২১৮ নং কিস্তি
দেবা কটা খুন করেছে, কটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছে, বাজার থেকে কতোটাকা তোলা তুলেছে, অন্যান্য দাদাদের সঙ্গে কতবার টক্কর নিয়েছে, তাতে ওর পাওয়ার বেড়েছে না কমেছে। কতবরা জিতেছে, কতবার হেরেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তনু হেসে ফেললো।
হ্যাঁগো তনু, না হলে তুমি তার পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করবে কেন?
তোমার টাকা তো ঘরে পড়ে নেই, বাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তুমি যেমন দেবে তেমন তুলেও নেবে। না হলে তোমার চলবে কি করে?
সত্যি তুই না। মিত্রা বললো।
বিশ্বাস কর।
কি বিশ্বাস করবো, এরকম হয় নাকি?
তাহলে আমি গল্প বলছি।
ঠিক আছে বল।
অনাদির সঙ্গে দেবার রিলেশন আমার কানে এসেছিল। চিকনা বলেছিল।
দেবা তখন কমবেশি নাম করেছে। অনাদিরও তখন প্রচুর প্রপার্টি। রক্ষা করতে হবে। দেবার সঙ্গে সাঁটগাট বাঁধল।
কিন্তু দেবা প্রথম সারির দাদা হতে পারছিল না যেহেতু ওর পেছনে একটা সলিড হাত ছিল না। বাজারে ঠিক ঠাক নামও করতে পারছিল না।
দেবা ভিখারাম সাঁট-গাঁট হলো।
আমিও সূত্রটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনাদি যে দেবার সঙ্গে একটা আণ্ডারস্ট্যান্ডিং-এ আসতে পারে এটা কখনও কল্পনা করতে পারিনি। বলেতে পারিস দেবাকে ভিখারামের কাছে ভেরানো আমার একটা টোপ ছিল।
বিনদকে একদিন হাল্কা করে বলেছিলাম, তুই শুধু দেবাকে চোখে চোখে রাখ আর ধীরে ধীরে ভিখারামের কাছ থেকে সরে আয়। এখন একবারে ঝামেলা করবি না। সুদে আসলে সমস্ত টাকা আমি তুলে নেব।
আমি দেবাকে চিনি, বিনদকে চিনি এটা ভিখারাম জানতো না। লাস্ট পাঁচ বছর ভিখারামের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে গোটা পাঁচবার, বাকিটা ফোনে ফোনে। তাও যখন ঠেকায় পড়েছে।
আমি কিন্তু ওকে বুঝতে দিই নি। ওকে সাহায্য করেছি। অনেকবার না হওয়া কাজ বার করে দিয়েছি। ও স্থির বিশ্বাস করে নিয়েছে প্রেমানন্দ সত্যি সাধু সন্ত মানুষ।
কিন্তু শেষের দিকে সম্পর্কটা একবারে তলানিতে ঠেকেছিল। আমিও কিছুটা মান-অভিমানের অভিনয় করে গেলাম।
একচ্যুয়েলি অনিন্দ ব্যানার্জী নামটা আমার খুব কাজে লেগেছে। আর সাধুবাবা প্রমানন্দ।
দেখ আমি কোন ভরং করি নি।
দুজনেই তাকিয়ে আছে।
আলতাফ-অর্জুন, বিনদের এ্যান্টি। আফতাবভাই বলেই দিয়েছে অর্জুনকে, বিনদকে দেখলেই মেরে দিবি। ওরাও তক্কে তক্কে আছে।
আমি খবর পাই। বিনদকে বলি একটু সাবধানে থাক।
একদিন বসে ওদের বোঝালাম। বিনদ কি তোদের কোন ক্ষতি করেছে। তাছাড়া ও একটা ভুল করে ফেলেছে। তাই তোদের দল থেকে ছিটকে গেছে।
যেদিন ও তোদের ক্ষতি করবে সেদিন ওকে সরাবার চিনতাভাবনা করবি। তার আগে নয়।
ওরাও যুক্তি খাঁড়া করলো, আমিও যুক্তি দিয়ে ওদের বোঝালাম।
ওরা ভেবে দেখলো অনিদা কথাটা খারাপ বলে নি।
এদিকে দেবা চর চর করে ওপরে উঠতে শুরু করলো।
ভিখারাম আমাকে আর বেশি পোঁছে না। সব খবর পাই। ও নাকি এখন টপ টপ দাদার ছত্র ছায়ায় রয়েছে। অর্জুন, অভিমন্যুর কেশ ঘটিয়ে দিয়েছে দেবা।
কথায় কথায় একদিন বিনদকে বললাম। ভিখারামের সঙ্গে অনেক দিন থেকেছিস। ব্যবসাপত্তরও ভাল বুঝেছিস। বসে থেকে লাভ কি, সামনে একজনকে খাঁড়া করিয়ে পেছনে তুই ব্যবসা শুরু কর। বাকিটা আমি বুঝবো।
ব্যাটা বলে টাকা দাও।
অগত্যা দিদির কাছে হাত পাতলাম। দিদি দাদার পকেট কেটে আমাকে দিল। আমি বিনদকে দিলাম।
বিনদ ব্যবসা শুরু করলো, বললাম, ভিখারামের থেকে চোখ সরাস নি।
এদিকে অর্জুন, অভিমন্যুরা তক্কে তক্কে রয়েছে যে ভাবেই হোক দেবাকে সরিয়ে দেবে। আমি পরলাম মহা ফেঁসাদে। আমার কি তাহলে তীরে এসে তরী ডুববে। বাধ্যে হয়ে একদিন বিনদের মাধ্যমে দেবাকে তুলে নিয়ে এসে ভালপাহাড়ে জমা করে দিলাম। কাকপক্ষীও টের পেল না। পরে যখন অর্জুনরা জানতে পারলো। আমার ওপর চোটপাট করলো, দেখলে তো তোমার পেয়ারের বিনোদ কি করলো। ওদের তো আর ভেতরের ব্যাপারটা বোঝাতে পারি না। বাবা বাছা করে বোঝালাম।
খবর চাপা থাকে না। ভিখারামের কাছে খবরটা পৌঁছে যেতেও সময় লাগলো না। এই প্রথম ভিখারামকে বুঝিয়ে দিলাম আমার দমটা তোমার থেকে বেশি।
তখনো টোডি কেশ হয় নি ?
না। এই সময়টা টোডি, ভিখা, দেবা, অনাদি বেশ ভাল জুটি বেঁধে ছিল।
তার পরপরই টোডিকে ওরালাম। তখন ভিখারাম আঁচ করে ফেলেছে, তৃতীয় ধাক্কাটা আমি ওকে দেব। বাঁচার তাগিদে ও তখন দিশেহারা।
এই প্রথম ও একটু ধস খেল। বুঝেগেল প্রেমানন্দ অনেক কিছু করতে পারে।
আমি নিশ্চিত ছিলাম এবার ও নড়ে চরে বসবে। না হলে ওর বাঁচা দুষ্কর।
আমার সঙ্গে তিন-চারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলো। পাত্তা দিলাম না।
এবার ওর তাঁবেদার মন্ত্রীদের কাছে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলো।
আমার কাছে সব খবর আসছে।
আমি দেশে ফিরলাম।
দিল্লীতে ওকে ডেকে পাঠালাম। এল না।
কানা ঘুষো খবর পেলাম মন্ত্রীরা ব্যাপারটা তলিয়ে দেখে বুঝে গেছে লতায় পাতায় খেলাটা অন্য জায়গায়। পরি কি মরি করে যে যার নিজের ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
ভিখারামকে থাবাড়ি দিয়েছে। দেখছি দাঁড়ান।
কিছুদিন পর ভিখারাম বুঝেছে তলার লেভেল দিয়ে ও কাজ গোছাতে পারবে না।
এবার ও আরও একটু ওপর তলায় গেল। সেখানে রাঘবনকে পেয়েছে। রাঘবন সব শুনে চুপচাপ থাকলো। এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ লোক খোঁজ খবর নিয়ে ও খুব তাড়াতাড়ি খেলাটা বুঝে গেল।
ভিখারামকে সামনে রেখে, ভেতরে ভেতরে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ঘুঁটি সাজাল। ওর প্রমোসন এই মওকায় বাগিয়ে নিতে হবে। রাঘবনের এ্যান্টি সন্মুগম ভিখারামকে কাজে লাগাল।
একদিন কথায় কথায় ব্যাপারটা রাঘবন বললো।
বললাম, একটু সময় দাও।
কলকাতায় এলাম।
কয়েক দিনের মধ্যে আমি ঘুসি খেলাম। তিন মাস নার্সিংহোম।
মিত্রা তনু দুজনেই ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে।
তখন সন্মুগম ভিখারামের সিঁড়িতে উঠে পড়েছে। রাঘবন বাঁচার তাগিদে আমার দিকে ঠিক মতো নজর দিতে পারে নি।
যখন নজর দিয়েছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আফতাবভাই-এর চাপ, আমার আরও যারা পরিচিত ব্যবসায়ী ছিল তাদের চাপ রাঘবন রাখতে পারলো না। বললো, তোমরা যা পারো করো। করার পর আমাকে জানাও আমি সামলাব।
ব্যাশ অর্জুন গেম খেলে দিল।
আমি সুস্থ হলাম।
দেশ বিদেশের আমার পরিচিত ব্যবসায়ী যারা ভিখারামের থ্রু দিয়ে ব্যবসা করে। তাদের কানে হাল্কা করে সমস্ত ব্যাপারটা আগেই চলে গেছে। সুস্থ হওয়ার পর ওদের মেলে সব জানালাম।
তারা ভিখারামের থেকে আমাকে বেশি ট্রাস্ট করে। ভিখারামের কীর্তীকলাপ শুনে খেপচুয়াস হয়ে গেল। ব্যবসায়িক লেন-দেন প্রায় যায় যায়।
সবাই ভিখারামের থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে বিনদের কাছে চলে গেল। বিনদ সত্তরভাগ ব্যবসা পায় বাকি তিরিশভাগ ভিখারাম।
ভিখারাম উপায় অন্তর না দেখে আবার বিনদকে ধরলো।
ততদিনে বিনদ বকলমায় ব্যবসা জমিয়ে নিয়েছে।
ভিখারাম প্রথমে বিনদকে বললো, তুমি ওকে সরিয়ে দাও।
মানে! মিত্রা বললো।
যাকে সামনে রেখে বিনদ ব্যবসা করছিল।
বিনদ পরলো ফ্যাসাদে। আমাকে বললো, দাদা কি করবো।
আমি বললাম কিছুদিন ল্যাজে খেলা। আমি আর একটা স্কিম করছি।
এরপর আফতাবভাই এলো। বিনদকে বললাম তুই ভিখারামের হয়ে খেল।
ও খেলতে শুরু করলো।
অনাদি, সাগর ভিখারামের থ্রুদিয়ে বেশ কিছু টাকা বাইরে পাঠাল। সে খবর পেলাম। বিনদ তার কাগজপত্তর আমাকে পাঠিয়ে দিল।
রাঘবনের কানে সমস্ত খবর যাচ্ছে। ও স্পিকটি নট।
তারপরেই অনাদি ভিখারমকে খবর পাঠাল যে ভাবেই হোক আফতাবকে আটকাতে হবে। না হলে আমাদের ব্যবসা চৌপাট। তখন এদের থ্রু-দিয়ে ভিখারামও অনেক টাকা ঢেলে ফেলেছে।
অনাদি-সাগর বার বার ভিখারামকে পোক করতে শুরু করলো, অনিকে যে ভেতরের নিউজ দিয়েছে সেই দুটোকে তুলে নিয়ে গুম করো।
আমি নিজেই অনাদিকে বকলমায় টিপ পাঠালাম। মাল দুটো এখানে আছে। এবং টোটাল ব্যাপারটা বকলমায় অপারেট করছে আপনার বন্ধু অনি ব্যানার্জী।
অনাদি ভিখারামকে খবর পাঠাল যে ভাবে হোক অনিকে আটকাতে হবে।
ভিখারাম ততদিনে জেনে ফেলেছে অনি-প্রেমানন্দ এক ব্যক্তি।
ভিখারাম এই কাজটা বিনদকে দিল। আমার ব্যাপারটা গোপন রেখে। বিনদ ব্যাপারটা আগে থেকে জেনে ফেললে ভিখারামকে ল্যাজে খেলাত।
এদিকে অনাদি বুঝতে পেরেছিল আমি যদি খবর পেয়ে যাই তাহলে ব্যাপারটা আটকে দেব।
ও ভিখারামকে অনুজের ব্যাপারটা বলে কিছু টাকা খিঁচে নিল, অনুজকে টাকা খাইয়ে আমাকে অন্যমনস্ক করে তোলার চেষ্টা করলো।
সত্যি সত্যি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম।
এই ফাঁকে চিকনার ঘটনাটা ঘটিয়ে আমাকে একটা ধাক্কা দিতে চাইল।
আমার কাছে খবর পৌঁছল দেরিতে।
বিনদ কাজটা নিয়ে নিল। তবু ওকে খবর পাঠালাম। ঠিক সময়ে ওর কাছে পৌঁছল না।
বাধ্য হয়ে ভিকিকে বললাম তুই কিছুটা সামাল দে, বাকিটা আমি বুঝছি।
ভিকি মহানন্দে বিনদের সঙ্গে ভিরে গিয়ে কাজটা করলো।
একদিকে আফতাবভাই, আর একদিকে অনাদি-সাগর-অনুজ। মাথাটা চিবিয়ে দিল।
বাধ্য হয়ে অর্কর হাতে সমস্ত কাগজপত্র তুলে দিয়ে বললাম, তুই সিগগির বম্বে যা। ভিখারামের সঙ্গে দেখা কর। যেভাবেই হোক ওর কানে তুলে দে এই রকম একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে। এই তার কাগজ পত্র।
নিজেকে সাংবাদিক হিসাবেই পরিচয় দিবি। বাকিটা তোকে গুছিয়ে বলে দিতে হবে না। শুধু তোকে যদি বিনদের ভয় দেখিয়ে চমকায়, তুই আলতাফ, অর্জুনের কথা বলবি।
অর্কর কাগজটা দেখে ভিখারামের চক্ষু চড়কগাছ। মাল ছাপা হলে শুধু ভিখারাম নয় অনেক মন্ত্রী সন্ত্রীর বারোটা বেজে যাবে। সেন্ট্রাল পর্যন্ত কেঁপে যাবার উপক্রম।
তখন ওখানে হৈ হৈ পরে গেছে। রাঘবন আপার হ্যান্ড নিল।
আমি অর্ককে যা যা বলেছি সব মিলে গেছে। ও ডাইরেক্ট ওখানে বসেই অর্জুনের সঙ্গে কি কথা হয়েছে ভিখারমকে শুনিয়ে দিল।
ভিখারাম বুঝে গেল ও ফাঁদে পরে গেছে। এ ফাঁদ থেকে বেরবার উপায় নেই।
তখন বিনদ চুলোয় যাক। আগে ওকে বাঁচতে হবে। অর্কর সঙ্গে নিগোসিয়েসনে বসেছে। অর্ক আমার ডিমান্ড ভিখারমকে জানিয়েছে। সেদিন ভিখারাম বুঝে গেল অনি কতটা বিপদ জনক।
যখন ভিখারাম সরল সত্যটা বুঝলো, ততক্ষণে ওর হাত থেকে গেম বেরিয়ে গেছে। এদিকে অর্জুন তেরে বিনদকে গালাগাল করেছে। বিনদ সেই ঝারটা ভিখাকে দিয়েছে।
দুপুরের ফ্লাইটে অর্ক ফিরে এলো।
ভিখারাম আগুপিছু চিনতাভাবনা করে দেখলো একমাত্র রাঘবনই অনিকে সামলাতে পারে। বাধ্যহয়ে ভিখা রাঘবনকে ফোন করেছে। রাঘবন বলেছে আমি কেশটা সাল্টাতে পারি। তুমি আগে আমার ব্যবস্থা করো। ডিমান্ড সাঁসালো পোস্ট। একবারে টপ লেভেল।
এদিকে সম্মুগম উপায়ন্তর না দেখে নিজের নাক কেটে যাত্রা ভঙ্গ করতে চাইল। অনিমেষদাদের পার্টিরও বেশ কিছু ওপরতলার নেতা এতে জড়িয়ে পরলো।
তারমানে রাঘবন এরকম একটা ঘটতে পারে আগে থেকে আঁচ করেছিল। মিত্রা বলে উঠলো।
অবশ্যই। এমনি এমনি সরকার ওদের পেছনে মাসে মাসে কোটি কোটি টাকা মুখ দেখতে খরচ করছে।
সেই জন্য হান্ড্রেড পার্সেন্ট থেকে সেভেন্টিন পার্সেন্ট বাদ ? মিত্রা বলে উঠলো।
আমি জোরে হেসে উঠলাম।
ঠিক বাদ না।
ওই টাকাটা রাঘবনের পেছনে খরচ হয়েছে। তনু বললো।
আমি হাসতে হাসতে মাথা দোলাচ্ছি।
সত্যি বুবুন তুই দাবা খেলিস। এখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি তুই যে বার বার বলতিস আমি দাবা খেলি সেটা মিথ্যে নয়।
তাহলে কৃপা ? তনু বলে উঠলো।
সব জানতে হবে ?
বারে, ওইটুকু আর বাকি থাকে কেন।
বাইরের দিকে একবার তাকাও।
ওরা জানলার দিকে মুখ ঘোরাল। মেঘের আড়ালে সূর্যের মুখ উঁকি ঝুঁকি মারছে। সদ্য স্নান সেরে উঠে আসা রমণীর মতো গাছের পাতাগুলো ঝক ঝক করছে।
মিত্রা তনু দুজনেই আমার শরীরে ঢলে পড়েছে।
পাখা চলছে না। তবু হাল্কা ঠান্ডা।
ওদের শরীরের উষ্ণ অনুভূতি আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠলো।
আমি তনুর বুকে হাত রেখে একটু দুষ্টুমি করতেই ও চেঁচিয়ে উঠলো।
দিদি দেখেছো, ও করলে দোষ নয়, আমি করলেই দোষ।
মিত্রা আমাকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে হাসছে।
এবার আমি একটু ঘুমোই।
ঘুমোওনা এমন অন্তর টিপুনি দেব বুঝতে পারবে। তনু বললো।
মাসীমনির কথাটা শুনবি না।
মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।
হ্যাঁ দিদি বলো বলো। তনু মিত্রার দুজনেরি চোখ চক চক করে উঠলো।
তুই তো খেয়ে উঠে চলে গেলি। মাসিমনি খেয়ে উঠে পুকুরঘাটে গেল মুখ ধুতে। সবাই বারন করলো। মাসিমনি কিছুতেই শুনলো না। আমাকে তনুকে বললো তোরা আমার পাশে থাক। তাহলেই হবে।
আমরা ধীরে ধীরে পুকুরঘাটে নামালাম। মাসীমনি নিচের ধাপিতে বসে মুখ ধুলো।
মিত্রা।
বলো।
এটা মনামাস্টারের পুকুর, আর ওট অধীপের পুকুর।
হ্যাঁ।
এখন কি এগুলো আছে, না দান করে দিয়েছে।
বাস্তুভিটে পুকুরদুটো সামনের অংশটুকু বাদে সব দান করে দেওয়া হয়েছে।
নীপা, সুরো, ঊষার তাহলে কি রইলো।
বুবুন সকলের যাতে সারাজীবন খেয়ে পড়ে চলে যায় তার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
সেটা কি—
কেন, রাইস মিল। প্রত্যেকের নামে মাসে মাসে একটা রেমুনারেসন পাঠান হয়। নীপা যেহেতু সরকারী কর্মচারী ওরটা সুরো মাসীকে দেওয়া হয়।
ব্যাঙ্ক।
ওটা আমাদের পরিবারের। তবে দায়িত্বে আছে চিকনা, বাসু।
ফার্ম?
ওটা একটা অন্য ফরমেশনে আছে তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারবো না।
কেন!
ওটা দেবা তোমায় গুছিয়ে বলতে পারবে। তবে আমি ওখানে আছি। দেবা মাঝে মাঝে সাইন করতে বলে করে দিই।
তনুর জন্য কি রেখেছে।
ওটা ও বলতে পারবে।
কিরে তনু—
আমার জন্য তো ও নিজেই আছে। আর আমার কিছু চাই না।
বড়ো জটিল বুঝেছিস, একবারে আমার ঠাকুরদাদার মতো। সেও শুনেছিলাম এইরকম ছিল। গত হওয়ার পর দেখলাম সকলের জন্য তিনি সব কিছু রেখে গেছেন। এমনকি উল্লেখও ছিল পারলে একসঙ্গে থাকবে, না হলে যে যার মতো থেকো।
মিত্রা।
সেরেছে। মিত্রা অস্ফুট শব্দে বলে উঠলো।
তনু হাসছে
বড়োমার সুরেলা কণ্ঠস্বর আবার ভেসে এলো। মিত্রা।
তনু পর পর শব্দগুলো শুনে যা। মিত্রা ফিস ফিসিয়ে উঠলো।
তনু হাসছে।
একবারে সারা দিবি না। কি কি বলে শোন।
তনু।
বড়োমা আবার ডেকে উঠলো।
কি ঘুমরে বাবা তোদের। কতো বেলা হলো, তোদের আর ঘুম ভাঙে না।
নিচের দরজা ধাক্কাবার শব্দ শুনলাম।
বুঁচকি, অনিকা….।
হতচ্ছাড়া। যেমনি বাপ-মা তেমনি তাদের ছেলেমেয়ে। মোষের মতো খালি ভোঁস ভোঁস।
একটু থেমে। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে আবার চেঁচিয়ে উঠলো।
ডাকতে ডাকতে গলার নলি শুকিয়ে গেল বাবুদের ওঠার নামগন্ধ নেই।
মিত্রা-তনু আমার শরীরে মুখ গুঁজে হেসে চলেছে, যাতে শব্দ না হয়।
সারাদিন ধিঙ্গি পনা করলে শরীরে কিছু থাকে।
মিত্রা….ও তনু….।
দাঁড়াও যাচ্ছি। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।
খাট থেকে নেমে দাঁড়াল।
দিদি ম্যাক্সি পরে? তনু বললো।
ছারতো, ওপরে নিয়ে আসি। ছেলের মুখ দেখলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।
গায়ে একটা কিছু চাপিয়ে যাও।
মিত্রা সোফার ওপর থেকে চাদরটা টেনে নিয়ে গায়ে জড়াল।
মিত্রা ঘরের বাইরে পা রাখতেই আমি তনুকে চটকে দিলাম। তনু কিছুটা দাপা দাপি করে নিল।
বড়োমা আসুক বলছি।
আমিও কালকে রাতের ঘটনা বলবো।
তনু হেসে ফেললো।
একটু জলের বোতলটা দাও।
তনু খাট থেকে নামলো।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। নিচ থেকে কথা ভেসে আসছে।
দিদানের চেঁচামিচিতে ছেলেমেয়েরা উঠে পড়েছে।
ঘুম হয়। কি বৃষ্টি। বাপের জম্মে এমন মেঘের গর্জন শুনি নি। আমরাও ছোট সময়ে গ্রামে মানুষ হয়েছি। শহরে ছিলাম না। নীচ থেকে বড়োমার গলা ভেসে আসছে।
মরার মতো ঘুমচ্ছিলাম, সোনা ঠেলে তুললো।
মাটির বাড়ি, ভাবলাম এই বুঝি দেয়ালে জল লেগে গলে গেল। শেষ পর্যন্ত দেয়াল চাপা পরে মরবো নাকি। আমি সোনা জেগে বস থাকলাম।
তোরা কখন উঠেছিস ?
যখন মেঘ ডাকছিল, ঝম ঝম করে বৃষ্টি পরছিল।
বড়োমা ঘরে ঢুকলো। আমি তখন সবে মাত্র বোতলটার ছিপি খুলে গলায় ঢেলেছি।
ও মা সকাল বেলা শুধু জল খেতে আছে নাকি! কালকে যে মিষ্টি দিলাম।
তনু বড়োমার দিকে তাকিয়েছে।
শুধু জল চাইল।
তোদের কবে বুদ্ধিশুদ্ধি হবে বলতো।
তনু মিত্রা চোখা চুখি হলো। আমি না পারছি হাসতে না পারছি গম্ভীর হয়ে থাকতে।
মিত্রা।
বড়োমা পেছন ফিরে তাকাল।
তনু আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করছে।
মিষ্টির বাক্সটা কোথায় ?
নেই।
সব খেয়ে নিয়েছিস!
বুবুন খেয়েছে।
কটা খেয়েছে।
গুনি নি।
সত্যি বাবা তোদের পেট।
রাত জাগলে খিদে পায়। মিত্রা বললো।
কে তোদের রাত জাগতে বলেছে।
ও তো ঠেলে তুললো।
বড়োমা ঘরে দাঁড়িয়েই তারস্বরে চেঁচাল।
বোচন।
তোমায় আর ডাকা ডাকি করতে হবে না। এখানে এসে বোসো। আমি বললাম।
ও বাড়িতে মিষ্টি আছে আনতে পাঠাই।
মুখ ধুই তারপর খাবো।
এখনো দাঁত মাজিস নি!
বা রে, কখন মাজবো। এই তো বিছানা ছেড়ে উঠলাম।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।
তুমি বরং ওই বাড়িতে গিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করো, আমি যাচ্ছি।
তুই চল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
মাজন ব্রাস নিয়ে যা। মিত্রা বললো।
লাগবে না।
তোর ঘুঁটের ছাই সব জলে ভিঁজে গেছে।
নিম ডাল, পেয়ারা ডাল আছে।
দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
মোবাইলটা পকেটে ভরে বড়োমাকে নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। মিত্রা একবার চোরা চাহুনি মেলে আমার দিকে তাকাল।
নিচে নামলাম। পক্কে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দিচ্ছে।
মামা, ঘুমটা সলিড নামালাম।
কথার ছিড়ি দেখ। বড়োমা খিঁচিয়ে উঠলো।
তুমি বুঝবে না দিদান।
আর বুঝে কাজ নেই।
তুমি দরজা না ধাক্কালে দিব্যি আরও ঘণ্টা খানেক মেরে দিতাম।
কেন কালকে মাঠে চাষ করতে গেছলে।
দেখলাম মেয়ে ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি মারলো। দিদানের কথা শুনে মুচকি হাসলো।
মর্নিং বাবা।
মর্নিং।
তুমি ওই পাশ দিয়ে যাও, আমি এই খিড়কি পাশ দিয়ে যাই। বড়োমার দিকে তাকালাম।
কেন!
অতোটা কে ঘুরবে।
মেয়ে হাসছে।
দিদান তুমি বাবার পেছন পেছন যাও নাহলে দেখবে বাবা ফুরুত।
বড়োমা অনিসার কথায় হাসছে।
আমি খিড়কি দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম।
মাটি ভিঁজে কাদা হয়ে গেছে। পুকুরের জল এক রাতের বৃষ্টিতে অনেকটা বেরে গেছে। চারিদিকে ভিঁজে মাটির গন্ধে ম ম করছে। হেলে পরা বাঁশগাছের পাতা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পুকুরের জলে টপ টপ করে ফোঁটা পড়ছে।
মেঘের জল পেয়ে প্রকৃতি মাতাল হয়ে উঠেছে।
দাঁড়িয়ে পরলাম।
কতদিন এ দৃশ্য দেখি নি।
পুকুরের জলে জলের ফোঁটা পরে কত ছবি আঁকা হয়ে যাচ্ছে।
কোন শিল্পীর সাধ্য নেই রং-তুলির মাধ্যমে এই দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে।
বাচিক শিল্পী কথার জাল বুনেও এই ইলুসান তৈরি করতে পারবে না।
শুধু হৃদয়ের অনুভূতি। তোমাকে অনুভব করতে হবে। মনের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে এই নিপুন তুলির রং, রস, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ মিশিয়ে নিতে হবে।
একসময় হাঁ করে এসব দেখতাম বলে কাকা কতো বকুনি দিয়েছে।
পাগল ছেলের কান্ড দেখ। যা ঘরে যা, ঠান্ডা লেগে যাবে।
আমাকে নিয়ে কাকা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতো।
নতুন জল পেয়ে বড়ো বড়ো মাছ ভেসে উঠেছে, তাদের লেজের ঝাপটানিতে জলটা মাঝে মাঝে ভুঁট ভুঁট করে উথালপাতাল হচ্ছে। জলের বুকে ঢেউয়ের অনুরণন।
চিকনাকে বলতে হবে জাল দেওয়ার জন্য।
দাঁড়ালাম না।
নিচে নামতেই পায়ে কাদা লাগলো। আঙুলের ফাঁক দিয়ে পচ পচ শব্দ করে মাটি গোলা কাদায় পায়ের পাতা রাঙিয়ে উঠলো। এই কাদার স্পর্শানুভূতিই আলাদা। পাজামার পায়ের দিকটা সামান্য গুটিয়ে নিলাম। মাথা নীচু করে হেলে পরা বাঁশগাছের তলা দিয়ে এই পুকুরের ধারে এসে দাঁড়ালাম।
এই পুকুরের জলও প্রায় হাত খানেক বেরে গেছে। কালকে যে ধাপিটা চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল, আজ সেটা উধাও। পেয়ারা গাছের সরু ডাল ভেঙে পায়ে পায়ে নদীর ধারে চলে এলাম।
সেই এক দৃশ্য। কাল নদীর বুকে যেটুকু ডাঙা মাথা তুলে টান টান হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়েছিল, আজ তা অদৃশ্য।
কাল এক হাঁটু ছিল। আজ বুক সমান জল। কোথাও কোথাও গলা পর্যন্ত।
ওপাশের ঘাটে দেখলাম সিং-এর ঘরের নৌক বাঁধা আছে।
নৌকা দেখেই মনটা কেমন চন-মন করে উঠলো।
ভরা বর্ষায় আমি ভানু এই নদীর বুকে কত দাপাদাপি করেছি। কত ছবি আঁকা আছে এই নদীর বুকে। হুড়মুড় করে চোখের সামনে সব ছবি ভেসে আসছে।
মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের ঘটনা।
জলবাড়তেই খালে নৌক নেমে পেড়েছে।
ধারে কাছে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। নির্ঘাৎ ভোরের দিকে ওরা মাছ ধরতে বেরিয়েছিল।
পেয়ারা ডালটা চিবোতে চিবোতে নদী গর্ভে নেমে এলাম।
এঁটেল মাটি, জল পেয়ে বেশ পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে।
জলের ধারে এসে চেঁচালাম, ছোটোকাকী।
আমার ডাকে চারদিকে একটা অনুরণনের সৃষ্টি হলো। সামান্য ঝোড়ো হাওয়া এখনো বইছে।
গাছের পাতায় দুলুনি। এক মনমোহনী পরিবেশ।
ছোটোকাকী….একবার, দুবার, তিনবার।
একটা বৌ একহাত ঘোমটা মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
কি হয়েছে গো।
নৌকাটা এপারে নিয়ে এসো।
এখান থেকেই বুঝতে পারলাম বৌটা খিল খিল করে হেসে ঘরে ঢুকে গেল।
আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি।
কিছুক্ষণ পর একটা মঝ বয়সী ছেলে বেরিয়ে এলো। চিনতে পারলাম না।
আমাকে দেখে একবারে নদীর ধারে এগিয়ে এলো।
কি গো অনিদা।
নৌকাটা এ পাশে নিয়ে আয়।
কাই যাবো।
একটু চড়ি।
হেসে ফেললো।
তুমি পারবো নি।
বেশ পারবো, তুই নিয়ে আয় না।
দাঁড়াও যাইঠি।
নৌকায় উঠে বাঁশে ঠেলা মারলো।
তর তর করে নৌকটা এপাশের তীরে এসে ভিড়লো।
মনটা কেমন আনচান করে উঠলো। কতদিন নৌকয় উঠি নি।
নদীর জলে পা ধুয়ে নৌকয় উঠলাম।
বাঁশটা আমায় দে আমি বাই।
তোমার অভ্যাস লাই তুমি পারব নি।
কেন, আমি কি কোনদিন নৌক বাই নি।
সে কতকাল আগে বাইছো।
তোরা এমন করিস, যেন আমি এ গ্রামের ছেলে নয়।
তুমি গ্রাম ছ্যাড়ে শহরে চলিইছ।
তাতে কি হয়েছে।
ও আমার হাতে বাঁশটা দিল। আমি গলুইতে উঠে দাঁড়ালাম।
ওঠি উঠ নি পা হরকিইবে।
ভাগ।
আমি বাঁশটা নিয়ে একটা ঠেলা মারতেই নৌকটা তরতর করে মাঝ নদীতে চলে এলো।
তোর এখন কি কাজ আছে।
বাড়ি তারতে যাব। (কোদাল দিয়ে মাটা কোপাব।)
কি চাষ করবি।
খাঁচি লাগাইব। (মাদুর কাঠির চাষ)
চল তোকে ওপারে নামিয়ে দিয়ে আমি একটু ঘুরে আসি।
কাই যাব।
একটু খ্যাঁড়েগোড়া হয়ে রামপুরা থেকে ঘুরে আসি।
যাবে নি।
কেন।
হা তুমি কাঠপুল পর্যন্ত জল পাব সে পাশে জল লাই।
জল হয় নি?
হছে এপাশে নামিইছে। সে পাশটা উঁচা এউ পাশটা লীচু।
আমরা নদীর এ পারে চলে এলাম। যা তুই নাম, আমি একটু ঘুরে আসি।
তোমাহরে ঘাটে বাঁধি রাখবে, আমি স্নান করতি এসে সাঁতরে এউপাশ নু লিয়ে যাব।
ঠিক আছে।
ছেলেটা লাফিয়ে নামলো, নৌকটা টাল খেল আমিও একটু টাল খেলাম। সত্যি সত্যি আর একটু হলে জলে পরতাম।
আমার অবস্থা দেখে ও হাসলো।
আমি ত্যাখনই কইলি।
তুই ওভাবে লাফিয়ে নামলি কেন, তাই টাল খেল।
কাই মনকার হয় নি।
তোদের হয় না, আমার হয়।
তুমি গলুইয়ে বুইসে বুইসে বাও।
আমি সত্যি সত্যি আর রিক্স নিলাম না। গলুই থেকে নেমে বসে পরলাম। জলের মধ্যে বাঁশ ডুবিয়ে ঠেলা মারতেই নৌক মাঝ নদীতে।
আমি নৌকর মুখটা ঘুরিয়ে কিছুটা এগিয়ে বাঁশটা নৌকর ওপর তুলে চুপচাপ বসে রইলাম।
নৌক তার আপন মনে জলে ভাসছে। বেশ লাগছে।
নদীর দুই পারে হাওয়ার টানে জল ছলাৎ ছলাৎ করে বারি খাচ্ছে।
শব্দটা ভারি সুন্দর।
কাল যেখানে মাছ ধরেছিলাম সেখানটা এখন চেনাই যাচ্ছে না। ঝোড়ো হাওয়ায় নদীর বুকে প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে আলপনা এঁকে চলেছে।
এখানটা প্রায় এক মানুষ জল দাঁড়িয়ে গেছে।
নদীর ধারের বাঁশঝাড় গুলো নদীর বুকে নুয়ে পড়েছে। অনিকারা কাল যেখানে দাঁড়িয়ে মাছ বাছছিল সেই জায়গাটা ডুবে গেছে।
সামন্ত ঘরের আঁখ বাড়ির পায়ের পাতায় জলের স্পর্শ।
লম্বা লম্বা আঁখগাছগুলো লক লক করে হাওয়ায় দুলছে।
হাওয়ার দোলায় পাতায় পাতায় ঘর্ষণ লেগে একটা সড়সড় আওয়াজ।
মনে মাতন লাগে।
নৌক নৌকর মতো ভাসছে আমি চুপ চাপ বসে আছি।
নৌকয় বসেই নদীর জলে মুখ ধুলাম। চোখে মুখে জলের ছিটে দিলাম। পাঞ্জবীতে মুখটা মুছে, মোবাইলটা বার করলাম।
মিত্রাকে ডায়াল করলাম।
তুই কোথায় ?
কেন!
বড়োমা আমার ষষ্ঠী পূজো শুরু করেছে।
তুই কোথায়?
পুকুর ঘাটে।
কি করছিস?
দাঁত মাজছি।
আর কে আছে?
তনু, সুরো, দিদিভাই, বনি, দিদি।
চলে আয়।
কোথায়!
কাঠপুলের কাছে।
কেন ?
নৌকো চরবি ?
দাঁড়া। একটু ধর।
মিত্রা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
এবার বল। ওখানে কথা বলা যায়। সকলে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
তুই এখন কোথায় ?
গাঙ্গুলী ঘরের পেছনে। নৌক চরবি ?
কোথায় পেলি!
সিং-এর ঘরের নৌক, চেয়ে নিলাম।
এখন একা গেলে ধরা পরে যাব।
সবাই চেল আয়, চুপি চুপি।
কোথায় যাব ?
যেখান থেকে নদী পার হই।
ভীষণ কাদা।
পা টিপে টিপে চলে আয়।
তুই কোথায় ?
নদীতে। নৌকয় একা একা বসে আছি।
তাই!
হ্যাঁ।
কোনপাশ দিয়ে গেলে কাদা কম পাব।
গাঙ্গুলী ঘরের পাশ দিয়ে বাঁশ বাগানের ভেতরে চলে আয়। দেখ একটা সরু রাস্তা নদীর ধারে এসেছে। ওটা গাঙ্গুলী ঘরের ঘাট। আমি নৌকটা ওখানে রেখে অপেক্ষা করছি।
পালিয়ে যাবি না।
না না। দেরি করিস না।
আচ্ছা।
ফোনটা পকেটে রেখে নৌক থেকে বাঁশটা তুলে নিলাম। একটু এগিয়ে গাঙ্গুলী ঘরের ঘাটে নৌক ভেরালাম। চারদিক নিস্তব্ধ। নৌকটা টেনে নদীর পাড়ে আটকে রেখে বাঁধের ওপরে উঠে এলাম।
সরু বনপথের দিকে তাকালাম কেউ কোথাও নেই।
একটু কথা বললেও আমি এখান থেকে শুনতে পেতাম।
আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘ উড়ে যাচ্ছে। বাঁশগাছের লম্বা ডগাগুলো হাওয়ায় দুলছে। শরীরে শরীরে ঘষা লেগে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হচ্ছে। ট্যাঁও ট্যাঁও শব্দ হতেই ওপরের দিকে তাকালাম।
সেই জামরুল গাছ। সবুজ রং-এর দুটো টিয়া গাছের পাতায় মিশে গেছে। ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে সোহাগ করছে। একটার পায়ে একটা আধখাওয়া জামরুল।
হেসে ফেললাম। ব্যাটা নিশ্চিন্তে বসে গায়ে গা লাগিয়ে প্রেম করছে।
সোহাগের বহরটা ভারি সুন্দর।
এই ছোটছোট দৃশ্যগুলো কেউ লক্ষ্য করে না। আমি পাগল তাই চোখে পরে যায়।
কালকে তনুদের এই জামরুল গাছের কথাই বলছিলাম।
ওপরের দিকে তাকিয়ে আমার বসে থাকা ডালটা একবার লক্ষ্য করলাম। খুঁজে পেলাম না।
সবুজ পাতার আড়ালে সাদা সাদা জামরুল ফল আমার দিকে তাকিয়ে কুর্নিশ করছে।
যেন বলছে, দেখ কেমন মজা।
শয়তানটা আর রাস্তা পেল না।
হাল্কা শব্দে চমকে উঠে কান পাতলাম।
দিদি নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটবে। একবারে চোখ সরাবে না। মিত্রার গলা।
বুঝলাম কেউ হয়তো সক্কাল সক্কাল প্রাকৃতিক কর্ম সেরে গেছে। মিত্রা দেখে ফেলেছে।
তুমিও আছো মিত্রাদি অনিদা বললো তুমি নেচে উঠলে। মিলির গলা পেলাম।
তারমানে! দলে ওরাও যোগ দিয়েছে।
আমাকে রাম গালাগাল দিতে দিতে ওরা এগিয়ে আসছে।
টিনা। মিলি চেঁচাল।
কথা বলিস না। মস্তি নিবি একটু কষ্ট করবি না। রস খাওয়ার কথা মনে আছে।
এখন গরম কাল।
অনিদাকে বলতে হবে কাল আঁখটা বেশ মিষ্টি ছিল।
হাসির শব্দ।
টিনা তুই আর মাথায় ঢোকাস না। দেখবি আমাদের নৌকয় রেখে আঁখ চুরি করতে গেল। মিত্রা বললো।
তুমি বলো, ছোটোমাও খেয়ে বলেছে, বেশ মিষ্টি।
বাঁকের মুখে প্রথমে মিত্রাকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে হেসে ফেললো।
লম্বা লাইন করে পা টিপে টিপে সবাই এগিয়ে আসছে।
কাছে এসে সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
দিদি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
তোর নৌক কোথায়?
নদীর ঘাটের দিকে ইশারা করলাম।
সুরো-বনির চোখ চক চক করছে।
বৌদি অনিদাকে জাপ্টে ধরে নামতে হবে, না হলে পা পিছলে আলুর দম।
বনির কথায় সবাই হেসে উঠলো।
রাম কাদা। সুরো বলে উঠলো।
শুধু কাদা আর কিছু পেলি না। আমি বললাম।
এ মাগো। মিলি বলে উঠলো।
তনু, এই সেই জামরুল গাছ।
তনু ওপরের দিকে তাকাল। সবাই তাকিয়েছে।
তুমি একা খেলে আমাদের কয়েকটা খাওয়াও। তনু বললো।
তোমাকে সকালে বলছিলাম। মিত্রা দিদির দিকে তাকাল।
দিদির চোখের ভাষা বদলে গেল। আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আবার গল্প! মিলি বলে উঠলো।
জায়গাটা কেমন লাগছে তোমার। দিদির চোখে চোখ রাখলাম।
ওয়ান্ডারফুল। না এলে খুব মিস করতাম।
জামরুল খাবে।
তুই গাছে উঠবি!
বেশি উঁচুতে উঠতে পারবো না। একটু খানি উঠলেই অনেকগুলো পেরে ফেলবো।
দিদি চোখে হাসছে।
আমি পাজামাটা একটু গুটিয়ে একটা ডাল ধরে খানিকটা ওপরে উঠে নিচের দিকে তাকালাম। দেখলাম ওরা বিষ্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নরম ডালটা পা দিয়ে দোলাতে খানিকটা বৃষ্টির ফোঁটার মতো জল ওদের ভিঁজিয়ে দিল সঙ্গে গোটা পনেরো জামরুল খসে পরলো।
নিচে হুটো পুটি লেগে গেছে কে কটা কুরোবে।
বেশ মজা লাগছে। আবার আর একটা ডালে পা দিয়ে খানিকটা দুলিয়ে দিলাম। ঝুপ ঝুপ করে আবার বেশ কয়েকটা খসে পরলো।
ওপর থেকেই চেঁচালাম, আর লাগবে?
শুধু আমরা খাব, ওরা খাবে না। সুরো ওপরের দিকে তাকিয়েছে।
আমি এবার হাতের নাগালে যা পেলাম ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচে ফেলতে আরম্ভ করলাম।
এবার নেমে আয়, জামরুল খেতে গিয়ে নৌক চরা হবে না। মিত্রা নিচ থেকে চেঁচাল।
মন ভরেছে।
হ্যাঁ।
তনু ওপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
সবার মুখ চলছে বুঝলাম শুরু করে দিয়েছে।
আমি ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে নিচে নমে এলাম।
মিত্রা আমার দিকে কুত কুত করে তাকিয়ে।
ঠিক মতো চরতে জানলে হাত পা ভাঙবে না।
একটা জামরুল ইকুয়ালটু হাফ গ্লাস জল। দুটো খেলে ফল খাওয়াও হলো জল খাওয়াও হলো।
তনু হাসছে আর কথা বলছে।
তুমি একটা খাও।
তনু কোঁচর থেকে একটা জামরুল বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিল।
রাখো পরে নিচ্ছি।
বনি, সুরো আমার দিকে তাকিয়ে।
তুমিতো বেশ সুন্দর বাঁদরের মতো তরতর করে গাছে উঠতে পারো। বনি বলে উঠলো।
ওরা হাসছে।
ছবি তুলেছিস।
টিনাদি তুলেছে।
নিয়ে বাঁধিয়ে রাখিস।
বনি এগিয়ে এসে পেটে গোঁতা মারলো।
তোরা কাল কোথায় মাছ ধরেছিলি। দিদি আমার দিকে তাকাল।
ওই জায়গাটা জলে ডুবে গেছে। কাল এক হাঁটু ছিল আজ এক মানুষ জল।
সত্যি!
হ্যাঁ গো। চলো দেখাচ্ছি।
দিদি আমার দিকে তাকিয়ে।
এসো, নামতে পারবে।
পারবো।
আমার হাতটা ধরো।
দিদি হাত বারিয়ে দিল।
বুঝতে পারছি দিদির চোখে মুখে বিষ্ময়ের আঁকি বুকি।
ওখানে যে পরিবেশে থাকে সেখানে এই পরিবেশ চিন্তা করা কল্পনাতীত। আমি দেখে এসেছি ওদের ঠাট বাঁট। জল গড়িয়ে নিজেদের খেতে হয় না। যা চাইবে সব হাতের কাছে।
দিদি আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছে।
ভয় পাবে না।
না। তুই আছিস।
আগে কখনো উঠেছো।
মাথা দোলাল। না।
অনিদা তুমি সবার আগে। পা পিছলোলে তোমার ঘারে সবাই। অদিতি বলে উঠলো।
নির্মাল্য কেশ। মিলি চেঁচিয়ে উঠলো।
দিদি তাকিয়েছে, মিলির দিকে।
মিত্রাদি, দিদিকে তুমি সেই এক্সপিডিসনের গল্পটা বল নি।
মিত্রা মাথা দুলিয়ে হাসছে। না।
কত বলবি।
না বলাই ভাল। তারপর যা হয়েছিল। মিলি বললো।
টিনা, মিলি, অদিতি সবাই জোরে হেসে উঠলো।
মিলি ভুরু নাচিয়ে দিদির দিকে তাকিয়ে বললো, রাস্তায় দেখে এলে, ওই কেশ।
দিদি হেসে ফেললো।
নৌকর কাছে এসে বললাম, তোরা একে একে উঠে ওপাশে চলে যা।
কি করে উঠবো। মিত্রা বললো।
যেমন ভাবে ওঠে।
তুই ধরে তুলে দে।
কোলে কোলে।
হলে ভাল ভয়।
ফাঁক তালে সবার কোলে চরা হয়ে যাবে কি বলো মিত্রাদি। মিলি বলছে আর হাসছে।
আমি নৌককে শক্ত করে ধরলাম। এলোমেলো বাতাস বইছে। একে একে সবাই নৌকতে উঠলো। তনু আমার কাছে দাঁড়িয়ে।
কি হলো ভেতরে গিয়ে বসো।
না বাবা ডুবলে তোমাকে জাপ্টে ধরবো।
মিত্রাদির কি হবে।
ও সাঁতার জানে।
তুমি।
জানতাম। ভুলে গেছি। এখন সাঁতরাতে গেলে জল খেয়ে পেট ভরে যাবে।
ডুববে না। কম জল।
নৌকর ও প্রান্তের গলুইয়ে মিলি, বনি, সুরো, ইসি। মাঝে অদিতি, টিনা। আমার কাছাকাছি মিত্রা, দিদি, তনু।
নৌকটা পার থেকে একটু ঠেলা মারতেই দুলে উঠলো। ওরা সবাই তারস্বরে হৈ হৈ করে চেঁচিয়ে উঠলো।
(আবার আগামীকাল)