১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বৃহস্পতিবার) সাহিত্যিক সুধীর চক্রবর্তীর জন্মদিনে প্রকাশিত হলো ‘সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা’ গ্রন্থটি। কৃষ্ণনগরের রবীন্দ্রভবনে আয়োজিত ‘সুধীর চক্রবর্তী স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪’-এর মঞ্চে সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রীর হাত দিয়ে গ্রন্থটির আবরণ উন্মোচন করা হয়। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন প্রকাশনা সংস্থা ‘মুদ্রা’-র কর্ণধার শৈবাল সরকার। ‘মুক্তধারা’ সাংস্কৃতিক সংস্থার পক্ষ থেকে মঞ্চে ছিলেন সম্পদনারায়ণ ধর, রামকৃষ্ণ দে, তপনকুমার ভট্টাচার্য ও দীপাঞ্জন দে। মুদ্রা সাহিত্যপত্রিকা ও তারকনাথ সরকার মেমোরিয়াল ট্রাস্ট-এর উদ্যোগে এবং কৃষ্ণনগর সেন্ট্রাল ক্লাবের সহযোগিতায় এই সাহিত্য বাসরের আয়োজন করা হয়েছিল। এদিন সন্ধ্যায় ‘সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা’ গ্রন্থটি প্রকাশের সময় সভাকক্ষে মুক্তধারা সাংস্কৃতিক সংস্থার একাধিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। গ্রন্থপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ‘মুক্তধারা’-র অন্যতম আহ্বায়ক সম্পদনারায়ণ ধর গ্রন্থটির বিষয় সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন এবং তাদের সংস্থা কর্তৃক সুধীর চক্রবর্তীকে নিয়ে এহেন গ্রন্থ নির্মাণের পশ্চাতে অন্তর্নিহিত ভাবনার বিষয়টি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
‘সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা’ গ্রন্থটিতে সাহিত্যিক সুধীর চক্রবর্তীর আটটি ভাষণ লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে। এগুলি হলো যথাক্রমে— রবীন্দ্র-বিচারের অভিমুখ, শরীর, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজি, জীবনধারণ জীবনযাপন জীবনবিকাশ, মানুষের বিকাশে জনপদের ভূমিকা, রবীন্দ্রনাথের জীবনগান, অবতলের কয়েকজন মানুষ এবং আমার চেনা দুজন আশ্চর্য মানুষ। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন— সম্পদনারায়ণ ধর, রামকৃষ্ণ দে এবং দীপাঞ্জন দে। কৃষ্ণনগরের প্রকাশনা সংস্থা ‘মুদ্রা’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। গ্রন্থের প্রচ্ছদ করেছেন বহরমপুরের বিশিষ্ট শিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত, যাঁর আরেকটি পরিচয় হলো তিনি সুধীর চক্রবর্তীর একান্ত অনুরাগী, এবং মুক্তধারারও আত্মজন। গ্রন্থসজ্জা করেছেন সৈকত মুখার্জি। এই গ্রন্থ প্রস্তুতের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য সর্বদা পাশে পাওয়া গেছে চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঝন্টু দাস ও স্বরাজ বক্সী-কে। আর যন্ত্রস্থ ভাষণগুলিকে লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন শুভময় সরকার, রুমা ধর, প্রিয়ঙ্কা বাঁশফোর, সৃজা ভট্টাচার্য ও রিয়া দাস। গ্রন্থটি মুক্তধারার আত্মজন অশোককুমার ভাদুড়ী, শংকর সান্যাল ও ডা: রমেন্দ্রনাথ সরকারের স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে।
সাহিত্যিক সুধীর চক্রবর্তীর অভিভাবকত্বে রবীন্দ্র-জন্মসার্ধশতবর্ষ উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে কৃষ্ণনগরের সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘মুক্তধারা’-র পথচলা শুরু হয়েছিল। সেই সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘মুক্তধারা’-র আলোচনাসত্রগুলিতে সুধীর চক্রবর্তীর সক্রিয় অংশগ্রহণ সংস্থার গৌরব বাড়িয়েছে। সংস্কৃতিমনস্ক শ্রোতারা নিজেদের ঋদ্ধ করতে অতি সহজেই মুক্তধারাকে আপন করে নেন। ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর সুধীর চক্রবর্তীর প্রয়াণ এই সংস্থার কাছে বড়ো আঘাত-স্বরূপ ছিল। তার আগে আয়োজিত মুক্তধারার ঊনচল্লিশটি আলোচনাসত্রের মধ্যে এগারোটিতে আলোচক হিসাবে ছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। মনোমুগ্ধকর সেই সকল বক্তব্য কালের নিরিখে আজ ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সুধীর চক্রবর্তী থাকাকালেই তাঁর এই ভাষণগুলি একত্রিত করে মুক্তধারার পক্ষ থেকে একটি গ্রন্থ প্রকাশের অভিপ্রায় তাঁকে জানানো হয়েছিল। সেই সময় স্যারের সহাস্য সম্মতি এই গ্রন্থ নির্মাণে মুক্তধারার সদস্যদের প্রাণিত করেছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী কোভিড অতিমারির প্রাদুর্ভাব এবং সেই কালপর্বে সুধীর চক্রবর্তীর প্রয়াণ এই কাজকে অনেকটাই মন্থর করে। ইতিমধ্যে ‘মুদ্রা’ প্রকাশনার পক্ষ থেকে প্রকাশনা গ্রন্থটি প্রকাশে তাদের আগ্রহের কথা মুক্তধারাকে জানায়। মুক্তধারা সানন্দে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ‘সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা’ গ্রন্থটি শেষপর্যন্ত পাঠকদের সামনে তাঁর ৯১তম জন্মদিবসে আত্মপ্রকাশ করল। ২৪৮ পৃষ্ঠার হার্ড বাইন্ডিং এই গ্রন্থটির মুদ্রিত মূল্য ৪৫০ টাকা।
‘সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা’ গ্রন্থটি ‘মুক্তধারা’-র আলোচনাসত্রে সুধীর চক্রবর্তীর আটটি ভাষণের একটি সংকলন। বিশেষ কারণে এই গ্রন্থে সুধীর চক্রবর্তীর অবশিষ্ট তিনটি ভাষণের মুদ্রণ সম্ভব হয়নি। মুক্তধারার আলোচনাসত্রে পরিবেশিত সুধীর চক্রবর্তীর ভাষণগুলি ছিল সম্পূর্ণ তাঁর স্মৃতিনির্ভর। দীর্ঘ আলোচনায় তিনি কোনোদিন একটি চিরকুটের সাহায্যও নেননি। অতএব বলা যায় যে এই গ্রন্থের বিষয়গুলি আসলে সুধীর চক্রবর্তীর স্মৃতি থেকে পরিবেশিত মৌখিক ভাষণের অন্যজন-কৃত লিখিত রূপ, যেগুলি বক্তাকে দেখিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার সুযোগ ও সৌভাগ্য শেষপর্যন্ত হয়নি। অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এটুকুই শুধু বলার যে, বাগ্মী সুধীর চক্রবর্তীর বলার ভাষাটাকে যতটা সম্ভব অপরিবর্তিত রেখে তাঁর ভাষণ দেবার কৌশলটিকে এই গ্রন্থে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সুধীর চক্রবর্তীর কথা বলার অননুকরণীয় স্টাইল, সাবলীল গতিময়তা এবং ভাষার মাধুর্য বজায় না রাখতে পারলে তাঁর ভাষণের স্বাদ আস্বাদন থেকেই পাঠকেরা বঞ্চিত হবেন, এই বিষয়টি গ্রন্থ নির্মাণের সময় থেকেই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছিল। তাই শেষপর্যন্ত গ্রন্থটিতে সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয়।
সুধীর চক্রবর্তীর ভাষণ ছিল স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল, মেধাদীপ্ত ও তথ্যনিষ্ঠ এক প্রত্যয়ী উপস্থাপনা। অনায়াস-পরিবেশিত তাঁর নির্মল পরিহাস আর সরস ঘরোয়া বাচনভঙ্গি এবং সহজ গল্প বলার স্টাইল— সেই সঙ্গে ভাষার সাবলীল গতি তাঁর বক্তৃতাকে করে তুলত অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোগ্রাহী। তাঁর আলোচনার পরিসমাপ্তিতে শ্রোতাদের চোখেমুখে যেন পরম এক তৃপ্তি ও প্রসন্নতার ছবি ফুটে উঠত। ‘সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা’ গ্রন্থে সংকলিত বক্তৃতামালার বিষয়বস্তু বৈচিত্রময় এবং অবশ্যই গভীরভাবে মননশীল। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীত ছিল তাঁর অতি প্রিয় দুটি বিষয়। তাই এই দুটি বিষয় বারবার ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর ভাষণে। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন ও তার পরিমণ্ডল নিয়ে গড়ে-ওঠা বিশাল রবীন্দ্রসাম্রাজ্যের তিনি ছিলেন একজন গুণগ্রাহী মানুষ। সে স্থানটিকেও তিনি ছুঁয়ে গিয়েছেন তাঁর ভাষণে, নানা প্রসঙ্গে। ওইসব আলোচনায় উঠে এসেছে তাঁর বরেণ্য শিক্ষকদের কথা, কৃতী সহপাঠী বন্ধুদের কথা, তাঁর পরিচিত বিশিষ্ট গুণীজনদের কথা এবং আরও কত মানুষের সান্নিধ্যের কথা। সেইসঙ্গে আলোচনায় বারবার স্থান করে নিয়েছে বাংলার লোকধর্ম ও লোকসংস্কৃতির সন্ধানী গবেষক সুধীর চক্রবর্তীর পায়ে-হেঁটে-চলা-পথে দেখা-পাওয়া কত অপরিচিত প্রান্তবাসী অবতলের দরিদ্র, বিপন্ন মানুষদের সুখদুঃখভরা যাপনকথা, বাউলফকিরদের কথা। মানুষের জীবনে সংশ্লিষ্ট জনপদের অবদান বিষয়ে তাঁর আলোচনা কিংবা জীবনধারণ, জীবনযাপন ও জীবনবিকাশ বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ আমাদের মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। কখনও তাঁর ভাষণের বিষয় হয়ে ওঠে ‘শরীর’— যা আমাদের নতুন ভাবনার রসদ জোগায়। আবার ‘রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধি’ বিষয়ে তাঁর আলোচনা আমাদের চিন্তা-চেতনা-মননে নতুন করে আলোড়ন জাগায়। সুধীর চক্রবর্তীর সাবলীল তথ্যবহুল আলোচনা-কৌশল— এই গ্রন্থের প্রধান সম্পদ। তাঁর বক্তব্যগুলি যতটা সম্ভব অপরিবর্তিত রেখে এবং সেই অনবদ্য বাচনভঙ্গিকে মর্যাদাপূর্ণ উপস্থাপনের প্রয়াস নিয়ে এই গ্রন্থটি নির্মাণ করা হয়েছে। আরেকটি কথা না বললেই নয়— বাগ্মী সুধীর চক্রবর্তীর মেধাদীপ্ত, তথ্যনিষ্ঠ আলোচনাগুলি লিপিবদ্ধ করে দুই মলাটের ভিতর পরিবেশন করার সদিচ্ছাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট ছিল না, বিষয়টি ছিল বেশ পরিশ্রমের। এই গ্রন্থ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে সেই পরিশ্রমসাধ্য দুরূহ কাজটি যেমন সম্পন্ন করা গেল, তেমনি আগামী প্রজন্মের জন্য এই সম্পদ সংরক্ষিত করাও সম্ভব হলো।
লেখক: আহ্বায়ক, মুক্তধারা।