মঙ্গলবার | ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:৫১
Logo
এই মুহূর্তে ::
মাটির গন্ধমাখা লোকগানে সতেজতার সন্ধানী অমর পাল : রিঙ্কি সামন্ত কোটিপতি সাংসদরাই কি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি : তপন মল্লিক চৌধুরী বাহের দ্যাশের লোকসংস্কৃতি ও লোকসঙ্গীত নানা বৈচিত্র্যে বৈচিত্র্যময় : মনোজিৎকুমার দাস আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (শেষ পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী মোদি ম্যাজিক ছিল কিন্তু সে ম্যাজিক ফিকে হয়ে গেছে : দিলীপ মজুমদার সুশান্ত দাসের ‘প্রকৃতিগাথা’ : দিলীপ মজুমদার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহনযোগ্যতা ও আরাকান আর্মি : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন কেদারনাথ-বদ্রীনাথ ভ্রমণ : প্রকৃতি আর ঈশ্বর যখন একটি বিন্দুতে মিশে যায়… : অমৃতাভ দে আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (তৃতীয় পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী বসিরহাটে নুনের হাট, শ্যামবাজার নুনের বাজার : অসিত দাস মুর্শিদাবাদের আমকথা (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত জেন অস্টিন নারী স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃৎ : মনোজিৎকুমার দাস ইসবার ইন্ডিয়া জোটকা সরকার, আমরা একাই একশো — মমতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (শেষ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন মুর্শিদাবাদের আমকথা (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (দ্বিতীয় পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী নজরুল ও মধুপুর (শেষ পর্ব) : জমিল সৈয়দ কবি কুসুমকুমারী দাশ ও পরাবাস্তবতার কবি জীবনানন্দ : বিজয়া দেব হুগলির লোকসভা ভোটে গ্রামীন এলাকায় ১৭১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (সপ্তদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি : সমাজ বিবর্তনের দলিল (প্রথম পর্ব) : মোজাম্মেল হক নিয়োগী নজরুল ও মধুপুর (প্রথম পর্ব) : জমিল সৈয়দ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (ষোড়শ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন আলাউদ্দিন অল আজাদ-এর ছোটগল্প ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি বড্ড বেশি জরুরি করে ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকগীতি ঘাটু গান আজ অবলুপ্তির পথে : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (পঞ্চদশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন হাসান আজিজুল হক-এর ছোটগল্প ‘স্বপ্নেরা দারুণ হিংস্র’ বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেদেদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের কথা : মনোজিৎকুমার দাস শান্তিনিকেতনের দিনগুলি (চতুর্দশ পর্ব) : সন্‌জীদা খাতুন
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই অক্ষয় তৃতীয়া-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

হাবিব আনিসুর রহমান-এর ছোটগল্প ‘শালবন মহুয়ার পাখি’

হাবিব আনিসুর রহমান / ১২৯ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৪

বিছানায় গেলে ঘুমের জন্য কসরত করতে হয় না আশফাককে। শুলেই ঘুমিয়ে পড়ে। রিনির কিন্তু তা হয় না। সারা রাত এপাশ-ওপাশ।

হয়তো শেষ রাতের দিকে একটু ঘুম হয় আবার হয়ও না। গভীর রাতে বৃষ্টি-বাদলের দিনে বাজ পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে আশফাক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রিনির দিকে, রিনি ঘুমায়নি!

আজও বৃষ্টি পড়ছে। গভীর রাত। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরাল রিনি।

খসখস শব্দ হলো। জানালার গ্লাস সরিয়ে বাইরে তাকাল। এক টুকরো ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। রাস্তার বাতিটার চারপাশে বৃষ্টির কণাগুলো ঝাপসা।

বাতাসে দুলছে গাছের পাতা। গভীর রাতে জানালার পাশে কেন রিনি! আশফাক গিয়ে দাঁড়াল তার পাশে — ‘বৃষ্টি পড়া দেখছ? — দেখো, দেখো, মনে হচ্ছে বরফের চিকন চিকন সুতা নেমে আসছে আকাশ থেকে, তাই না!’ বলল রিনি।

ছকে বাঁধা জীবন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে নাশতা রেডি করা। আশফাক যাওয়ার সময় দুপুরের খাবারটা হাতে তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুই করে রিনি।

তবুও কোথায় একটা শূন্যতা অনুভব করে আশফাক! রিনি ঘুমায় না। নাকি ঘুমাতে পারে না! কোনো কোনো সময় বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি ভাবে আশফাক। তোমার ঘুম হয় না? জিজ্ঞেস করলে রিনি বলে — হয়, ঘুম না হলে মানুষ বাঁচে?

অফিসের সিনিয়র কলিগ আবুল কালাম আজাদকে একদিন কথাটা বলেই ফেলল আশফাক-

‘আজাদ ভাই, একটা কথা ছিল।’

‘বলো।’

‘আমার নিজের, পারসোনাল।’

‘প্রাইভেট?’

‘জি।’

‘সমস্যা নেই, বলো।’

‘প্লিজ, কথাটা কাউকে বলবেন না।’

‘সিরিয়াস কিছু?’

‘না, খুব সিরিয়াস কিছু না।’

‘তাহলে বলে ফেল।’

আজাদ সাহেবের মুখের কাছে মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে আশফাক বলল,

‘ভাই, আমার বউ ঘুমায় না।’

আশফাকের দিকে অবাক হয়ে তাকালেন আজাদ -ঘুমায় না! বলো কী!

‘হ্যাঁ, আজাদ ভাই, ওকে আমি কখনো ঘুমাতে দেখি না, দিনরাত সব সময় দেখি ও জেগে আছে।’

সামনে ঝুলে থাকা পর্দার দিকে ৩০ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে আজাদ বললেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিষয়ে কিছু বলা বা মন্তব্য করা ঠিক হবে না, বিষয়টা খুবই জটিল।’ নিজের ডেস্কে ফিরে গেল আশফাক! হঠাৎ আশফাককে ইশারায় কাছে ডাকলেন আজাদ  — ‘আজ রাতে একটু খেয়াল করে দেখবে না ঘুমিয়ে তোমার বউ কী কী করে-তবে এটা যেন সে বুঝতে না পারে।’

অফিস থেকে ফিরে অন্য দিনের মতো আজও হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয় আশফাক। রিনির মুখোমুখি বসে চা খায়, কথা বলে। বেশি ঘনিষ্ঠ হয়। কারণ আজ রাতে সে রিনির দিকে লক্ষ রাখবে। আজকের চায়ের স্বাদটা অন্য রকম। কেমন চকোলেট চকোলেট সুগন্ধ। আশফাক বলে,

‘চায়ের স্বাদটা অন্য দিনের চেয়ে আলাদা।’

‘খারাপ? জানতে চায় রিনি।’

‘না, না, খারাপ না, খুব টেস্টি।’

‘আর এক কাপ দিই?’

‘হবে?’

মাথা নাড়ে রিনি, হবে। আর এক কাপ চা আনে সে। চায়ে মুখ দিয়ে আশফাক চমকে ওঠে, ‘এই চা-টা আরো মজা। ব্যাপার কী! আগে তো এত মজার চা খাইনি!’ রিনি একটু হাসল -‘ওটা ওভালটিনের গন্ধ, বুঝতে পারোনি?’ আশফাকের মনে হলো রিনি ওভালটিন পেল কোথায়? সে তো ওভালটিন কেনেনি! হঠাৎ রিনি বলল, ‘আমাকে একটা ক্যামেরা কিনে দেবে?’

‘ক্যামেরা! ক্যামেরা দিয়ে কী করবে?’

‘ওমা, ক্যামেরা কী দিয়ে করে মানুষ! ছবি তুলব।’ রিনি হাসে। — ‘দেবে তো?’

আশফাকের মনে পড়ে গেল আজ রাতে সে রিনির দিকে খেয়াল রাখবে। সে বলল, ‘ছবি তুলবে, কিন্তু কোথায়, কিভাবে?’

‘ভোরবেলা জানালার ধারের গাছটাতে অনেক পাখি আসে, কিচিরমিচির শব্দ করে, ওদের ছবি তুলব।’

‘পাখি, আমি তো দেখতে পাই না?’

‘তুমি দেখবে কী করে, তুমি তো সকালে ঘুমাও। তারপর অফিসে যাও।’

‘আচ্ছা, একটা ক্যামেরা কিনে দেব।’

‘দেবে তো?’ রিনি আবদার করে, ‘দিতে হবে কিন্তু, আচ্ছা।’

রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে দুজন। বিছানায় গেলে দুজন দুজনকে উজাড় করে দেয়। ভালোবাসার কমতি নেই কোথাও। সংসারের সব দায়িত্ব পালন করে রিনি। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবারটা রেডি করে দেওয়া, রাতের খাবার প্লেটে তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুই করে। নিজের হাতে আশফাকের জামা-কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে ইস্ত্রি পর্যন্ত করে দেয়। শুধু একটা জায়গাতে শূন্যতা। রিনি ঘুমায় না!

ঘুমিয়ে গেল আশফাক। না ঘুমিয়ে রিনি কী করে সেটা লক্ষ করতে বলেছেন আজাদ, সেটা ভুলে গেল সে।

মাঝরাতে ঝনাৎ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আশফাকের। সমস্ত ঘর অন্ধকার। বিছানায় নেই রিনি! কেন ঘর অন্ধকার! রিনি পাশে নেই কেন? কিসের শব্দ! হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া আশফাক কিছুই বুঝতে পারে না। রিনি বলে ডাকতে গিয়ে থেমে যায় সে। আবুল কালাম আজাদের কথা মনে পড়ে গেল। রিনিকে বুঝতে না দিয়ে সব কিছু লক্ষ করতে বলেছেন আজাদ! কিন্তু এই অন্ধকারে কোথায় গেল রিনি? বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আশফাক। অন্ধকারে রিনিকে না ডেকে কোথায়, কিভাবে তাকে দেখবে সে! হতবুদ্ধি আশফাক দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পাশের ঘরে শব্দ হলো। কেউ কিছু টানল! সেদিকে এগিয়ে গেল আশফাক। খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবল। একজন মানুষ ঘুমায় না, না ঘুমিয়ে সে কী করে, সেটা দেখার জন্য এই মাঝরাতে লুকিয়ে লুকিয়ে …এসব কী করছে আশফাক! কিন্তু রিনি তার স্ত্রী, এটা দেখা তার কর্তব্য। সে কেন ঘুমায় না বা ঘুমাতে পারে না। আবার খসখস শব্দ! খুব নিচু গলায় গান গাইছে রিনি-আকাশ ভরা সূর্য-তারা…। হ্যাঁ, রিনিই গাইছে। নাকি অন্য কেউ! চারপাশে আঁধার আর মৌনতা। মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আশফাক! সে ঘরের ভেতর তাকায়। অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই সেখানে! পেছনে ফিরে এসে বাথরুমের সুইচ অন করে। বুঝে ফেলে বিদ্যুৎ নেই। আবার দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ টেবিলের ওপর ল্যাম্পটা জ্বলে উঠল। পাশে বসে আছে রিনি। বিদ্যুৎ এলে চারপাশে কেমন একটা কোলাহল মূর্ত হয়ে ওঠে। চারপাশের মৌনতা ভেঙে যায়। রিনি উঠে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে একটা পেনসিল। মুখোমুখি দুজন, নির্বাক। আশফাক দেখল টেবিলের ওপর একটা বড় খাতা। ছবি এঁকেছে রিনি! সাদা পৃষ্ঠার ওপর একটা গাছের ডাল আর সবুজ পাতার মাঝখানে একটা টিয়া পাখি। মৌনতা ভাঙল রিনির-‘স্যরি, তুমি রাগ করেছ?’ আশফাক যখন কিছুই বলল না, তখন রিনি আবার বলল-‘লাল পেনসিলটা খুঁজে পেলাম না, দেখো ঠোঁটটায় রং দিতে পারিনি।’ রিনির আঁকার হাত এত ভালো এটা জানত না আশফাক। সে ভেবে পাচ্ছে না কী বলবে রিনিকে। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাল আশফাক, রাত ২টা! ‘অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড়ো।’ আশফাক বলল।

পাশে শুয়ে রিনি। ভাবছে আশফাক। রাত ২টার সময় না ঘুমিয়ে পাখির ছবি আঁকছে রিনি! কিছুই বুঝতে পারে না সে। স্বাভাবিক মানুষ এমন করে? নাকি অন্য কিছু করছিল রিনি! আশফাকের উপস্থিতি বুঝতে পেরে ছবির খাতা বের করে অভিনয় করে গেল! আজাদ বলেছেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিষয়টা জটিল! আসলে বিষয়টা জটিল, না রহস্যময়! কার কাছে গেলে এসবের উত্তর পাবে? হঠাৎ আশফাক আলতোভাবে রিনির গায়ে হাত রেখে বলল — ‘ঘুমিয়েছ?’ কিছুই বলল না রিনি। মনে হলো সে ঘুমিয়ে গেছে।

অফিসে যেতেই আবুল কালাম আজাদ জানতে চাইলেন,

‘কী খবর, যা বলেছিলাম করেছ?’

আশফাক বলল-‘কোন খবর আজাদ ভাই?’ রিনির কথা ভাবতে ভাবতে আজাদের কথা ভুলেই গিয়েছিল আশফাক।

‘এক রাতের মধ্যে ফিলোসোফার হয়ে গেলে, আশ্চর্য!’

আশফাকের মনে পড়ে গেল সব কিছু — ‘ভাই, বিষয়টা কাউকে বলবেন না প্লিজ।’

‘আরে না, না, কি হলো তাই বলো।’

‘গভীর রাতে উঠে সে টিয়া পাখির ছবি আঁকছিল।’

‘টিয়া পাখির ছবি আঁকছিল!’

‘হ্যাঁ।’ আশফাকের কথা শুনে বোকা বনে গেলেন আবুল কালাম আজাদ, টিয়া পাখির ছবি!

‘আচ্ছা ,কথাবার্তা অস্বাভাবিক ছিল বা অন্য কিছু, যা তোমার চোখে পড়েছে?’

‘না, তেমন কিছুই না, শুধু পাখির ছবি আঁকা।’

‘একটু ভেবে দেখ?’

‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে, নিচু স্বরে গান গাইছিল।’

‘কোন গান?’

‘আকাশ ভরা সূর্য-তারা…।’

‘অফিস শেষে দেখা করো, কথা বলব।’ খুব সিরিয়াসলি বললেন আবুল কালাম আজাদ।

‘ঠিক আছে ভাই।’

আবুল কালাম আজাদ মানুষ হিসেবে ভালো। একজনের কথা অন্যজনকে বলেন না। আশফাকের ধারণা, বিকেলে আজাদ ভাই ভালো কিছু একটা বলবেন।

বিকেলে আজাদ নিজেই ডেকে নিয়ে বসতে বললেন আশফাককে-

‘লাঞ্চের সময় তোমার স্ত্রীর বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক ভেবে দেখলাম। মোটামুটি একটা সলিউশনও পেয়ে গেছি।’

‘কেমন?’ জানতে চাইল আশফাক।

‘আসলে তোমার বউ সারা দিন ঘরে বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছে। ছোট সংসার অল্প কাজ। কম সময়ে হয়ে যায়। হাতে কাজ না থাকলে মানুষ যা করে আর কী, উদ্ভট সব চিন্তাভাবনা চলে আসে মাথার ভেতর।’

‘তাহলে আমি কী করব বলেন?’

‘শোনো, আমি বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি। তুমি এক কাজ করো।’

‘কী কাজ?’

‘অফিস থেকে ফেরার সময় খাঁচাসহ একটা সুন্দর লাল ঠোঁট টিয়া পাখি কিনে নিয়ে যাবে।’

‘কেন, টিয়া পাখি কেন?’

‘যা বলছি শোনো।’

‘বলেন।’

‘তাকে বলবে পাখিটাকে খুব যত্ন করতে। ঠিক সময়ে খাবার দিতে, গোসল করাতে, আর অবসর সময়ে কথা বলা শেখাতে বলবে। এতে হবে কী, সে আগের উদ্ভট চিন্তাগুলো ভুলে গিয়ে পাখি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। দেখবে, তখন রাতে ঠিকই ঘুমাচ্ছে।’ ‘আইডিয়াটা মন্দ না আজাদ ভাই। একটা পাখি কিনে নিয়ে যাব আজ।’ আজাদ বললেন — ‘সোজা কাঁটাবন চলে যাবে, ওখানে সব ধরনের পোষা পাখি-পায়রা, খরগোশ বিক্রি হয়, টিয়া পাখিও পাবে।’

কাঁটাবনে রাস্তার পাশে সারি সারি পশু-পাখির দোকান। অনেক দেখেশুনে আশফাক একটা লাল ঠোঁট টিয়া পাখি পছন্দ করল। খাঁচাসহ পাখির দাম পড়ল ৭০০ টাকা। পাখিটা যেমন সুন্দর, খাঁচাটাও তেমন আঁটসাঁট ও পরিপাটি! খুব খুশি হয়ে পাখিটা নিয়ে ঘরে ফিরল আশফাক। স্বামীর হাতে ঝোলানো খাঁচার ভেতর টিয়া পাখি দেখে আশ্চর্য হলো রিনি। অবাক হয়ে তাকাল আশফাকের দিকে! আশফাক বলল-‘নিয়ে এলাম, খুব সুন্দর লাল ঠোঁট টিয়া, দাম বেশি না, একটু যত্ন-আত্তি করলে কথা বলবে।’

‘ঠিক আছে যাও, আগে হাত-মুখ ধুয়ে রেস্ট নাও, আমি চা আনছি।’ পাখির খাঁচাটা বারান্দার তারে ঝুলিয়ে রেখে রিনি কিচেনে ঢুকে পড়ল। রিনি খাঁচা এবং পাখির ব্যাপারে কোনো আগ্রহ না দেখানোয় বোকা বনে গেল আশফাক। তবে আশা ছাড়ল না। চা খেতে খেতে আশফাক বলল-‘খুব ভালো জাতের টিয়া, একটু পরখ করে দেখো, অসম্ভব সুন্দর, ঠোঁটটা লাল টকটকে, গলায় নীল কণ্ঠহার, দেখো খুব তাড়াতাড়ি কথা বলবে। তবে যত্ন করতে হবে। ঠিকমতো গোসল করাতে হবে, খাওয়াতে হবে। কয়েকটা কলা দিল লোকটা, বলল, খাঁচার ভেতরে দিলে ও নিজেই খেতে পারবে।’

টিয়া পাখিটা কিনে দিতে পেরে খুব ভালো লাগছে আশফাকের। পাখিটাকে কিভাবে নিল রিনি! ক্যামেরার দাম অনেক। বুঝিয়ে বলবে রিনিকে, দু-এক দিন পর কিনে দেব। রিকশা থেকে নেমে দ্রুত বাসার দিকে হাঁটতে থাকে আশফাক। ডোরবেলে হাত রাখল। ঘরের ভেতর বেল বাজার শব্দ শুনতে পেল। এক মিনিট দাঁড়িয়ে আছে অথচ দরজা খুলল না রিনি! আবার বেল টিপল। আগে কখনো এমন হয়নি। বেল বাজতেই দরজা খুলেছে সে। দরজা খুলল রিনি। হাসিমুখে ঘরের ভেতর ঢুকে আশফাক জিজ্ঞেস করল — ‘পাখিটা কেমন আছে?’ রিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলল — ‘বসো তুমি ক্লান্ত, রেস্ট নাও, সব বলছি।’ আশফাক না বসে সোজা বারান্দায় চলে গেল। দেখল তারে ঝুলছে খাঁচা অথচ ভেতরে টিয়া পাখিটা নেই। শূন্য খাঁচার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল আশফাক! মনে হলো একটু আগে কেউ হাত দিয়েছিল খাঁচায়। ওটা দুলছে।

‘পাখি! পাখিটা কোথায় গেল রিনি!’ পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল রিনি, সে বলল, —

‘প্লিজ, তুমি রাগ করো না, এত কষ্ট করে, এত দাম দিয়ে পাখিটা কিনে আনলে অথচ সে উড়ে গেল!’

‘উড়ে গেল, উড়ে গেল কিভাবে!’

‘দুপুরবেলা ভীষণ গরম পড়ছিল। গোসল করানোর জন্য রেডি হচ্ছি, খুব ছটফট করছিল পাখিটা। হঠাৎ খাঁচার দরজার লোহার কাঠিটা পড়ে গেল, মুহূর্তের ভেতর উড়ে গেল পাখিটা, আমি কোনো কিছু বোঝার আগেই! কী করব বলো?’ আশফাক রিনির চোখের দিকে তাকাল। অনেক প্রশ্ন তার চোখে। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না।

পরদিন অফিসে মন খারাপ করে বসেছিল আশফাক। আজাদ বললেন —

‘তুমি একটা কাজ করো।’

‘কী কাজ?’

‘একজন মনোচিকিৎসককে দেখাও।’

‘আমি তো এ ধরনের কোনো চিকিৎসকের নাম জানি না আজাদ ভাই।’

‘সেন্ট্রাল হসপিটালের দক্ষিণে বসেন প্রফেসর মাহমুদা খানম, খুব বড় মনোবিজ্ঞানী, একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তাঁকে দেখাও।’

‘না থাক, যেমন আছে তেমন থাক, না ঘুমালে না ঘুমাক।’

‘শোনো, মানসিক রোগীর চিকিৎসা প্রথম দিকে না করালে পরে পস্তাতে হবে। কেন সে এমন করছে, সেটা জানা জরুরি, তোমার কি মনে হয়?’ আজাদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল আশফাক, তারপর বলল — ‘ঠিক আছে যাব।’

অনেক অপেক্ষার পর শেষ পর্যন্ত মনোচিৎিসক মাহমুদা খানমের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল। দুপুরের খাওয়া শেষ হলে আশফাক বলল —

‘রিনি, আজ বিকেলে তোমাকে নিয়ে ডাক্তার মাহমুদা খানমের কাছে যাব।’

‘তোমার মনে হচ্ছে আমি অসুস্থ?’

‘না, তা মনে হচ্ছে না।’

‘তাহলে কেন যাব!’ রিনি হাসল।

‘তোমার ঘুম হয় না, সে জন্য।’

‘ঘুম হয় না সে জন্য, বেশ যাব, কখন বের হতে হবে বলো?’

‘ঠিক ৫টায়।’

‘শাড়ি, না সালোয়ার-কামিজ, কী পরব?’

‘শাড়ি, আকাশি রঙেরটা।’

‘বেশ তাই হবে।’

রিনির এমন সহজ-সরলভাবে সম্মতি দেওয়া আশফাকের মনে দুর্বোধ্য এক অজানা আশঙ্কার জন্ম দেয়। রিনিকে সে বুঝতে পারে না কিছুতেই! সে কি সত্যিই মানসিক রোগী!

রিনির সাক্ষাৎকার নিলেন মনোচিকিৎসক প্রফেসর মাহমুদা খানম।

‘আপনার নাম বলুন?’

‘রিনি হাসান।’

‘বাবার নাম?’

‘আবুল হাসান।’

‘স্বামী?’

‘আশফাক আহমেদ।’

‘আজ তারিখ কত?’

‘৬ জুন, দুই হাজার পনেরো।’

‘আপনার জন্মস্থান কোথায়?’

‘কুষ্টিয়া।’

‘গ্রামে, না শহরে?’

‘শিলাইদহের শালবন মহুয়া গ্রামে।’

‘খুব সুন্দর নাম আপনার গ্রামের। আপনার মা-বাবা ও অতীত সম্পর্কে কিছু বলুন তো?’ রিনি সোজা হয়ে বসে বলল, ‘সব বলব ম্যাডাম?’

‘বলুন।’

‘আমার বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ৫০ বছর পর্যন্ত সুস্থ ছিলেন। একদিন স্কুলে চার-পাঁচটা চমচম খেয়ে বাবা বললেন, মাথা ঘুরছে। বাবা মাটিতে পড়ে গেলেন। ডাক্তার বললেন, উনার ডায়াবেটিস হয়েছে, খুব বেড়ে গেছে। কয়েক বছর পর বাবা অন্ধ হয়ে গেলেন। চোখে কিছুই দেখতে পেতেন না। খালি কাঁদতেন। মহুয়া গ্রামে শুধু গাছ আর গাছ, পাখি আর পাখি। বাবা কাঁদতেন আর বলতেন, মা, আমার কী শাস্তি হলো, সুন্দর দুনিয়ার কিছুই দেখতে পাই না আর।

‘দেখুন রিনি, গতকাল বিকেলে এসে আপনার স্বামী আমার সহকারী ডাক্তারের কাছে অনেক কথা বলে গেছেন, ওগুলো এখন আমার হাতে, আপনি নাকি মোটেও ঘুমান না, কেন ঘুমান না?’

‘একদিন বাবা উঠোনে বসেছিলেন। তখন পাশের গাছে বসে একটা পাখি ডাকছিল খুব সুর করে, বাবা তখন হু হু করে কাঁদছিলেন। বললাম, কাঁদছ কেন বাবা? বাবা বললেন, পাখিটা কী সুর করে গান গাইছে আর উড়ে উড়ে সারা দুনিয়া দেখে বেড়াচ্ছে, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না মা।’

‘আপনি ঘুমান না কেন, সেটা বলুন?’ ডাক্তার জানতে চাইলেন।

‘দুনিয়াটা কত আনন্দের, কত সুন্দর, আমি যদি সব সময় ঘুমিয়ে থাকি, তাহলে এসব দেখব কী করে?’ হঠাৎ প্রফেসর মাহমুদা খানম উঠে দাঁড়ালেন। পাশের বুকশেলফ থেকে দুটো বই বের করে রিনির হাতে দিয়ে বললেন, ‘অবসর সময়ে পড়বেন কেমন, আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ, যান আপনার হাজব্যান্ডকে পাঠিয়ে দিন।’

আশফাক চেম্বারে ঢুকে দেখল ডাক্তার মাহমুদা খানম খসখস শব্দে দ্রুত প্রেসক্রিপশন লিখছেন। তাকে চেয়ারে বসতে বললেন ডাক্তার। আশফাকের হাতে প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে বললেন — ‘ওষুধগুলো ঠিকমতো খাবেন, নিচে পরামর্শ দেওয়া আছে ওগুলো মেনে চলবেন আর তিন মাস পর দেখা করবেন।’ প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিল আশফাক। রোগীর নামের জায়গাতে আশফাক আহমেদ লেখা দেখে সে বলল, ‘একটু ভুল হয়েছে ম্যাডাম, পেসেন্টের নাম রিনি হাসান।’ সরাসরি আশফাক আহমেদের চোখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার মাহমুদা খানম বললেন, ‘আমার ভুল হয়নি, পেসেন্ট রিনি হাসান নন, আপনি।’ ডাক্তারের দিকে তাকাল আশফাক। ডাক্তারকে আরো কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল সে। হাতের প্রেসক্রিপশনটাকে ভীষণ ভারী মনে হলো তার।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন