দুটো হাত : সুবোধ সরকার
“পাখি যেমন মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে
একটা কোন গান দিয়ে
ভোরের বেলা আজান দিয়ে
বাবার হাত ধরতে চায়
মেয়ের হাত প্রাণ দিয়ে।
***
বাবাও মৃত, মেয়েও মৃত,
জলে ভেসেও অপাবৃত
বাবা আমার হাত ধরো
ধান যেভাবে ধানের ক্ষেত
আগলে ধরে ধান দিয়ে।”
আজকের ছবিওয়ালার গল্প বিশিষ্ট কবি সুবোধ সরকারের এই কবিতা দিয়েই শুরু করলাম। শেষ করেছি এই সময়ের আর এক বিশিষ্ট কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা দিয়ে। ঘটনাটা ঘটেছিল ২০০৫ সালের ২৯ অক্টোবর।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘুমন্ত বাবা মেয়ে ট্রেনের কামরা থেকে যখন ভেসে যাচ্ছিল জলের তোড়ে তখন জীবন দিয়েও বাবা তার মেয়েকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে গেছে। মেয়েও নিশ্চিত বাবাকে একবারের জন্য ছাড়েনি। মা নিশ্চয়ই ছিল। ওদের শেষ কথা আমরা জানিনা। হয়তো সে আগেই স্বামী মেয়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে যায়।
মেয়েটির হাত বাবার হাত ছুঁয়ে আছে। জল জল করছে প্লাস্টিকের বালাটা। দুজনেরই হাতদুটো অনেকটা মাছের বাজারের মাসিদের মাছ ঘাঁটতে ঘাঁটতে যেরকম হয়ে যায় ঠিক ঐরম দেখতে লাগছে। প্রচন্ড স্রোত পাথরের ধাক্কাও বাবা মেয়েকে আলাদা করতে পারেনি। ওই জলে ওদের চিৎকার শোনা যায়নি। বাবা মেয়ে কেউ কাউকে দেখতেও পায়নি। তবু ওরা ভেসে যাবার আগের মুহূর্তে যেমন ছিল এতটা পথ স্রোতে ভেসেও শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে আছে!!
বালি সারা শরীর জুড়ে ঢাকা। বিধ্বস্ত জামা কাপড়। গোলাপি রঙের ফ্রকটা ছিঁড়ে গেলেও গায়ে আটকে আছে। গলায় পুঁতির মালাটা নাকে গিয়ে আটকে আছে। এই মুহূর্তে আমার ভাবনা বাবা মেয়েকে নিয়ে… পৃথিবীর অন্যতম আত্মিক সম্পর্ক!
ঘটনা ২০০৫ সালের ২৯ অক্টোবরের। অন্ধ্রপ্রদেশের রামান্নাপেটের কাছে ভেলুগোণ্ডায় অতিরিক্ত বর্ষায় রেললাইনের পাশেই একটা জলাধার উপচে পরে। জলের স্রোতে রেললাইন বেঁকে যায়। ভোরের দিকে ওই ভাঙ্গা লাইনে যে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে কিছু কোচ নৌকোর মত ভেসে যায় সেই ডেল্টা ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ট্রেনটিতে ঘুমন্ত যাত্রীরা প্রায় সবাই বাড়ি যাচ্ছিলো দীপাবলীর ছুটিতে। কিন্তু আলোর উৎসব মৃত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে যায়।
ভারতীয় রেল দুর্ঘটনার ইতিহাসে এটি ভয়ংকরতম একটি ঘটনা। যেটি কভার করতে আমি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক অনিন্দ্য জানা এই খবর পেয়ে সকালেই আকাশ পথে রওনা দিই। তারপর গাড়ি নিয়ে সোজা স্পটে। পৌঁছেই অনিন্দ্য আমি যে যার মতন কাজ শুরু করি। এখনও অবধি সরকারি ভাবে মৃত একশো দশ। বেসরকারি একশো পঞ্চাশ। নিখোঁজ কোনো ঠিক নেই। আমরা সেই নিখোঁজের সন্ধানে হাঁটছি।
সামনে ভাঙ্গা ব্রিজ রেল লাইন ঝুলছে জলের ওপর ভাঙ্গা কোচ ছাড়া ছবি নেই। কিন্তু এয়ারপোর্টে নেমেই শুনেছি উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের তুলনায় নিখোঁজ বহু। অনিন্দ্য খবর আর আমি ছবির জন্য নদীর পার দিয়ে হাঁটছি আর দু পাশে লোকেদের জিজ্ঞাসা করছি কোথাও বডি পাওয়া গেছে কিনা? কিন্তু ভাষা তো কেউ বুঝছে না। তবে আমার হাতে ক্যামেরা দেখে অনেকেই ধরে নিচ্ছে যে, এরা সাংবাদিক। তারা হাত তুলে ওই সামনে দেখিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে বিকেল গড়িয়ে আসছে…
অনিন্দ্য বললো “অশোকদা এখানকার কাজ আমার শেষ। প্রশাসনিকভাবে কিছু মানুষের সাথে আমার কথা বলা প্রয়োজন। তাছাড়া হোটেল ঠিক করা। খবর পাঠানো ইত্যাদি…. তুমি কি এখন যাবে?”
আমি অনিন্দ্যকে বললাম, “তুমি ওগুলো করে নাও। আমি আরেকটু দেখি। কোনো বডি পাওয়া যায় কিনা….!!”
এখানে বলি, লেখনী সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিকের একটা তফাৎ সাংবাদিকতায় তখনো ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনো ঘটনা ঘটলে একটা সাংবাদিক প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ শুনে, প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে, এমন কি স্পটে না গিয়েও একটা রিপোর্ট তৈরি করে নিতে পারে। সেই সুবিধা তাদের থাকলেও চিত্র সাংবাদিকদের এমন সুবিধে একেবারেই নেই। ছবিতে কিছু একটা দেখাতেই হবে। যা লেখাকে সাপোর্ট করবে। এবং ছবি দেখেই বোঝা যাবে ঘটনার ভয়াবহতা। যদিও পুরোটাই একটা টিম ওয়ার্ক।
চলুন গল্পে ফিরি….
খুঁজতে খুঁজতেই নদীর চরে প্রায় দু-কিলোমিটার হেঁটে এই দৃশ্য! বাবা আর মেয়ে একটু পাথুরে বালির চরে শুয়ে আছে… দুজনেই মৃত। কিন্তু বাবার হাত মেয়েকে এমনভাবে ছুঁয়ে আছে যে মৃতদেহ হলেও বুঝতে পারলাম এতটা পথ প্রবল স্রোতে ভেসে এলেও কেউ কাউকে ছাড়েনি। থমকে দাঁড়ালাম। যাক পাওয়া গেলো একটা না দুটো বডি।
এরকম একটা ছবিই তো আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু এমন দৃশ্য হবে ভাবিনি। ছবি তুলতে গিয়ে কেমন যেন লাগছিল মেয়ে বাবাকে দেখে। পড়ন্ত বিকেল। সেই সময় এই ধরনের ছবি তোলার আগে না হলেও পরে মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত। উদাস উদাস লাগতো। পরে সেটা কেটে যায়। একেবারে লাশ কাটা ঘরের ডোমের মত।
নিজের চোখ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। ভুলে গেছি আমার কাজ। ক্যামেরা দেখে দূরে কিছু লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে। সম্বিতে ফিরলাম। দ্রুত বাবা মেয়ের হাতের কিছু ক্লোজ আপ ছবি তুলে হাঁটা দিলাম।
ছবি তুলেই ওই পাহাড়ি বালি, ছোট ছোট বোল্ডার পেরিয়ে দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম ব্রীজের দিকে। যেখানে গাড়ি থেকে নেমে ছিলাম। তখন লক্ষ্য একটাই ছবি পাঠানো আর অনিন্দ্যকে বলা যে, ‘এই ছবিটা তুললাম।’ কোনরকম খুব অনুরোধ করে এক পুলিশের সাহায্যে গাড়িতে শহরে ঢুকলাম। ছবি মেল করে অনিন্দ্যকে ছবির বর্ণনা আমার মতো করে বললাম।
অনিন্দ্যর লেখা স্টোরিটি ছবি সহ পরদিন পেজ ওয়ানে বেরিয়েছিল। ক্যাপশন ছিল — “পাশাপাশি, তবে প্রাণ নেই। চিহ্ন বইছে ভেলুগোন্ডা। রবিবার জল সরার পরে।”…..অশোক মজুমদার।
এটা না বললেই নয়। সাদা বাড়ির কালো গ্রিল (আনন্দবাজার) পত্রিকায় অনিন্দ্য আমার জুটি সব চেয়ে বেশি অ্যাসাইনমেন্ট করেছি। বহু এক্সক্লুসিভ খবর দুজনের আছে। সেই সময়ের এক্সিকিউটিভ এডিটর সুমন চট্টোপাধ্যায় আমাদের দুজনের কাজ খুব পছন্দ করতেন। অনিন্দ্যর বাংলা সাংবাদিকতা নিজ গুনে একটা পাঠক তৈরি করেছিলো। যা আজও লোকে বলে।
পুরোনো লাল হয়ে যাওয়া কাগজ থেকে বৃহস্পতিবার খুঁজে পাই ছবিটা। ছবি দেখে কত কিছুই মনে পরছে। আজ ছবিওয়ালার গল্পে তাই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করে নিলাম আমার মনখারাপের অনেক ছবির ভিতরে একটা।
আসলে চিত্র সাংবাদিকের স্বার্থকতা বোধহয় এখানেই। যে একটা সামান্য ছবি হাজার হাজার কথা হয়ে ওঠে পাঠকের ভাবনায়। খুব সামান্য হলেও চল্লিশ-এর একটু কম বছর ধরে আমি শুধু চেষ্টা করেছি ওইটুকুই। ভালোমন্দের বিচারক তো আপনারা।
সত্যি বলতে আজও এমন কোনো ভাষা আমার জানা নেই এই ছবিটার কথা লেখার মাধ্যমে আপনাদের বোঝাতে পারি। তাই এই সময়ের আমার দুই প্রিয় কবি বন্ধু এবং সাহিত্যিক সুবোধ সরকার ও বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়কে ছবিটা পাঠিয়ে আবদার করি, “আমার এই ছবিটা দেখে তোমাদের মত চার পাঁচ লাইন কবিতা লিখে দেবে?”
আমার ধৃষ্টতা অস্বীকার করবো না তবু ওরা আমায় ছবি দেখে এই কবিতাগুলো পাঠায়। লেখার শুরুতেই কবি সুবোধ সরকারের কবিতা দিয়ে শুরু করেছি ও শেষে দিলাম কবি বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়-এর কবিতা। এ আমার পরম সৌভাগ্য। দুজনের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ।
সব কাজ ফেলে : বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
তুমি এলে
কৃষ্ণচূড়া অন্ধকারে
দিল রঙ জ্বেলে
কত জল ঢেলে
কত তপ্ত বালি আমি ভিজিয়ে দিয়েছি অবহেলে
কেন তবে মরে যাব
মুহূর্তের কোনও শক্তিশেলে
ভালবাসা পেলে
আর যদি নাও পাই
‘ কখনও পেতেও পারি’
অপেক্ষার কাছে ডানা মেলে
আমার চোখের জল
তোমার চোখেও দেখে ফেলে
আজকের রাত্রি চলে যেতে যেতে
একটা ভোর
আগামীর দিকে দেবে ঠেলে…
তুমি এলে।
১১ মার্চ ২০২৩