থাকত ধামাশোলের বিখ্যাত মণ্ডা। সেদিন পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলি করা হতো মিষ্টি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছোটরা বড়দের প্রণাম করত।

সেসব দিনের কথা মনে পড়ে সরোজিনীর। এখানে নববর্ষের আগের দিন থেকে বাড়িতে ভিয়েন বসে। কত রকমের যে মিষ্টি হয়, তার ইয়ত্তা নেই। তার জন্য কলকাতা, কৃষ্ণনগর থেকে কারিগর আনা হয়। সাহেবদের জন্য তৈরি হয় নানা ধরনের খাবার। সেসব সরোজিনী স্পর্শও করেন না।

বরং প্রতি বছরই নববর্ষে দুপুরে খাওয়ার আয়োজন নিজেই করেন সরোজিনী। সেই রান্না করেন রাঁধুনি বামুন। প্রথমে হয় গোপীবল্লভের ভোগ। সেই ভোগরাগ শেষ হলে দুপুরের আহার শুরু হয়। সেদিন তিনি নিজে হাতে পরিবেশন করেন স্বামীকে। দুপুরে নিমন্ত্রিত অতিথিদের পাতে দেন পায়েস।

সন্ধ্যায় বেনারসি সাজে সাজলেন সরোজিনী। গা জুড়ে গয়নার যেন ঢল নেমেছে। মনে হয় স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন ঈশ্বরী। ঠাকুরদালানে সন্ধ্যায় একবার কীর্তনের আসর ঘুরে এলেন। আরতি শেষ হলে চলে এলেন ঘরে।

ওদিকে সন্ধ্যা থেকে নাচঘরে আলোর ফোয়ারা। অতিথিরা এসে গিয়েছেন। প্রথমে গানের আসর, তারপর নাচ। হরিমতী বাঈজির গানে দম আছে। যখন গায়, ‘রসিয়া তোরি আঁখিয়ারে, জিয়া লল চায়’, তখন যেন আসর ইন্দ্রসভা হয়ে ওঠে। সুর আর সুরায় ভেসে যায় নববর্ষের রাত।

ওদিকে রাতে একা একা বিছানায় শুয়ে থাকেন সরোজিনী। হালকা গানের সুর ভেসে আসে। একটা একটা করে গয়না তিনি খুলে ফেলেন। চোখের কোণে জল টলটল করে। সারাদিন আজ বছরের প্রথম দিন হলেও রাতে সেই নববর্ষ তার বৈশিষ্ট্য হারাল। এই রাত যেন ৩৬৫ দিনের মতোই আর একটা অপ্রাপ্তির রাত।

একাল

মিতা দিন কয়েক আগে সুনন্দকে বলল, ‘হাজার পাঁচেক টাকা দাও তো। আকাশ থেকে পড়ে সুনন্দ। পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে কী করবে?’

মিতা ঝাঁঝিয়ে বলে, ‘সংসারের দিকে কোনওদিন ভালো করে তাকিয়ে দেখেছ? বিয়েতে পাওয়া বিছানার চাদর দিয়ে এখনও চালাচ্ছ। বিয়ের সময় কেনা পর্দায় তেল কালি পরে কী ছিরি হয়েছে। এসব পাল্টাব। সস্তায় চৈত্রসেল থেকে কিনব। নতুন বছরে শুরু নতুন সাজানো সংসার।’

সুনন্দ বলল, ‘তা তোমার সেই সাজানো নতুন সংসারে আমার ঠাঁই হবে তো?’

মিতা হাসতে হাসতে বলে, ‘পাঁচ হাজার টাকা ফেলে দিলেই হবে।’

সংসার সুখের হয় রমণীর বায়না মেটালে! সুনন্দও সেই মন্ত্রে সংসার সুখে রাখার চেষ্টা করে। সেই টাকা পেয়ে মিতা ঝাঁপিয়ে পড়ল কেনাকাটায়। ঘর সাজানোর খেলায়। নববর্ষের দিন দশেক আগে থেকে চলল কেনাকাটা। সুনন্দ জানে, ওর মাথাটা খাচ্ছে তিনতলার গাঙ্গুলি বৌদি। বড্ড বড়লোকি চাল। মনে মনে ফুস ফুস করলেও সুনন্দ কিছু বলতে পারে না।  হাতিবাগান থেকে এল বিছানার চাদর। গড়িয়াহাট থেকে দরজা, জানালার পর্দা, নানা রকমের শো পিস। নিউ মার্কেট থেকে পরিবারের সকলের পোশাক, নিজের ব্যাগ। আর ছাতুবাবুর বাজারের চড়কের মেলা থেকে সাঁড়াশি, রুটি সেঁকা, চা ছাঁকনি…।

সব জিনিস কিনে এনে মিতা সুনন্দকে দেখায় আর বলে, ‘জানো তো খুব সস্তায় পেয়েছি। ভালো হয়েছে না?’

সুনন্দকে গুডবয়ের মতো ঘাড় নেড়ে বড় করে ‘হ্যাঁ’ বলতে হয়, তবেই মিতা খুশি হয়। নববর্ষের আগের দিন বিকেল থেকে একেবারে তুলকালাম ব্যাপার শুরু হল। সুনন্দকে বলেছিল তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে আসতে। পর্দা, বিছানার চাদর বদল হল। বালিশে নতুন ওয়াড় পরানোর দায়িত্ব ছিল সুনন্দর। সে এক ভয়ঙ্কর কাণ্ড। নতুন ওয়াড়, অথচ ভিতরে তুলো বের করা বালিশ। সেই তুলোর গুঁড়োয় সুনন্দর বেমক্কা কয়েকটা হাঁচি হল। ঘরেতে উড়ছে তুলো সুড়সুড়িয়ে।

নববর্ষের দিন সকালে সুনন্দকে একরকম ধাক্কা দিয়ে সে তুলে দিল। সুনন্দ  উঠে বলল, ‘কী হয়েছে, এত তাড়াতাড়ি তুলে দিলে কেন?’

—‘তাড়াতাড়ি স্নান করে নাও। নতুন জামাকাপড় পরে চলো দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে পুজো  দিয়ে আসি।’

সুনন্দ দেখল, মিতার স্নান হয়ে গিয়েছে। নববর্ষের সকালে স্নানসিক্ত মিতার যেন অন্যরূপ। বেশ ভালো লাগল তার।

দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে পুজোর লাইনে দাঁড়াল। ভক্তরা ঝুড়িতে লক্ষ্মী-গণেশ নিয়ে পুজো দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ হালখাতা। লাইনে দাঁড়িয়ে মিতা বলল, ‘স্বর্ণমৃগ জুয়েলারি থেকে ভল্টুদা নেমন্তন্ন করে গিয়েছে। সন্ধ্যায় ওখানে যেতে হবে।’

পুজোর শেষে একটা দোকানে ওরা ব্রেকফাস্ট করল। গঙ্গার ধারে কিছুক্ষণ বসল। মিতা বলল, ‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। সুনন্দ মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠল। মিতার আইডিয়া মানেই ‘পকেটবধ কাব্য’।

মিতা বলল, ‘ঠিক করেছি, আজ নববর্ষে লাঞ্চ সারব বাইরে কোথাও। একটু বাঙালি ফিউশন খাবার খেতে হবে। তুমি একবার মোবাইলটা খুলে দেখ না, কোথায় কী মেনু আছে।’

খুঁজে খুঁজে মিতার পছন্দ হল ‘গোগ্রাস কন্টিনেন্টাল’এর বাঙালি মেনু। বাফে সাড়ে আটশো টাকা মাথাপিছু। কড়াইশুঁটির কচুরি, সাদা ভাত, পোলাও, আলু ভাজা, মোচার ঘণ্ট, থোড় ছেঁচকি, পোস্তর বড়া, সর্ষে পার্শে, ভেটকি পাতুড়ি, মাটন, চাটনি, পাঁপড়, দই, রসমালাই, ভাপা সন্দেশ, পান। মেনুটা পড়ে মিতা বলল, ‘এতগুলো খাবার সাড়ে আটশো টাকা মাত্র! এত সস্তায় দিচ্ছে কী করে গো?’ সুনন্দ বলল, ‘তুমি এগুলোর একপিস করেও সব খেতে পারবে না।’

—‘তুমি না কিপটে হয়ে গেছ। বছরের প্রথম দিন এমন করলে, সারা বছর কিপটেমি করবে। তাড়াতাড়ি ওদের নম্বরে ফোন করে বুক করে দাও। চল বাড়ি গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে তারপর বেরব।’

দুপুরে বাঙালিয়ানা করতে গিয়ে একগাদা টাকা যে খসে গেল তাই নয়, গরমে সুনন্দর পেটের ভেতর যেন পাতুড়ি, ঘণ্ট, ছেঁচকি আর মাটনের রেষারেষি শুরু হয়েছে। বাড়ি এসে এসি চালিয়ে দু’জনেই একেবারে কাত। মিতার মুখেও কথা নেই। শুধু বলল, ‘খুব ভালো রান্না করেছে। বেশি খেয়ে ফেলেছি।’

সন্ধ্যায় সোনার দোকানে গিয়ে মিতা সুনন্দকে বলল, ‘অ্যাই আজ বছরের প্রথম দিনে আমায় কিছু কিনে দেবে না? ছোট করে একটা কিছু দাও না গো?’

ব্যস, হয়ে গেল। সোনার দোকানে ছোট করে মানে তো কম করে পনেরো হাজার টাকা। কার্ড দিয়ে কোনও রকমে ম্যানেজ করল সুনন্দ। টাকা দিয়ে মিষ্টি আর ক্যালেন্ডার নিয়ে বাড়ি ফিরল ওরা। ফেরার পথে সুনন্দ মনে মনে হিসাব করল, নববর্ষের গেরোয় কতটা খসল।

রাতে নো ডিনার। শুধু দুটো অ্যান্টাসিড মেরে কাত সুনন্দ। মিতা বলল, ‘দিনটা দারুণ কাটল। সারাবছর যেন এরকমই যায়।’

সুনন্দ বলল, ‘একদম না। সারা বছর এমন গেলে আমাকে দিগম্বর হয়ে পথেঘাটে ঘুরতে হবে। কাল থেকে দু’মাস আলু সেদ্ধ ভাত।’

মিতা বলল, ‘ছি, কী যে বল! নতুন বছরের প্রথম দিনে এমন কথা বলতে নেই।’

সুনন্দ কোনও উত্তর দিতে পারল না। শুধু ‘ঘ্যাঁও’ শব্দ করে একটা বড় ঢেকুর তুলল। বলল, ‘পয়সা খতম, নববর্ষ হজম।’


আপনার মতামত লিখুন :

One response to “অতীত থেকে আজ, বদলায়নি নববর্ষ : সন্দীপন বিশ্বাস”

  1. Nandini Adhikari says:

    ভালো লাগলো সেকাল আর একালের নববর্ষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন