ভোটের প্রচারে রাজনৈতিক দলগুলির নেতারা জনগণের উদ্দেশ্যে নানা প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন। মানুষের উন্নয়ন থেকে শুরু করে সামাজিক ন্যায়, দেশের প্রগতি থেকে শুরু করে চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি নানা গালভরা কথার ফুলঝুরি ফুটতে থাকে তাদের কথায়। আদৌ সেই প্রতিশ্রুতি পালন সম্ভব কিনা তা ভেবে দেখার অবকাশ থাকে না তখন। এমনকি কোথাও কোথাও নির্বাচনী প্রচারে ভোটের বিনিময়ে মদ দেওয়ার কথাও শোনা গিয়েছে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা যদি সত্যি সত্যিই মদকে নির্বাচনের ইস্যু করে তোলেন অথবা কোনো রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে জয়ী হয়ে জনগণকে সস্তায় মদ দেওয়ার কথা বলে, তাহলে নির্বাচনে সেই দলের ফলাফল কী হতে পারে? ভেবে দেখা হয়নি। কিন্তু এমনটাই ঘটেছে এবারের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে। অন্ধ্রপ্রদেশে লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে প্রচারে এসে সুরাপ্রেমীদের উদ্দেশ্যে সত্যিই সুখবর শুনিয়েছেন তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)-র প্রধান তথা সে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু। তিনি ঘোষণা করেছেন, টিডিপি-বিজেপি-জনসেনা জোট অন্ধ্রপ্রদেশে ক্ষমতা দখল করলে মদের দাম কমানো হবে। কেবল তাই নয়, চন্দ্রবাবু তাঁর বিধানসভা কেন্দ্র কুপ্পমের দলীয় সভায় বলেন, “আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আমরা সরকার গড়লে ৪০ দিনের মধ্যে উন্নতমানের মদ সরবরাহ করব। শুধু তাই নয়, সেই ভালো জাতের মদের দামও সস্তা করে দেব”।
প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগেই আবগারি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তথা আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল ইডির হাতে গ্রেফতার হয়ে তিহারে বন্দি রয়েছেন। দিল্লির আবগারি দুর্নীতি মামলায় ভারত রাষ্ট্র সমিতির নেত্রী তথা তেলঙ্গানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের কন্যা কে কবিতাকেও গত ১৫ মার্চ হায়দরাবাদের বানজারা হিলস এলাকায় তাঁর বাড়ি থেকে ইডি গ্রেফতার করে। দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতে তেলঙ্গানা বিধান পরিষদীয় সদস্য কবিতার অন্তর্বর্তী জামিনের আর্জি খারিজ হয়ে গিয়েছে। উল্লেখ্য, চন্দ্রবাবু নায়ডু যখন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন সেই রাজ্য আইটি ক্ষেত্রে দারুণ ভাবে অগ্রসর হয়েছিল। সিলিকন ভ্যালি গড়ে তোলা সেই চন্দ্রবাবু সম্প্রতি রাজ্যের রাজনীতিতে প্রায় অতীত হয়ে পড়ে ফিরে আসার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে তিনি এটা কোন ধরণের প্রতিশ্রুতি দিলেন? এমন প্রতিশ্রুতি কি শুধুই রাজনৈতিক চমক, নাকি অন্য কিছু? অর্থ যাই হোক না কেন, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সস্তায় উন্নতমানের মদ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি নিয়ে গোটা রাজ্যে যথেষ্ট শোরগোল পড়েছে। যখন অনেকেই নেশামুক্ত সমাজ গড়ার কথা বলছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন সমাজসেবী ব্যক্তিত্ব। সেই লক্ষ্যে তাঁরা তাঁদের প্রচার এবং প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক নেতাদের পাশে চাইছেন, ঠিক সেই সময়ে ভোটের আগে জনগনের রায় নিজেদের পক্ষে পাওয়ার আশায় কম দামী উন্নত মদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন দেশের একজন পরিচিত রাজনীতিবিদ?
আশ্চর্য হতেই হয় কারণ, চন্দ্রবাবু নায়ডুর শ্বশুর প্রয়াত এনটি রামা রাও আশির দশকে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেই সময় চন্দ্রবাবু নিজেই এনটিআর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে দক্ষিণের এই রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নাইডু। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ওয়াইএসআরসিপি জগনমোহন রেড্ডির নেতৃত্বে অন্ধ্র প্রদেশে ক্ষমতায় এসেছিল। সেই সময়ে রাজ্য সরকার আবগারি শুল্ক থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা আয় করেছিল। চন্দ্রবাবু নাইডু তখন মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহন রেড্ডিকে লক্ষ্য করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এলে মদ নিষিদ্ধ করে দেবেন। কিন্তু সেই নাইডু কিভাবে এখন তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন। নাইডু এও বলেছেন, যখন তিনি অ্যালকোহলের কথা বলেন, তখন নাকি অনেক মানুষ খুশি হয়। তারা মদের দাম কমাতে চায়। নায়ডু জগনমোহন রেড্ডির নামোল্লেখ করে বলেন, তিনি মদের দাম ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা করেছেন এবং ১০০ টাকা পকেটে রেখেছেন। কেবল তাই নয়, নাইডুর অভিযোগ যে জগন সরকার নিম্নমানের মদ সরবরাহ করে জনগণের স্বাস্থ্য নষ্ট করছে। এরপরেই তিনি জনসভায় জনগণকে সম্বোধন করে প্রতিশ্রুতি দেন যে টিডিপি ক্ষমতায় আসার ৪০ দিনের মধ্যে, কেবলমাত্র মানসম্পন্ন মদই পাওয়া যাবে না, দামও কমানো হবে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময় অন্ধ্রপ্রদেশে মদ নিষিদ্ধ করার জন্য পূণ্যবতী শংকরার নেতৃত্বে এক সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। কারণ মদ্যপান থেকে সেই রাজ্যে মেয়েদের উপর নানা অত্যাচার জন্ম নিচ্ছিল, মেয়েদের আন্দোলনের চাপে মদ নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৯৩ সালে আরাক নামের কড়া দেশী মদ নিষিদ্ধ হয়। পরের বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে অন্ধ্রের মহিলারা ওই রাজ্যে মদ্যপান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালে তাদের সমর্থন করেন তেলুগুদেশম পার্টির নেতা এনটি রামারাও। তার আগের দুই মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রী তৃতীয় মেয়াদের জন্য পুননির্বাচিত হতে বুঝেছিলেন, ভোটে জিততে হলে মেটেদের সমর্থন দরকার। তখন সময়টা এমন ছিল যে কেউ যদি অন্ধ্রপ্রদেশের রাজনীতিতে টিকতে চায় তাহলে তাকে মদ নিষিদ্ধ করার অঙ্গীকার করতেই হবে। ১৯৯৪ সালে তেলুগুদেশম পার্টি নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাজিত করে এবং এনটি রামারাও তৃতীয়বারের মত মুখমন্ত্রী হয়ে হায়দরাবাদে তার অভিষেক অনুষ্ঠানে এক বাক্যে মদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে এনটি রামারাওকে সরিয়ে চন্দ্রবাবু নাইডু যখন মুখ্যমন্ত্রী হলেন, দু’বছর পর তিনি মদের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন। তার একটি কারণ ছিল বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার শর্ত, আরেকটি কারণ প্রভাবশালী মহল বিশেষ করে হোটেল ইন্ডাস্ট্রির চাপ। তা ছাড়া মেয়েদের আন্দোলনের গতিও তখন বেশ কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল।