বাইজীর কুঠির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। আজকে আমাকে দেখার মতো কেউ নেই। সবাই উৎসবের মেজাজে। অনুপের ড্রাইভারের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, তুমি ঘণ্টাদুয়েক পর ফিরে এসো, আমি এর মধ্যে কাজ সেরে নিচ্ছি। তোমাকে ফোন করবো। ওর ফোন নম্বরটা নিলাম।
অনুপের ড্রাইভার চলে গেল।
রাতের এই পাড়ার সঙ্গে দিনের এই পাড়ার আকাশ পাতাল তফাৎ। তায় আজ পরব। পার্থক্যটা বড্ডবেশি চোখে লাগছে। দামিনীমাসির ওখানেও এটা লক্ষ্য করেছি।
চারিদিকে ছুটির আমেজ।
আমি ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম। সব কিছু কেমন ম্যাড়মেরে ফাঁকা ফাঁকা। বাইজীর দরজার সামনে এসে বেল বাজালাম। বেশ কিছুক্ষণ পর বাইজী নিজে দরজা খুললো।
আমি বাইজীকে দেখে অবাক হলাম। পরনে একটা ঘাগড়া। রংটাও ভীষণ সুন্দর। খুব চেনাচেনা। বাইজী সেদিন একবারে সাজেনি। খুব সাধারণ ঘরের মেয়ের মতো লাগছে। কোমরের নীচ পর্যন্ত কালোমেঘের মতো এলোচুল পিঠ ময় ছড়িয়ে পড়েছে। শরীরের সমস্ত সৌন্দর্য যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরছে। শুধু নাকে একটা হীরের নাকছাবি জল জল করছে।
মনে মনে আফতাবভাইকে ধন্যবাদ জানালাম। তুমি তোমার রাখেল হিসেবে ঠিক মেয়েকেই পছন্দ করেছ। সুন্দরী না হোক সে তোমার ঐতিহ্যের ধারক বাহক।
মেহেরবানী করকে আপ আন্দার আইয়ে। বাইজী ভীষণ সুন্দর করে বললো।
একটু হয়তো অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলাম। বাইজী মুচকি হাসলো।
আমি ভেতরে এলাম। বাইজী দরজা বন্ধ করলো।
নাচ ঘরটায় আজ কোন জৌলুস চোখে পরলো না। যন্ত্রগুলো ফরাসের ওপর এলোমেলো ভাবে হাত-পা ছড়িয়ে টান টান হয়ে শুয়ে আছে। চারদিক শুনসান। কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
আইয়ে।
কাঁহা!
আন্দার।
আপ একেলা হ্যায়!
বাইজী মুচকি হাসলো। হাঁ।
আপকা পাশ যো আদমি ঔর আউরাত থা।
সব কোই কো ছুট্টি দে দিয়া, আজ হামারা পরব হ্যায় না।
মনে মনে ভাবলাম বাইজী কি তাহলে আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে? মনের কথা বুঝতে দিলাম না।
বাইজী সামনে, আমি পেছনে।
বাইজীর পায়ের নুপুরের নিক্কন রিনিঝিনি শব্দে নাচঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পরছে।
নাচঘরের ভেতর দিয়েই আর একটা দরজার সামনে এলাম। এই দরজা দিয়ে বাইজীকে নাচঘরে আসতে দেখেছি। দরজা খুলতেই সরু একটা প্যাসেজ। শেষে একটা বড়ো বারান্দা। পর পর দুটো দরজা। আমি থমকে দাঁড়ালাম। বাইজী একটু এগিয়ে গিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
আইয়ে।
আমি এগিয়ে গেলাম। বাইজী দরজা খুলে ভেতরে গেল। আমি পেছন পেছন ঢুকলাম।
ঘরের চারদিকটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। পুরনো আমলের বাড়ি লাল সিমেন্টের মেজে। খুব সাধারন সাজসজ্জা কিন্তু তার মধ্যেই কেন জানিনা রুচির ছাপ স্পষ্ট। বেশ বড়ো ঘর। একপাশে একটা মান্ধাতা আমলের পেল্লাই খাট। একটা কাঠের আলমাড়ি, ইজি চেয়ার। আসবাব-পত্রের মধ্যে কোথাও আধুনিকতার গন্ধ নেই।
আমি চেয়ে চেয়ে চারদিক দেখছি।
বাইজী আমাকে ইজি চেয়ারে বসতে বললো। বসলাম।
আমার সৌভাগ্য আপনি আজ আমার কাছে এসেছেন। বাইজী পরিষ্কার বাংলায় বললো।
আমি বাইজীর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
আমাকে ইজি চেয়ারে বসিয়ে বাইজী খাটের এক কোনায় গিয়ে বসলো।
আমি বাঙালী।
আমি যেন শব্দকরে কথা বলতে ভুলে গেছি। একটি শব্দও মুখ থেকে বার হচ্ছে না।
বিশ্বাস হচ্ছে না?
বিশ্বাস না হওয়ার কি আছে। গলাটা খুব সামান্য হলেও কাঁপল।
আফতাবভাই আপনাকে বলে নি?
বলেছে।
তাহলে এতদিন আপনি মাতৃভাষার বদলে অন্য ভাষায় কথা বলতেন।
চুপ করে রইলাম।
আমি বিধর্মী। বাইজী মাথা নীচু করে রয়েছে। আমি বাইজীর দিকে তাকিয়ে।
বাইজী মুখ তুললো। চোখে মুখে হাসির ছটা।
কাল রাতে কি মনেহলো হঠাৎ আপনাকে ফোন করলাম। আপনি রাগ করেন নি তো?
না।
আমি জানতাম, আপনি আফতাবভাই-এর যখন এত ঘনিষ্ঠ তখন আপনার মধ্যে ধর্মের বাঁধন নেই।
আমি হাসলাম।
আপনাকে যদি আমাদের পূজোর প্রসাদ দিই আপনি খাবেন?
খাব।
বাইজীর চোখে মুখে খুশীর রং ছড়িয়ে পরলো।
একটু বসুন আমি গুছিয়ে নিয়ে আসি।
বাইজী খাট থেকে নেমে নিমেষের মধ্যে ঘর থেকে উধাও হয়েগেল।
আমি শূন্য ঘরে একা বসে আছি। বার বার মনে হচ্ছে কেন বাইজী এই রকম ভেক ধরেছে। তাহলে কি ওর কোন অসৎ উদ্দেশ্য আছে। কিছুতেই যুক্তি তক্ক দিয়ে বাইজীর আচার-আচরণ মেলাতে পারছি না।
তাহলে কি বাইজী আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে? বার বার একই চিন্তা আমার মনের মধ্যে নিভৃতে খেলা করে চলেছে।
তা হবে কেন! আজ আমি প্রথম এই কুঠিতে আসছি না। এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছি। হ্যাঁ, অন্দরমহলে প্রবেশের ছাড়পত্র মেলে নি।
তাই যদি হবে তাহলে আফতাবভাই আমাকে একটা ইন্টিমেশন দিত।
বুদ্ধি দিয়ে তখন কোন ব্যাখ্যা ধোপে টিকছে না। কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
বাইজী ঘরে এলো। এক হাতে একটা কুশের আসন। আর এক হাতে একটা কাঁসার গ্লাস।
আসনটা পেতে গ্লাসের থেকে একটু জল সামনে ছড়িয়ে দিল। একবারে হিন্দু মেয়েদের মতো। আমাদের গ্রামের ঘরে কাউকে খেতে দেওয়ার আগে এই ধরণের রেওয়াজ আছে। কেমন যেন খটকা লাগলো। নিজের মনকে বোঝালাম আমি বাঙালী হিন্দু তাই হয়তো বাইজী এরকম আচরণ করলো।
জিন্নাত আজ তোমার কর্মচারীরা কোথায়?
বাইজী আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
ছুটি দিয়ে দিয়েছি।
আমি বাইজীর দিকে তাকিয়ে।
বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার।
ঠিক তা নায়। এত বড় কুঠিতে তুমি আমি একা!
বাইজী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমি পুরুষ মানুষ তায় বিধর্মী, তোমার কোন ভয় করছে না।
জিন্নাত সারাটা শরীরে হিল্লোল তুলে খিল খিল করে হেঁসে উঠলো।
আমাদের মতো কৃমিকীটরা পুরুষের চোখের লোভ-লালসার সন্ধান আগে পায়।
আমি জিন্নাতের দিকে তাকিয়ে।
আসুন। আপনি বসুন। আমি প্রসাদ নিয়ে আসছি।
জিন্নাত দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি স্থানুর মতো ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে আছি। মাথার মধ্যে নানা চিন্তা কিলবিল করছে।
জিন্নাত যে কখন ঘরে ঢুকেছে টের পাই নি।
আপনি এখনো বসে আছেন!
চমকে তাকালাম।
দেখলাম জিন্নাত একটা কাঁসার থালায় গুছিয়ে দই, দুধ, খই-মুড়কি, খেঁজুর, আখরোট, কাজু, কিসমিস, পাটালি নিয়ে এসেছে। থালাটা কুশাসনের সামনে রাখা।
আমি ওর দিকে সম্মোহনের মতো তাকিয়ে আছি। পবিত্রতার ছোঁয়া ওর চোখে মুখে।
জিন্নাত হাসছে।
আসুন।
আমি সম্মোহনের মতো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ধীর পায়ে আসনে এসে বসলাম।
কিছুতেই জিন্নাতের ব্যবহারটা আমার কাছে স্বাভাবিক ঠেকছে না।
বার বার নিজেকে প্রশ্ন করছি। এর আগেও বহুবার জিন্নাত আমাকে পরিপাটি করে খাওয়াবার চেষ্টা করেছে। আমি এতটুকু সেই সব বস্তু ছুঁয়ে দেখি নি। এমনকি এক গ্লাস জলও খাই নি।
তাহলে কেন সেইদিন কি খেয়ালের বসে ওর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম?
কুশাসনে বসে গ্লাস থেকে হাতে জল নিয়ে থালার চারপাশে ছড়িয়ে দিলাম।
জিন্নাত আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে।
মাথা নীচু করে থালাটা আমার দিকে সামান্য টেনে নিলাম।
দাঁড়ান। শব্দটা ঠিক শ্রুতি মধুর শোনাল না।
আমি জিন্নাতের দিকে মাথা তুলে তাকালাম। থম থমে মুখে ঝড়ের পূর্বাভাস।
জিন্নাত পরনের ঘাগরাটা উঁচুতে তুলে ধরলো। ফর্সা দুই থাইয়ের মাঝখানে টকটকে লাল ইজের প্যান্ট চেপে বসে আছে। জিন্নাতের চোখ হাসছে।
আমি একটুও অবাক হলাম না। এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে সেটা ভেবেই নিয়েছিলাম। মনে মনে বললাম, লোভী আমি কোনদিনই ছিলাম না। আজও নই।
মাথা নীচু করে খইতে হাত দিলাম।
এখন খাবি না। একটু দাঁড়া। জিন্নাতের কণ্ঠে হুকুমের সুর।
আকাশে ঘোর কালো মেঘে বিদ্যুৎ চমকের মতো কথাটা কানে বাজলো। তুই!
চমকে মুখ তুলে তাকালাম। জিন্নাত একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমার চোখে পলক পরছে না।
জামাটা ধর, বার করি। জিন্নাতের গলাটা ভেঙে এলো।
আমি তড়িতাহতের মতো আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। থালাটা ডিঙিয়ে জিন্নাতের মুখো মুখি দাঁড়ালাম।
একটু ধর না, ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন। ধরা গলায় জলভরা টল টলে চোখে জিন্নাত আমার দিকে তাকিয়ে।
বিশ্বাস কর কনি, আমি তখন কিছুতেই মিলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। আমার কাছে সব কেমন ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি মনে হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে একটা প্রচন্ড সঙ্কোচ, ওকে ছুঁতে পারছি না। কিন্তু ও আমার কতো কাছে।
তখন আমি দোলাচলে, আমার স্বপ্ন কি তাহলে বাস্তবের এত কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়িয়েছে?
জোর করে আমার হাতটা ধরে ওর ঘাগড়ায় রাখলো। আমি স্থবিরের মতো ওর ঘাগড়াটা ধরে রইলাম। জিন্নাত কোমড়ে মোড়া ইজের প্যান্টের অংশটুকু থেকে একটা কাগজের মোড়ক বার করে আনলো।
স্বগতোক্তির সুরে বলে উঠলো, মিয়াপুরু তোর এত লোভ হয়্যা মরছে কেন।
শানিত চাবুকের মতো কথাটা আমার কানের ভেতর দিয়ে বুকে আঘাত করলো।
এ আমার অজ পাড়াগাঁয়ের ভাষা। আগ্রার এই বাইজী জানল কি করে! তাহলে কি….!
আমি বাইজীর ঘাগরা ছেড়ে দিয়েছি এক দৃষ্টে বাইজীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
বাইজীর চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল মাটিতে গড়িয়ে পরছে। জিন্নাত আমার দিকে কাঁপা কাঁপা চোখে তাকিয়ে। মুখ-চোখ দুমড়ে মুচড়ে একাকার।
আমার ঠোঁট দুটো সামান্য কেঁপে উঠলো, জড়িয়ে মরিয়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ বেরিয়ে এলো।
আ-য়ে-ষা!
হ্যাঁ অনি, আমি আয়েষা। জিন্নাত ভেঙে পরলো।
সব সঙ্কোচ মুছে ফেলে আয়েষা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। হাপুস নয়নে আমার বুকে মাথা রেখে ফুলে ফুলে কাঁদছে। ওর ডুকরে ডুকরে কন্নার শব্দ নিস্তদ্ধ ঘরের বাতাসটাকে ক্রমশ ভাড়ি করে তুললো। শান্তনা দেবার ভাষা সেই মুহূর্তে আমার কাছে ছিল না। অমিও তখন স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে। নড়চড়া শক্তি টুকু তখন আমার মধ্যে ছিল না।
কতক্ষণ ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল জানি না। চেষ্টা করেও আমি মুখ দিয়ে একটি শব্দও বার করতে পারি নি। বুকটা ভীষণ যন্ত্রণা করছিল। বেশো কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মুখ দিয়ে অনবরতো নোনাজলের স্রোত বইছে। বুকের মাঝখানে কিছু যেন দলাপাকিয়ে আটকে রয়েছে। একটা চাপ চাপ ব্যাথা। মনে হচ্ছে এখুনি আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আয়েষা আমার বুক থেকে মুখ তুললো। কান্না ভেঁজা কণ্ঠে বলে উঠলো।
ওখানে বসে তোকে খেতে হবে না। তুই মাটিতে বোস।
আমাকে ছেড়ে আলমাড়িটার কাছে চলে গেল। আমি ওকে হাপুস নয়নে দেখছি। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে। বুঝতে পারছি ঘন ঘন চোখের পাতা পরছে।
আলমাড়ির পাল্লাটা খুলে একটা হলুদ হয়ে যাওয়া কলাপাতা বার করলো। আমার চোখের পাতা পরছে না। ওকে দেখছি। পাল্লাটা ভেজিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
কাছে আসতে বুঝলাম ওটা কলাপাতা নয় শালপাতা। আমি ওর মুখের দিকে কিছুতেই ঠিকভাবে তাকাতে পারছি না। বার বার চোখ নামিয়ে নিচ্ছি।
তুই ওখানে বোস। আমাকে খাটের দিকটা দেখাল।
আমি তখন চলশক্তিহীন গা-হাত-পা কেমন ভারী ভারী ঠেকছে। ওর মুখের দিকে তাকালাম। চোখের পাতা ভিঁজে কাদা হয়েগেছে।
দাঁড়িয়ে রইলি কেন, বোস।
আমি স্থবিরের মতো ওখানেই মাটিতে থপ করে বসে পরলাম।
ও আমার মুখো মুখি বসলো।
শালপাতাটা মাটিতে রেখে কোঁচর থেকে বার করা কাগজের মোড়কটা থেকে দুটো খেঁজুর কয়েকটা কাজুবাদাম, কিসমিস, একটা আধভাঙা আখরোট, একটুকরো পাটালি রাখলো।
সেই সময় ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছিল বুঝলি কনি, পারি নি। ওর মুখের দিকেও ঠিক মতো তাকাতে পারছি না। বার বার চোখ নামিয়ে নিচ্ছি।
জানিস অনি, পাটালিটা নিজে হাতে তৈরি করেছি। আম্মিকে পাবো কোথায় বল। সকালে নিচ থেকে এক সের আঁখের রস কিনে এনে ছিলাম। গ্যাসে বসিয়ে জাল দিয়ে তৈরি করেছি। তোর জন্য কিছুটা রেখেছি, নিজে কিছুটা খেয়েছি।
আমি আয়েষার দিকে তাকিয়ে।
নে খা, পরে তোকে সব বলছি।
আমি ধীরে ধীরে সম্বিত ফিরে পাচ্ছি। ধরা গলায় বললাম।
তুই একটু খা।
আমি খেয়েছি, এটা তোর জন্য তুলে রেখেছিলাম।
তবু আমি একটা খেঁজুর ওর ঠোঁটের সামনে তুলে ধরলাম।
তুই একটু কামরে নিয়ে আমাকে দে।
হাসলাম। আয়েষার কথা রাখলাম।
তখন একটু একটু ধাতস্থ হয়েছি। খেতে খেতেই ওর সঙ্গে কথা শুরু করলাম।
শালপাতা পেলি কোথায়?
সে অনেক ইতিহাস।
কিরকম!
এ কি আমাদের পালের ঘরের বাগান, কুড়িয়ে নিয়ে চলে এলাম।
তাহলে?
তুই সেদিন যখন বললি আসবি তারপর দিন কিনে এনেছি।
কোথা থেকে!
একজনকে বলে রেখেছিলাম। সে জোগাড় করে এনে দিয়েছে। প্রত্যেকদিন একবার করে জলে ধুয়ে আলমাড়িতে তুলে রাখতাম। দেখ তবু কেমন হলদেটে হয়ে গেছে।
তুই জানতিস আমি আসবো?
অনি আসবে জানতাম, প্রেমানন্দ হলে আসতো না।
আমি আয়েষার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
আমার মন থেকে ঘটনাটা যেমন আজও পর্যন্ত মুছে যায় নি, তোর মন থেকেও মুছতে পারে না। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।
তাই তুই মাঝরাতে ফোন করেছিলি!
আয়েষা আমার দিকে ছল ছল চোখে তাকাল। একটু কথা বললেই ওর চোখ জলে ভরে উঠছে।
মাথা দোলাল। হ্যাঁ।
তার কিছুক্ষণ আগে আমি নমাজ পরে উঠেছি। সেই সময় তোর ঈশ্বর, আমার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, তুই যদি সত্যি অনি হোস তাহলে এই মাঝরাতে আমার ফোন রিসিভ করবি। আর তুই যদি আমার অনি না হোস তাহলে আমার ফোন রিসিভ করবি না।
আমি আয়েষার দিকে তাকিয়ে।
তুই ফোন রিসিভ করেছিলি।
আয়েষা একটু থামলো। ওর বুকের থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
চোখের জল মুছলো।
এর আগেও তুই বহুবার এসেছিস। তোকে আমি একগ্লাস জল খাওয়াতে পারি নি। সেদিন তুই আমার আবেদনে প্রথম সারা দিয়েছিলি। তাই নিজেকে ধরা দেবার জন্য ….।
আয়েষা কথা বলতে পারলো না। চোখের কোল বেয়ে আবার টপ টপ করে জল গড়িয়ে পরলো।
তুই কাঁদলে আমার খারাপ লাগবে।
তুই কি এতটাই পাষাণ, একটুও বুঝতে পারিস নি? জলভরা চোখে আয়েষা আমার দিকে তাকাল।
বুঝতে পারলে অনেক আগে তোর কাছে এসে ধরা দিতাম।
একটু থামলাম।
বিগতো তিরিশ বছর এই ক্ষত বয়ে বেরাচ্ছি। বিশ্বাস কর। গতো তিরিশ বছরে আমি কোনওদিন ঈদের চাঁদের দেখা পাই নি। বহু চেষ্টা করেছি।
কাল রাতে তোর ফোনটা পাওয়ার পর অনুপের বাড়ির ছাদে উঠে ঈদের চাঁদ দেখলাম। তোর কথাটা বড্ড বেশি মনে পরছিল। কিন্তু তোর আট-নয় বছরের মুখটাই যে আমার চোখের সামনে ভেসে আছে। আঁটত্রিশ বছর বয়েসটা কম নয়।
আয়েষার মুখের দিকে তাকালাম। স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
এখানে তো পালের ঘরের পুকুর নেই একটু জল দে হাতটা ধুই।
আয়েষা হেঁসে জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিল। হাতটা ধুতে ধুতে আয়েষার দিকে তাকালাম।
ব্রাহ্মণ মানুষ পেটুক হয়। থালাটা গুছিয়ে রাখ, একটু পরে খাব।
ওটা তোকে খেতে হবে না।
কেন!
ওটা প্রেমানন্দের।
তাহলে অনি কি খাবে।
তোর জন্য মুগডাল, সাবু ভিঁজিয়ে রেখেছি। আঁখের গুড় আছে। আর দুধ কলা।
এলাহি ব্যবস্থা।
তুই ব্রাহ্মণ মানুষ তোকে মোচলমান ঘরের অন্নভোগ দিতে পারি না।
আমি কিন্তু ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরে যাব।
আজ তোর যাওয়া হবে না।
কেন, দুজনে মিলে এক্কাদোক্কা খেলবো।
আয়েষা হো হো করে হেসে উঠলো। তোর মনে আছে?
এই ছোট ছোট স্মৃতি নিয়েই আমি এই মুহূর্তে বেঁচে আছি।
গাড়ি কোথায় রেখেছিস?
জানিনা। ড্রাইভরকে বলেছিলাম ঘণ্টা দুয়েক বাদে আমি ফোন করবো।
ভাড়া গাড়ি?
না।
তাহলে?
অনুপের।
ফোন করে বলে দে, আজ ফিরবি না। ও ফিরে যাক।
তা হয় না।
আজ তুই সারাদিন আমার সঙ্গে থাকবি।
আয়েষার কন্ঠের মধ্যে অধিকার বোধের সুর ঝড়ে পরলো।
কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকার পর, অনুপের ড্রাইভারকে ফোন করলাম।
ওকে বললাম, তুমি আজ ফিরে যাও। আমি ফিরতে পারছি না। উল্টে ও জানাল, অনুপ ফোন করেছিল, বলেছে তুমি অনিকে একলা ওখানে ছেড়ে আসবে না। ওকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। আজ যদি না ফেরে, কাল ওকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবে। বাধ্য হয়ে ওকে বললাম তুমি কাছাকাছি কোন হোটেলে একটা ঘর নিয়ে নাও। কাল সকালে তোমাকে ফোন করবো।
আয়েষা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, ওর চোখে মুখে খুশির ছোঁয়া।
আমাকে থাকতে দিবি কোথায়?
এই ঘরে।
এই ঘরের যারা বাসিন্দা।
আমি এই ঘরে থাকি।
তোর আর কর্মচারীরা।
সব কাল সকালে আসবে।
তুই থাকবি কোথায়?
এই ঘরেই থাকবো।
পাশের ঘরটা।
ওটা শরীর বিক্রির ঘর।
চুপ করে গেলাম।
আয়েষা উঠে দাঁড়িয়ে কুশের আসন, খই-মুড়কির থালা নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
পায়ে পায়ে জানলার কাছটায় এলাম। দামিনীমাসির পাড়াটার সঙ্গে কোন অমিল খুঁজে পেলাম না। আয়েষার এতদিনকার জীবনটা খুব জানতে ইচ্ছে করছে। শুরুটা কোনখান থেকে করবো, কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না।
সত্যি তোর কোন পরিবর্তন হয় নি।
পেছন ফিরে তাকালাম। আয়েষা ঘরে ঢুকেছে। হাতে ট্রে। ট্রের ওপর চায়ের পট কাপ ডিস।
হাসলাম।
ওদিকে কোন বকুল গাছ নেই।
আমি হাসছি। তোর মনে আছে।
একটু খোঁজা খুঁজি করলে তোর হাতে তৈরি একটা বকুল বাঁশি হয়তো পেয়েও যেতে পারি। জানিনা সেটা অক্ষত আছে কিনা। বাজবে কিনা তাও বলতে পারি না।
আমি আয়েষার দিকে তাকিয়ে। একটু আগে যে কালো মেঘের ছায়া ওর চোখে মুখে ফুটে উঠতে দেখেছিলাম, এখন তা অনেক পরিষ্কার।
আয় দুজনে মিলে খাটে উঠে বসি।
আয়েষা এগিয়ে এসে চায়ের ট্রে খাটের ওপর রাখলো। আমি খাটে উঠে বসলাম।
মুখো মুখি দুজনে।
আয়েষা যত্ন করে দুটো কাপে চা ঢালছে।
অনি।
উঁ।
স্যার কেমন আছেন?
দেহ রেখেছেন।
আয়েষা আমার দিকে তাকাল। আবার চোখটা ছল ছল করে উঠলো।
আমার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল।
কবে মারা গেছেন।
বছর পাঁচেক।
তুই তখন কোথায় ছিলি?
বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
তোর মৃত্যুর আগে না পরে?
চমকে তাকালাম আয়েষার মুখের দিকে।
বলনা।
বছর তিনেক পরে।
তারপর থেকে এই বেশ ধারণ করেছিস।
মাথা দোলালাম।
জিজ্ঞাসা করলি না, আমি এতসতো জানলাম কি করে?
তুই আমার ওপর খুব ভাল হোম ওয়ার্ক করেছিস, তাই ধরা দিয়েছিস।
আমার সম্বন্ধে তোর জানতে ইচ্ছে করছে না?
করছে তো।
কই একবারও জিজ্ঞাসা করছিস না।
তুই তো বললি সব বলবি। তাই অপেক্ষা করছি।
তোর শরীরে আমার দেওয়া একটা স্মৃতি চিহ্ন আছে।
হাসলাম।
বল না, তোর মনে আছে?
না।
তোর বাঁ-পাটা দেখি।
আমি আয়েষার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছি।
দে।
পা বেশি ধরলে খয়ে যাবে।
হঁ তোকে কইছে।
আমি হেসেফেললাম। একবারে গাঁইয়া ভাষা ঝেরে দিলি।
আয়েষা হাসতে হাসতে চায়ের কাপটা একপাশে একটু সরিয়ে রেখে জোর করে আমার পা টেনে ধরলো।
কাটা জায়গাটার ওপর হাত বোলাতে শুরু করলো।
আবার আয়েষার চোখ ছল ছল করে উঠলো।
নামতা পড়তে ভুল করেছিলাম বলে তুই গুম করে পিঠে কিল মারলি। আমিও ভাঙা স্লেটটা দিয়ে তোর পায়ে মারলাম। ফালা হয়ে গেল। রক্ত বেরতে দেখে চিকনা কেঁদে ফেললো। কে যেন ছুটটে গিয়ে পোকা মাস্টারকে খবর দিল। গণেশ ডাক্তার এসে তোর পায়ে তিনটে সেলাই করেছিল। এইটুকু ছাড়া আর কিছু মনে নেই।
আয়েষার চোখে মুখে রং-লেগেছে।
জীবনের এই ছোট ছোট ক্ষতগুলো কত গভীর তাই না অনি?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
তোর একটুও মনে নেই?
এখন মনে পরলো।
মিয়াপুরু।
হো হো করে হেসে উঠলাম। তুই গাল দিলু। আবার গুম গুম।
দে না, আয়েষা ওই টুকু নিয়ে মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকবে।
আয়েষা চুপ করে রইলো। চারদিক নিস্তব্ধ।
অনাদি মাস্টার, পোকা মাস্টার বেঁচে আছে?
না মারা গেছেন।
আবার আয়েষা কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে থম মেরে বসে রইলো।
অনাদি মাস্টারকে আমি কোনদিন ক্ষমা করতে পারবো না।
তবু তিনি আমাদের শিক্ষাগুরু ছিলেন।
ওই মানুষটার জন্য….। আয়েষার গলা রুদ্ধ হয়ে গেল। আবার চোখে জল ভরে এলো।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো।
বিশ্বাস কর পা কেটে যাওয়ার ঘটনার পর, তুই আমাকে আর কোন দিন বকিস নি। মারিস নি। তোকে আমার ভীষণ ভাললাগতো, কিন্তু তোকে ভালবাসার কথা কোনদিন কল্পনাও করতে পারি নি।
ওই বয়সে এই রসায়নটা থাকে না।
তবু অনাদি মাস্টার….।
থাক। আর মনে করে কষ্ট পাস না।
নারে অনি, আজ আমি যেখানে এসে দাঁড়িয়ে আছি স্রেফ অনাদি মাস্টারের জন্য।
তুই যেমন সেদিন বাড়ি ফিরে মানা মাস্টারের কাছে বেদম মার খেয়েছিলি, আমিও তেমনি আব্বার কাছে মার খেয়েছিলাম। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলো। বিয়ে দেওয়ার নাম করে বলতে পারিস আব্বা আমাকে আমার এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের কাছে বেচে দিল। প্রতিদিন রক্তারক্তি, যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠতাম। সে এক অসহ্য জীবন।
আয়েষা মাথা নীচু করে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে।
এতো কষ্টের মধ্যেও পাঠশালায় যাওয়ার থলিটা এখনো সঙ্গে রেখেছি। আধভাঙা শ্লেট, হাসিখুশি, সহজপাঠ প্রথম ভাগ, নামতার বই, বর্ণপরিচয়, একটুকরো খড়ি, তোর দেওয়া বকুল বাঁশি।
কাঁদতে কাঁদতে আয়েষা হেঁসে ফেললো।
বল ঠিক করি নি?
চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে। তবু অপলক নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
ওটা আমার আল্লাহ। দেখবি?
মুখ থেকে কোন শব্দ বেরলো না। আস্তে করে মাথা দোলালাম।
আয়েষা খাট থেকে নেমে ছুটে আলমাড়ির কাছে চলে গেল। একটা জীর্ণ টিনের বাক্স বার করে নিয়ে এসে আমার সামনে খাটে রাখলো।
জানিস কনি টিনের বাক্সটা খুলতেই আমার বুকের ব্যাথাটা আবার চিন চিন করে শুরু হলো। সেই হলদেটে রংয়ের ফ্রক, রংটা কেমন ম্যাড়মেরে হয়ে গেছে, ভাঁজ করা অংশের কয়েকটা জায়গা ফেটে গেছে। লাল ইজের প্যান্ট, লালফিতে।
আয়েষা লালিত্য মাখান নরম দুটো হাতে যত্ন করে সেই পোষাক টিনের বাক্সটা থেকে খাটে নামিয়ে রাখলো। কাঁপা কাঁপা দীঘল চোখে আমার দিকে তাকাল। হেসেফেললো।
এই পোষাকটা দেখে তোর কিছু মনে পরছে।
আমি মাথা নীচু করে নিলাম।
এই দেখ তোর হাতে তৈরি বকুল বাঁশি।
মুখ তুলে তাকালাম।
আয়েষা হাসছে।
এই দেখ হাসিখুশি, সহজপাঠ, নামতার বই।
দেখলাম পাতাগুলো সব লাল হয়ে দোক্তাপাতার মতো হয়েগেছে।
আয়েষা একে একে বাক্স থেকে সব নামিয়ে খাটে সাজিয়ে রাখছে।
আমি আয়েষার দিকে তাকিয়ে। পরিতৃপ্ত মুখখানা আপন মনে কল কল করে চলেছে।
এই ভাঙা শ্লেটটা দিয়ে তোর পায়ে বারি মেরেছিলাম।
দেখলাম আধভাঙা একটা শ্লেটের টুকরো।
ঈদের আগের দিন পাঠশালায় শেষ গেছিলাম তারপর আর যাই নি। ওইদিন পর্যন্ত এই টুকু অবশিষ্ট ছিল। সেটুকুই সঙ্গে রেখেছি।
আমার চোখের পাতা ঘন ঘন ওঠানামা করছে। আয়েষা যত্ন করে আবার সব ভাঙা টিনের বাক্সে গুছিয়ে রেখে আলমাড়িতে তুলে রাখলো।
জানিষ অনি, আমার ছেলেকে বলেছি, আমি মরে গেলে আমাকে গোর দেওয়ার সময় আমার মাথার তলায় এই টিনের বাক্সটা রেখে দিবি।
তোর ছেলে! কোথায় সে?
তোকে দেখাব।
এখুনি ডাক।
আজ ঈদ একটু ফুর্তি করছে।
ফুর্তি করছে মানে! পড়াশুন করে না।
বাইজী বেশ্যার ছেলে, শিক্ষিত হবে এটা ভাবিস কি করে?
এটা তোর অভিমানের কথা।
দু-দিন পরে এলাকার দাদা হবে, দু-চারটে ডাকাতি, রাহাজানি, তোলা তুলে এলাকার দাদা হয়ে পুলিশের খাতায় নাম লেখাবে….।
আমি আয়েষার দিকে তাকিয়ে। আয়েষা এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরে ফেললো।
চোখ দুটো আবার ছল ছল কর উঠলো।
আমি মরে গেলে আমার ছেলেটাকে একটু দেখিস।
আয়েষা কাকুতি মিনতি করে বলে উঠলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে।
ভেবে নিস ওটা তোর ছেলে, আজ এই শুভ ঈদের দিন আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোকে দিলাম।
এ তুই কি বলছিস!
আমি ভেবেচিনতে বলছি।
তুই আবার ভাব।
আমার ভাবা হয়েগেছে।
এতবড় গুরুদায়িত্ব তুই আমাকে দিলি। আমি কি পালন করতে পারবো?
তুই পারবি। আমি সব খোঁজ খবর নিয়েছি।
তুই ভেবে বল।
তুই কথা দে। না করবি না।
আমি আয়েষার মুখের ওপর আর কোন কথা বলতে পারলাম না। মাথাটা নীচু করে নিলাম।
তোকে একটা কথা দিতে হবে।
কি বল।
তুই যে আমার ছেলেবেলার বন্ধু, আমরা এক স্কুলে পড়তাম, এক গ্রামে থাকতাম, আমরা দু-জন দুজনের যে এতোটা পরিচিত ও যেন ঘুনাক্ষরেও কোন দিন জানতে না পারে।
এটা কি করে সম্ভব!
হওয়াতে হবে।
আমি আয়েষার জেদের কাছে আত্মসমর্পন করলাম।
যদি কখনো সেরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হই।
তখন বলিস।
আয়েষা আমার হাতদুটো ছেড়ে দিল। নীচু হয়ে খাট থেকে ট্রে-টা টেনে নিল। বেশ বুঝতে পারলাম ওর চোখে মুখে অসংলগ্নতার ছাপ স্পষ্ট।
তোর খাবার নিয়ে আসি?
আমি একা খাব না।
ঠিক আছে, তুই যা খাবি তার থেকে একটু তুলে দিস আমি সেটাই খাব।
তা কি করে হয়।
মেয়েছেলের জান কই মাছের মতো। আয়েষা যেমন খাঁটী মুসলমানী, তুই তেমনি খাঁটী বামুন ঘরের ছানা।
আয়েষা চলে গেল।
আমি ঘরে একা। খোলা জানলাটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আট-দশটা বাড়ি পরে একটা মসজিদের চূড়ো দেখা যাচ্ছে। একটু আগে যখন আয়েষা ওর ছেলেকে আমার কাছে রাখার কথা বলছিল, তখন আজানের শব্দ শুনেছিলাম।
আমাদের গ্রামের মসজিদটা মাটির দেওয়াল খড়ের চাল। অনেকটা আমাদের শিব মাড়োর শিবের মন্দিরের মতো। মসজিদের মেঝেত একটা উঁচু ঢিবি। একটা সিল্কের চাদরে মোড়া।
কাকার হাত ধরে ওই তল্লাটে একবারই এসেছিলাম। তখন আমি বেশ ছোটো। আশাপুড়ার স্কুলেই পড়ি। কি একটা সমস্যা হয়েছিল। কাকা তার বিচার করতে এসেছিল। মুসলমান পাড়ার সঙ্গে আমাদের বামুন পাড়ার দূরত্ব চিরকালের।
শৈশবে পাঠশালার ছবিগুলো ঘন ঘন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। প্রায় দিনই আমি একা যেতাম, সধন বাঁকুড়ার বাড়ির কাছে গেলে চিকনাকে দেখতে পেতাম। ও বটগাছের তলায় বসে থাকতো। আমি, চিকনা, বাসু, আয়েষা, অনাদি, দেবা, মৌসুমী, স্বাতী, কনা, সৌমি….। সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
নাঃ তোর দারা দাদাগিরি হবে না।
আয়েষার কন্ঠস্বরে চমকে ফিরে তাকালাম। ততধিক অবাক হলাম ওকে দেখে। ওই মুহূর্তে ওকে অদ্ভূত সুন্দর দেখতে লাগছিল। বিশ্বাসই হচ্ছে না ও আয়েষা, মুসলমানী। পরনে লালপাড় গরদের শাড়ি। একবারে সাধারণ ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ের মতো। কাপরটা আটপৌরে করে পড়েছে। কপালে একটা লাল বিন্দির টিপ। ব্যাশ শুধু ওইটুকুতেই আয়েষা মোহময়ী হয়ে উঠেছে।
আমি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
আয়েষা মুখ টিপে হাসলো।
এতক্ষণ আমি মুসলমানী ছিলাম। স্নান করে ঘাগরাটা ছেড়ে রেখে এটা পরলাম।
আমি বাকরহিত।
যতই হোক তোর মতো বামুন ঘরের একটা পঁটা বামুনকে খেতে দেব। বল ঠিক করেছি কিনা?
কোন কথা বলতে পারছি না।
হাতের আসনটা মাটিতে পাতলো।
তোর আবার পূব-পশ্চিম আছে নাকি?
সেটা কি?
পূব দিকে বসে খেতে নেই। পশ্চিম মুখো করে খেতে হয়।
তুই কি করে জানলি!
পালের ঘরে একবার অষ্টমপ্রহরে হরিসংকীর্তন হয়েছিল, তোর ঘরের ঠাকুর আসছিল। প্রসাদ খাইতে গেছলি। ওরা মাহেশ্ব, অতসতো নিয়ম কানুন জানবে কি করে? টিকিধারী ব্রাহ্মণ গুলোর সে কি তর্জন গর্জন। সেউঠি দেখছি।
হাসলাম। তুই কিন্তু মঝে মাঝে গাঁইয়া ভাষা ঝাড়ছিস।
তুইও বল না, কে বারন করেছে?
না আমার সেরকম কোন বাতিক নেই। বিদেশ বিভুঁইয়ে নিয়ম নাস্তি। মনাকাকা মারা গেছেন। আমার পালিত পিতা। তাঁর কোন শ্রাদ্ধ শান্তি করতে পারি নি। যেদিন পারবো করবো। যতদিন না পারি তাঁর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানানর জন্য এই বেশ ধারণ করেছি। সব সময় সব কিছু পালন করতে পারি না।
ঠিক আছে বোস। খেতে খেতে শুনবো।
তোর আসন কোথায়?
আমি মাটিতে বসে পরবো।
তাহলে আমিও মাটিতে বসি।
না।
কেন!
তুই পুরুষ মানুষ, মেয়ে মানুষের মনের কথা বুঝবি না।
ঠিক আছে যা, নিয়ে আয়, বসছি।
আমার সব গোছান হয়ে গেছে, যাব আর আসব।
তোকে একটু সাহায্য করি।
কিচ্ছু করতে হবে না।
আয়েষা বেরিয়ে গেল।
আসাতক ওই ঘরটার বাইরে আমি একপাও কোথাও যাই নি। আয়েষা আমাকে ওই ঘরে বন্দী করে রেখেছে। কেন? কিসের তাগিদে? একবারও জানতে ইচ্ছে করছে না। মনের মধ্যে কোন প্রশ্নেরও উদয় হচ্ছে না। বার বার আয়েষার সেই সময়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
অনি আমাকে দেখতে ভাললাগছে। আমি তখন পেটুক চূড়ামনি। মন দিয়ে খেয়ে চলেছি।
বোকার মতো নিজের মনে নিজে হাসি।
তুই ওখানে দাঁইড়ে কি করুঠু রে। কদবার কইছি সেউঠি বকুল গাছ নাই।
আমি ওর দিকে ফিরে তাকালাম। হাসির রেশ তখন আমার ঠোঁটে মাখামাখি।
ওই দেখ, আবার বোকার মতো হাসে।
তুই আজকে বললি না।
আয়েষা কাঁসার থালার ওপর সব গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। মাটিতে রাখতে রাখতে বললো।
কি?
অনি আমাকে দেখতে ভাললাগছে?
আয়েষা হাসলো। এই হাসির মধ্যে বেদনা লুকিয়ে আছে।
সে বয়সটা আর ফিরে আসবে না। আয় বেলা হয়েছে।
তোর লোকজন কেউ আসবে না?
তোর সঙ্গে একা থাকবো বলে সকলকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি।
আমি ধীর পায়ে এসে আসনে বসলাম।
(আবার আগামীকাল)