বুধবার | ১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১:৫৩
Logo
এই মুহূর্তে ::
মনসার নাম কেন ঢেলাফেলা : অসিত দাস ভোও.. ও ..ও.. কাট্টা…! ভো… কাট্টা…! : বিজয় চৌধুরী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা : সন্দীপন বিশ্বাস নারীবেশী পুরুষ অভিনেতা শঙ্করকে সামাজিক ট্যাবুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় না : বিশ্বেন্দু নন্দ সাসারামের রোহতাসগড়, বৃহতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ : নন্দিনী অধিকারী জমিদার রবীন্দ্রনাথ : আহমাদ ইশতিয়াক আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর, এবারও অধরা রইলো আলোচনা : সুমিত ভট্টাচার্য জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব চাষির দুঃখের ঘরে সাপের বাসা, আজও রেহাই নেই ছোবলের হাত থেকে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সল্টলেক তথা লবণহ্রদই কি কুচিনান : অসিত দাস পদ্মা বা পার্শ্বপরিবর্তনী একাদশী ব্রতকথা : রিঙ্কি সামন্ত জয়া মিত্র-র ছোটগল্প ‘ছক ভাঙার ছক’ কত দিন বিনা চিকিৎসায় চলে যাবে অসুস্থ মানুষের প্রাণ? প্রশ্ন দেশ বাঁচাও গণমঞ্চের : সুমিত ভট্টাচার্য দেবী করন্দেশ্বরীর পূজো ঘিরে উৎসবের আমেজ মন্তেশ্বরের করন্দা : প্রবীর কুমার সামন্ত প্রেতবৈঠকে (প্ল্যানচেট) আত্মার আগমন : দিলীপ মজুমদার সংগীত সাধক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য : রিঙ্কি সামন্ত শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যের অন্দরে বাহিরে বিরাজমান সিণ্ডিকেট : তপন মল্লিক চৌধুরী কবিতা সিংহ-এর ছোটগল্প ‘পশ্চিম রণাঙ্গন আজ শান্ত’ কলকাতার আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠী : অসিত দাস মঙ্গলবারের মধ্যে কাজে ফিরুন — সুপ্রিম ধমক, উৎসবে ফিরুন — মমতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (পঞ্চম পর্ব) : বিজয়া দেব বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত হাঁসের ডিমের উৎপাদন বাড়াতে এগিয়ে এল রাজ্যের প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতর : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় এ আমার এ তোমার পাপ : দিলীপ মজুমদার জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (চতুর্থ পর্ব) : বিজয়া দেব রোহিঙ্গা সংকট — ত্রান সহায়তা ও কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে কি তিলোত্তমা সুবিচার পাবে : তপন মল্লিক চৌধুরী বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত সময় হোক বা পরিস্থিতি, প্রণাম সব শিক্ষককেই : প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (তৃতীয় পর্ব) : বিজয়া দেব
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘কুইট ইণ্ডিয়া’

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় / ১০৬ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৪

ওটি আর-এর একখানি প্যাসেঞ্জার গাড়ি আসিতেছে গোরক্ষপুরের দিক থেকে। ভিড় যথেষ্ট আছে, তবে প্রথম শ্রেণীর কামরাটা একেবারে খালি, মাত্র আমি আছি আর একটি ইংরাজ যুবতী; ইংরাজ বলিয়াই যুবতী বলিলাম, বয়স প্রায় সাতাশ আটাশ হইবে। গোটা-দুই ষ্টেশন একত্রে আসার পর তিনি একটু গল্প-প্রবণ হইয়া উঠিলেন।

অনেকগুলি কারণ ছিল; প্রথমতঃ অন্য সঙ্গীর অভাব, দ্বিতীয়তঃ আমি সামরিক পোষাক পরিহিত, সুতরাং অতটা অপাঙ্ক্তেয় নই, তৃতীয়তঃ, যাহা কথাবার্তায় টের পাইলাম, তিনি সদ্য বিলাত হইতে আসিয়াছেন, এদেশটা সম্বন্ধে কৌতুহলও টাটকা আর এখনও কৃষ্ণবিদ্বেষটা উগ্র হইতে পায় নাই। নাম বলিলেন মিস ফ্লোরা গ্রেস। ছাপরার কাছাকাছি একটা জায়গায় কে একজন মিষ্টার ট্রেভার কিছু জমিদারী এবং কৃষিসম্পত্তি লইয়া আছেন, তাঁহারই সাক্ষাৎকারে যাইতেছেন। মিস গ্রেস নিজে মাসকয়েক হইল দেরাদুনের নিকটবর্তী কোন একটি জায়গায় একটি ইংরাজ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা লইয়া আসিয়াছেন। মিষ্টার ট্রেভার সম্প্রতি সেখানে শৈলবিহারে গিয়াছিলেন, আলাপ হয়, নিমন্ত্রণ রাখিয়া আসিয়াছিলেন।

অর্থাৎ কোর্টশিপ চলিতেছে। আন্দাজের কথাটা আমিই বলিলাম, তবে অত স্পষ্ট করিয়া নয়, একটু হাসিয়া বলিলাম— “মিষ্টার ট্রেভারের সৌভাগ্যে তাঁকে অভিনন্দিত করছি যে, এই নিদারুণ গ্রীষ্ম অগ্রাহ করে আপনি তাঁর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছেন।”

মিস গ্রেসের হাসিতে একটু লজ্জা জড়াইয়া পড়িল, বলিলেন— “কিন্তু আমি তাঁর সৌভাগ্যকে প্রীতির চক্ষে দেখতে পাচ্ছি না মিষ্টার মুখার্জি— যদি সৌভাগ্যই হয় সেটা— উঃ, কী অসহ্য গরম— নরক একেবারে!”

সত্যই অসহ্য গরম। জুন মাস, তায় সময়টাও দুপুরের কাছাকাছি। পাখা চলিতেছে –কে যেন অদৃশ্য আগুন লইয়া দেয়ালীর আজি ৰাজি খেলিতেছে। বলিলাম— “কিন্তু মিষ্টার টেভারেরই তো এই সময় শৈল-নিবাসে থাকা উচিত ছিল, তা না করে আপনাকে যুদ্ধ এই অগ্নি পরীক্ষায় টানলেন যে?”

মিস গ্রেসের মুখটা গম্ভীর হইয়া গেল, জানালার দিকে ফিরাইয়া লইয়। নিরুত্তর হইয়া বসিয়া রহিলেন। বেশ একটু অপ্রস্তুত হইয়া গেলাম, কি বেফাস হইয়া গেছে নাকি? অথচ আসল যেখানে ঠাট্টা করিলাম সেখানে তো বিরক্তির কোন লক্ষ্মণই দেখা গেল না, বরং ইহারা বেশ সময়মত ঠাট্টাগুলা যেমন প্রীতিভরেই গ্রহণ করেন, সেইভাবেই করিলেন গ্রহণ। কিছু বলিয়া সামলাইতে যাওয়া ঠিক হইবে কিনা ভাবিতেছি, এমন সময় মিস গ্রেস মুখটা আবার ফিরাইয়া আনিলেন। রাগ নয় কপট রোষের অভিনয় করিয়া বলিলেন— “শুনুন মিষ্টার মুখাজি, সত্যি কথাটা যদি বলতেই হয়, এর জন্যে দায়ী আপনারাই।”

একটু হাসিয়া প্রশ্ন করিলাম— “কি করে তা জানতে পারি কি?”

“সব দিক দিয়েই, একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারাবন। আমরা আপনাদের যা শাস্তি আর স্বচ্ছন্দতা দিয়েছি, তার বদলে আপনারা আমাদের শাস্তি হরণ করতে বসেছেন। বেশি দিনের কথা নয় যে আপনাদের স্মৃতিপথ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে,— এই কিঞ্চিদধিক শ-দেড়েক বৎসর— একবার ভেবে দেখুন কি অবস্থ। ছিল এই দেশের যুদ্ধ বিগ্রহে দেশ ছিন্ন ভিন্ন, প্রতিটি রাজদরবার চক্রান্তের কেন্দ্র, রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে, যা বা আছে দিনে ব্যবহারের জন্যও নিরাপদ নয়, যানবাহন সেই আদম ঈভের সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়— আপনারা যে জগতের সর্ব পুরাতন জাতিদের অন্যতম একথা আমরা অস্বীকার করি না, কিন্তু যে— অবস্থায় আপনারা ছিলেন, তখন তাতে আফ্রিকা বা অষ্ট্রেলিয়ার আদিম জাতিদের চেয়ে খুব বেশি প্রভেদ ছিল না। এর জায়গায় আমরা কি দিয়েছি একবার ভেবে দেখুন মিষ্টার মুখার্জি— শক্তিমান কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত করে প্রথমতঃ দরবারে দরবারে চক্রান্ত আর পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহের নিরসন করেছি। রাস্তাঘাট এখন সুগম এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ, যানবাহনে আপনারা বোধ হয় পৃথিবীর সভ্যতম জাতির সমকক্ষ— সভ্যতা আর বৃষ্টির দিক দিয়েও দেখুন আমাদের প্রবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্ট আপনাদের কবি, বৈজ্ঞানিক জগতের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল প্রাইজ পর্যন্ত অর্জন করে নিয়ে এসে আপনাদের দেশকে গৌরবান্বিত করেছেন। অল্পাধিক দেড় শতাব্দীর ব্যবধানের ভারতবর্ষের এই দুটি রূপ, অথচ আজ আপনারা এইভাবে তোয়ের হয়ে নিয়ে আমাদেরই বলছেন— ‘কুইট ইণ্ডিয়া’ ! আমার রূঢ়তা মার্জ্জনা করবেন মিষ্টার মুখার্জ্জী, কিন্তু আমি একটা কথা জিগ্যেস করি— অকৃতজ্ঞতা কি এর চেয়ে বেশী দূরে যেতে পারে?”

দেখিলাম সংযমের জ্ঞান যথেষ্ট থাকিলেও মিস গ্রেস উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছেন। বেশ একটু ফাপরে পড়িলাম— স্ত্রীলোক, তায় গাড়ীর মধ্যে নিঃসঙ্গ, ওঁর বাধা গতের মত তর্কগুলার উত্তর দিতে তো পারিলাম না, এমন কি নোবেল প্রাইজ পাওয়া লইয়া যে সাংঘাতিক ভ্রান্ত ধারণা রহিয়াছে সেটাও দূর করিতে কেমন যেন একটা দুরূহ সঙ্কোচ বোধ হইল৷ ঠাণ্ডা করিবার জন্যই বলিলাম— “একটা জাত স্বাধীনতার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে মিস গ্রেস— তাদের দোষ ত্রুটি বা আতিশয্যগুলো আপনাদের মতো স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষদের একটু ক্ষমার চক্ষেই দেখা উচিৎ নয় কি?”

মনটা বোধ হয় একটু ভিজিয়া থাকিবে, কেননা মিস গ্রেস আর করিলেন একটু নরম সুরেই, কিন্তু বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেইরকম উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন— হয়তো একটু বেশিই, বলিলেন— “তর্কের খাতিরে আপনার কথাটা মেনে নিলেও এটা আপনাকে খোলাখুলি জানিয়ে দেওয়াই ভালো মনে করি মিষ্টার মুখার্জি যে আপনারা একটা ধুয়ো তুলেছেন বলেই যে আমরা এ-দেশ ছেড়ে চলে যাব এটা আপনারা যেন স্বপ্নেও না ভাবেন। আপনাদের গলার জোর থাকতে পারে কিন্তু তর্কের মধ্যে কোন জোর নেই। আর আমাদের জাত যদি কোন জিনিসকে মর্যাদা দিতে অভ্যস্ত থাকে তো তা তর্কের সারবত্তা, কণ্ঠের শক্তি নয়। কণ্ঠশক্তি নিয়োগ করার মধ্যে একটিমাত্র উদ্দেশ্য থাকতে পারে মিটার মুখার্জি, ভয় দেখানো; যে জাত নিজের শক্তি আর অধ্যবসায়ের গুণে অর্ধেক পৃথিবীতে তার উপনিবেশ স্থাপন করলে সে কি এতই ভয়প্রবণ যে, আপনাদের গলাবাজিতেই তাদের অধিকার ছেড়ে পালিয়ে যাবে?”

একটু না টুকিয়া পারিলাম না, তবে যতটা সম্ভব রমণীশ্রুতির উপযোগী করিয়াই বলিলাম— “মাপ করবেন মিস গ্রেস— পৃথিবীতে আপনাদের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। জাতি হিসাবে সবচেয়ে বড় বিধান দাতা (Law giver) বলে আপনাদের একটা খ্যাতিও আছে— তাই জিগ্যেস করছি অধিকার জিনিসটা এলো আপনাদের কোথা থেকে। আপনি বিদুষী, অধিকারের মূলে যা যা থাকে তা তো নিশ্চয় আপনার অজ্ঞাত নয়…”

উণ্টা ফল হইল, মিস গ্রেস এক রকম অসংযত হইয়াই উঠিলেন, মুখ একেবার সিঁদুরবর্ণ হইয়া উঠিল, ওষ্ঠাধরও মাঝে মাঝে কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল, যে তর্কের সারবত্তার ওপর এত শ্রদ্ধা তাহার ধার দিয়াও না গিয়া বলিলেন— “দেখুন মিষ্টার মুখার্জি, অধিকার সম্বন্ধে পাঠ আমাদের অন্যের কাছ থেকে নিতে হবে না, সে জ্ঞান আমাদের যথেষ্টই আছে এবং আমাদের অধিকার কি করে রক্ষা করতে হয় তা আমরা ভালো রকমই জানি। তাহলে কথাটা আরও একটু স্পষ্ট করেই বলি— মিষ্টার ট্রেভার আর আমার মধ্যে বাগদান হয়ে গেছে। কংগ্রেস গবর্ণমেন্ট ফিরে আসায় আবার ‘কুইট ইণ্ডিয়া’ রব ওঠায় এবং আপনি যে ঐ অধিকারের কথা বললেন, সে প্রশ্ন নিয়েও চারদিকে গুগতান ওঠায় তাঁকে তাড়াতাড়ি এই অগ্নিকুণ্ডে নিজের জমিদারিতে ফিরে আসতে হয়েছে। আশা ছিল যুক্তির জয় হবে, তা তাঁর যে কখানি চিঠি পেয়েছি তার প্রত্যেকটিতেই এই খবর যে, অবস্থা দিন দিনই খারাপ হয়ে উঠছে। শেষে আমি পৰ্য্যস্ত অভিষ্ঠ হয়ে এই চলেছি। কেন তা আন্দাজ করতে পারেন?”

দীর্ঘ উচ্ছ্বাসে বেশ বিপর্যন্তই হইয়া পড়িয়াছিলাম, বলিলাম— “আজ্ঞে না, কৈ আন্দাজ করতে পারছি না তো কিছু

অর্থাৎ এবার ভালোমন্দ কিছুই বলিলাম না, যদি এভাবেই উত্তাপটা কমে। কিছু না। মিস গ্রেস এবার দৃষ্টিতে খানিকটা শাসনের ভাব মিশাইয়া বলিলেন— “ইংরাজ রমণী হিসাবে আমি তাঁর বিপদে তাঁর পাশে গিয়ে দাড়াতে যাচ্ছি মিষ্টার মুখার্জি, কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটা সঙ্কল্প নিয়ে— যদি তিনি ভয়ে বা অন্য কোন কারণে এদের অন্যায় আবদারে নিজের অধিকার ছেড়ে সড়ে দাড়ান তো তাঁকে আরও একটি জিনিসের মায়া ছাড়তে হবে……”

মিস গ্রেস আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন— অর্থাৎ আমায় ; আমি যাচ্ছি, হয় আমাদের এনগেজমেন্ট দৃঢ় করে আসব, না হয় একেবারেই চিরতরে ভেঙে দিয়ে আসব। তাহাকে প্রশ্রয় দেওয়ায় আমি অভ্যস্ত নই। আপনাদের অধিকার আমাদের চেয়ে যে বেশি, তা সাব্যস্ত করতে হলে আমরা খুব বিশ্বাসজনক প্ৰমাণ চাই মিস্টার মুখার্জি; যদি মনে করেন, মুখে “কুইট ইণ্ডিয়া” বললেন, আর আমরা তল্লি-তল্লা বেঁধে…

এমন সময় গাড়িটা একটা স্টেশনে আসিয়া পড়িল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কামরায় যেন একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। গাড়ীর দুই পাশের দোর-জানালা দিয়া দুইটা যাত্রীদল পিল পিল করিয়া ঢুকিয়া পড়িয়া গাড়িটা একেবারে ভর্তি করিয়া ফেলিল— কেহ নিজের শক্তিতে উঠিল, কাহাকেও ভিতর থেকে টানিয়া তুলিল, কাহাকেও বাহির হইতে ঠেলিয়া তুলিল; নানা রকমে ছোটবড় জিনিসপত্র আসিয়া যেখানে সেখানে পড়িতে লাগিল এবং মিনিট দুয়েকের মধ্যে অমন যে খালি কামরাটা তাহাতে তিল ফেলিবার ঠাঁই রহিল না৷ ছোট স্টেশন, ইতিমধ্যে ট্রেনটা হুইসিল দিয়া ছাড়িয়া দিল এবং গোলমাল যে হইতেছিল, সেটাকে ছাপাইয়া ভিতর এবং বাহির থেকে একটি চীৎকার উঠিল— “বর ওঠে নি— বর ওঠে নি!… বর ছেড়ে গেছে!…”

কয়েকজন দুইধার থেকে এলার্ম চেন টানিয়া ধরিল এবং গাড়ীটা ভালো করিয়া থামিবার পূর্বেই দুই দিকের জানলা গলিয়া দুইটি বর দুই দিক হইতে হাতে হাতে, পাজায়-পাজায় গাড়ির মাঝখানে আসিয়া পড়িল। গাড়ি আবার ছাড়িতে যেটুকু বিলম্ব হইল, তাহাতে সবাই আরও তককগুলা লোককে গাদিয়া গাদিয়া দুই দিক হইতে চালান করিয়া দিল।

মিস গ্রেস একেবারে হতভম্ব হইয়া গেছেন খানিকটা যে ভীতৎ, সেটা বেশ বোঝা যায়। অত যে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিলেন, মুখে একেবারে রা নাই। শুধু বিস্ফারিত নেত্রে সব দেখিয়া যাইতেছেন। ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁহাকে কোণের জায়গাটিতে বসাইয়া নিজে পাশে বসিয়াছি এবং মাঝখানে আমাদের দুইজনের সুটকেস রাখিয়া একটা অন্তরালের সৃষ্টি করিয়া দিয়াছি। এতক্ষণ ভিতরের ব্যাপারই লক্ষ্য করিতেছিলেন, গাড়িটা একটু অগ্রসর হইলে একবার বাহিরের দিকে মুখ বাড়াইয়া ত্রস্ত কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন— “মিস্টার মুখার্জি, একবার বাইরে চেয়ে দেখুন! এ কি! এমন দৃশ্য তো জীবনে দেখিনি!…”

গলা বাড়াইয়া যাহা দেখিলাম, তাহা সম্পূর্ণ না হইলেও কতকটা অভিনব বটেই। গাড়ির পা’দানে আগে থাকতেই বেশ কিছুটা লোক ছিলই— আগাগোড়া— এখন সেখানেও রীতিমতো ভিড়, তাহার উপর যা সমস্ত দৃখটাকে আরও দর্শনীয় করিয়া তুলিয়াছে, তাহা ভিড়ের গায়ে বিলম্বমান নানারকম বাজনা-ঢাক, জয়ঢাক, বড় বড় করতাল, ক্ল্যারিনেট, কর্নেট আরও সব জটিল বিলাতি বাজনা; ব্যাগপাইপ, দেশী ঢোল, ঢাক, সানাই, রামশিঙা— রকমারি ব্যাপার একেবারে! আমাদের গাড়ির দুই দিকে একেবারে দুই-তিনখানা গাড়ি পর্যন্ত। ওদিকেও নিশ্চয় এই অবস্থা। আর এই সমস্তর উপর ছাপরা জেলার জুন মাসের ভরা দুপুরের রোদ যেন ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। ভিতরের হাওয়াই আগুনের হল্কা।

মিস গ্রেস সেই রকম বিমূঢ় দৃষ্টিতেই চাহিয়া প্রশ্ন করিলে— “কিছু ঠাহর করতে পারছেন? যেন মিলিটারী ব্যাণ্ডের মতো দেখাচ্ছে, মতলবখানা কি ওদের?”

বেশ বোঝা যায়, আগস্ট বিদ্রোহের আতঙ্কের নূর রহিয়াছে কণ্ঠে। বলিলাম— “ না অন্য ব্যাপার কিছু নয় মিস গ্রেস, এ আমাদের দেশের একটা খুব সাধারণ ব্যাপার— বিবাহ হতে চলেছে; এর সঙ্গে বাজনা-বাজি থাকাটা আমাদের একটা রেওয়াজ; আপনি সবে এদেশে এসেছেন, তাই আপনার নতুন ঠেকছে; দেখবেন, মিস্টার ট্রেভার এতে বেশ অভ্যন্ত।”

মিস গ্রেস স্থিরদৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া রহিলেন, কি বলিবেন যেন, কথা জোগাইতেছে না, শেষে ধীরে ধীরে টানিয়া টানিয়া বলিলেন— “এমন অসাধারণ একটা ব্যাপার এখানকার সাধারণ রেওয়াজের মধ্যে মিস্টার মুখার্জি? বলেন কি আপনি? এদের প্রাণশক্তি দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি!”

আশ্চর্য হইবার তখনও অনেক কিছুই বাকি ছিল এবং এর পর যাহা দেখিলেন, তাহাতে মিস গ্রেস একরকম বাক্‌শক্তি রহিত হইয়া বসিয়া রহিলেন বলিলে অত্যুক্তি হয় না৷

মিস গ্রেসের প্রশ্ন করিবার ক্ষমতাই যেন লুপ্ত হইয়া গেল এবং অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কোন প্রশ্ন করিলে বোধ হয় আমাকেও নিরুত্তরই থাকিতে হইত৷

নবাগতদের মধ্যে জায়গা লইয়া খুব একচোট কাড়াকাড়ি পড়িয়া গেল। ছাপরা জেলা, কেউ হাটবার পাত্র নয়, বচসা প্রচণ্ডতর হইতে হইতে ক্রমে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইল, তাহার পর ওরই মধ্যে কয়েকজনের মধ্যস্থতায় সবাই এক রকম ঠাণ্ডা হইয়া গেল। কতকটা ব্যবস্থাও হইল— ওদিককার বেঞ্চে ওদলের মাতব্বরেরা বরকে লইয়া একটু গুছাইয়া সুছাইয়া বসিল; এদিককার বেঞ্চেও সেই ব্যবস্থা হইল, বাকি সবাই দাড়াইয়া রহিল বা মালপত্রের উপর গাদাগাদি করিয়া বসিয়া রহিল, ওরই মধ্যে দুইটা দলের মধ্যে কিন্তু পার্থক্যটা বজায় রাখিয়া চলিল। আমার পাশেই যে ভদ্রলোকটি বসিয়াছিলেন তাঁহার নিকট হইতে কিছু ভিতরকার খবর জোগাড় হইল। বরপক্ষীয়েরা একই জায়গার লোক, পরস্পরের জ্ঞাতি, জাতিতে রাজপুত। স্টেশন থেকে মাইল ছয়েক দূরে সিমরি গ্রামের জমিদার; একদল নামিৰে ছাপরা, একদল সোণপুর। ওদিকে মোটা গোঁফ আর গালপাট্টা সমন্বিত প্রবীণ ভদ্রলোকটি ওদিককার বরের পিতা। নাম বাবু গুলজার সিং। ভয়ঙ্কর রাশভারি আর ফরিয়াদি লোক। এদিকতার কর্তা বরের বড় ভাই, এই বেঞ্চের যিনি শেষদিকে বসিয়া আছেন— মাথায় বাবরি, গোঁফ অত বড় নয়, তবে একটা রাজপুতী ঢং আছে, অত্যস্ত রগচটা মানুষ। নাম বলবত্ত সিং।

উভয় পক্ষের মধ্যে তিনপুরুষ ধরিয়া বৈরভাব চলিয়া আসিতেছে।

বলিলাম – “এরকম ফরিয়াদী আর খাপ্পা মেজাজের লোক একদিনেই বরযাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন— বৈরিভাবও বলছেন বনেদী, উঠলেনও এক কামরায়, একটা হ্যাঙ্গামা বাধবে নাতো?”

ভদ্রলোক একটু হাসিয়া নির্বিকারকণ্ঠে বলিলেন— “সেটা জগদম্বার ওপর নির্ভর করছে। তাঁর যদি ইচ্ছা হয় গোটাকতক শির ধড় থেকে নামলে আপনি আমি কি রুখতে পারব বাবুজি? রাজপুতের বিয়ে— আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন? প্রায় তো লেগেছিল, জগদম্বার ইচ্ছেয় থেমে গেল তাইতো? তাঁরই মর্জি হলে আবার বেধে যেতে কতক্ষণ? দুই কর্তার মুখের ভাবটা একটু লক্ষ্য করুন না।”

সত্যই লক্ষ্য করিবার বিষয়। দুইজনেই বাহিরের দিকে মুখ করিয়া বসিয়া আছেন, অত্যন্ত গম্ভীর। ওরই মধ্যে ঘাড় ফিরাইয়া কয়েকবার পরস্পরের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, বার দুয়েক বোধ হয় চোখোচোখিও— হইয়া গেল তাহাতে মুখ দুইটা আরও গম্ভীর হইয়া উঠিল— ভিতরে খুব উগ্ররকম কোন চিন্তাধারা চলিতেছে।

মেমসাহেব নিথর নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছেন, বাহিরে অমন জ্বলন্ত হাওয়া তবু মুখটা এক একবার একটু বাড়াইয়া দৃশ্যটা না দেখিয়া লইয়া যেন পারিতেছেন না। ভীষণতার যে একটা মোহিনী শক্তি আছে সেটা যেন তাঁহাকে পাইয়া বসিয়াছে। কিছু বলিতেছেন না কিন্তু নিশ্চয় পারিতেছেন না বলিতে।

অবশ্য গাড়ির মধ্যে উভয় পক্ষ মিলিয়া খুব একটা হৈ হল্লা চলিয়াছে। তবে সেটা মিশিয়া যাইতেছে না, এদিকে-ওদিকে পার্থক্যটা মোটামুটি বজায় আছে। মিশিয়া গেলে অর্থাৎ এই অবস্থায় আবার বচসা সুরু হইয়া গেলে অবস্থাটা কিরূপ দাড়াইবে ভাবিতেছি এমন সময় আমাদের দিকে হঠাৎ যেন একটা রামশিঙ্গার আওয়াজ উঠিল। মিস গ্রেস এক রকম চমকাইয়া মুখটা বাড়াইয়া তখনই টানিয়া লইলেন, চক্ষু দুইটি বিস্ময়ে আরও বিস্ফারিত হইয়া গেছে। কিছু একটা প্রশ্ন করিতেন কিন্তু আরও রুন্ধবাক হইয়া গিয়া যেন পারিতেছেন না। ওঁর কথাটা নিজের হইতেই—

“Mr. Mukherjee, I am surprised at their stamina!”

ওঁর পরেই লক্ষণীয় ছিল দুই বরকর্তার মুখের ভাব। ঘটনাটা আমাদের দিকের, এই অগ্নিবৃষ্টির মধ্যে কেহ রামশিঙায় ফুঁ দিতে পারে এটা বাৰু বলবন্ত সিংএর রাজপুতী কল্পনারও অতীত নিশ্চয়, তিনি একবার ঝুঁকিয়া বাহিরে চাহিয়া লইয়া গোঁফে একটু তা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে অনিচ্ছাকৃত হইলেও তাঁহার ব্যঙ্গপূর্ণ দৃষ্টির খানিকটা তির্যক রেখায় বাবু গুলজার সিংএর উপর গিয়া পড়িল। তিনি বোধহয় এই রকম একটা কিছু প্রত্যাশাই করিয়াছিলেন, ঘাড় ফিরাইতে একটু চোথোচোখিও হইয়া গেল দুইজনের। সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র গুম্ফ আর গালপাট্টার নীচে তাঁহার সুগৌর মুখমণ্ডল একেবারে রাঙা হইয়া উঠিল ৷ ব্যাপারটা দুই দিকের সবাই লক্ষ্য করিল এবং হঠাৎ সমস্ত গাড়িটাতে একটা থমথমে ভাব আসিয়া পড়িল। বাবু গুলজার সিং মুখটা খানিকক্ষণ বাহিরের দিকেই করিয়া রাখিলেন— রাগে ফুলিতেছেন। মেম সাহেব নিশ্চয় অতটা কিছু বুঝিতে পারিতেছেন না, রামশিঙার বিস্ময়েই অভিভূত হইয়া আছেন। আমি কিন্তু দুই রাজার লড়াইয়ে উলুখড়ের নসিবের কথা চিন্তা করিয়া ভিতরে ভিতরে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছি— বিশেষ করিয়া এই বিদেশিনীর জন্য। বাইরের লোক হিসাবে প্রয়োজন হইলে আমার এর মধ্যে পড়িয়া দুই পক্ষকে ঠাণ্ডা করিতে যাওয়া ঠিক হইবে কিনা ভাবিতেছি, এমন সময় বাবু গুলজার সিং গর্জন করিয়া উঠিলেন— “তেওয়ারী!”

—এই প্রথম তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিলাম, শুনিবার জিনিস বটে!

ডাকটা সবার কণ্ঠেই প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। দরজার কাছে— “গরীব পরবর!” বলিয়া একটা প্রত্যুত্তর হইল এবং একটি লোক ভিড় ঠেলিয়া হওদস্ত হইয়া সামনে আসিয়া কুর্ণিশ করিয়া দাড়াইল— যেমনি লম্বা তেমনি আড়ে, মাথায় গোলাপী রঙের বিরাট শাফা, হাতে পেতলে- বাঁধানো লাঠি, পাশে ঘুন্টি দেওয়া পাঞ্জাবীর ওপর সোনার তাগার একটা একটা মালা।

এ তরফেও হুকুমের প্রত্যাশায় সবাই বাবু বলবন্ত সিংএর মুখের দিকে চাহিয়াছে।

শ্রাদ্ধটা কিন্তু ওদিকে গড়াইল না, সবাই একটু বেশী প্রত্যাশা করিয়া বসিয়াছিল। বাবু গুলজার সিং সেই রকম জলদ-গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করিলেন— “এটা বিয়ে হতে যাচ্ছে, না শ্মশানযাত্রা?”

কথাটার তাৎপর্য্য তেমন বুঝিতে না পারিয়া তেওয়ারী শুধু আর একটা কুর্ণিশ করিয়া বেশ সোজা হইয়া দাড়াইল।

আরও এক পর্দা চড়া সুরে প্রশ্ন হইল— “বাজনদারেরা যদি ছেড়েই গেল তা আমাদের আসবার কি দরকার ছিল— আমার ছেলের বিয়ে দিতে যাচ্ছি কি আমায় শ্মশানযাত্রা করাচ্ছ তোমরা? বলো, কথা কইছ না কেন?”

তেওয়ারী একবার পিছনে সবাইয়ের উপর দৃষ্টি বুলাইয়া লইল এবং সে ও আরও কয়েকজন একসঙ্গে বলিয়া উঠিল— “বাজনদারেরা তো এসেছে হুজুর… চারটে দল তাদের আগে চড়িয়ে আমরা তবে উঠেছি… কি কথা হুজুর, তাদের না চড়িয়ে আমরা উঠতে পারি কখন!”

“এসেছে যে তার প্রমাণ কি? বাজনা কোথায়?” সবাই চুপ করিয়া রহিল, এ অবস্থার মধ্যেও যে বাজনার প্রত্যাশা করে তাহাকে কি উত্তর দেওয়া যায় যেন ভাবিয়া পাইতেছে না ; শেষে মোসাহেবগোছের একজন একটু সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিল— “হুজুর, তারা সব এক হাতে হ্যাণ্ডেল ধরে কোন রকমে ঝুলতে ঝুলতে চলেছে, বাজাবার একটু কোনও উপায় থাকলে তারা ছাড়ত না, সে পাত্রই নয় তারা…”

এই সময় রামশিঙায় আর একটা আওয়াজ উঠিল এবং বলবস্তু সিং নিজের কয়েকজন লোকের উপরই দৃষ্টি বুলাইয়া লইয়া ঈষৎ হাসিয়া গোঁফে একটু চাড়া দিলেন।

বাবু গুলজার সিং মোসাহেবের কথায় গভীরভাবে উত্তর করিলেন, “এর পরের ষ্টেশনেই সবাই নেমে যাবে, ফিরে যেতে হবে! তোমরা ভেবেছ গুলজার সিং মরেছে, কিন্তু সেটা তোমাদের ভুল ধারণা!”

এর পরে আর কিছু বলিলেন না। ভিড়ের ও-অংশে সেই রকম—

সে এশিয়ার করিয়া শো তেওয়ারীকে লইয়া কয়েকজন মাতব্বর একত্র হইয়া কি একটা পরামর্শ আঁটিতে লাগিল। গাড়ীর বেগ কমিয়া আসিল, গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, একটা ষ্টেশন আসিতেছে।

গাড়ী থামিলে তেওয়ারী নামিয়া গেল। ছোট ষ্টেশন, মিনিট দুয়েক থামিল গাড়ীটা, চলিতে আরম্ভ করিলে তেওয়ারী আসিয়া আবার উঠিয়া পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে এদিক পানে অনির্দিষ্ট ভাবে এমন একটা কটাক্ষ হানিল, যাহার অর্থ দাড়ায়— “এইবার চলে এসো।” তাহার পর রামশিঙাটি বাজিয়া উঠিতে যা দেরী, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ীর ওদিকে চারটে দলের যত রকম যন্ত্র থাকিতে পারে— করনেট, ক্লারিওনেট, ব্যাগপাইপ, সানাই, রামশিঙা— সেই অগ্নিবর্ষী আকাশের নীচে একসঙ্গে আর্তনাদ করিয়া উঠিল৷ মিস গ্রেসের চোখ দুইটা বিস্ময়ে যেন ঠেলিয়া বাহির হইয়া আসিবে, আমার পানে চাহিয়া বলিলেন— “এযে পুরোদস্তুর সঙ্গীত, মিষ্টার মুখার্জি!!

(This is full-fledged music Mr. Mukherjee!)”

অবশ্য ঠিক সঙ্গীত বলিতে যা বোঝায় তাহার কিছুই নয়,— তবে কোন যন্ত্রই বোধ হয় বাদ নাই, সুর-তালকে ছিন্ন ভিন্ন করিয়া সবগুলা যেন একটা প্রলয় তাণ্ডবে মাতিয়া উঠিয়াছে।

বাবু বলবন্ত সিঙের মুখ দেখিলাম একেবারে ছাইপানা হইয়া গেছে। বাবু গুলজার সিং জলদ গম্ভীর স্বরে বলিলেন— “ফরসী!”

চিলমচি অপেক্ষাই করিতেছিল, তাওয়াদার চিলিম আর গড়গড়ার ব্যবস্থায় মোতায়েন হইয়া গেল।

সমস্ত পথ একটানা ঐ ব্যাপার চলিল। বাবু বলবন্ত সিং একবারও গাড়ির দিকে মুখ ফিরাইলেন না। ক্রোধে, অপমানে আক্রোশে জ্বলন্ত আকাশের দিকে এক দৃষ্টে চাহিয়া স্তব্ধভাবে বসিয়া রহিলেন। গাড়ির গতিবেগ কমিয়া গেল, ষ্টেশন আসিল, গাড়ির শব্দ রহিত থাকায় বাজনার ঝঞ্ঝা আরও প্রবল হইয়া উঠিল। বাবু বলবন্ত সিংএর সান্ত্রী একবার গাড়ির ওদিকে দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করিয়া গাড়ি হইতে লাফাইয়া পড়িল। গাড়িটা মিনিট দুই-তিন থামিল, বাজনা ওদিকে আরও ঝঞ্ঝাময় হইয়া উঠিল, তাহার পর গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে বাৰু বলবন্ত সিংএর সাস্ত্রী একলাফে আবার গাড়ির উপর লাফাইয়া উঠিল, তেওয়ারীর সেই বিজয় দৃষ্টিকে স্বদে আসলে ফিরাইয়া দিয়া বেশ ঘটা করিয়া মনিবকে একটা কুর্ণিশ করিয়া আবার পাহারায় দাড়াইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দিকের আগে পিছনের কয়েকটা গাড়ির পাদান থেকেও বিশ-পঁচিশটা বাঘের সেই উৎকট ঝন্‌ঝনা।… বোধ হয় সম্বন্ধে আটকায় বলিয়া বাবু বলবন্ত সিং আর ‘ফরাসী’র ফরমাসটা করিলেন না, তবে গোঁফে চাড়া দেওয়ায় যতটা সম্ভব বিশিষ্টতা ফুটাইবার চেষ্টা করিলেন এবং নিজের সান্ত্রীর দিকে এমন একটি প্রসন্ন দৃষ্টিপাত করিলেন যাহাতে স্পষ্টই বোঝা গেল একটা মোটা বকশিস তাহার কপালে নাচিতেছে।

বাবু গুলজার সিংএর মুখটা আবার আরক্তিম হইয়া উঠিল, বাহিরের দিকে চাহিয়া অনেকটা পথ অতিক্রম করিলেন, তাহার পর আবার মেঘমন্দ্রস্বর উঠিল— “তেওয়ারী!”

তেওয়ারী ভিড় চিরিয়া তটস্থ হইয়া দাড়াইল।

“এমন গুঙা (বোবা) বাজনা কোথা থেকে জোগাড় করেছ তোমরা? জবাব দাও, চুপ করে কেন?” সবাই আবার স্তব্ধ হইয়া গেল, এমন কি ওদলের লোকেরা পর্যন্ত।

অর্থ টা বোধ হয় ধরিতে না পারায় তেওয়ারী একটু ব্যাকুলভাবে একবার সবার মুখের উপর দৃষ্টি বুলাইয়া আনিল, শেষে সেই মোসাহেব ভদ্রলোক আবার সাহস সঞ্চয় করিয়া করজোড়ে নিবেদন করিল, “কেন, আওয়াজ তো হচ্ছে হুজুর।”

কর্তা হুঙ্কার করিয়া উঠিলেন— “কিন্তু ঢাক ঢোলের আওয়াজ কোথায় মশাই? বাজনায় ঢাক নেই, বিয়েতে তো তাহলে কনে না থাকলেও চলে।” সকলের মুখ আরও অন্ধকার হইয়া গেল।

মিস গ্রেস আমার প্রশ্ন করিলেন— “আবার কি চায় ভদ্রলোক?” বলিলাম— “বাজনায় ঢাকের অভাব ওকে পীড়া দিচ্ছে।”

“কিন্তু তা কি করে সম্ভব মিষ্টার মুখার্জি?”

সবাই এক হাত— তাও আবার ডান হাতে হাণ্ডেল বা জানালার ফ্রেম ধরিয়া আছে, অন্য হাতে বাঁশী শিঙে ধরিয়া পরিত্রাহি ফু দিয়া যাইতেছে, যো-সো করিয়া দু’একটা আঙ্গুলেই কোন রকমে এক আধটা চাবি টিপিয়া, কিন্তু ঢাক সামলাইবে কি করিয়া?… উত্তর আর কি দিব? বিমুঢ় দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলাম।

এবার ষ্টেশনটা খুব কাছে, অল্পের মধ্যে গাড়ির গতিবেগ স্তিমিত হইয়া আসিল। থামিলেই দুই সান্ত্রীতে পরস্পরের প্রতি কটাক্ষ হানিয়া গাড়ি হইতে তড়াং তড়াং করিয়া লাফাইয়া পড়িল।

আমায় এর পরের ষ্টেশনেই নামিতে হইবে; বেশী দূরেও নয় সেটা। গোছগাছ করিতেছি এমন সময় মিস গ্রেস যেন দারুণ আতঙ্কে বলিয়া উঠিলেন— “দেখুন! মিষ্টার মুখার্জি, এদিকে দেখুন!! ও মাই গড!!”

একটা গাঁটরি মুক্ত করিতেছিলাম, যতক্ষণে মুখ বাহির করিয়া দেখিব যতক্ষণে গাড়িও ছাড়িয়া দিয়াছে সঙ্গীত আরম্ভ হইয়া গেছে। এবার একেবারে স-ঢাক; বাজনাও চলিতেছে সুরে তালে।

বাহিরে মুখ বাড়াইয়া একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম, একেবারে কল্পানাতীত ব্যাপার! এদিকে আমাদের গাড়ি আর আমাদের পেছনের দুইটা গাড়ির ছাত আর ওদিকে সামনের দুইটা গাড়ির ছাত আর ওদিকে সামনের তিনটা গাড়ির ছাত বোঝাই হইয়া গেছে। ঢাকি সানাইয়ে কর্ণেটি রামশিঙেওয়ালা কেহ বাদ নাই। লোকের উপর বাজনার চাপে ছাত যেন ভাঙ্গিয়া পড়িবে। গাড়ির বেগ যত বাড়িতে লাগিল, বাজনা ততই হইয়া উঠিতে লাগিল উগ্রতর। গাড়ির মধ্যের উত্তাপই বোধ হয় তখন একশ পনের ষোল ডিগ্রী। বাহিরে টিনের ছাতের উপর কত তাহা অনুমান করাও শক্ত…

একবার বেশ খানিকটা বুক পর্যন্ত বাহির করিয়া না দেখিয়া পারিলাম না। এদিকে তিনটা ছাত আর ওদিকে তিনটা। ওদিকের তিনটা ছাতে দুইটা দল পরস্পরের দিকে উগ্রদৃষ্টিতে চাহিয়া গলা ফুলাইয়া কপালের শির ফুলাইয়া কাসিয়া ঘামিয়া যেন সঙ্গীতের গোলা দাগাদাগি করিতেছে; আগুনের হল্কার মতো হাওয়াটা আর সহ্য করিতে না পারিয়া আবার নিজেকে টানিয়া লইলাম। দেখি বাবু বলৰস্ত সিং গোঁফে তা দিতেছেন, বাবু গুলজার সিং শান্ত মর্যাদায় ফরসী সেবন করিতেছেন।

পরের ষ্টেশনে নামিলাম; কুলি নাই, তবে বরযাত্রীর লোকেরাই ভদ্রতা করিয়া জিনিসপত্র গুলা নামাইয়া দিলেন। কুলির জন্য হাকাহাকি করিতেছি মিস গ্রেসও ধীরে ধীরে ছোট মুটকেসটি হাতে করিয়া নামিয়া আসিলেন।

বলিলাম— “আপনার তো এখানে নামবার কথা নয়?”

বাজনার লড়াই বিপুল বিক্রমে চলিতেছে, মিস গ্রেস অন্যমনস্ক হইয়া সেইদিকে চাহিয়াছিলেন, উত্তরে বলিলেন— “আমার এর পরের ষ্টেশন মিষ্টার মুখার্জি; এইখানেই অপেক্ষা করব, মিষ্টার ট্রেভারকে টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি কারটা পাঠিয়ে দেবেন। নিশ্চয় রাস্তা আছে?”

বলিলাম— “রাস্তা তো আছে, কিন্তু…”

মিস গ্রেস আবার ওই দিকে চাহিয়া অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছেন, আমার কথায় বাধা দিয়া বলিলেন— “আর জানেন মিষ্টার মুখার্জি?– আমার সঙ্কল্পটাও বদলে ফেলেছি।”

প্রশ্ন করিলাম— “কি রকম”

“মিষ্টার ট্রেভারকে এদেশ ছাড়তে আমি বাধ্য করব আর যদি না ছাড়েন তো…”

গাড়ি ধীরে ধীরে চলিতে আরম্ভ করিয়াছে, সঙ্গীত আরও ক্ষিপ্ত, ওদিকে চাহিয়া অন্যমনস্কভাবেই কথাগুলা এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া হঠাৎ আমার মুখের পানে চাহিয়া থামিয়া গেলেন। মিষ্টার ট্রেভারকে কেন যে এ দেশ ছাড়িতে বাধ্য করিবেন— অধিকারজ্ঞান হঠাৎ কেন এত শিথিল হইল, সে বিষয়ে আর কিছুই টের পাওয়া গেল না।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন