বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বিশেষ সংখ্যার লেখা।
রামদাস — নাড়ু, এদিকে আয় বাবা।
হরিদাস — না, যাব না আমি।
— আর মারবো না বাবা।
— তোমাদের ঘরে আর থাকবো না আমি।
যেদিকে মন চায়, সেদিকে চলে যাব।
— এমন বলিস না বাবা, আর মারবো না।
**
— সরলা, ও সরলা, ওঠ না একবার, হরি তো ঘরে নেই। দেখ না একটু।
— আমি আর উঠবো না, যেখান থেকে পারো আমার ছেলে এনে দাও। আজ চৈত্র সংক্রান্তি, আমি পুজো করবো না, খাবো না, যা হয় হোক, আমি উপোষ করে মরবো।
**
রামদাসের জীবনধারণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে, আজ প্রায় সাত বছর হল। হরিদাস চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন বা ওইদিন ভোর থেকে বাড়ী ছাড়া। সরলা হরিদাসের চলে যাবার পর আর কোনোদিন সুস্থ হয়ে ওঠে নি। অনেক লড়াই করলেও সন্তানের বিচ্ছেদ তাকে কিছুতেই স্বস্তিতে থাকতে দেয় নি। হয়তো পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে সে এখন হরিদাসের বিচ্ছেদ সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করেছে।
**
আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে হরিদাস এসেছে বাড়ীতে। রামদাস ছেলেকে চিনতে পারে নি প্রথমে। পরে সে যখন বুঝলো, তখন ছেলের হাত ধরে নিয়ে এলো ভিতরের ঘরে চৌকির কাছে। শূন্য ঘর হরিদাসকে বুঝিয়ে দিল, তার মা নেই। রামদাসের মনে হয়তো বিশ্বাস ছিল কোনো একদিন হরিদাস ফিরবে, তাই সরলার অস্থি সে রেখে দিয়েছিল। ছেলের হাতে সেই অস্থিশুদ্ধ ঘট সে দিল। হরিদাস বাবার হাত থেকে ঘট নিয়ে অশেষ যন্ত্রনায় আকুল হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। বাবাকে জড়িয়ে সে বললো,
— আমি আর বাড়ী ছেড়ে যাব না বাবা।
— কাল পয়লা বৈশাখ। জীবনকে একবার ফিরে দেখার চেষ্টা কর বাবা।
***
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দুই বন্ধু। মিনুর বয়েস মাত্র ১০ বছর। মিনুর প্রিয় বন্ধু লিলি। বাঙালী খ্রিস্টান লিলির মিনুর টিফিন খেতে খুব ভালো লাগে। দুজনেরই খুব ভালো বন্ধুত্ব হলেও একে অন্যের বাড়ী যাওয়া হয় নি। দুজনেই অনেকবার একথা ভেবেছে, কিন্তু যাওয়া আর হয় নি।
— কাল টিফিন কি আনবি?
— কাল তো চৈত্র সংক্রান্তি, বাড়ীতে পুজো, মা হয়তো ফল দেবে একটু।
— কি পুজো রে?
— জানিনা, ওই তো মায়ের পুজোর আসনে যেসব ঠাকুর আছে, তাদের পুজো।
— কাল তোদের বাড়ী যেতে পারি?
— আসতে পারিস, কিন্তু কাল আমাদের ভেজ খাবার। তোর ভালো লাগবে না।
— ভেজ? ইউ মিন নো মাছ মাংস?
— ইয়েস।
— কিন্তু তোর টিফিন এর ভেজ তো আমার ভালো লাগে।
— আয় তাহলে।
***
—আর লোক পেলি না? শেষে সংক্রান্তির দিনে খ্রিস্টান বন্ধু?
— কেন কাকু?
— আরে আজ বাড়ীতে পুজো।
— সেই জন্যেই তো এল ওরা।কত মজা করলাম আমরা।সজনে ডাঁটার শুক্ত, ডালের বড়া, এঁচড়ের তরকারি আর কাঁচা আমের চাটনি দিয়ে আমরা তো দারুণ খেলাম। ঠাকুমা তো যাবার সময় লিলির মাকে কত ফল আর মিষ্টি দিল।
— তোমার ঠাকুমা তো আবার সর্বধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাসী।
— সেটা আবার কি?
— ওইসব আরো একটু বড় হলে বুঝতে পারবে মিনু। হ্যাঁ রে রবি, তুই বড়দিনে কেক খাস কেন? লজ্জা করে না?
— ঠাকুমা, কাকুকে তুমি বকছো?
— না, কাকুকে বুঝিয়ে দিচ্ছি, সব উৎসবে সবার নিমন্ত্রণ আছে, যে আসবে সেই আমার আপন আজ। তুমি শুধু মনে রেখ মিনু, বন্ধুর কোনো ধর্ম, জাত নেই, সে শুধুই বন্ধু হয়।
***
উপরের দুটি ঘটনা কিন্তু আজকের নয়। একটি আমার দিদার কাছে শোনা, একটি আমারই বয়েসী একজন বন্ধুর জীবনের ঘটনা। আজ আর সংক্রান্তির কথা ছোটরা সেভাবে কেউ জানেই না। সংক্রান্তির সময় বিশেষ পুজো, খাওয়া, গাজন, বাসন্তী পুজো এইসব কথা সেভাবে আলোচনাও হয় না, আর বাড়ীর বড়রা তেমন ভাবে এগুলি খুব যে পালন করে থাকেন, তাও নয়। তবে ব্যতিক্রম তো আছেই।
একসময় আমাদের বাড়িতেও বসতো চড়ক আর গাজনের উৎসব। সমানে ঢাকের আওয়াজ শিব পার্বতীর সং।পিছনে অনেক লোকের ধেই ধেই নাচ, হাতে সবার গাঁজার ছিলিম। সে এক দৃশ্য, ধুলো আর ধুনোর ধোঁয়া, ছোট ছিলাম, ভয় ও লাগতো, ভালো ও লাগতো। বাড়ীতে ঢালাও মিষ্টির ব্যবস্থা।
ঠাকুরদা বাংলাদেশ থেকে সুদূর বর্ধমানে এসে বিশাল এক জমিদারই শুরু করেছিলেন বলা যায়। ওঁরা ছিলেন সাত ভাই। সম্পত্তি ও কম ছিল না। কাজেই যে মাঠের কথা বলছি, তাও কম বড় ছিল না। প্রচুর লোক সমাগম হত। ভিয়েন বসতো দিন দুই আগে থেকে। বোঁদে, দরবেশ, নিমকি, গজার কথা এখনো মনে পড়ে। আর মনে পড়ে তেতো খাবার কথা, তখন তো ভালোই লাগতো না, আর এখন শরীরের জন্য নিয়ম করে খাই। যারা আসতো, তারা লুচি তরকারি মিষ্টি খেয়েই যেত। সন্ধ্যে বেলা একটু রাতের দিকে সব শেষ হত। মায়ের পিছন পিছন ঘুরে মরতাম খালি, মা শুতে না গেলে শান্তি নেই।
চৈত্রের শেষে বকুল ঝরানো দিনে পুকুর পারে ভালোই আসর বসতো মনে আছে।জ্যাঠা কাকাদের হুঁকো খাওয়া দেখতাম, হুঁকো সাজতে ইচ্ছে করতো খুব, পারতাম না, তারজন্যে নির্দিষ্ট লোক ছিল, ওগুলো আমাদের কাজ নয়। সারাদিনের পরে শিব পার্বতী আর তাদের সঙ্গী সাথীরা সব বখশিস নেবে, জামাকাপড় নেবে, চাল ডাল আনাজপাতি কিছু কিছু নিয়ে তারা বিদায় নিত।সবার মনে খুশীর হাওয়া, আগামীকাল নতুন বছর শুরু। প্রকৃতি যেন মানুষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যেত। অতীত কে বিদায় দেওয়া হলো একরকম ভাবে, এবার তার জায়গায় সুমধুর ভবিষ্যতকে প্রাণমন দিয়ে বরণ করা। মনে হয়, চৈত্র সংক্রান্তি তার নিজস্ব উজ্জ্বলতায় অনেক বেশী আপন আমাদের কাছে নববর্ষের উৎসবের থেকে। বাঙালির একান্ত নিজের ঘরের উৎসব হলো চৈত্র সংক্রান্তি। বড় জ্যেঠিমা কোনোদিন তেমন ভাবে সকলের সামনে যখন তখন বেরোতেন না। কুঁচি দিয়ে কাপড় পড়তেন ঘরেও। মনে আছে, একদিন চৈত্র সংক্রান্তির রাতে মায়ের কাছে বসে জ্যেঠিমা কাঁদছিলেন। অনেক বড় হবার পরে মায়ের কাছে তার সুখ দুঃখের কথা কিছু জেনেছিলাম। সেসব নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। পরের দিন পয়লা বৈশাখ বলে বাড়ীতে প্রচুর কাজ থাকতো।
***
একটা কথা মানতেই হবে, বাড়ীতে এত লোকজনের থাকা বলেই মা জ্যেঠিমাকে অনেক কাজ করতে হলেও রান্নাঘর সামলাতে হত না তেমন। তদারক করতে হত সারাক্ষন, কিন্তু রাঁধতো ঠাকুর। পয়লা বৈশাখ বলে সেদিন অনেক লোকের নিমন্ত্রণ ও থাকতো। এখনকার মত খাবার দাবার নিয়ে তখন স্বাস্থ্য সচেতনতা এত বেশী ছিল না।তাই আগের দিন এত খেয়েও পরের দিন লোকে আবার ভরপেট খেতে পারতো।
***
চৈত্র বৈশাখ নিয়ে লিখতে বসেছি, কিন্তু কি যে লিখবো শেষ পর্যন্ত তা জানা নেই। তবে চৈত্রের কথা মনে পড়লেই বুকের ভিতরে একটু ব্যথা যেন কোথাও আসা যাওয়া করে।
“কার যেন এই মনের বেদন চৈত্রমাসের উতল হাওয়ায়,
ঝুমকোলতার চিকন পাতা কাঁপে রে কার চমকে চাওয়ায়।।”
এই বিষয়ে প্রথম যে স্মৃতি, তা হল মামার বাড়ীতে লুকিয়ে আচার খেতে গিয়ে ধরা পড়ে মার খাওয়া। বয়েস খুবই কম, বছর ছয় কি সাত, লুকিয়ে কিছু করতে পারা তেমন রপ্ত হয় নি তখনো।
দ্বিতীয় ঘটনা, একবার নিজেদের বাড়ীতে দুপুরবেলায় কালবৈশাখী ঝড়ের অভিজ্ঞতা। ঝড়ের সেই প্রথম আতঙ্ক। আমার বাবার অফিসের কোয়ার্টারে তখন পাকা ছাদ ছিল না, টিনের চাল, যদি উড়ে যায়! মাকে জড়িয়ে ধরে আছি দুই বোন। মা বলছে, “দেখ না, বৃষ্টি নামবে এখুনি, সব ঠিক হয়ে যাবে।” একটু পরে সত্যি বৃষ্টি নামলো, কিছুক্ষন পর আকাশের কালো মেঘ পরিষ্কার হয়ে হাল্কা রোদ ও উঠে গেল। তখন ভয় পেয়েছিলাম, আজ আর ভয় নেই।
আজ তো জানি —
“ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে
বাধাবন্ধহারা
গ্রামান্তের বেনুকুঞ্জে নীলাঞ্জন ছায়া সঞ্চারিয়া
হানি দীর্ঘ ধারা।”
কালবৈশাখীর ধ্বংস রূপের মাঝেই আছে নূতনের আবির্ভাবের বার্তা। সেদিন কিন্তু প্রকৃতির এই রূপকে খুব ভয় পেতাম।
***
পয়লা বৈশাখ, নববর্ষের দিন, সকলেই খুশী। আমরা ভাই বোনেরাও নতুন জামা পড়তাম। মা, কাকিমা, জ্যেঠিমারা নতুন কাপড় পড়তো। বাড়ীতে পুজো হত, তবে সে আমাদের মনকে বেশী টানতো না। আমরা বড়দের প্রণাম করতাম, তারাও আশীর্বাদ করতেন, সঙ্গে কিন্তু দু চারটে টাকা পয়সাও পেতাম। ওই পাওনা যে কি আকর্ষণ বলে বোঝানো যাবে না। খুব উত্তেজিত হয়ে সেই পয়সা, চার আনা,আট আনা, একটাকা যে কতবার গুনতাম তার ঠিক নেই। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই আনন্দ কোথায় যে হারিয়ে গেল, আর তাকে খুঁজে পেলাম না। সেই অতি সামান্য পয়সার কী যে অসীম মূল্য ছিল কী করে বলি!
সকালে তো জলখাবার এক পর্ব, লুচি, আলুরদম রসগোল্লা, পান্তুয়া। এই খাবারটাই সকলে খেত। তবে এখনকার মত দুপুরের খাবার মেনু হত না আমাদের। এখন তো বহুরকমের খাবারের কথা শুনি, সব মনেও থাকে না।শুক্ত, এঁচড়ের ডালনা, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, রুই মাছের ঝোল, পাঁঠার মাংস, কাঁচা আমের চাটনি, পাঁপড়, দই, মিষ্টি। বছর বছর এই খাবারই খেয়েছি।
এখন অবশ্য এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা পয়লা বৈশাখ তেমন মনে রাখে না, যতটা ইংরিজি নববর্ষকে তারা আপন মনে করে। আসলে ঔপনিবেশিক ভাবধারা আমাদের মনে করতে বাধ্য করিয়েছে যে, নিজের ভাষার থেকেও ইংরিজি বেশী প্রয়োজন। ভাষা সমাজ কে অনেকরকম ভাবে পাল্টে দেয়। অনেক কারণ আরো আছে বলাই বাহুল্য। তর্ক বিতর্ক বাদ দিয়ে যে কথা বলতেই হয়, তা হল, কাজের ক্ষেত্রে যে ভাষা আমরা ব্যবহার করি সেটাও যেমন প্রয়োজন, তেমনি মনের কথা বলতে গিয়ে মায়ের ভাষাও তো দরকার। দুটির মধ্যে কী সমন্বয় সাধন সম্ভব?
***
ভাষা, সংস্কৃতি উৎসব সব দেশের যেমন আছে, আমাদের ও আছে। সকলের সঙ্গে মিলতে গিয়ে নিজেদের যেন ভুলে না যাই আমরা। আমরা বাঙালী, বাংলা নববর্ষ পালন আমাদের নিজের ঘরের নিয়ম রীতি মেনে নাহয় হলই একটু। ছোটদের শেখাই তো আমরাই, তাই বোধহয় দায়িত্ব আমাদেরই বেশী। নববর্ষের দিনের ঐতিহ্য নাহয় একটু ছড়িয়েই দিলাম এদের ভিতরে।
দেহের পুষ্টি সাধন করাটাই তো সব নয়, মানসিক আবেগ এবং আনন্দের প্রকাশটাও তো প্রয়োজন। যে কোনো উৎসব সমাজে বৈচিত্র্য আনে, পারস্পরিক মেলা মেশার সুযোগ হয়। ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রটি প্রসারিত হয়, হৃদয় উদ্ভাসিত হয়, যেগুলো আমাদের জীবনে বিশেষ ভাবেই জরুরী আজকের দিনে। মানুষ আজ একা হয়ে পড়ছে, সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তাই হৃদয়ের মুক্তির পথকে সহজ সরল করে নেবার জন্যেই উৎসবের দরকার। কাজের জগতে আমরা সকলেই ব্যস্ত থাকি। প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামে আমরা নির্জন দ্বীপের মত। কিন্তু নববর্ষের মিলনে আমরা যখন সকলের সঙ্গে মিলিত হই, দুটো মনের কথা বলি, তখন নিজেকে আর একা মনে হয় না, ভাবি, “এই তো সবাই আছে আমার কাছে।”
পয়লা বৈশাখের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল হালখাতা, লক্ষ্মী গণেশ পুজো, আমপল্লব দিয়ে সাজানো ঘট, মিষ্টি, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি। বৈশাখের নতুন দিনে, আশা – আকাঙ্খা বাঙালীর জীবনে বয়ে আনে অনাবিল আনন্দ।
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “শুভ উৎসব” প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “……… আমার আনন্দে সকলের আনন্দ হোক, আমার শুভে সকলের শুভ হোক, আমি যাহা পাই, তা পাঁচজনের সহিত মিলিত হইয়া উপভোগ করি, এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ।”
লেখার শুরুতে দুটি গল্প বলেছিলাম, যা অন্যের কাছে শোনা। শেষ করবো নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া গল্প দিয়ে।
ক্লাস নাইন এ পড়ি তখন, মা বাবার সঙ্গে পয়লা বৈশাখের দিন সন্ধ্যায় মায়ের একজন সহকর্মীর বাড়ীতে যাচ্ছি। মায়ের সব সহকর্মীরাই আমাদের মামা আর মাসী। মনে ভাবছি, ভালো ভালো সব খাবার খাবো, কী মজা।সুমিতা মাসীর বাড়ীর কাছে এসে মা হঠাৎ আমায় বললো, “গিয়ে কিন্তু শুভ নববর্ষ বলো না যেন। বেশী হাসাহাসি করবে না একদম।” একটু বোকার মত হয়ে গেলাম তখন। বেল বাজাতেই সুমিতা মাসীর ছেলে দরজা খুলে দিল। আমরা গেলাম, বসলাম, মা বাবা কথা বলছে, মাসীর মেয়ে আমার থেকে একটু ছোট, সে আমাকে তাদের শোবার ঘরে নিয়ে গেল। দেখলাম, একজন হাসি খুশী মানুষের ছবির সামনে ঘট, থালায় খাবার দাবার,মনে হচ্ছে কোনো পুজো হয়েছে। বুঝলাম মেসো আর নেই। পরে মায়ের কাছে শুনেছি গতবছর এই দিনেই মেসো মারা গেছেন। আজ বার্ষিকী। মাকে সুমিতা মাসী আসতে বলে নি, কিন্তু মা বাবা তবু এসেছে। বেরোবার সময় বাবা বলেছিলো, “সবাই ভালো থাকবে।” সুমিতা মাসীর উত্তর আজও মনে আছে আমার। “হ্যাঁ দাদা, আমার তো আর শুভ নববর্ষ হবে না কখনো, আজীবন একলা বৈশাখ কাটাতে হবে। ভালো ভাবে থাকার চেষ্টা তো করতেই হবে।”
***
শিক্ষকতা পেশা হওয়াতে শিক্ষা শুধু দিয়ে যাই, তা তো হয় না, প্রতিদিন শিক্ষা নিতেও হয়। সারা বৈশাখ মাস জুড়েই তো “শুভ নববর্ষ” চলে। পয়লা বৈশাখের দু/একদিন পর ক্লাস ওয়ান এ গিয়েছি, বৈশাখ নিয়ে কথা চলছে, মিষ্টি খাওয়া, নতুন জামা ইত্যাদি। বোর্ডে লিখেছি “১লা বৈশাখ”। তারপর এটা ওটা কথা, হাসি, গল্পের মাঝে হঠাৎ একটি ফুটফুটে মেয়ে চলে এল একদম কাছে।
— তুমি কে?
— আমি তো ম্যাম।
— আমাদের তো পড়াও না তুমি, কেন এসেছো?
— আমি একটু বড়দের পড়াই। আজ একটু ইচ্ছে করলো তোমাদের কাছে আসতে।
— সেটাই তো। বড়রা কিচ্ছু জানে না।
— তাই বুঝি?
— তুমি পয়লা বৈশাখ বানান জানো না?
— তুমি লিখবে?
— দাঁড়াও, লিখছি।
সে লিখলো, “পয়লা বৈশাখ”
— তুমি তো ১লা বৈশাখ লিখেছো। বাড়ী গিয়ে ভালো করে বানান প্র্যাক্টিস করবে।
***
পয়লা বৈশাখ তো প্রতিবছরই আসবে। তবে আগের দিনের মত করে হয়তো আসবে না। ভোর বেলা স্নান সেরে, পিঠে ভিজে চুল ছড়ানো,নতুন তাঁতের গন্ধ জড়ানো শাড়ী পরা মা, কাকিমা, বাড়ীর মেয়েদের হয়তো তেমন ভাবে দেখা যাবে না আর বেশী দিন। এখন শাড়ী, গয়না, হোটেলের খাবার বিজ্ঞাপনে মানুষ হালখাতার কথা কিছুটা ভুলে গেছে মনে হয়।
**
তবুও তো বাংলা বছরের প্রথম দিন, যার যেমন ইচ্ছে পালন করতে পারলেই হল। বাঙালীর ঘরে ঘরে সৌভাগ্যের আনন্দ দীপ জ্বলুক, আপন ঘরের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক ঘর থেকে বাইরে, হৃদয় থেকে হৃদয়ে সঞ্চারিত হোক প্রীতি। বড় ছোট সকলেই যেন একে অপরের জন্যে শুভ বোধ, সুস্থ্ জীবনের আশা অঙ্গীকার করতে পারি, এই হোক আমাদের সকলের ব্রত।
খুব সুন্দর। ছোট বেলার অনেক স্মৃতি ফিরে পেলাম।