“ত্রিলোকপতির তীর্থগমন” গল্পটি জগদীশের এক ব্যতিক্রমী গল্প। গল্পটির গঠনশৈলীর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও গল্পটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। একটি বিবাহের ঘটনার সূত্র ধরে ত্রিলোকপতির ভাবনার বিস্তার গল্পটির চুম্বক।
বন্ধু গুরুদাসের বোন শিউলির বিবাহের পাকা কথা হতে দেখে ত্রিলোকপতির মনে বিচিত্র ভাবের উদয় হয়। শিউলিকে সে পুরুষের একান্ত আকাঙ্খিত নারীদের প্রতিভূরূপে এবং রঘুনাথগঞ্জের সেই এম, এ পাশ পাত্রটিকে নারীর একান্ত কাম্য পুরুষের প্রতিভূরূপে কল্পনা করে নেয় এবং এই সূত্র ধরে তার ভাবনা বিস্তারিত হতে থাকে। বিবাহ, স্বামী স্ত্রীর ভালবাসা, দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে ত্রিলোকপতির বিশ্লেষণ –
“মেয়েটিকে পুরুষ আসিয়া বিবাহ করিয়া লইয়া যাইবে। নির্বোধ ব্যক্তির হঠাৎ মনে হইতে পারে, মেয়েটির বিবাহের বয়স হইয়াছে, অতএব মন্ত্রশক্তি দ্বারা জীবনে একটা অকাট্য গ্রন্থি দিবার অভিনয় করিয়া পুরুষটি মেয়েটিকে লইয়া যাইবে সন্তানার্থে এবং সুলভে এমন সব হাস্যোদ্দীপক স্থূল কাজ করাইয়া লইবে যার নাম হইবে স্বামীসেবা এবং গেরস্থালী। …. এই কুসংস্কার যাদের আছে যে বিবাহ আর কিছুই নয়, উভয়পক্ষেরই অর্থাৎ স্ত্রী এবং পুরুষের জীবনযাপন সম্বন্ধীয় একটি সুবিধাজনক চুক্তিমাত্র…. পুরুষের আধিপত্য স্বীকার করিয়া লইয়া স্ত্রী থাকিবেন পোষা…. ঐ ধৃষ্ট লোকগুলির প্রজ্ঞার ঐখানেই শেষ, তার বেশি অগ্রসর হইতে তারা শিখে নাই…. কিন্তু বিবাহের গভীর তাৎপর্যও রহিয়াছে… স্ত্রীকে সহধর্মিণী বলা হয়, মিথ্যা বলা হয় না…. বিবাহ ঐহিকও নয়, দৈহিকও নয়, বিবাহ পারত্রিক এবং আত্মিক। ইহা যে মানিতে চায় না, সে উৎসন্ন গিয়াছে…. উভয়ের গভীর অন্তরগত মিলন যেমন কামনাকে অভূতপূর্ব অনির্বচনীয় করিয়া তোলে, তেমনই দেহকে করে সুন্দর, মনকে করে পবিত্র, আত্মাকে করে অন্তর্মুখী।”
একটি স্থিতিস্থাপক সমাজ, যার ভেতর লেখকের অন্তর্ভেদী দৃষ্টির অবলোকন অবিরাম অন্বেষণ করে কতটুকু মনুষ্যত্ব ধারণ করে আছে সমাজবিধি সেখানেই ত্রিলোকপতির ভাবনার বিস্তার অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং সমাজের
স্থিতিস্থাপকতার শক্ত খোলের ওপর সজোরে আঘাত করে। বিবাহ বস্তুটি ঠিক কেমন? তার ভাবনার পক্ষবিস্তার নারীজীবনের বৈবাহিক আনন্দের পরবর্তী স্তরকে তুলে ধরে কুণ্ঠাহীন ভাষায় — “বিবাহ একটি সুবিধাজনক চুক্তি, স্ত্রীর পুরুষের আধিপত্য স্বীকার করা”, “পোষা” শব্দটি তো মেয়েদের সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে গভীর তাৎপর্যবাহী।
আসলেই ত্রিলোকপতি কল্পনা করে, নিঃসংশয়, নিরুপদ্রব কল্পনা নয়, ঐ “ধৃষ্ট” লোকগুলির দৃষ্টিভঙ্গি তাকে আহত করে। বিবাহ যে শুধুমাত্র দেহকেন্দ্রিক নয়, এটা যে দুটি মানুষের পবিত্র আত্মিক বন্ধন অথচ এই ধৃষ্ট লোকগুলির সেই “প্রজ্ঞা”-র অভাব তাকে ভাবায়। কল্পনায় সে কঠোর বাস্তবকে খন্ডন করে এক সুকুমার কাল্পনিক বৃত্তহীন জগত তৈরি করে যেন নিজেই নিজের ভাবনাকে খন্ডন করে পরিত্রাণ চায়-
“ইহারা পরস্পরকে ভালবাসিবে, সে ভালবাসার তুলনা নাই, একই অবস্থায় নিপতিত দুইটি অসহায় ব্যক্তির মুখাপেক্ষিতা ইহা নহে, শাসিতের প্রতি শাসকের অনুকম্পা বা অনুগ্রহ নহে, কেবল হৃদয় দিয়া তাহারা ভালবাসিবে, সত্য অমলিন সর্বান্তকরণ সেই ভালবাসা।…”
ভাবনার এই পর্যায়ে এসে ত্রিলোকপতি বুকে খচ করে একটা যন্ত্রণা অনুভব করে। যদি এমনটা না হয়!
“মানুষের প্রেমের ট্র্যাজেডি মৃত্যুতে নয়, বিরহে নয়, অবসাদে আর ক্ষুদ্রতার পরিচয়ে আর উদাসীনতায়। ত্রিলোকপতি মনে মনে একটু ক্রুর হাসিল, নিজেরই উদ্দেশ্যে। খারাপ হালকা আয়নার ভিতর ছায়া বিকৃত অদ্ভুত দেখায় এ-ও তেমনি। অর্থাৎ তাহার নিজের মন অতিশয় ক্রুর বলিয়া প্রেমের এই অসম্ভব বিকৃতির কথা সে ভাবিতেছে।… সে যাহা হউক… ইহারা পরস্পরকে ভালবাসিবে… সে হইবে তীর্থতুল্য। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থ ইহাই।”
গল্পটিকে আসলেই বিবাহ, নারী পুরুষের বিবাহোত্তর সম্পর্ক, দাম্পত্য প্রেম নিয়ে ত্রিলোকপতির দীর্ঘ বিশ্লেষিত প্রতিবেদন বলা চলে, যার মাধ্যমে লেখক বাস্তব ও কল্পনার জগতের এক ধূপছায়া তৈরি করেছেন। ত্রিলোকপতির ভাবনার মাধ্যমে নিজের সৃষ্ট “কলুষিত জগত” টার গায়ে আঘাত করেছেন এবং ত্রিলোকপতির তীর্থগমনের মাধ্যমে নিজেই যেন রূঢ় বাস্তব থেকে মুক্তি নিয়ে খোলা হাওয়াতে মুক্তির নি:শ্বাস নিতে চাইছেন।
জগদীশ গুপ্তের কয়েকটি গল্প একই ধাঁচে তৈরি। “কলঙ্কিত সম্পর্ক”, “পামর”, “পুত্র ও পুত্রবধূ”। “কলঙ্কিত সম্পর্কে”-র সাতকড়ি, “পামর”-রের তমাল কৃষ্ণ, “পুত্র ও পুত্রবধূ”র অমৃতানন্দ একই গোত্রের, আদি রসে পরিপূর্ণ, সূক্ষ্মতাবর্জিত। এদের স্ত্রীরা মর্মান্তিক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত। মাখনবালা, মাধবী ও মায়া তিনটি চরিত্রই প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, অসুস্থ দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে বিক্ষত তিনটি চরিত্রের ভাষ্য আদতে একই।
যে সময়ে বসে জগদীশ গুপ্ত লিখছেন, সেই সময়ের থেকে অগ্রসর ভাবনাই তার লেখাকে আজকের পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেই সময়ের ভাবুকতার কোনও প্রভাব তাঁর একটিও লেখাতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁর নিজস্ব স্বতন্ত্র জগতটিই সৃষ্টি করে তাঁর নিজস্ব কথনশৈলী, অন্তরালের অন্ধকার প্রকট করে তুলবার যথার্থ শব্দপ্রয়োগ।
শ্রদ্ধেয় কবি ও আলোচক মোহিতলাল মজুমদার জগদীশ গুপ্তের গল্পের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন — ” মানুষের প্রতি গভীর এক অশ্রদ্ধাই তাঁর রচনার প্রধান লক্ষণ…”
অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন — “…..জগদীশের সাহিত্যের মূল কথাই হলো মনুষ্যত্বে অবিশ্বাস…. ”
অথচ জগদীশ গুপ্তের গল্পে অজস্র মর্যাদাসম্পন্ন চরিত্রের সন্ধান মেলে, বিশেষ করে নারীচরিত্র। এরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং অন্যায়ের কাছে আপোষহীন। এরা মনুষ্যত্বহীনতা দেখে জর্জরিত হয় এবং অবিরত মনুষ্যত্বের অনুসন্ধানে রত থাকে। (ক্রমশ)