ছপ্পন মহল, মাণ্ডু
একটি সমাধিসৌধ। কার? কেউ জানে না। কিন্তু কবে এই সৌধ নির্মিত হয়েছিল, তার সময়কালও জানা নেই। ভিতরে সমাধিও আর নেই। তার বদলে এখানে মধ্যপ্রদেশ সরকার একটি মিউজিয়াম বানিয়েছেন।
তাহলে যাঁদের সমাধি এখানে একদা ছিলো, তাঁদের আত্মারা নিশ্চয়ই এতদিনে পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক রহিত করে স্বর্গালোকে চিরশান্তির দেশে বিরাজ করছেন!
অক্টোবরের পড়ন্ত বিকেলবেলায় বেরিয়েছিলাম ঘুরতে। বিভিন্ন ভাঙাচোরা ও পরিত্যক্ত সৌধ দেখতে দেখতে নির্জন মাণ্ডুকে অনেকখানি দেখা হয়ে গেল। রাস্তায় লোকজনের চলাচল খুব কম, কোথাও মানুষের কণ্ঠস্বর ও হৈ-হল্লা শোনা যায় না। সর্বত্রই শান্তি বিরাজমান। রাস্তায় কোনও টোটো-অটোরিকশা চলে না, তাই নিজেদের সঙ্গে গাড়ি না থাকলে পায়ে হেঁটে ঘুরতে হবে, যা আমাদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব ।
এসে দাঁড়ালাম ৫৬ মহলের সামনে। ১৩ ফুট উঁচু চাতালে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। বাম দিকে একটি প্রশস্ত কক্ষ আছে, যেখানে কয়েকজন কর্মচারী শুয়ে-বসে আছেন। ডানদিকে নিচুতে একটি আয়তাকার কক্ষ, সেখানে সুলতানি আমলে ভৃত্যরা থাকতেন কিংবা অতিথিরা এলে থাকতে পারতেন।
এদের ঠিক মাঝখানে উঁচু হয়ে আছে লাল রঙের স্যাণ্ডস্টোনে গড়া সমাধি স্তম্ভ কিংবা বলা ভালো মিউজিয়াম।
৫৬ মহল নামকরণের রহস্য কী?
বিক্রম সংবৎ ১৯৫৬ সালে এই সৌধের সংস্কার হয়েছিল। তাই এর নাম ছাপান্ন মহল।
সংবৎ ১৯৫৬ — সেটাই ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ।
অর্ধবৃত্তের মতো আর্চের ভিতর দিয়ে প্রবেশপথ। ভিতরে ঢুকে দেখি বেশ বড় চৌকো কক্ষ, দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে সাড়ে ৩১ ফুট (না, আমি মেপে দেখিনি !!!), সেখানে থরে থরে সাজানো আছে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি। মাণ্ডু ও পার্শ্ববর্তী ধার শহর ও সংলগ্ন ক্ষেত্র থেকে পাওয়া মূর্তিগুলো এখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
অনেকক্ষণ ধরে মূর্তিগুলো দেখলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখি, খোলা প্রাঙ্গণে অনেক মূর্তি ও পাথরে খোদিত শিল্পকলা রোদ-বৃষ্টি-বাতাস মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এক মহিলা সন্তের সমাধি, মাণ্ডু
সকালবেলায় টুরিস্ট লজে ব্রেকফাস্ট করে চলেছি জাহাজমহলের দিকে। কিন্তু টুরিস্ট লজ থেকে একটু এগিয়েই — রাস্তার বামদিকে, রাস্তা থেকে একটু দূরে, মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একটি সৌধ।
আমি ড্রাইভারকে বললাম, ছবি তুলবো?
— হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
— তাহলে একটু থামুন। …
আমি ভেবেছিলাম, ওই সরু মেঠোপথ ধরে হেঁটে যাবো।
ড্রাইভার বলল, নামবেন না, গাড়িটা ওখানে নিয়ে যাচ্ছি।
সরু পথ ধরে গাড়িটা এগিয়ে দাঁড়ালো সৌধের সামনে।
সামনে একটি বোর্ড লাগিয়ে রেখেছে মধ্যপ্রদেশ সরকার — Tomb of Roza. হিন্দিতে “রোজা কা মকবরা”— তারপর বন্ধনী চিহ্নের মধ্যে — “খদীজা বিবি কা রোজা”। যাঃ, আমার গুলিয়ে গেল, ভাবছিলাম এখানে সমাধির নিচে চিরশয্যায় শুয়ে আছেন জনৈকা রোজা — কিন্তু রোজা শব্দের অর্থ হয়তো সমাধি!
লেখা আছে, এটি এক মহিলা সুফি সন্ন্যাসিনী খাদিজা বিবির সমাধি। সেসময়ে ইনিই ছিলেন একমাত্র সন্ন্যাসিনী (সন্ত)।
বোর্ডে লেখা আছে, “গুলজার-ই-আবরার’ (Gulzar-i-Abrar) নামে একটি বইয়ে (বইয়ের নাম অবশ্য ভুল লেখা আছে), সেইসময়ের শত শত পীর-দরবেশ-সন্তদের তালিকায় ওই একটি মাত্র মহিলা সন্ত বা সন্ন্যাসিনীর নামের উল্লেখ আছে।
ভিতরে ঢুকে দেখলাম, পাশাপাশি চারটি সমাধি, দ্বিতীয় সারিতে আরও একটি। এসব সমাধি কাদের৷ কে জানে। শুনেছি বিশিষ্ট পির বা ধর্মগুরুর সমাধিকে অতি পবিত্র ভেবে, তাঁদের শিষ্য বা অনুসারীরাও সেই জায়গায় নিজেদের শেষ শয্যা পাতেন ।
দরজার সামনে একটি লোক অবনত হয়ে দুহাত তুলে কিছু প্রার্থনা করে যাচ্ছে।
বাড়ি ফিরে, এই মহিলা সন্তের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোথাও কিছু লেখা নেই।