রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ইতিহাস সৃষ্টি করেননি, ইতিহাসের ধারক-বাহক হিসাবেও তাঁর অবিসংবাদিত ভূমিকা বর্তমান। সেই ইতিহাসের আধারে তাঁর সান্নিধ্যলাভে যাঁরা ধন্য হয়েছেন, তাঁরাও তাতে স্বনামধন্য হওয়ার অবকাশ পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাঁর সান্নিধ্যের পরশে তাঁরই সৌরভ বিস্তারে ব্রতী হয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন অনেকেই। তাঁদের পরিচয়ের আধারই রবীন্দ্রনাথের পরশ। সেই পরশে স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথ পরশমণি। তাঁর ছোঁয়ায় জীবনধন্য করার মানসে যাঁরা নিজেকে সঁপে দিয়েছেন, বা আজীবন ব্রত উদযাপনে সক্রিয় থেকেছেন, তাঁরা সকলে স্বকীয় বৃত্তে পরিচিতি পেলেও জনসমাদরে জনপ্রিয়তা লাভে তাঁদের মধ্যে তারতম্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেখানে প্রখ্যাত হওয়ার অবকাশ যাও-বা সক্রিয় হয়ে ওঠে, বিখ্যাত হওয়ার পরিসর আপনাতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। অথচ মুখ থেকে প্রমুখ হওয়ার হাতছানি তার অনায়াসে সক্রিয় হয়ে ওঠে। গুরুভক্তির পরাকাষ্ঠায় গুরুর মহিমায় আপনাকে সামিল করার আত্মগৌরবে সেই হাতছানি আপনাতেই প্রকাশমুখর। সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথের পরশধন্য হওয়ার গৌরববোধে তাঁর মাহাত্ম্যের প্রচারে বা প্রসারে প্রমুখের ভূমিকা আপনাতেই জনমানসে আবেদনক্ষম হয়ে ওঠার হাতছানিকে সক্রিয় করে তোলে। অথচ জনমানসের সেই আলোতেও যিনি রবীন্দ্রনাথের সংযমের আদর্শকে পাথেয় করে নীরবে তাঁর সঙ্গীতসুধাকে আপন করে যাপন করে দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্রতে আজীবন সনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ, রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষক ও স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুমদার (১৯০০-১৯৯২)। তাঁর আত্মনিবেদিত প্রকৃতিই তাঁর নীরব সাধনাকে সবুজ ও সজীব করে তুলেছে।
শৈলজারঞ্জন বারবার তাঁর সঙ্গীতঅন্তপ্রাণের কথা নানাভাবে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের নেত্রকোনার বাহাম গ্রামে তাঁর জন্মস্থানে তিনি বেড়ে ওঠেন। ছোটবেলাতেই ঠাকুমার কাছে বৈষ্ণবীয় গানে প্রাণ খুঁজে পেতেন। এছাড়া কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি প্রভৃতি লোকসঙ্গীতও শিখেছিলেন তিনি। অথচ তা তাঁর শিক্ষাজীবনে আনুকূল্য লাভ না করাই দস্তুর। পড়াশোনাতে ভালো হওয়ায় গানের যোগ্ আপনাতেই বিয়োগ হয়ে ওঠে। অথচ তারপরেও তাঁর গানের প্রতি টান কমেনি, বরং প্রতিকূলতায় আরও তীব্র হয়েছে। সেখানে পড়াশোনার চেয়ে গানেই শৈলজারঞ্জন প্রাণ ফিরে পেতেন। অন্যদিকে ইতিমধ্যে শান্তিনিকেতনে পাঠরত খুড়তুতো কাকাদের কাছে থেকে সেখানকার আশ্রমিক জীবন ও রবীন্দ্রনাথের গানের কথা তাঁকে স্বপ্নলোকের হাতছানি দেয়। এজন্য নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে যখন তাঁর উচ্চশিক্ষায় দুটি বিকল্প স্কুলের একটি শান্তিনিকেতনের কথা উঠে আসে, তিনি কায়মনোবাক্যে তার জন্য প্রতীক্ষা করেন। এদিকে তাঁর বাবা রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার যেমন রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন, তেমনই তিনি চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর মতো করেই মানুষ হবে। সেখানে শৈলজারঞ্জনের ইচ্ছে-অনিচ্ছার মূল্য ছিল না। এজন্য কলকাতায় স্কটিশ চার্চ থেকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবরই কৃতিত্বের পরিচয়েও রমণীকিশোরের মন ভরেনি। এম.এসসি-তে রসায়নে দ্বিতীয় বিভাগে প্রথম (১৯২৪) হয়ে যে ছেলেটি গবেষণায় সামিল হয়েছিল, তাঁকেও বাবার কথামতো ওকালতি পাশ করে (১৯২৭) নেত্রকোনায় তাঁরই আসনে সমাসীন হতে হয়েছে। অবশ্য তার পূর্বে কলকাতার আশুতোষ কলেজে কিছুদিন লেকচারার হিসেবে কাজের কথা জানা যায়।
অন্যদিকে অনিচ্ছায় ওকালতির কাজ বেশিদূর এগোয়নি। মাসতিনেকের মধ্যেই তা থেকে শুধু রেহাই পাননি, পেয়েছিলেন সব পেয়েছির দেশ। সে দেশের সাকিনঠিকানার হদিশ যে কলকাতায় গিয়েই প্রাণস্হ করেছিলেন। সেখানে কলেজে পড়তে গিয়ে সেই কাকাদের কাছে পেলেন, পেলেন জোড়াসাঁকোর হদিশ। আর ১৯২১-এ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে পেলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পরশ, তাঁর স্বকণ্ঠে গান ও আবৃত্তি শোনার সৌভাগ্য। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথের গান শৈলজারঞ্জনকে সঞ্জীবনী সুধায় আপন করে নেয়। দিল্লি আকাশবাণীর জন্য ‘উত্তরসূরি’র সম্পাদক অরুণ ভট্টাচার্যের নেওয়া সাক্ষাত্কারে শৈলজারঞ্জন জানিয়েছেন : ‘তারপর থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত একেবারে আমাকে জাপটে ধরেছে।রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া কোন গানই আমার মনে দাগ কাটেনি।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শ্রদ্ধাভক্তির পরাকাষ্ঠায় শৈলজারঞ্জন নেত্রকোনায় ফিরে গিয়ে প্রথম রবীন্দ্রনাথের গান শোনানোর আয়োজন থেকে তাঁর জয়ন্তী পালনে সামিল হয়েছিলেন। তারপর অদম্য আগ্রহে গানশেখার পালা। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শোনা থেকে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দলে ভেড়া সবেতেই তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ আন্তরিক করে তুলেছিল। সৌমেন্দ্রনাথের দলে থাকার সময় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনটি গান শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই গান দিয়েই শৈলজারঞ্জন রবীন্দ্রনাথের মনে ঠাঁই পেতে চেয়েছিলেন এবং তা শুধু পাননি, পেয়েছিলেন কল্পনাতীত। অথচ তারপরেও তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের ভেলায় প্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা থেকে স্বেচ্ছায় সংগোপনে থেকেছেন। সেখানে নৈঃশব্দের আভিজাত্য তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। তিনি যেন গানের ভাষাতেই কথা বলেছেন, জনকণ্ঠের হাতছানি তার অলক্ষ্যে থেকে গেছে।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার ও কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
শৈলজারঞ্জন বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও তাঁর জীবনে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের যোগকে নিয়তি নির্ধারিত মনে করেছেন। তাঁর শান্তিনিকেতনমুখী জীবনের আকস্মিকতা সেকথা যেন প্রত্যয়সিদ্ধ করে তোলে। ওকালতির প্রয়োজনে কেনাকাটা জন্য কলকাতায় গিয়ে বন্ধু প্রভাত গুপ্তের খোঁজখবর নিতে গিয়ে শৈলজারঞ্জন নিজেই নতুন কাজের আমন্ত্রণ পেয়ে যান। ইতিমধ্যে তাঁর বন্ধুটি বিশ্বভারতীর অর্থনীতির অধ্যাপক হয়েছেন। তিনিই শৈলজারঞ্জনকে বিশ্বভারতীর রসায়নের অধ্যাপক হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দেন। স্বাভাবিক ভাবেই এতে শৈলজারঞ্জনের রুদ্ধ পথ যেন আকস্মিক বানে মুক্ত হয়েই যায় না, উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
১৯৩২-এ শৈলজারঞ্জন মজুমদার বিশ্বভারতীতে রসায়নের অধ্যাপনায় যোগ দিলেও তাঁর আত্মপরিচয়ের সোপানে সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতই অগ্রজের ভূমিকা সক্রিয় হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেও তাঁর গানের পরিচয়ে নিজেকে মেলে ধরার অবকাশে শৈলজারঞ্জনের ঐকান্তিকতা ফলপ্রসূও হয়। রবীন্দ্রনাথও তাঁর সুযোগ্য শিষ্যকে চিনে নিতে পেরেছিলেন প্রথম দর্শনেই। শৈলজারঞ্জনের পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারের ভাষ্য অনুযায়ী কবি তাঁকে দেখেই জানিয়েছেন, ‘দেখি দেখি, তোমাকে তো চিনি আমি, তুমি আমার গান করো।’ শিষ্যের বিনম্র শ্রদ্ধায় সম্মতি লাভে গুরুর প্রত্যয়ী অভিব্যক্তিতে গানের ভেলায় জাহাজের স্বপ্ন নিবিড় হয়ে আসে, ‘তুমি এখানেই থাক, তুমি আমার গান করো।’ স্বাভাবিক ভাবেই সেই প্রস্তাবে গানঅন্তপ্রাণ শৈলজারঞ্জনের অন্তরাত্মা নেচে ওঠে। লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে রসায়নে মতি না দিয়ে তাঁর গানের রসে মগ্ন হওয়ার আজ্ঞা প্রদান করেন এবং শৈলজারঞ্জনও তাতে ‘খুব খুশি’তে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শেখার আনন্দ তাঁকে যতই আন্তরিক করে তোলে, ততই গুরুদেবের কাছে নিজেকে নিবিড় করে তোলার অবকাশ মেলে। শিক্ষানবিশী থেকে শিক্ষকের আসনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তাঁকে সামিল করেন। ১৯৩৫-এ গুরুদেবের কথায় শৈলজারঞ্জন ছোটদের গানের ক্লাস নিতে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, ১৯৩৪ থেকে সমানতালে চলতে থাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপিকরণের কাজও। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, ছাত্র হিসাবে শৈলজারঞ্জন বরাবরই মেধাবী ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতকেও তিনি স্বভাবসুলভ ভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর বৈজ্ঞানিক মনটিও তাঁকে এ কাজে আরও পারঙ্গম করে তুলেছিল। বিশেষ করে স্বল্প দিনের মধ্যেই তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপিকরণের বিশ্বাস অর্জন সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তাঁর বেশি বয়সে যেভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা লাভ ও অনতিবিলম্বে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠাটার মধ্যে শৈলজারঞ্জনের সঙ্গীতের প্রতি আত্মনিবেদিত প্রকৃতিটি আপনাতেই সবুজ মনে হয়। এজন্য একের পর এক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া থেকে নিজেকে সেই সঙ্গীতের গুরু দায়িত্বে সামিল করা সবেতেই তাঁর তীব্র অনুরাগই তাঁকে সাধকের আসনে বসিয়েছে। রবীন্দ্রনাথও তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন।
১৯৩৯-এ সঙ্গীতভবন প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর প্রথম অধ্যক্ষের দায়িত্ব শৈলজারঞ্জনের উপরেই ন্যস্ত হয়। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপককে সঙ্গীতের গুরুদায়িত্বে বসানোর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের গভীর আস্থা ও নির্ভরতাই প্রতীয়মান। অন্যদিকে শৈলজারঞ্জন অন্য একটি কারণেও বিশেষ ভাবে স্মরণীয় মনে হয়। রবীন্দ্রনাথকে নতুন গানের সানুরোধ তাগাদা দিয়ে অসংখ্য গান রচনা করিয়ে নিয়েছিলেন। জীবনের অন্তিম পর্বে যেভাবে গুরুদেবকে নতুন গান রচনায় সক্রিয় করেছিলেন, তার জন্যও শৈলজারঞ্জনের সদর্থক ভূমিকা অনস্বীকার্য। সার্বিক ভাবে যাঁরা শৈলজারঞ্জনের রবীন্দ্রসান্নিধ্যের আট বছরকে তাঁর গান শিখতেই অতিবাহিত হয়েছে বলে মনে করেন, তাঁরা যে শুধু তাঁকে অবমূল্যায়ন করে থাকেন না, সত্যের অপলাপেও তন্নিষ্ঠ হন। ১৯৩৫-এ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর ভূমিকাই তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ভূমি দান করেছে। শৈলজারঞ্জন তাঁর স্বকীয় প্রতিভায় নিজস্ব ঘরানা তৈরি করায়ও সক্ষম হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁকে যোগ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ হিসাবে শৈলজারঞ্জন একটানা দীর্ঘ ২১বছর স্বপদে ছিলেন। অথচ তারপরেও রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাঁর অভিভাবকসুলভ গ্রহণযোগ্যতা জনমানসে নিবিড়তা লাভ করেনি। অবশ্য তার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। (বাকিটুকু আগামীকাল)
লেখক : প্রফেসর, বাংলা বিভাগ, সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরুলিয়া-৭২৩১০৪।