রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের দুই প্রধান কান্ডারি — দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) এবং কেশবচন্দ্র সেন। প্রথম দিকে দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্রের মধ্যে ছির দারুণ সখ্য। ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা সভায় তাঁরা বসতেন পাশাপাশি। কিন্তু ১৮৭০-এর দশকে তাঁদের দুজনের সম্পর্কে চিড় ধরে। ব্রাহ্ম হলেও দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন অনেকটা প্রাচীনপন্থী। হিন্দুধর্মের আচার-অনুষ্ঠান অনেকটাই পালন করেন তিনি, ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেন হিন্দুমতে, ব্রাহ্মণদের উপবীত ধারণে অনুমতি দেন। পক্ষান্তরে কেশবচন্দ্র অনেক বেশি আধুনিক ও বিপ্লবী। ব্রাহ্মধর্মকে তিনি হিন্দুধর্ম থেকে একেবারে আলাদা করতে চান। তাঁর মতে, ব্রাহ্মরা অ-হিন্দু। হিন্দুধর্মের সকল প্রচার কুসংস্কারমূলক আচার-অনুষ্ঠান বর্জনের তিনি পক্ষপাতী। ক্রমে এই দুই ব্রাহ্ম-নেতার বিরোধ ধারণ করে চরম রূপ। এসময় ব্রাহ্ম ধর্মসভায় নারীদের প্রকাশ্য স্থানে উপাসনা করার পক্ষে ও বিপক্ষে মত প্রকাশে দেখা দেয় নতুন বিতর্ক। এ বিতর্কের সূত্র ধরেই ১৮৭৮ সালে ভেঙে যায় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ। এ সময় শিবনাথ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৭৮)। অন্যদিকে কেশবচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৭৮)। দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ছিল ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রী এসময় পালন করেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাঁর নেতৃত্বগুণে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ দ্রুত কলকাতার সমাজজীবনে প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়। ধর্ম প্রচার ছাড়াও সমাজ সংস্কার ও রাজনৈতিক সংস্কার ছিল সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রধান কর্মসূচি। সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে শিবনাথ শাস্ত্রী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ প্রচার করেন।
ইতোপূর্বেই শিক্ষাব্রতী হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রীর খানিকটা পরিচয় আমরা জেনেছি। এ প্রসঙ্গে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সিটি স্কুলের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল উত্তরকালে সিটি কলেজে রূপান্তরিত হয়। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে উনিশ-বিশ শতকের বহু আলোকিত মানুষ বিদ্যা লাভ করেন। সিটি স্কুল প্রতিষ্ঠায় শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু আনন্দমোহন বসু এবং সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর সহযোগ লাভ করেন। অভিন্ন উদ্দেশ্যে এঁরা প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্টুডেন্ট সোসাইটি’ (১৮৭৯)। বস্ত্তত এটিই হলো ভারতবর্ষের প্রথম ছাত্রসংগঠন।
১৮৮৮ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী ইংল্যান্ড গমন করেন। ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডের সমাজকে তুলনামূলক দৃষ্টিতে বিচার করার মানসেই তাঁর বিলেত গমন। ছয় মাস তিনি বিলেতে প্রবাসজীবন যাপন করেন। এ সময় তিনি ইংল্যান্ডের নানা স্থানে ভারতবর্ষের সমাজ ও সংস্কৃতি, বিশেষত ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ে বহু বক্তৃতা দেন এবং অর্জন করেন প্রচুর প্রশংসা। ইংল্যান্ড ভ্রমণ শিবনাথ শাস্ত্রীর মনে গভীর রেখাপাত করে। ইংরেজদের মধ্যে তিনি লক্ষ করলেন বহু সদ্গুণ। দেশে প্রত্যাবর্তন করে ওই সদ্গুণের চর্চা করার মানসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাধনাশ্রম’ (১৮৮৯)। জনগণের মধ্যে উচ্চ আদর্শ ও সদ্গুণ প্রচারে সাধনাশ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখক হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রীর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। সমাজ সংস্কারমূলক বিচিত্র কাজে ব্যস্ত থাকলেও তিনি সাহিত্যসৃজনেও ছিলেন সমান উৎসাহী ও আন্তরিক। তাঁর লেখা কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ইতিহাস, আত্মজীবনী বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। শিবনাথ শাস্ত্রী যেসব কাব্য প্রকাশ করেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – নির্বাসিতের বিলাপ (১৮৬৮), পুষ্পমালা (১৮৭৫), হিমাদ্রি কুসুম (১৮৮৭), পুষ্পাঞ্জলি (১৮৮৮), ছায়াময়ী পরিণয় (১৮৮৯) ইত্যাদি। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা শিবনাথ শাস্ত্রীর কবিতার বিশিষ্ট লক্ষণ। সহজ-সরল হৃদয়বাণী গুণে শিবনাথের কবিতা সমকালে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। তাঁর লেখা ‘আজি শচীমাতা কেন চমকিলে/ ঘুমাতে ঘুমাতে উঠিয়া বসিলে।’ — পঙ্ক্তিদ্বয় তখনকার প্রতিটি ছাত্রের মুখে-মুখে উচ্চারিত হতো।
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় শিবনাথ শাস্ত্রীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। একটি বিশিষ্ট আদর্শ তাঁর ঔপন্যাসিক চেতনায় সর্বদা থেকেছে ক্রিয়াশীল। নারীজীবনকে তিনি সমাজে-সংসারে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন স্বমহিমায়। প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয়ে না দেখে সামাজিক লৈঙ্গিক দৃষ্টিকোণে নারীকে বিবেচনার প্রাথমিক আভাস শিবনাথ শাস্ত্রীর উপন্যাসে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শিবনাথ শাস্ত্রীর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে আছে মেজবৌ (১৮৭৯), নয়নতারা (১৮৮৯), যুগান্তর (১৯১৫), বিধবার ছেলে (১৯১৬) ইত্যাদি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তাঁর যুগান্তর উপন্যাস থেকেই উত্তরকালীন বিখ্যাত সংবাদপত্র যুগান্তরের নামকরণ করা হয়েছিল। উপন্যাসে ভাষা-ব্যবহারে শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন অতিসতর্ক। কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কথ্যভাষা ব্যবহার তাঁর উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের বিকাশের ধারায় শিবনাথ শাস্ত্রীর অবদান যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এখনো মূল্যায়িত হয়নি।
প্রাবন্ধিক হিসেবেও শিবনাথ শাস্ত্রী রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। সমাজ সম্পর্কে প্রগতিশীল দৃষ্টিই তাঁর প্রবন্ধ-সাহিত্যের উপজীব্য বিষয়। হিন্দু ধর্মের নানামাত্রিক কুসংস্কার থেকে তিনি সমাজকে মুক্ত করার মানসে একের পর এক প্রবন্ধ লিখেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হচ্ছে — এই কি ব্রাহ্ম বিবাহ? (১৮৭৮), খৃষ্টধর্ম (১৮৮১), জাতিভেদ (১৮৮৪), বক্তৃতা স্তবক (১৮৮৮), মাঘোৎসব উপদেশ (১৯০২), মাঘোৎসব বক্তৃতা (১৯০৩), প্রবন্ধাঞ্জলি (১৯০৪), ধর্মজীবন (১৯১৬) ইত্যাদি। ব্রাহ্মধর্মের তিন প্রধান তাত্ত্বিকের জীবনী লিখেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী। তাঁর জীবনীগ্রন্থগুলো হচ্ছে রামমোহন রায় (১৮৮৫), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ G(১৯১০) এবং ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র (১৯১০)। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী আত্মচরিত। তাঁর আত্মচরিত পাঠ করলে গোটা উনিশ শতক পাঠকের চোখে ভেসে উঠবে। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর কালজয়ী গ্রন্থ রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, যা ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবে উত্তরকালে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইংরেজি ভাষাতেও শিবনাথ শাস্ত্রী কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য ইংরেজি গ্রন্থ — History of the Brahma Samaj (১৮৮৮) এবং Men I have seen (১৮৯৯)।
১৯১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শিবনাথ শাস্ত্রী কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজ-সংস্কারক, পন্ডিত এবং ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হিসেবে তিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। সমাজ উন্নয়নের ধারায় তাঁর অবদান আজো গভীয় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
তিন
সূচনা-সূত্রেই ব্যক্ত হয়েছে যে, রামতনু লাহিড়ী এবং উনিশ শতকী বাঙালির নবজাগরণকে সমান্তরাল দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে শিবনাথ শাস্ত্রী রচনা করেছেন রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ। রামতনু লাহিড়ীর ব্যক্তিজীবন উপস্থাপন সূত্রে শিবনাথ শাস্ত্রী এই গ্রন্থে নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন উনিশ শতকী উন্মথিত বাঙালির জাগরণ-ইতিহাস। কেবল উনিশ শতকী সমাজ নয়, সমকালীন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কেও এখানে পাওয়া যাবে শিবনাথ শাস্ত্রীর বিশ্লেষণাত্মক মূল্যায়ন। গ্রন্থটি কেবল উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকিত মানুষ রামতনু লাহিড়ীর জীবনেতিহাস নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে ওই শতকের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও রেনেসাঁস-আন্দোলনের ঐতিহাসিক এক দলিল। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় শিবনাথ শাস্ত্রীর নিম্নোক্ত ভাষ্য :
…অগ্রে ভাবিয়াছিলাম বিশেষভাবে তাহার [রামতনু লাহিড়ী] অনুরক্ত ব্যক্তিগণের জন্য একখানি ক্ষুদ্রাকার জীবনচরিত লিখিব।… অতএব, প্রথমে তদ্নুরাগী লোকদিগের জন্যই লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম। কিন্তু তৎপরে মনে হইল, লাহিড়ী মহাশয়ের যৌবনের প্রথমোদ্যমে রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার ও ডিরোজিও, নব্যবঙ্গের এই তিন দীক্ষাগুরু তাঁহাদিগকে যে মন্ত্রে দীক্ষিত করেন, সেই মন্ত্রের প্রভাবেই বঙ্গসমাজের সবর্ববিধ উন্নতি ঘটিয়াছে; এবং সেই প্রভাব এই সুদূর সময় পর্যন্ত লক্ষিত হইতেছে। আবার সেই উন্নতির স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেন, অগ্রসর হইয়া অত্যগ্রসর দলের সঙ্গে মিশিয়াছেন, এরূপ দুই একটি মাত্র মানুষ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে লাহিড়ী মহাশয় একজন। অতএব, তাঁহার জীবনচরিত লিখিতে গেলে, বঙ্গদেশের আভ্যন্তরীণ ইতিবৃত্তকে বাদ দিয়া লেখা যায় না। তাই বঙ্গদেশের আভ্যন্তরীণ সামাজিক ইতিবৃত্তের বিবরণ দিতে প্রবৃত্ত হইতে হইল। ৩ (ক্রমশ)