অনুদীপ এখন পুরু লেপের ভেতরে বউকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। পূর্ণিমার রাত। চারদিক জোৎসনার আলোয় ভাসছে। লেপের ভেতরে যাওয়ার আগে ব্যালকোনীতে দাঁড়িয়ে অনুদীপ ও সুচরিতা চাঁদের আলো দেখতে দেখতে দু’জনেই আনন্দে বিহ্বল! সুচরিতা চাঁদের আলোয় উচ্ছ্বসিত হয়ে গান ধরে, ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো’ —
লেপের ও বউয়ের শরীরের ওমের আমেজে অনুদীপের মন ভরে যায়।
ছাত্রাবস্থায় সে লজিং-এ থেকে পড়াশোনা করত, সে সময়ে যশোরের দড়াটানা রোডের মালু বিহারীর লেপের দোকান থেকে তেরো টাকায় কেনা লেপের কথা ভাবলে অনেক কথাই এখনও মনে পড়ে অনুদীপের। লেপটা ছিল তার অমলা বউদির পরণের খাটো শাড়ির মতো। দীর্ঘাঙ্গী অমলা বৌদির পরণের শাড়ি আচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিলে পা আলগা হয়ে যেত। পা ঢাকলে মাথায় ঘোমটা থাকতো না। সে সময় অনুদীপের তেরো টাকায় কেনা লেপের অবস্থা ছিল ঠিক তেমনই। প্রচন্ড ঠান্ডায় লেপটা দিয়ে মাথা ঢাকলে পা দু’খানা আলগা হয়ে থাকতো। সেবারের প্রচন্ড শীতে অনুদীপ পাতলা আর খাটো লেপ গায়ে দিয়ে কাহিল! সে সময় সে মনে মনে ভাবতো, এ বাড়িতে তো লেপের কোন অভাব নেই। একটা লেপ দিলে তাকে এত কষ্ট পেতে হতো না!
অনুদীপ তার এই লজিং বাড়িতে আসার কয়েকদিন পরে তার বয়সী একটা দোকানদার ছেলে তাকে বলল, ‘তুমি ঘোষবাবুদের বাড়িতে লজিং থাকো?’
‘হ্যাঁ।’
‘ও বাড়িতে যে ছেলে লেজিং থাকে সে তো ওই বাড়ির জামাই হয়।
‘বড়লোকের বাড়ির জামাই হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।’ অনুদীপ বললো।
ছেলেটির কথা শুনে অনুদীপের মনে তেমন ভাবান্তর না হলেও সে ভাবলো, তাকে তো ঘোষবাবুর দুই মেয়েকে পড়াতে হয়। তখনকার বড় মেয়েটি পাঁচ ক্লাসে, আর ছোটটি তিন ক্লাসে পড়ে। কৃষ্ণা নামের মেয়েটি পাঁচ ক্লাসে পড়লেও শরীর স্বাস্থ্যে একটু বড়সড়। গ্রামের গরীব বাবা মায়ের নিরীহ ছেলে অনুদীপ। সে গায়ে বাংলা জামা আর পরনে পাজামা পরে। তার কথাবার্তায় গেঁয়ো ভাব বর্তমান। অনুদীপ বুঝতে পারলো, বয়সের তুলনায় কৃষ্ণা বেশ একটু পাকা স্বভাবে। তার কথাবার্তা আর পোশাক আশাক মেয়েটির পছন্দের নয়।
কয়েকদিন ধরে শৈত্যপ্রবাহ চলছিল, রাতে প্রচন্ড ঠান্ডায় হিম হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। পাতলা লেপ, তার ওপরে লেপের ভেতরে রাবিশ তুলো ভরা। লেপটা গায়ে দিলে শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে হয়, আর লেপের ভেতরের তুলোতে যতরাজ্যের পাটকাটির টুকরো গায়ে বেঁধে। অনুদীপের মা লেপটাতে পুরনো কাপড়ের কভার দিয়ে দেওয়ায় তবু কিছুটা রক্ষে।
কথায় বলে মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে, অনুদীপ বুঝতে পারলো মাঘের শীতে মানুষও কাঁপে। প্রচন্ড শীতের এক রাতে অনুদীপের মনে হলো, দোকানদার ছেলেটির কথা সত্যি হলে তাকে হয়তো প্রচন্ড শীতে রাবিশ লেপটা গায়ে দিতে হতো না হয়তো। কৃষ্ণার বাবা মায়ের কাছ থেকে জামাই আদর পেতে হলে তাকে ভাল পোশাক আশাকে সেজেগুজে থাকতে হতো। চালচলন, কথাবার্তায় স্মার্ট হওয়ার দরকার হবে। কিন্তু তা তো অনুদীপের পক্ষে করা সম্ভব না। বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে ঘোষ বাড়ির জামাই হওয়ার চেয়ে রাবিশ মার্কা তের টাকায় কেনা লেপটাই ভাল!
অনুদীপ এক সময় তের টাকায় কেনা লেপটাকে রাবিশ ভাবলেও এখন কিন্তু সে লেপটাকে অপয়া না ভেবে পয়াই ভাবে। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেও ওই লেপটাই ছিল অনুদীপের সঙ্গের সাথী। ওই লেপটাই শীতের রাতে সামান্য হলেও ওম দিয়েছিল। ভাল রেজাল্ট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করার পর একটি ওভারসিজ মাল্টিন্যাশানাল এন্টারপ্রাইজে চাকুরী পাওয়ার পর অনুদীপের ভাগ্যের চাকা সামনের দিকে ঘুরতে থাকে।
কলকাতা, সিঙ্গাপুর এবং কুয়ালামপুর অফিসে কাজ করার পর গত বছর থেকে অনুদীপ ঢাকা অফিসের দায়িত্বে আছে। বাবা মায়ের পছন্দের মেয়ে সুচরিতার সঙ্গে অনুদীপের বিয়ে হয়েছে দু-মাস আগে, সুচরিতা ঢাকার একটা বেসকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। বিয়ের পরে অনুদীপ তের টাকায় কেনা লেপটা গল্প সুচরিতাকে শোনাতে ভোলেনি। অনুদীপের কাছ থেকে তের টাকায় কেনা লেপটা গল্প শুনে সুচরিতা তাকে বলেছিল, ‘তোমার পয়া লেপটাকে আমি যত্ন করে তুলে রাখবো।’ সুচরিতার কথা শুনে অনুদীপ স্বস্তিবোধ করে।
মনোজিৎকুমার দাস, কথাসাহিত্যিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।