সপ্তম শ্রেণির ছাত্রদের আশরাফ সিদ্দিকীর ‘একুশের কবিতা’ পড়াতে গিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত দিনে। উনিশশো বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সেই দিনটির কথা শুনে ছাত্রদের চোখে ফুটে উঠতে দেখলাম বাংলাভাষার কত না ছবি। মদনমোহন তর্কালঙ্কার কতদিন আগে লিখেছিলেন — “পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল।” ‘একুশের কবিতা’য় ব্যবহৃত এই পঙক্তি ওদেরও নিয়ে গেল ওদের ছোট্টবেলায়। বাংলাভাষার ছন্দে মেতে উঠল পুরো ক্লাস। ‘সহজপাঠ’-এর কবিতার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওরা পৌঁছে গেল রূপকথার জগতে, লোকগানের সুরে মেতে উঠল। একসঙ্গে উচ্চারণ করল-“আমার দেশের জারি সারি ভাটিয়ালি মুর্শিদি/আরও কত সুরের সাথে মিশে আছে/আমার মায়ের মুখ/আমার মায়ের গাওয়া কত না গানের কলি!” আজ যখন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের এত চাহিদা যখন বেশির বাবা-মা বলছেন ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’-তখন আমার স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা বাংলাভাষাকে ভালোবেসে গায় — “আমি বাংলায় গান গাই/আমি বাংলার গান গাই/আমি আমার আমিকে/চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই”; পড়ে আবুল ফজলের ‘একুশের তাৎপর্য’। সমবেত কণ্ঠে তারা বলে “মাতৃভাষার ইজ্জত আর অস্তিত্ব নিয়ে কোনো আপস চলে না।প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে হলেও মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে হয়।মাতৃভাষার দাবি স্বভাবের দাবি,মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার দাবি।এ দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেই একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদেরা প্রাণ দিয়েছিলেন-প্রাণ দিয়ে তাঁরা শুধু আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকেই বাঁচাননি,আমাদেরও বাঁচার পথ করে দিয়েছেন।তাই তাঁরা ও তাঁদের স্মৃতি চিরস্মরণীয়। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার এমন অনন্য দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদেরা আমাদের অনন্য গর্ব ও আমাদের গর্ব।” ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জানে —”
‘একুশ’ মানেই উৎসব নয় , রথ-দোল বা চড়কের
‘একুশ’ মানেই একটা ছবি রক্তে-ভেজা সড়কের”।
আমাদের বাড়ি সীমান্ত থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। ছোটবেলা থেকেই জানতাম “আমরা যেন বাংলাদেশের/চোখের দুটি তারা/মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে/থাকুক গে পাহারা।’ স্কুলের বাংলার দিদিমণি আবেগভরা গলায় পড়াতেন “বাংলাভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে রোদ /বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন…” আমাদের স্কুলে মাঠে রবিবার হাট বসতো। চারপাশের কত না মানুষের আনাগোনা।মিলিয়ে মিলিয়ে পড়তাম ‘দূরে দূরে গ্রাম দশ-বারোখানি/মাঝে একখানি হাট’। সন্ধ্যা নামতো গ্রামের পথে জীবনানন্দের কবিতার মতোই।চণ্ডীমণ্ডপে রামায়ণ গান,মনসার পালা।বাংলাভাষাকে জড়িয়ে ধরে আমাদের বেড়ে ওঠা।জেঠু ভোর হলেই গাইত ‘রাই জাগো রাই জাগো’ অথবা “প্রভাত সময় কালে… গৌরচাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে।” বাংলাভাষা আর বাংলাদেশ যেন আমাদের শৈশবের সহচর ছিল। বাড়ির আলমারি জুড়ে কত বাংলা বই। গ্রামের লোকসেবা শিবিরের লাইব্রেরিতে কত না বাংলা বইয়ের হাতছানি। গদাধরের মেলায় লোকগানের আসর, লোকনাটক, যাত্রাপালা, কবিগান। বাংলাভাষার দশ দিগন্ত খুলে যেত আমাদের সামনে। সালাম, বরকত, রফিক-যাঁরা ঢাকার রাজপথে ভাষার জন্য শহীদ হলেন তাঁদের কথা বলতে গিয়ে বাবার গলা ভারী হয়ে আসত। রেডিয়ো চলত বাড়িতে। রাত বারোটায় বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচার হত শহীদমিনারের অনুষ্ঠান। ভেসে আসত — “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলতে পারি?” ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি ভাষা আন্দোলনই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইকে ত্বরান্বিত করেছে। দীর্ঘদিনের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে তৈরি হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। আমাদের ছোটবেলায় ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের রমরমা ছিল না, সময়টা কিন্তু বেশিদিন আগে নয়। উনিশশো ছিয়াশি-নব্বই। আজ বাংলামাধ্যম স্কুলে ভর্তির রিস্ক নিতে নারাজ বেশিরভাগ সচেতন অভিভাবক। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলা পড়ার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভাষাকে ঘিরে তৈরি হওয়া আবেগটাকে আমরা হত্যা করতে নিশ্চয় পারি না।ইংরেজি শিখি, পাশাপাশি নিজেদের আপন ভাষাকে আলিঙ্গন করি এসো। বলি — “আমার আত্মা তুমি /আমার সহচর, প্রিয় বাংলাভাষা/তুমি আছো বলে বেঁচে থাকার সাহস পাই /আমি আমার সন্তানের হাত ধরে হেঁটে যাই শব্দের গভীরে / জন্ম দিই হাজার হাজার কবিতার…” আত্মার আত্মীয় আমার বাংলাভাষা। ‘অক্ষিগোলকের মধ্যে আঁখিতারা’র মতোই।চেনা বর্ণমালাকে পাশে নিয়ে হেঁটে গেছি পাহাড়, অরণ্য, সমুদ্র কিংবা মরুদেশে। জীবনানন্দের ধূসর পাণ্ডুলিপির পাতায় চোখ রেখে খুঁজে পেয়েছি ইতিহাস কিংবা রোমান্টিক কোনো কল্পজগতকে। ‘আচার্যের ভদ্রাসনে’ বসে কবি দেবদাস লিখেছেন ‘মানুষের মূর্তি’-বাংলাভাষার জাদুস্পর্শে সৃষ্টি হয়েছে কত না মানুষের রূপ। বাংলার প্রকৃতি, মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বাংলা শব্দবন্ধে। অক্ষর জুড়ে জুড়ে তৈরি করেছি কবিতার ঘর, গল্পের মহল কিংবা উপন্যাসের বাড়ি। বাংলাভাষা তার শরীর থেকে ঢেলে দিয়েছে রং, রূপ, গন্ধ। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা শ্লেট-পেনসিল নিয়ে বসে গেছে শব্দ তৈরির নেশায়। কী জাদু বাংলা ভাষায়!ক্লাসরুমে বসে আদিবাসী ছেলেমেয়েরা মহানন্দে আজও পড়ে আলমাহামুদের কবিতা। পুরুলিয়ার জঙ্গলঘেরা ডুংরির উপরে আজও বসে বাংলা কবিতার মেলা। রাঢ়ভূমিতে লালমাটির পথে পথে তারাশঙ্কর বিছিয়ে রাখেন নিতাই কবিয়ালের গান। অজয়ের তীর ঘেঁষে বাংলাভাষা আলপনা এঁকে দেন যেন। আজও পলাশপরবে মাতে মাহাতো পরিবার-বাড়ির দেওয়ালে আঁকা হয় বাংলাবর্ণমালার স্থিরচিত্র। ইছামতী আজো বয়ে চলে, যেভাবে বয়ে চলে অপুর সংসার। পদ্মার মাঝি এখনও গেয়ে চলে ভাটিয়ালি। আজও বাংলাভাষা উচ্চচারিত হলে চোখে ভেসে ওঠে কত চেনা ছবি,যা আমাদের ছোটবেলাকে আগলে আগলে রাখে-পাখিদের রব, কাননের ফুল, কুসুমকলি আমাদের একটু একটু করে বড় করে তোলে। লিখতে ইচ্ছে করে —
ভাষা যদি নদী হয়ে বয়
আমি তবে ছায়াঘেরা মেঘ
সে মেঘের নাম ধরে আজ
তুই তবে কবিতাই লেখ
#
কবিতায় ডুবে গিয়ে রোজ
সব্বাই ভাষা খুঁজি চল্
ভাষানদী একুশের ভোর
কেন তোর চোখ ছল্ ছল্ ?
#
ভেজা-চোখে কারা গান গায়?
সে গানেই কান পেতে রই
ভাষা যদি নদী হয়ে বয়
আমি তবে নীল ঢেউ হই
#
নীল জলে ভাষা ঝিলমিল
নীল জলে জোছনার টিপ
ভাষানদী একুশের ভোর
আমি তবে মায়াময় দ্বীপ।
সেই দ্বীপে ফুল ফোটে রোজ
সেই দ্বীপে জোনাকির দল
ভাষা যদি নীলপরী হয়
সব্বাই আলো ঝলমল।
আমার আত্মার আত্মীয় বাংলাভাষা ভাল থেকো। আগামী প্রজন্ম তোমার গহনে ডুব দিয়ে তুলে আনুক রূপকথার মণিমাণিক্য-তুমি হাত ধরে থেকো ওদের-আমার প্রিয় বর্ণমালা ভালো থেকো। “তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার? উনিশ শো’ বাহন্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।”
অমৃতাভ দে।কৃষ্ণনগর। নদিয়া। দোগাছি উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক।