ভারত জিআই নিয়ে নেওয়াতে বিবি’দি ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি সে দেশের আমলা-অফিসারদের অপদার্থতার প্রশ্ন তুলেও তো অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তার পশ্চাতে কারণটা কি এই নয় যে কোনওদিনই তাঁর দেশের কর্তারা এই শিল্পটির প্রতি মোটেই নজর দেননি! অপ্রিয় হলেও একথাটি সত্যি যে, টাঙ্গাইল শিল্পটা ছিল হিন্দু বসাক তাঁতিদের একচেটিয়া জীবিকা— মুসলিম সম্প্রাদায় বা অন্য পেশার মানুষ তখন এই তাঁত-পেশাকে হীন নজরে দেখত, তাঁতিদের শান্ত স্বভাবকে দুর্বলতা ভেবে সুযোগ পেলে হেয় করতে দ্বিধা করত না অনেকেই। ছোটোবেলায় স্কুলের সহপাঠীদের কাছে, গাঁয়ে-ঘরে অন্য সম্প্রদায়ের কাছে হামেসাই ‘শালা তাঁতির পোলা’ বলে গালি খাওয়া আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমি নিতান্ত শিশুবেলায় ও-দেশ থেকে আসিনি, এসেছি অনেক বড়োবেলায়। একটি নির্দিষ্ট দরিদ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা ও পেশাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, তলে তলে তাঁদেরকে দেশছাড়া করে টাঙ্গাইল শিল্পকে ও-দেশে নিশ্চিহ্ন করার গোপন প্রয়াস পরিণত বয়সে নিজ চোখে যা দেখে-বুঝে এসেছি, তা ভুলি কী করে! শীতলপাটি ও আরও কিছু শিল্পের জিআই বাংলাদেশ অনেক আগেই নিয়েছে। তখন কেন টাঙ্গাইল শাড়ির কথা মনে পড়েনি? শিল্পগুণে তা শীতলপাটি থেকে এতই নিচে ছিল যদি, তাকেই আজ কেন তারা বিশ্ববিখ্যাত বলে সুরের কীর্তন শুরু করেছেন? এতদিনে চৈতন্য পেয়ে জিআই তকমা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ আজ যতই চেল্লাচেল্লি করুক, টাঙ্গাইলকে বিশ্ববিখ্যাত করার প্রয়াসে তাদের কানাকড়ি অবদান আছে কি? টাঙ্গাইল শিল্পকে বিশ্বময় আদরণীয় করেছে ও-বঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা এ-বঙ্গের ফুলিয়া, ভাতজাংলা, সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রামের পরম্পরাগতভাবে শিক্ষিত দক্ষ তাঁতশিল্পীরাই। অন্য কেউ এই দাবি করলে তা হবে নেহাৎ গায়ের জোর দেখানো।
দেশভাগের পরে যে সব বসাক তাঁতিরা উদ্বাস্তু হয়ে এ-দেশে এসেছেন, তাঁরা এ-বঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়িকে জনপ্রিয় করার জন্য, অন্যান্য শাড়ির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এর ভোল-বানা, ডিজাইন প্যাটার্ণে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন টাঙ্গাইল শাড়ির পারম্পরিক বয়নকৌশলকে সম্পূর্ণভাবে বজায় রেখেই এবং এটি ঘটেছে নদিয়া ও পূর্ব বর্ধমানের উদ্বাস্তু তাঁতিদের ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। এই কাজে ফুলিয়া টাঙ্গাইল তন্তুজীবী সমবায় সমিতিগুলির অবদান অনস্বীকার্য এবং সর্বোপরি ভারতের বাজারে টাঙ্গাইল শাড়িকে জনপ্রিয় করার মূল কারিগরই হচ্ছে এই সমবায় সমিতিগুলি। পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সারা ভারতে সেই বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম বোর্ডের একদল সদস্য ১৯৮২ সালে ফুলিয়ায় এসে টাঙ্গাইল বসাক তন্তুবায় সমবায় তথা টাঙ্গাইল শাড়ি দেখে জানিয়েছিলেন, “দেশের ঐতিহ্য বজার রেখে আজ ফুলিয়া টাঙ্গাইল শাড়ি বয়ন শিল্প সমবায় সমিতি লি: দেখে খুবই আনন্দিত ও গর্ব অনুভব করছি। বাংলার নাম এই শাড়ির মাধ্যমে আরও উজ্জ্বল হউক ইহাই আমাদের কাম্য।” আন্তর্জাতিক বাজারে টাঙ্গাইল শাড়ির পরিচয় ঘটিয়েছে সমবায় সমিতি তার রপ্তানি বস্ত্র বয়নের মাধ্যমে। এই সমস্ত ঘটনার আনুপুর্বিক বিবরণ ধরা আছে ১৯৮০ সালে ফুলিয়া থেকে প্রকাশিত টানাপোড়েন তন্তুবায় মুখপত্রে। ১৯৯৮ সালে এই পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেলেও, সুখের কথা, ২০২১ সালে এর নবপর্যায়ে প্রকাশনা সম্ভব হয়েছে। তবে জিআই আবেদনে টাঙ্গাইল শাড়ির এই রূপান্তর বোঝাতে ‘হাইব্রিড’ তকমা বড়োই অশালীন। সরকারি আমলারা আর কোনও যুৎসই শব্দ পেলেন না! তাছাড়া টাঙ্গাইল শাড়িকে ‘হাইব্রিড অফ শান্তিপুর ডিজাইন অ্যান্ড ঢাকা-টাঙ্গাইল’ বলা হলেও শান্তিপুরি শাড়ির দ্বারা টাঙ্গাইল শাড়ি প্রভাবিত হয়নি, বরং দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের বাজারে নবাগত টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে শান্তিপুরি শাড়ি তার নিজস্ব ঐতিহ্যকে নষ্ট করেছে। আর ‘ঢাকা-টাঙ্গাইল’ কেন ব্যবহার করেছেন আমাদের আমলাগণ, তার সদুত্তর বোধকরি তারাই দিতে পারবেন!
বাংলাদেশের এক প্রবাসী শিল্পী-গবেষক আবার উদ্বাস্তু তাঁতিদের কঠিন জীবন-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ি বয়নের ধারাকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও স্বার্থের প্রশ্ন তুলেছেন! (“এই যে কল্পনাও করেননি তা কি টাঙ্গাইল শাড়ির প্রয়োজনে, নাকি নিজেদের রুটি রুজির প্রয়োজনে?”) বাংলাদেশের এক পত্রিকায় ‘অন্য বঙ্গে এখখন্ড টাঙ্গাইল ও শাড়ি’ বলে কিছু বাক্য ব্যয় করেছেন বটে, তা বলে একথা কেউ যেন ভেবে না বসেন যে তিনি ভারতের পক্ষ নিয়ে বলেছেন। তবে প্রবাসী এই শিল্পী-গবেষক অবশ্য এই জিআইকে লবেঞ্চুষের সঙ্গে তুলনা করেছেন। লবেঞ্চুষ চুষলে ক্ষণিকের মিষ্টত্ব প্রাপ্তি হয়, তার বেশি কিছু নয়। হস্তচালিত তাঁতশিল্পে জিআই দিয়ে তাঁত ও তাঁতির কোন লাভ নেই।
বিবি’দি এক পত্রিকায় (সমকাল, ঢাকা, ০৪/০২/২৪) সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ-দেশের বসাক তাঁতিদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। তাঁরা সকলেই ভারতের এই জিআই গ্রহণে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তারা কারা তিনি নাম বলতে চাননি। কারণ তাতে নাকি তারা এ-দেশে হয়রানির শিকার হবেন বলে তিনি আশঙ্কিত। দীর্ঘদিন এ-দেশে আছি, ৫০ বছরের উর্দ্ধে তাঁতশিল্প ও তাঁতিদের নিয়ে কাজ করছি, লড়াই-আন্দোলন করেছি, কিন্তু দিদি যা বুঝাতে চাইছেন, সেই অর্থে তাঁতবোনা তাঁতিদের এ-দেশে হয়রানির শিকার হতে দেখিনি কোনওদিন। বরঞ্চ তাঁতি-কল্যাণে এ-দেশের সরকার পরিকল্পনা করে নানাবিধ কাজ করে চলেছে। যদিও সে সব কাজ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, পরিকল্পনা রূপায়নে ত্রুটি-বিচ্যুতিও ঘটে, এবং তা নিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলন ও প্রকাশ্যে সমালোচনাও হয়। তার জন্য কোনও তাঁতির নাকাল হতে হয়েছে, এমন ঘটনা এ-দেশে নিতান্তই বিরল।
সাক্ষাৎকারে বিবি’দি আরও যোগ করেছেন, “এই বসাকরাই যখন একই ধরনের শাড়ি ফুলিয়ায় বুনছে, তখন সেটা ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ হচ্ছে না। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৫০ লাখ পিস্ টাঙ্গাইল শাড়ি আমদানি করতে হয় ভারতকে।…টাঙ্গাইলে যেমন মিহি শাড়ি তৈরি হয়; সেটা ভারতে হয় না। সে কারণেই তো ভারতকে টাঙ্গাইল শাড়ি আমদানি করতে হয়।” জানি না দিদির মতো ব্যক্তিত্বেরও বাংলাদেশে হয়রানির ভয় আছে কি না! নইলে কী কারণে এমন অসত্য কথন তিনি করতে যাবেন। তিনি কি এটা জানেন না যে, বাংলাদেশ থেকে ভারতকে কাপড় আমদানি করার প্রয়োজন পড়েনি কখনও। বাংলাদেশের বস্ত্রাদিসহ ৪৮০টি পণ্যের ভারতে রপ্তানি নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘদিন। তখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি যে কাপড়ের অভাবে ভারতবাসীকে বেয়াব্রু থাকতে হয়েছিল। বাংলাদেশের বারংবার অনুরোধ-উপরোধেও ভারত সরকার সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকা যে আবদার করে এসেছে, আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ৪৮০টি পণ্যের মধ্যে ৬১টি পণ্যকে ছাড় দেওয়ার যার মধ্যে ৪৭টি সুতিবস্ত্র। শেষে ২০১১ সালে ঢাকায় গিয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বন্ধুত্বের পরাকাষ্ঠা দেখাতে ৪৭ প্রকারের কাপড় রপ্তানির অনুমতি দিয়ে আসেন বাংলাদেশের সকাতর অনুরোধে, এ-দেশের তাঁতিদের তীব্র আপত্তি অগ্রাহ্য করে। সেই ৪৭ প্রকারের মধ্যে টাঙ্গাইল শাড়ি একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। ৫০ লক্ষ পিস্ শাড়ি বাংলাদেশ থেকে সোজা পথে এবং বেশিটাই বাঁকা পথে রপ্তানির নামে যা আসে তার এক পিস্ও টাঙ্গাইল শাড়ি নয়, বেবাক সিন্থেটিক সুতোর পাওয়ারলুমে বোনা অতি নিম্নমানের সস্তার শাড়ি— টাঙ্গাইল শাড়ির বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন মাত্র তাতে খুঁজে পাওয়া ভার। এ-দেশে তা টাঙ্গাইল শাড়ি বলে বিক্রিও হয় না। ধুরন্ধর ব্যবসায়ীরা বড়োজোর সেগুলি চিপার হ্যান্ডলুম শাড়ি বলে গছিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে তঞ্চকতা করে। দিদি আরও একটি হাস্যকর কথা বলেছেন, “টাঙ্গাইলে যেমন মিহি শাড়ি তৈরি হয়, সেটা ভারতে হয় না।” তাই কি? ভারতে যে সুতোয় টাঙ্গাইল শাড়ি হয়, তা ১০০ নম্বরের। পাকিস্তান আমলে কিছু বিদেশি মিহি সুতা মিললেও স্বাধীন বাংলাদেশে ১০০ নম্বরের সুতা সহজপ্রাপ্য নয় আজও, অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে ভারত থেকে অল্প কিছু জোগার হয়, বাকিটা ৮০/৮২ নম্বর দিয়ে চালিয়ে দিয়ে ‘মিহি কাপড়’ বলে ডঙ্কানিনাদ করা হয়।[ক্রমশ]
অবসরপ্রাপ্ত সমবায়কর্মী, লেখক ও তাঁতশিল্প গবেষক, ফুলিয়া