ভাবাদিঘি এলাকার মানুষজন আবার এলাকায় মিছিল করে বিক্ষোভ দেখালেন। দিঘি বাঁচাও কমিটির উদ্যোগে এই মিছিল অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। বিভিন্নভাবে রটিয়ে দেওয়া হয় ভাবাদিঘি এলাকা প্রশাসন দখল নিয়ে মাটি ফেলবে। রেলের কন্ট্রাক্টরদের কাজ করতে সুযোগ করে দেবে। দীর্ঘদিন ধরে এই রটনার জেরে শেষ পর্যন্ত আর বসে থাকতে না পেরে ভাবাদিঘি এলাকার মানুষজন বুধবার পোস্টার নিয়ে মিছিল করেন এলাকা জুড়ে। এমনকি রাতারাতি যাতে কাজ শুরু হয়ে যায় তা রুখতে রুটিন অনুযায়ী ভাবাদিঘিতে পাহারা শুরু হয়েছে।
তারকেশ্বর থেকে বিষ্ণুপুর দীর্ঘ ৮২ কিলোমিটার রেলপথ তৈরির ছাড়পত্র দিয়েছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রি তথা বর্তমানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তী সময়ে এই কাজ দ্রুত শেষ করতে কংগ্রেসের আমলে রেল মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্রুত কাজ শেষ করতে তৎপর হন। রাজ্যে ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। ওই সময় তারকেশ্বর থেকে আরামবাগ দ্রুত কাজ শেষ করতে নির্দেশ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাওয়ায় রেলমন্ত্রী করে দেওয়া হয় মুকুল রায়-কে। এরপর ২০১২ সালের ৪ জুন তারকেশ্বর থেকে আরামবাগ রেলপথের সূচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রেলমন্ত্রী মুকুল রায়। পরবর্তী ক্ষেত্রে অধীর চৌধুরী রেল প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময় আরামবাগ থেকে গোঘাট রেলপথের সূচনা হয়।
অপরদিকে বিষ্ণুপুর থেকে কিছুটা ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এরই মধ্যে গোঘাট থেকে কামারপুকুরের মধ্যে ভাবাদিঘির জট এসে যাওয়ায় থমকে যায় গোঘাট থেকে কামারপুকুর পর্যন্ত রেললাইন পাতার কাজ। অপরদিকে কামারপুকুর থেকে জয়রামবাটি যাবার ক্ষেত্রেও পশ্চিমপুর মৌজাতেও দাম নিয়ে সমস্যা হয়। যদিও পরবর্তী ক্ষেত্রে তা ঠিক হয়ে যায়। রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করে। রেলের কাজ শুরুর সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে মিছিল শুরু করে ভাবাদিঘির মানুষজন। সম্প্রতি এই মিছিলকে কেন্দ্র করে এলাকা সরগরম হয়। রেল দপ্তর সূত্রে খবর ভাবাদিঘির জমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। রাজ্য সরকার তা অধিগ্রহণ করে দেয়। দখলের দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। সবাই যেহেতু চেক নেয়নি তাই বিষয়টি রাজ্য সরকারকেই প্রয়োজনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাজ্য সরকার চাইলে রেল পথ হবে, না চাইলে হবে না। প্রসঙ্গত , বর্তমানে কোনো নির্বাচন নেই। তাই সামনের ২০২৬ এর বিধানসভা ভোটের লক্ষ্যে তৎপর রাজ্য সরকার। কারণ মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের অসুবিধা হবে এটা রাজ্য সরকার জাতীয় স্বার্থে বৃহত্তর কাজ করবে বলেই মনে করছে মানুষজন।
এদিকে জয়রামবাটি থেকে গোপিনাথপুর ময়নাপুর লাইনেও জোর কদমে কাজ চলছে।
উল্লেখ্য, আচমকা এলাকায় রটে যায় ভাবাদিঘির দখল নেবে পুলিশ ও রেল। রেললাইন পাতার কাজও শুরু করে দেওয়া হবে বলে এলাকায় খবর ছড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারী গ্রামবাসীরা পোস্টার নিয়ে মিছিল করেন গোটা ভাবাদিঘি জুড়ে। রাতভর দিঘি পাহারা দেওয়াও শুরু হয়েছে। তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর রেলপ্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে গোঘাটের ভাবাদিঘিতেই থমকে রয়েছে। বর্তমানে হাওড়া থেকে তারকেশ্বর এবং তারকেশ্বর থেকে গোঘাট পর্যন্ত রেল চলাচল করছে। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে ভাবাদিঘির জমি জটে আটকে রয়েছে রেলপ্রকল্প। ২০১৭ সালে ফের রেল জমি দখল করতে গেলে ভাবাদিঘি বাঁচাও কমিটির সঙ্গে প্রশাসনের তীব্র বিরোধ বাধে। সংঘর্ষে রক্তও ঝরেছে। এর পর থেকেই আন্দোলনের জেরে থমকে যায় সব কিছু। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভাবাদিঘি নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আন্দোলনে নামে। আইনি জটিলতার ফলে আপাতত বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। সেখানেই গ্রামবাসী ও কমিটির প্রশ্ন, বিচারাধীন প্রকল্পে কী ভাবে জমি দখল করতে পারে রেল? বর্তমানে ভাবাদিঘির পশ্চিমপাড় থেকে কামারপুকুর স্টেশন পর্যন্ত লাইন পাতার কাজ শেষ হয়েছে। কামারপুকুর স্টেশনও তৈরি। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের দিক থেকেও জোরকদমে জয়রামবাটি পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ চলছে।
আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দিলীপ পণ্ডিত বলেন, ‘গায়ের জোরে কাজ করতে এলে আমরা মরণপণ রুখে দেব। আমাদের একটাই দাবি ভাবাদিঘি বাঁচিয়ে, জল ও পরিবেশ রক্ষা করে লাইন পাতা হোক।’ ভাবাদিঘি বাঁচাও কমিটির সম্পাদক সুকুমার রায় বলেন, ‘রেল বা প্রশাসন কী করে এই অন্যায় কাজ করছে? ভাবাদিঘির উত্তরপাড় দিয়ে লাইন পাতা হোক। যে মানচিত্র ছিল সেই মানচিত্র অনুযায়ী লাইন হোক। নয়তো আমরা রুখে দেব।’ আন্দোলনে জড়িত মহিলা কৃষ্ণা খান, ঝর্ণা দাসের মতো অনেকেরই বক্তব্য, ‘আমরা মরব, তবু দিঘি ছাড়ব না।’ এ প্রসঙ্গে আরামবাগের সাংসদ মিতালি বাগ বলেন, ‘আমি এখন দিল্লিতে সংসদ অধিবেশনে আছি। ভাবাদিঘি নিয়ে আমি সংসদে যা বলার বলেছি। এখন কী হচ্ছে তা জানি না। আমাকে কেউ কিছু জানায়নি।’ যদিও পূর্বরেলের সিপিআরও কৌশিক মিত্র বলেন, ‘রাজ্য সরকার না চাইলে রেল কিছুই করতে পারে না। অতএব এই ধরনের খবরের কোনও ভিত্তি নেই।’
উল্লেখ করা যেতে পারে তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর রেল প্রকল্প চালু করতে গিয়ে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় গোঘাটের ভাবাদিঘিকে নিয়ে। স্থানীয় মানুষের দাবি ভাবাদিঘি বাঁচিয়ে রেললাইন পাতা হোক। এখানেই রেল বেঁকে বসে। থমকে যায় রেলের কাজ। স্থানীয় তৎকালীন তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক মানস মজুমদার সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসেন। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে বসে জট খোলার উদ্যোগ গ্ৰহণ করেন।
এ প্রসঙ্গে গোঘাটের তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক ও বিশিষ্ট নেতা মানস মজুমদার বলেন, মুখ্যমন্ত্রী পূর্বেই ভাবাদিঘীর মানুষের যে দাবি কোনোভাবে রেল লাইনের জন্য ভাবাদিঘির জল স্পর্শ করতে তারা দেবে না — সেই দাবীকে সম্মান জানিয়ে রেল দপ্তরকে এলাইনমেন্ট পরিবর্তন করা যায় কিনা অনুরোধ করেছিলেন। রেল এর উত্তরে জানিয়েছিল করা সম্ভব নয়। পূর্বে যে জায়গায় অ্যালাইনমেন্ট দেখিয়েছে রেল মুখ্যমন্ত্রী সেই জায়গা দিয়ে জমির ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু বিজেপি বলছে তারা ক্ষমতায় আসলে এলাইনমেন্ট পরিবর্তন করে দেবে। তার মানে প্রমাণ হয় ভাবাদিঘির সমস্যা রেল এবং বিজেপির সুপরিকল্পিত চক্রান্ত দ্বারা তৈরি। তাই ভাবাদিঘির মানুষের আবেগকে সম্মান জানিয়ে বলছি, অ্যালাইনমেন্ট পরিবর্তন করা যদি রেলের পক্ষে সম্ভব হয়, তাহলে যেখান থেকে পরিবর্তন করে যে জায়গা দেখাবে সেখান থেকেই জমির ব্যবস্থা করবে রাজ্য সরকার। যেভাবেই হোক রেললাইন পাতার কাজ সমাপ্ত হোক কামারপুকুর পর্যন্ত।