চাষিদের কাছে এখনও আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস বর্ষাকাল। আষাঢ় গত। শ্রাবণের শুরু। অধিকাংশ চাষি ধান রোপণের কাজ শুরু করতে পারেনি। মুখ্যত কারণ বৃষ্টির অভাব। একদিকে বীজ গড়ে উঠেনি। অপরদিকে জমিতে জলের অভাব। অথচ সময় চলে যাচ্ছে ধান রোপণের কাজ। এখনও পর্যন্ত যা বৃষ্টি হয়েছে রাজ্যের বেশিরভাগ জেলায় তার ঘাটতি। চিন্তিত চাষিরা। পরামর্শ দিতে চাষিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজ্যের কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
মূলত বৃষ্টির জলের উপর নির্ভর করে খরিফ মরশুমে আমন ধানের চাষ করা হয়। বৃষ্টি বেশ কম হওয়ার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে কখনও সখনও আমন ধানের চাষ করার জন্য সেচের জল সরবরাহ করার বিশেষ উদ্যোগ নিতে হয়েছে সরকারকে। কৃষিদপ্তরের এক কর্তা জানিয়েছেন, এখনও সেরকম পরিস্থিতি হয়নি। দক্ষিণবঙ্গের বেশির ভাগ এলাকায় এখনও স্বাভাবিকের থেকে ৫০ শতাংশের মতো কম বৃষ্টি হয়েছে। গত মাসে কয়েকদিনে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও তা ধানের চারা রোপণ করার জন্য যথেষ্ট নয় বলেই কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এরই মধ্যে আশার কথা শুনিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। নিম্নচাপের প্রভাবে আগামী শনিবার থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা। তার প্রভাবে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির মাত্রা বাড়তে পারে। ওই বৃষ্টির দিকে এখন তাকিয়ে আছেন কৃষিদপ্তরের আধিকারিক ও চাষিরা।
প্রসঙ্গত, সাধারণভাবে ১৫ আগস্টের মধ্যে ধানের চারা রোপণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। তারপরে আগস্ট মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়া করলে উৎপাদন অনেক কমে যায়। তখন ধানের বদলে বিকল্প ফসলের চাষ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কৃষিদপ্তর সূত্রের খবর, সেরকম পরিস্থিতিতে বিকল্প চাষ করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা তৈরি আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, জুলাই মাসের মধ্যে শ্রী ধানের চারা রোপণ করা সবথেকে ভালো। রোপণ করতে দেরি হলে ধান গাছে সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়। এই কারণে রোপণে দেরি হওয়ার মতো পরিস্থিতি হলে বীজতলাতে চারা গাছের বিশেষ পরিচর্যা করতে হয়। এজন্য চাষিদের পাশে থেকে সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছেন প্রতি কৃষি ব্লকের আধিকারিকরা। উল্লেখ্য, এবারে বর্ষায় মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ জেলায় ৪০ শতাংশ বৃষ্টিপাতের ঘাটতি, অন্যদিকে হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান, নদিয়া ইত্যাদি জেলাতে প্রায় ৫০ শতাংশ ঘাটতি রয়ে গিয়েছে। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় পরিমাণমতো বৃষ্টি হয়েছে, বাকি সমস্ত জেলাতেই বৃষ্টির ঘাটতি রয়ে গিয়েছে বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া দফতর। বৃষ্টির ঘাটতির ফলে ওই সমস্ত জেলাগুলিতে আমন চাষ কম হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে কৃষি বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বৃষ্টির ঘাটতির ফলে চাষ কিছুটা কম হলেও ধানের ফলন আশানুরূপ হবে। তবে চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, জমি ফেলে না রেখে বিকল্প চাষ করে লাভবান হওয়ার জন্য। উঁচু জমিতে যেখানে ধান চাষ হবে না বৃষ্টির অভাবে, সেখানে ডালশস্য অর্থাৎ মুগ, খেসারি, মুসুর, ছোলা, কড়াইয়ের চাষ হতে পারে। তাছাড়া সরষে, বাদাম চাষও হতে পারে। ওই সমস্ত বিকল্প চাষে খরচ কম, সেচ ও সার এবং ওষুধ লাগেও কম। ফলে স্বল্প দিনে চাষ করে আমনধানের সমান লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। এছাড়া যে সমস্ত চাষি এই সমস্ত বিকল্প চাষ করতেও আগ্রহী নন, তাঁদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সবজি চাষের। ঢ্যাঁড়শ, পটল, বেগুন, লঙ্কা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালং, নটে শাক ইত্যাদি সবজির চাষ করে উপযুক্ত আর্থিক লাভবান হতে পারেন চাষিরা।
এদিকে চাষিরা চিন্তিত এই কারণে যে, বর্ষায় উপযুক্ত বৃষ্টি না হওয়াতে ভূগর্ভস্থ জলে টান পড়বে। বর্ষাতেই ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্ষার পরই রবি চাষ চাষিদের কাছে অন্যতম অর্থকরী ফসল। এ সময় বেশিরভাগ সেচের জল নির্ভর করতে হয় ভূগর্ভস্থ জলের ওপর। বর্ষায় বৃষ্টি না হওয়াতে রবি চাষে জলে টান পড়তে পারে। তাছাড়া পরবর্তী গ্রীষ্মে বোরো ধান চাষে হয়তো ভূগর্ভস্থ থেকে জলই মিলবে না। তাই এখন থেকেই আশঙ্কা চাষিদের জলের অভাবে চাষ বন্ধ হবে না তো!
চাষিরা জানান, দক্ষিণবঙ্গে ধানের চারা রোপণ প্রক্রিয়া অনেকটাই পিছিয়ে আছে। বৃষ্টির পরিমাণ কিছুদিনের মধ্যে না বাড়লে এর জেরে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে।এ নিয়ে কৃষিদপ্তর বেশ চিন্তিত। কারণ চালের দাম এমনিতেই উর্ধ্বমুখী। পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদন কম হলে গোটা দেশেই পড়বে তার নেতিবাচক প্রভাব। কৃষি দপ্তর সূত্রের খবর, এবার গোটা রাজ্যে খরিফ মরশুমে ৪১.৮৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা করা হয়েছে। সেখানে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৫.৪৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধানের চারা রোপণ হয়েছে। উত্তরবঙ্গে বৃষ্টি অনেক বেশি হয়েছে। ফলে ধান চাষের প্রক্রিয়া সেখানে শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘এটা ঠিকই যে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি একটু কম হয়েছে। কিন্তু এখনও কিছুটা সময় আছে। আমরা সতর্ক। পরিস্থিতির উপরে নজর রেখেছি।’ কৃষিদপ্তরের এক শীর্ষ কর্তা জানিয়েছেন, ধানের বীজতলা তৈরির কাজ দক্ষিণবঙ্গেও মোটামুটি সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। বীজতলা থেকে ধানের চারা মূল চাষের জমিতে স্থানান্তরিত করার জন্য সেখানে বেশি পরিমাণে জল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বৃষ্টি কম হওয়ায় সেটা হচ্ছে না। এটাই চিন্তার বিষয়। কারণ বীজতলায় নির্দিষ্ট সময়ের বেশি ধানের চারা থেকে গেলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এতে উৎপাদনের হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও রাজ্য কৃষিদপ্তরের চুঁচুড়া চাল গবেষণা কেন্দ্রের প্রাক্তন কর্তা ডঃ পার্থ রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, এরকম পরিস্থিতিতে বীজতলায় ধানের চারার পরিচর্যা করার বিশেষ পদ্ধতি আছে। কৃষিদপ্তরের পরামর্শ নিয়ে চাষিদের সেসব ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। রাজ্যে প্রতি বছর আড়াই কোটি টনের বেশি ধান উৎপাদন হয়। এর মধ্যে দেড় কোটি টনের বেশি ধান উৎপাদন হয় খরিফ মরশুমে। মূলত বৃষ্টির জলের জেরে উপর নির্ভর করে খরিফ মরশুমে আমন ধানের চাষ করা হয়। বৃষ্টি বেশ কম হওয়ার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে কখনও সখনও আমন ধানের চাষ করার জন্য সেচের জল সরবরাহ করার বিশেষ উদ্যোগ নিতে হয়েছে সরকারকে। কৃষিদপ্তরের এক কর্তা জানিয়েছেন, এখনও সেরকম পরিস্থিতি হয়নি।