এককালে পৌষপার্বণে পিঠেপুলি বানানোর জন্য চালের গুঁড়ি তৈরির কাজে ঢেঁকির বিকল্প কিছু ছিল না। গ্রামীণ জনজীবনের নিত্যনৈমিত্তিক গৃহস্থলীতে ঢেঁকির ভূমিকা অনস্বীকার্য। বঙ্গের লোকায়ত জীবনচর্চায় অনুষঙ্গ হিসেবে ঢেঁকির কৌলিন্য ছিলো পারিবারিক মর্যাদা, বৈভব ও আভিজাত্যের এক নির্ভরশীল বিজ্ঞাপন। আবার কৃষিভিত্তিক সভ্যতা কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বাহক ঢেঁকি ছিলো ভারতের ঐতিহ্যের অহংকার। তাই নবান্নে মাতোয়ারা প্রায় প্রতিটি বাড়িতে থেকেই ভেসে আসতো ছন্দময় ধ্বনিমাধুর্য ভাটিয়ালি সুরের গান…. ‘ও ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া/ ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া…’
এইভাবেই আবেগ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে রয়েছে ঢেঁকির অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ঢেঁকির ধাপুর-ধুপুর শব্দে মুখরিত হত গোটা পাড়া। তবে ডাকাতেরা ‘ঢেঁকি’ দিয়ে দরজা ভেঙে ডাকাতি করতো এমন গল্পও বহু শোনা যায়।
সপ্তর্ষিমণ্ডলের তপস্বী ব্রহ্মার মানসপুত্র ও নারায়ণের একনিষ্ঠ ভক্ত, ত্রিকালজ্ঞ, সুকণ্ঠক, বীণাবাদক, বেদজ্ঞ নারদমুনি ত্রিভুবন পরিক্রমা করতেন এই ঢেঁকিতে চড়েই। অসংখ্য দেবদেবীর আস্থাভাজক ও কৃপাধন্য তিনি। তথাপি তিনি কলহ সংঘটক হিসেবেও সর্বজনবিদিত এবং সেই দুর্নাম যুগপরম্পরায় চলে আসছে। তিনি বহুবার দেবতা ও অসুরদের মনে সন্দেহের বীজ বপণ করে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিলেন। তাই নারদকে দেখে সবাই যেমন ভক্তিও করতেন তেমনি ভয়ও পেতেন। তিনি তাঁর বাহন ঢেঁকিতে চড়েই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতেন বা পৌঁছে দিতেন। হয়তো সেই থেকেই ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’ এই প্রবাদটির উদ্ভব হয়েছে।
নারদ নামটির সাথে ‘ঢেঁকির একটি সূক্ষ্ম সম্পর্ক আছে। নারদ সর্বদা জলতর্পণ করতেন পুজো সারতেন বলে তার নাম নারদ। জলের সঙ্গে কৃষির এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন আছে। কৃষি এবং ঢেঁকি একে অপরের পরিপূরক। হয়তো তাই নারদের বাহন ঢেঁকি। যদিও পৌরাণিক অভিধান লিখছে নারদের বাহন ঢেঁকি আসলে একটি প্রবাদ মাত্র, শাস্ত্রে এর কোন ব্যাখ্যা নেই।
গ্রামীণ জনজীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘর গৃহস্থলীতে ঢেঁকির ভূমিকা অপরিহার্য। ঢেঁকি ছাঁটা চাল যেমন সুবাসিত, তেমনই যথেষ্ট খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ। ঢেঁকিতে ধান ছাড়াও বিভিন্ন শস্য, চাল, গম, মসলা গুঁড়া করা হতো। ঢেঁকি পরিবেশবান্ধবও।পুরান সাহিত্যে বা সঙ্গীতেও যথেষ্ট মান্নতা পেয়েছে ঢেঁকি। শিবায়ন’এ উল্লেখ আছে… ‘নারদের ঢেঁকি লয়ে ধান ভানে ভুতে।’ বঙ্কিম সাহিত্যে রয়েছে, ‘আমি শ্রী কমলাকান্ত ঢেঁকি… স্বর্গে ধান ভানি।’ প্রবাদে সাধারণত মন্দভাগ্যের পরিবর্তন হয় না এমন মানুষের অর্থ প্রকাশে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়। স্থান কালভেদে কর্মদক্ষতার দিকটাও ইঙ্গিত করা যেতে পারে। আবার বোকা মানুষকে “বুদ্ধির ঢেঁকি”, অকাজের লোককে “আমড়া কাঠের ঢেঁকি”, কিংবা কূটকচালি-বিবাদ বিতর্কে আলোচনাকারীকে ‘নারদের ঢেঁকি’ হিসেবেও আমরা চিহ্নিত করি। কোন বিষয়ে প্রতি ইচ্ছাবিরুদ্ধ কষ্টসাধ্য সমর্থনও স্বীকৃতিকে বলা হয় ‘ঢেঁকি গেলা।’
ঢেঁকি অবতার বলতে নির্বোধ ও অলস ব্যক্তি বোঝায়। ঢেঁকি শব্দটির বৈচিত্র্যময় প্রয়োগ দেখা যায়। যে সমস্ত অনার্য দেশী শব্দ পরিবর্তিত হয়ে বাংলা এসেছে তার মধ্যে ঢেঁকি শব্দটি অন্যতম। আদিতে অস্টিক বংশের ভাষা থেকে এর উদ্ভব। কুমিরের মতো সরীসৃপের অনুকরণে বস্তুটি মহুয়া, কুল, শাল, বাবলা, জাম, কাঁঠাল, গাব গাছের কাঠ দিয়ে নির্মিত হয়। লম্বায় তিন-চার ফুট ও চওড়ায় এক ফুট মোটা ভারী দীর্ঘ কাঠের টুকরো মাটিতে তৈরি করা একটি গর্তের সোজাসুজি লাগানো হয়। আগায় একটি লোহার বেড় পরানো অংশকে বলে ‘মুষল’, আর মাটিতে তৈরি চার পাঁচ ইঞ্চির গর্তটিকে বলে ‘গড়’বা নোট। জমির সঙ্গে আনুভূমিক স্থাপন করা ঢেঁকির লেজের অংশে পায় করে চাপ দেওয়া হয়, ফলে মুষল ক্রমাগত ওঠানামা করে। ঢেঁকির লেজের অংশে পায় করে একজন চাপ দেয়, অন্যজন ওঠানামার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে গড়ের মধ্যে শস্য ফেলে। ঢেঁকি যেখানে থাকে সেখানটিকে বলা হয় ঢেঁকিশাল।
গ্রামে বিয়েতে ‘ঢেঁকি মঙ্গলা’ নামে পুজো করা হয়। ঢেঁকিতে হলুদ-জিরে-ধনে-তেজপাতা-লঙ্কা কুটনোর গন্ধে বাতাস ম-ম জানান দেয় অনুষ্ঠানের। রাঢ়বঙ্গে ‘পিঠে পরব’-এ, দুর্গাপুজোয় ‘গুড় পিঠে’ তৈরিতে বা ঢেঁকি ছাটা চালের নাড়ুতেই পূজিত হন দেবী আজও। হাটখোলার বিখ্যাত দত্ত পরিবারে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের বিশেষ তিথি নক্ষত্রে ঢেঁকি পূজার বৃত্তান্ত সম্পর্কে অনেকেই জানেন।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেন ঢেঁকি ছাটা এক কাপ চালে ১১০ ক্যালরি শক্তি মেলে যেখানে সম পরিমাণ চালকলের চালে থাকে ৮০ থেকে ১০০ ক্যালরি। এতে ভিটামিন ও অন্যান্য খাদ্যগুণের পরিমাণও রয়েছে বেশি। বড় বিপনিতে ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে এই চাল পাওয়া যায়। তবে চাহিদা সীমিত। কোন এককালে জমিদার বা সমর্থ বিত্তবানেরা বাড়ির রাস উৎসব, দুর্গোৎসব, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, দোল বা কোনও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে ঢেঁকিছাটা চালের ভাত খাওয়াতেন। আগে থেকেই তার ব্যবস্থা করা হতো। এর জন্য কাউকে ‘ভাচা’ (বরাত) দিতেন। এখনও এই ব্যবস্থা চালু আছে শুধু পার্থক্য এইটুকুই ঢেঁকিছাটা চালের জায়গায় ব্যবহার হচ্ছে মিলের চাল।
কালের বিবর্তন ও আধুনিক শিল্প সভ্যতা ঢেঁকিকে ব্রাত্য করে তুলেছে। এই প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠর ঢেঁকি সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই, শুধুমাত্র অতীত ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে বর্তমানে তার স্বীকৃতি। এমনকি প্রান্তিক জীবনচর্চায় যন্ত্র সভ্যতার প্রচুর প্রভাব পড়েছে। ঢেঁকিশাল আজ রূপান্তরিত হয়েছে মডিউলার কিচেনে।
তবু আজও অনেকেই ঢেঁকিছাঁটা মশলা, চালের খোঁজ নেন। লোকায়ত সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে ঢেঁকির কৌলিন্য বজায় থাকুক বংশ পরম্পরায়।