মঙ্গলবার | ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৪২
Logo
এই মুহূর্তে ::
মমতার স্পষ্ট বার্তা — আগে বাংলার মানুষ আলু খাবে, তারপর বাইরে পাঠানো হবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (দ্বিতীয় পর্ব) : রহমান হাবিব লঙ্কা চাষ বাড়ছে, লাভবান চাষিরা, রপ্তানি বাড়াতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পাশাপাশি, তবে প্রাণ নেই, চিহ্ন বইছে ভেলুগোন্ডা, রবিবার জল সরার পরে : অশোক মজুমদার নলিনী বেরার কবিতা — স্বভূমি, স্বদেশ, স্বজন : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (প্রথম পর্ব) : রহমান হাবিব রংবাহারি ক্যাপসিকাম : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যের কৃষকমান্ডিতে কৃষকদের ধান বিক্রিতে দালাল মুক্ত করার নির্দেশ সরকারের : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘উচ্ছেদ’ আমাদের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নানা মত : তপন মল্লিক চৌধুরী বেঙ্গল গোট গ্রামীণ অর্থনীতিতে এনে দিতে পারে স্বচ্ছলতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পিটার নাজারেথ-এর ছোটগল্প ‘মালদার’ অনুবাদ মাসুদ খান আমরা নারী-আমরাও পারি : প্রসেনজিৎ দাস ঝুম্পা লাহিড়ীর ছোট গল্প “একটি সাময়িক ব্যাপার”-এ অস্তিত্ববাদ : সহদেব রায় ঝুম্পা লাহিড়ী-র ছোটগল্প ‘একটি সাময়িক বিষয়’ অনুবাদ মনোজিৎকুমার দাস ঠাকুর আমার মতাে চিরকালের গৃহীর চিরগুরু : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ভাবাদিঘির জট এখনও কাটেনি, বিষ্ণুপুর থেকে জয়রামবাটি রেল চলাচল শীঘ্রই : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (শেষ পর্ব) : অভিজিৎ রায় উৎপন্না একাদশী মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত মারাঠাভুমে লাডকি বহিন থেকে জয়, ঝাড়খণ্ডে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী প্রচারে হার : তপন মল্লিক চৌধুরী কিন্নর-কৈলাসের পথে : বিদিশা বসু হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (চতুর্থ পর্ব) : অভিজিৎ রায় ভনিতাহীন চলন, সাইফুর রহমানের গল্প : অমর মিত্র সাইফুর রহমান-এর বড়োগল্প ‘করোনা ও কফিন’ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (তৃতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় নানা পরিচয়ে গৌরী আইয়ুব : গোলাম মুরশিদ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায়
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কবিতা সিংহ-এর ছোটগল্প ‘পশ্চিম রণাঙ্গন আজ শান্ত’

কবিতা সিংহ / ১৬৮ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সারাদিন রাতের মধ্যে, আজকাল ফটিকের কাছে এই সময়টা সবচেয়ে আনন্দের হয়ে উঠেছে। খাওয়াদাওয়ার পর মাদুর আর বালিশ নিয়ে ফটিক আর টেবু ছাদে শুতে আসে।

ফটিক সামনে সামনে। টেবু পিছনে পিছনে। ছাদের মাঝখানটা মাদুর বালিশ পেতে দুজনে পাশাপাশি শোয় আর আকাশ দেখে। তারপর কথা বলে। বলেও না। কেবল একটু একটু করে শান্তির মধ্যে, ঘুমের মধ্যে ঢুকে যেতে থাকে।

আজও দুজনে পাশাপাশি শুয়েছিল। ঘুম-জড়ানো গলায় টেবু বলল—

—দাদু, জেগে আছ?

—হ্যাঁ দাদু, জেগে আছি?

ফটিক টেবুর কচি গলার স্বরটুকু কেবল কান দিয়েই নয়, যেন সারা শরীরের প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে পর্যন্ত উপভোগ করল। ফাল্গুনের শেষের দিকে, বৈশাখের কাছাকাছি এই সময়টিতে চিলের ছাদের ওপর উঠলে ফটিক তাদের গলির হিজিবিজি জাল বিছানো পাড়াটার অনেকখানি পরিধি দেখতে পায়। অনুজ্জ্বল ইট কাঠ সিমেন্টের জঞ্জালের মধ্যে নিবারণদের বাড়ির পিছনের পোড়ো ভাঙা অংশের খোপে কচিঘাস ওঠা একটা চৌখপি অংশ দেখতে পায়। এবড়ো-খেবড়ো ছাপকা ছাপকা পোড়া রঙের মধ্যে থেকে যৌবন ফাটিয়ে উঠে আসা একগুচ্ছ কচকচে সবুজ। টেবুর সঙ্গে ওই কচি সবুজের অদ্ভুত মিল আছে।

ফটিক টের পায়, তার বুকের ভিতরেও, কোথাও, পোড়ো ভাঙা ইট কাঠ সিমেন্ট ফাটিয়ে যেন টেবু নামের এই তিনহাত ছেলেটা ঘাসের মতো, সতেজে উঠে দাঁড়িয়েছে।

—ও দাদু, গল্প বলো না!

নিজস্ব অধিকারে টেবু তার একটা নরম পা তুলে দিল ফটিকের পেটের ওপর। আরামে আদুরে ফটিকের গলার ভিতরটা ঈষৎ ঘড়ঘড় করে উঠল।

নীচে এখন বোধহয় বউমাদেরও খাওয়াদাওয়া শেষ। ভাইপোরাও বোধহয় খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে। অন্তত শুয়ে পড়া উচিত। নীচের ভ্যাপসা কুম্ভের মতো দেয়াল-ঘেরা অন্ধকার থেকে কথা বলার আওয়াজ ক্রমশই মিইয়ে আসছে। ফটিকের ঘরটা তো আরো বেশি অন্ধকূপ। টেবু আসার আগে ছাদে এত আরাম এত খোলামেলা জেনেও ফটিক ওই অন্ধকারেই যেন কাদার মধ্যে শুয়োর ছানার মতো, মুখ গুঁজরে পড়ে থাকত।

পনেরো দিন হল টেবু এসেছে। ফটিক এই পনেরো দিনেই বুঝেছে একটা নরম, স্বর্গের শিশু কী রকমভাবে সবকিছু বদলে দিতে পারে। আঃ, কী পরিতোষই না লাগছে। ছাদে এখন জ্যোৎস্না আর হাওয়ার লুটোপুটি। ঝুঁকেপড়া নিমগাছের চিকরি। কাপড় শুকোনোর দড়িগুলো এদিকে-ওদিকে টান টান। এরিয়ালের বাঁশে একটা ভাঙা বাঁশের ঝুড়ি টাঙানো। তেলতেলে জীর্ণ ফটিকের মাদুর-খানা। কিন্তু আস্ত। ওয়াড় ছাড়া একখানা তেলচিটে বালিশ ফটিকের। পাশে ছোট্ট মাথাটি রেখে খালি গায়ে, কেবল একটা নীল রঙের ইজের পরে শুয়ে আছে তিনহাত টেবু। ফটিকের বড়দার বড়ছেলে গোবিন্দর বড়টি। ফটিক স্নেহভরে আড়চোখে তাকাল একবার। চাঁদের আলোয় গঙ্গামাটির প্রলেপ দেওয়া। একমেটে একটা পুতুলের মতো ছেলেটা। গাল দিয়ে, কপাল দিয়ে, নাক দিয়ে, ঠোঁট দিয়ে, চিবুক দিয়ে যেন লাবণ্য ঝরে পড়ছে। গালের ওপর লম্বা লম্বা পলকের ছায়া। মানুষের চোখের পলক কখনো এত লম্বা লম্বা হয়? আমার স্বর্গের পুতুল! মনে মনে বলল ফটিক। আমার ননীর গোপাল। হোক স্বর্গের পুতুল। কিন্তু এই মাটির পৃথিবীর লাবণ্য নিঙড়ে নিঙড়েই তো এই মানুষটা তৈরি। আর একবার টেবুর কচি গলাটা শুনতে চাইল ফটিক। তাই সাড়া দিল না। খানিকক্ষণ।

—ও দাদু! দাদু গো, জেগে আছ? না, ঘুমিয়ে পড়লে?

—হ্যাঁ দাদু, হ্যাঁ সোনার ঠাকুর জেগে আছি!

—তাহলে একটা গল্প বলো দাদু!

—কোন গল্প?

টেবু বলল, আহা যেন জানো না? ফটিকের মুখে এই ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্নাতেও কালো একটা ছায়া পড়ল। সে জেগে থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছে করে একটু ঘুম ঘুম ভাব করে বলল, সুখু দুখু?— উহু।

—লালকমল নীলকমল?

—উহু।

—বুদ্ধু ভূতুম?

—উঁহু। যুদ্ধের গল্প। যুদ্ধের গল্প খুব ভালো লাগে দাদু। আমাকে যুদ্ধের গল্প বলো!

ফটিকের সমস্ত ভিতরটা চাপা গুপ্ত একটা যন্ত্রণায় যেন কুঁকড়ে উঠল। খুব গোপনে ঢোক গিলল সে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার। পাশে জার্মান সিলভারের পুরোনো ঘটিটা ভাঁজ করা গামছায় ঢাকা ছিল। সেটা মুখের কাছে তুলে নিয়ে, ফটিক ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে নিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকেই শাপান্ত করল সে। নিজের বেসামাল লোভ আর গোপন পাপের কথা ভাবল। টেবুর এই কথার জন্য সেই-ই দায়। ছিঃ—

ফটিকেরও অনেক গোপন ব্যাপার আছে। জীবনের বেঁচে থাকার কতকগুলো পয়েন্ট। পয়েন্টগুলো অবশ্য, যত দিন যাচ্ছে, ততই কমছে।

ছোটবেলা কুকুরওয়ালা বাড়ির ফুলন্ত বাগান ভেঙে ঘর উঠে যাবার পর, ফটিকের একটা সুখের পয়েন্ট মারা যায়। আর একটা সুখের গোপন পয়েন্ট তৈরি হয় ঝাঁ বাবুর সুন্দরী মেয়ে শেফালীর আত্মহত্যার পর। শেফালীর আত্মহত্যার কারণ শুনে পাড়ার লোক সত্যিই অবাক হয়েছিল। শেফালীর বাবা-মা-ভাই-বোন কেঁদেছিল। বড়বউদি টিটকারি করেছিল। বড়বউদি মানে এই টেবুর বাবা গোবিন্দর মা। গোবিন্দর মা তখন বেঁচেছিল। আর ফটিক মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেফালী নাকি, তার চোদ্দ বছর বয়সেই, কেবল জানালা দিয়ে দেখে দেখেই, ফটিককে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল। বড়বউদি হেসে বলেছিল, ও বাবা, তা-ও ফটিক ঠাকুরপো কুশপেয়ে না হতো! শেফালী নাকি সাহস করে বলেও ছিল যে সে ফটিককে বিয়ে করবে। ফটিক এসবের কিছুই জানত না। জানল, শেফালী গলায় দড়ি দেবার পর। ফটিক আজও মাঝে মাঝে ভাবে, যে, শেফালীর মতো অমন একটা সোনার তালের তৈরি, বড় মানুষের মেয়ে, হঠাৎ তাকেই-রা ভালোবাসতে গিয়েছিল কেন? ফটিকের আর একটা বেঁচে থাকার পয়েন্ট ছিল

তার মা।

তার নানা বয়সের মা। কাঁচা বয়েসের পাকা বয়সের, এমনকি বুড়ো বয়সের রোগে ধরা মা। সেই সুখের পয়েন্টটাও বছর দুয়েক চলে গেছে। আর তার জীবনের সবচেয়ে গুপ্ত পয়েন্ট, গোপন আর অন্ধকার, ভয়ঙ্কর আর অনেক ভিতরে ঠেলে রাখা। সেটা এত গোপন এত সাংঘাতিক যে ফটিক তার কোনো চিহ্ন রাখেনা। পাছে ধরা পড়ে যায়। গোপন বার্তা পড়ে যেভাবে গুপ্তচরেরা কাগজটা গিলে ফেলে দেয়— ঠিক তেমনি।কিন্তু একদিন এক দুর্বল মুহূর্তে ফটিক তার সেই গোপন পাপ, গোপন সুখ টেবুর কাছে একটু মেলে দিয়েছিল। ব্যস্।

সেই থেকে টেবুও যেন তার উত্তরাধিকার পেয়ে গেছে।

—কই দাদু বলো! যুদ্ধের গল্প বলো!

ফটিক আড়চোখে তাকাল আবার। শান্ত গলায় সে বলল, কি হবে যুদ্ধের গল্প শুনে? পৃথিবীতে তো আর যুদ্ধ নেই দাদুভাই! দ্যাখো না সব কিছু কি শান্ত। ভালো লাগছে না তোমার। কেমন গা জুড়োনো হাওয়া, জ্যোছনা, কেমন আরামে শুয়ে থাকা।

এবছর জয়হরির সন্দেশের দোকানে যে রঙিন বালকৃষ্ণের ক্যালেন্ডার করেছে টেবু কবছর আগে হুবহু তেমনিটি দেখতেছিল। এখনো টেবুকে ননীর দলা দিয়ে তৈরি মনে হয়।

এই কদিন হল এসেছে টেবু? আসার পর থেকেই টেবু ফটিকের জিম্মায়। ফটিকের কাছেই টেবু তেল মাখবে, চান করবে, ফটিকের হাত ধরে স্কুলে যাবে। বিকেলে ফটিকের সঙ্গেই পার্কে যাবে। আর রাতে দাদুর কাছে শোবে। বাড়ির সবাই দারুণ নিশ্চিন্ত। বিশেষত বড়বউমা। কারণ টেবুর পর তার কোলে আরো একটি গিয়ে একেবারে উপুরঝুপর।

ফটিকরা দুই ভাই। বড়দা মারা গেছে। বড়বউদিও গেছে। মা-ও। আছে কেবল ফটিক আর বড়দার তিন ছেলে। বড় মেজ দুভাই বিয়ে করেছে। ছোট এখনো করে নি। ফটিক এতদিন মেজবউয়ের কাছেই খেত। সে নিজে কোনোদিন চাকরিবাকরি করে নি। তার দাদাই তাকে রেখেছে। এখন ভাইপোরাও তাকে সেইভাবেই রেখেছে। এবাড়ির অর্ধেক অংশ তার। সে অংশে ভাড়াটে আছে। সেই সাবেকি ভাড়াটে। তাই মাত্র ষাট টাকা ভাড়া দেয়। সেটুকু হাত খরচের জন্য রাখে আর সংসারের ভাত খায়। তার বদলে ফটিক রেশন আনে, ক্রাচিন তেলের খোঁজ রাখে, তেলকল থেকে খাঁটি শ্বেত সরষে আর নারকেল পেষা তেল নিয়ে আসে। বউমাদের জন্যে বারোটার শোয়ের টিকিট কেটে আনে। বাজার দোকান করে। আর বাচ্চা রাখে। নামে দাদু হলেও ফটিকের বয়স কিন্তু পঞ্চাশের বেশি নয়। টেবুর বাবা গোবিন্দর সঙ্গে ফটিকের বয়সের তফাৎ মাত্র তেরো। কিন্তু মাত্র তেরো হলেও ওদের সঙ্গে ফটিকের একটা যুগের ফারাক। অর্থাৎ ফটিকের সময়ের কোনো শরিক এ বাড়িতে নেই। ফটিকের গোপন পয়েন্ট, ভয়ঙ্কর সুখ, মানস-পাপের আর কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রইল না। যখন সেকেন্ড ওয়ার্লড ওয়ার চলছিল তখন এ বাড়িতে আর একসেট লোক থাকত। বাবা, মা ফটিকেরা দুই ভাই। পরে বউদি। ওরা সেই যুদ্ধের সময়কার লোক ছিল। ফটিকের ভাইপো তো জন্মালো স্বাধীন দেশে। এল একেবারে ন্যাশনাল ফ্লাগ্ উড়িয়ে। ওরা সব স্বাধীন ভারতের বাসিন্দা।

—ও দাদু! দাদু!

নাকে কান্না কেঁদে যাচ্ছে নাছোড়বান্দা ছেলেটা। স্বর্গের পুতুল, অথচ এত নরকের দিকে চোখ! চোখটা কিন্তু ফটিকই একদিন আবেগের ঘোরে ফুটিয়ে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ফটিক হেরে যাওয়া ক্লান্ত গলায় বলল,— জানো দাদু, একটা মস্ত বড় সুমুদ্দুর ছিল। সেই সুমুদ্দুরে একটা মাছমারা জাল ফেলেছিল। তা, তার জালে উঠল একটা মস্ত বড় কলসি!

টেবু অশৈরণ গলায় বলল,— ওটা তো যুদ্ধের গল্প না, ওটা তো আরব্য উপন্যাসের গল্প! ওটা তো তুমি আগেই বলেছ। আমি তো ওটা জানি।

ফটিক বলল,— আহাঃ! দাদুভাই, শেষ পর্যন্ত শোনোই না। সেই কলসিতে ছিল একটা দৈত্য। মাছমারা যখন কলসির মুখ খুলে তাকে বের করল তখন সে বেরিয়ে আকাশ ছেয়ে গেল। তারপর মাছমারাকে বলল, এবার তোমাকে মারব!

মাছমারা বলল, সত্যিই তুমি এই কলসিতে ছিলে? বিশ্বাস হয় না!

দৈত্য অমনি কলসিতে সেঁদিয়ে গেল। যেই না সেঁধনো অমনি মাছমারা কলসিটা বন্ধ করে দিল সেটাকে জলে ফেলে। ব্যস্ সেটা সুমুদ্দুরের অতলে তলিয়ে গেল। যুদ্ধের গল্পটা অমনি তলিয়ে দিতে পারো না দাদাভাই! টেবু রিনরিনে গলায় বলল, না, না, ফেলে দেয় নি শেষ পর্যন্ত। আবার তো কলসিটা তুলেছিল তো—

চাঁদের ওপর দিয়ে একটা পাতলা মেঘ উড়ে যাচ্ছিল। হালকা ছায়ায় জ্যোৎস্না স্নান হল। ফলে চাঁদ আর ছাদ সমান চলন্ত হল। অথচ কেউ কারো নাগালছাড়া হল না। ক্লান্ত গলায়, হেরে যাওয়া, ধরা দেওয়ার ভঙ্গিতে ফটিক বলল,— কিন্তু দাদু কলসিটা জলে ফেলে দিলেই সবচেয়ে ভালো হত। অতবড় একটা ভয়ঙ্কর দৈত্যকে এই মানুষের পৃথিবীতে ছেড়ে রাখা উচিত নয়।

টেবু বলল,— কি করবে দৈত্যটা। আসুক না একবার। ঢিসুম ঢিসুম, এ্যামসান দেব না? জানো— দাদু আমি তিনরকম বন্দুকের আওয়াজ জানি। শুনবে? ছোট পিস্তল, বড় বন্দুক, আর মেশিনগান্। বলো না দাদু, যুদ্ধের গল্প বলো না।

ফটিক চমৎকৃত হয়ে তাকাল টেবুর দিকে। টেবুর ঠোঁট দুটিতে সীম ফুলের হালকা রং। যুদ্ধের সময় টেবুর মতো বয়স ছিল ফটিকের। সেসময় ফটিক কিন্তু যুদ্ধ ব্যাপারটাকে ভালো বোঝে নি। কেবল শুনত যুদ্ধ। যুদ্ধ। তাই ভয়ঙ্কর একটা অজানা ভয় তার ভিতর অন্ধকারের তালের মতো ঢুকে গিয়েছিল। সেই থেকে সেগুলো সেইভাবেই আছে। আর বাইরে আসে নি। টেবুকে আর কতটুকুই-বা বলেছে সে?

কিন্তু সেইটুকুই-বা কেন বলল ফটিক। গলির অজস্র জাল নিয়ে এই পাড়া। ডকের কাছাকাছি। সেখানে নিত্যই পেটো পড়ে। মারামারি হয়। পুলিশ রেড করে। দলের মধ্যেও ঝগড়া হয়। গোবিন্দর বদলির চাকরি। এতদিন ওরা কলকাতার বাইরে ছিল। টেবু কচিবেলায় বার দুয়েক এসেছিল বাপ-মায়ের সঙ্গে। এখন স্থায়ীভাবে থাকতে আসা। গোবিন্দ এখন কলকাতায় পোস্টেড। এ পাড়ার কাণ্ডকারখানা টেবুর ঠিক জানা নেই। টেবুও হয়তো সেই ছোট্ট ফটিকের মতো ভয় পাবে। হয়তো যুদ্ধের গল্পের সঙ্গে সঙ্গে মিশে তার মনেও জমে উঠবে তাল তাল কালো অন্ধকার। অন্ধকারের তাল। আচ্ছা গোবিন্দ কি চাকরি করে? ফটিক কিন্তু ঠিক জানে না৷

টেবুর যুদ্ধের গল্প শোনার ইচ্ছে জাগার কাহিনীটা একটা ঘটনার জন্যে। ঘটনাটা ঘটেছিল দিন দশেক আগে। একরাতে। টেবুকে তখন ফটিক সিন্ডারেলার গল্প বলছিল। হঠাৎ ফটাফট কয়েকটা আলোর বালব ভাঙল। অন্ধকারের কালো কালো ফোয়ারা লাফিয়ে উঠতে লাগল অঞ্চল জুড়ে! হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার— গুলির আওয়াজ! আর বোমার ফেটে পড়া। ফটিক আলিবাবার গল্প বলতে ভুলে গিয়ে টেবুকে বলে ফেলেছিল,— জানো সোনা! আমার এখন যুদ্ধের সময়ের কথা মনে পড়ছে।

ব্যস্! খুলে গিয়েছিল কলসির মুখ! বেরিয়ে পড়েছিল সেই গোপন দৈত্যটা। সরু ধোয়ার রেখা, ধীরে ছেয়ে গিয়েছিল সারা আকাশ।

টেবু প্রশ্ন করেছিল, যুদ্ধ?

ধীরে

—হ্যাঁ যুদ্ধ! এ রকম ছোটোখাটো পাড়ার ঝগড়া নয়। মস্ত বড় ব্যাপার। পৃথিবী জোড়া। একদিকে পৃথিবীর এক ভাগ মানুষ। আর একদিকে পৃথিবীর আর এক ভাগ মানুষ। জানো দাদু!

তারপর ফটিকের মাথায় যেন ভূত চেপে গিয়েছিল। সে গলগল করে বলে গিয়েছিল। একবারও থামে নি। থামতে পারে নি। ভিতরের অনেক দিনের জমে থাকা কালো চাপ চাপ হয়ে বেরোচ্ছিল তো বেরোচ্ছিলই।

—জানো দাদু, সে যে কি কাণ্ড। তখন রাস্তার সব আলো, বাড়ির আলো সবেতেই কালো ঠুলি পরানো থাকত। সন্ধে থেকেই সারা কলকাতায় ব্ল্যাক আউট। ঘরের ভিতর টিমটিমে ঘোলাটে আলোয়, আমাদের লেখাপড়া খাওয়াদাওয়া চলত। জানালার কাচে লম্বা লম্বা শাদা কাপড়ের ফালি আটকানো হয়েছিল। সিঁড়ির তলায় জল, বালি, ফাস্ট এডের বাক্স রাখা। ওখানে যেতে হবে সাইরেন বাজলে। ওটার নাম শেলটার। ফটিকের দাদা একবার একটা বই এনেছিল বাড়িতে। বইটা কি একটা জার্মান বইয়ের বাংলা অনুবাদ। বইটা যেন একটা আবিষ্কার। যেন একটা গুপ্তধন। কতবার যে পড়েছিল বইটা ফটিক। সে এখনো বইটার ঘটনাগুলো হুবহু মনে করতে পারে। তারপর থেকে ফটিক তার এই পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত খুঁটে খুঁটে সেই ভয়ঙ্কর মহাযুদ্ধকে জেনেছে। যেন হারিয়ে যাওয়া একটা ডাইনোসারাসকে নানান টুকরো টুকরো ফসিলের মধ্যে দিয়ে জানা।

একটা মহাযুদ্ধ।

সারা পৃথিবীব্যাপী। ভাবা যায়? ফটিক পচাচালের ভাত খেয়েছে। তাদের বাড়ির দরজায় আকালের মড়া দেখেছে। সন্ধের অন্ধকারে বাবার হাত ধরে হারানকাকার বাড়ি রেডিও সেটে জার্মানি থেকে প্রচারিত সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতা শুনতে গেছে। তবু ফটিক কিন্তু ঠিক তখন ব্যাপারটা বোঝে নি। হাঙরে পা কেটে নিয়ে গেলে যেমন নাকি সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না। কিন্তু পরে একটু একটু করে বুঝেছে, পৃথিবীতে কি বীভৎস একটা সময় নেমে এসেছিল। ফটিক টেবুর প্রশ্নের উত্তরগুলো পরপর অসহায় নিরুপায়, বাঁধা জন্তুর মতো দিয়ে গিয়েছিল। কারণ সে নিজেও যে ভুক্তভোগী হয়ে জানে, মহাযুদ্ধের নেশা কি জিনিশ। মানুষকে কিভাবে আচ্ছন্ন করে রেখে দেয়। এখনো ফটিক টেবুকে বলে নি কি অদ্ভুত দৃশ্য সে ছোটবেলায় দেখেছিল। একদিন সাইরেনের কোঁকানি কান্নার মধ্যে তারা সবাই যখন ওপর থেকে ছুটে ছুটে নেমে শেলটারে আশ্রয় নিচ্ছিল তখন ওপর তলায় শুয়ে থাকা তার টাইফয়েড রুগি মরণাপন্ন ছোটকাকা কিভাবে একা একাই কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এসেছিল। মৃত্যুভয় এমন। বাঁচার আকাঙ্ক্ষাও এমন। সেই পাঁজরের হাপর, সেই ধ্বক ধ্বক বেরিয়ে আসা চোখের আতঙ্ক। সেই ঘাম! কি অমানুষিক। কাকার এই অস্বাভাবিক আচরণটা ফটিকের সেই শৈশব মনে গভীর একটা দাগ কেটেছিল। কেন কেটেছিল তা অনেক পরে বুঝতে পেরেছিল ফটিক। যখন আর একটু বয়সে সে এরিখ মারিয়া রেমার্কে বলে একজন বিদেশীর লেখা সেই একটা বাংলা অনুবাদে যুদ্ধের বই পড়ে। তার জীবনে এই বইটার যেন একটা অদ্ভূত ভূমিকাই রয়ে গেছে। এই বইটা যেন তার জীবনের সেই গোপন নিজস্ব ব্যাপারটা সঙ্গে হাড়ে মাংসে জড়িয়ে যাওয়ার মতো, জড়িয়ে, পাকিয়ে গেছে। মনে আছে বইটা নিয়ে দুপুর বেলা সে আচ্ছন্নের মতো বসে থাকত। যেন তার আর কিছু করার নেই। সব কাজকর্ম সব দায়িত্ব তার শেষ হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর সব বর্ণনা, নিষ্ঠুর সব আচরণ— অথচ এইসব বর্ণনার মধ্যে দিয়ে আরো অনেক সব অবর্ণনীয় ঘটনা রয়ে গেছে। একজন সৈনিকের পেটে শেল্ লেগেছিল। তারপর তার নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসে। সে দুহাতে নিজের নাড়ি ভুঁড়ি চেপে ধরে পাগলের মতো ছুটেছিল হাসপাতালের খোঁজে। তখনো তার মনে কেবলই বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। বইটা কতবার কতবার যে পড়েছিল ফটিক। পড়বে না ভেবেও। বীভৎস ঘটনাগুলো উলটে যাবে ভেবেও— ঠিক সেইগুলোই আবার তারিয়ে তারিয়ে পড়ত সে।

ফটিক কখনো কখনো দূর থেকে বইটার দিকে লোভীর মতো কেবল তাকিয়ে থাকত। তারপর পড়বে না ছোঁবে না দেখবে না ভেবেও, কখন যেন নিজের অজান্তে এগিয়ে যেত বইটার দিকে। বইটা টেনে নিত কাছে। তারপর আবার গোগ্রাসে গিলতে থাকত। এমনিই বোধহয় হয়। নাহলে টেবুর মতো নরম তুলতুলে স্বর্গের পুতুল— তার এত কুৎসিতের দিকে চোখ কেন? এক সময় ফটিকের এমন অবস্থা হয়েছিল যে সে তার মামাতো ভাইয়ের সুপারিশ নিয়ে ভবানীপুরের একটা লাইব্রেরির মেম্বার হয়েছিল কেবল কিছু যুদ্ধের বই পড়বার জন্য। ফটিক তখন বুঝত না আসলে সে কী চায়? যুদ্ধের কথা জানবার জন্যে তার এত মাত্রা ছাড়ানো কৌতূহলই-বা কেন?

লাইব্রেরি থেকে বাঁধানো পত্রপত্রিকা নিয়ে ফটিক যুদ্ধ, ধর্ষণ, ভাঙচুর, মৃত্যুর খবর পড়ত। ছবি দেখত। কত জায়গা অজায়গা থেকেই যে সে খুঁটে খুঁটে তুলত যুদ্ধের খবর। এই ডক্ পাড়ার মুসলমান আয়া রাবেয়া গল্প করত, তারা যুদ্ধের সময় গ্রাম ভেঙে এই শহরে এসে আড্ডা গাড়ে। গ্রামে যখন ছিল সেই যুদ্ধের সময়ে, তখন ন্যাঙটা থাকতে হত। কারণ পরনের কাপড় পাওয়া যেত না। চট জড়িয়ে থাকত প্রথম দিকটায়। পরে তাও জুটত না। ফটিকদের তিনটে বাড়ি পরে থাকে রামচন্দ্র দাদার বুড়ি পিসি। ফটিকের মা সেই বুড়ি পিসির বাড়ি বেড়াতে গেলেই, কতবার শুনেছে তার বাবা, তার মাকে বকত। বলত আবার ওই ‘ওয়াকাই’ মাগীটার বাড়ি গিয়েছিলে? ওর সঙ্গে অত দহরম মহরম কিসের?

‘ওয়াকাই’ কি মা? ফটিক জিজ্ঞেস করেছিল।

‘ওয়াকাই’ মানে যারা যুদ্ধের আপিসে কাজ করত। ‘ওয়াকাই’ মানেই যুদ্ধ। চোখে কাজল ঠোটে রং, খুরো তোলা জুতোয় চাকরিতে নামার প্রথম পর্যায়ের কিছু কিছু বাঙালির মেয়ে আমেরিকান অফিসারের বাহুলগ্নতায় ঘুরে বেড়াত। তারা ছিল ‘ওয়াকাই’। তবে ফটিকের কিশোর বেলার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্মৃতি একটি মুড়ির ঠোঙায় দেখা ছবি। আর তার সঙ্গে লেখা অসম্পূর্ণ একটা খবর।

বিলিতি ম্যাগাজিনের কাগজ কেটে তৈরি ঠোঙা। তাতে এক জুতোর পাহাড়ের ফটোগ্রাফ। পাশে কতকগুলো ছেঁড়াখোঁড়া ন্যাকড়ার পুতুল পড়ে আছে। নিজের ক্লাস এইটের বিদ্যে নিয়ে কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে তলার ইংরেজিতে লেখা রিপোর্টের অসম্মপূর্ণ টুকরোটা পড়েছিল ফটিক। ওই ছোট ছোট জুতোগুলো নাকি ছোট ছোট ইহুদি খোকাখুকুর। গ্যাস চেম্বারে পাঠানোর আগে পা থেকে খুলে নেওয়া হয়েছিল।

—এত জুতো? তাহলে কত খোকাখুকু? সেই ছবি দেখার পর মাঝে মাঝে রাতে ফটিক জুতোর পাহাড়ের স্বপ্ন দেখত। গ্যাস চেম্বার কেমন দেখতে তা ফটিক জানে না। কিন্তু তার কেমন যেন মনে হত, অনেকটা বোধহয় তাঁবুর মতো।

তার স্বপ্নে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ক্রমাগত ভিড়, কে যেন ঠেলে ঠেলে ঢুকিয়ে দিতে থাকত। রোগা রোগা বড় বড় কালো চোখের ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে ছেলেমেয়েরা। তার বুকের ভিতরই যেন গ্যাসের বিষাক্ত ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে টলে টলে অবশ হয়ে পড়ে যেতে থাকত তারা।

তবু তো বালাইষাট যুদ্ধ তেমন সোজাসুজি ঘনিয়ে আসে নি এদেশে। বোমায় ধ্বংস হয়ে যায় নি শহরের পর শহর। মেয়েরা ধর্ষিত হয় নি, শিশুরা নিহত হয় নি। সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে দগ্ধে দন্ধে মারা হয় নি এদেশে।

না, না, মানুষ মরেছে। হাজারে হাজারে। বন্যায়, দুর্ভিক্ষে। ফটিক দেখেছে।

—ওঁ দাদু— তারপর? আরো বলো। সেই জার্মান যুদ্ধের গল্প বলো। ও দাদু! তোমার গল্পের সেই পল লোকটা কি খুব বীর ছিল?

একটু ভাবল ফটিক। বীর? অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। এই বইটার যে নায়ক, পলি, সত্যি সে কি বীর ছিল? বীর ঠিক কাকে বলে?— বীর মানে তো বুক ফুলিয়ে অনেকের সঙ্গে লড়ে যাওয়া। অনেক খুন জখম করা। না পল তা ছিল না। পল কেমন যেন অন্যরকম মানুষ। ফটিক বলতে লাগল টেবুকে।

—বুঝলে দাদু! পলের একজন বন্ধু ছিল। সেই বন্ধুটির নাম ছিল ম্যুলের। ম্যুলের বড় কষ্ট পেয়ে মারা যায়। একবার কয়েকদিনের ছুটিতে পল বাড়ি ফিরেছিল। তখন ম্যুলেরের শোকাতপা মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, পল, আমায় সত্যি করে বলো তো, ম্যূলের কি খুব কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছিল? পল চোখ নামিয়ে বলেছিল, না! তুমি মিথ্যে বলছ না তো পল?— না, না।

ম্যুলেরের মা তখন বলেছিলেন, বেশ— তুমি যদি আমার কাছে সত্যি কথা না বলে থাকো, তাহলে আমিও তোমায় বলছি, তুমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরবে না!

তাই যেদিন পল যে রণক্ষেত্র সম্বন্ধে যুদ্ধ করছিল, সেই রণক্ষেত্র সম্বন্ধে খবরের কাগজে হেডলাইন বেরোল যে,– “পশ্চিম রণাঙ্গন আজ শান্ত”— ঠিক সেইদিনই দেখা গেল পল বসে আছে। হাতে বন্দুক। মাথায় লোহার টোপ্ পরা। কখন প্লিন্টার ছুটে নিঃশব্দে তার মৃত্যু হয়েছে। বলতে বলতে ফটিক একবার টেবুর দিকে চোখ ফেরাল। দেখল টেবুর চোখ দুটো নিদ্রাতুর হয়ে এসেছে। আস্তে আস্তে ঘুমে ঢলে পড়ে যাচ্ছে সে। ফটিক তার কপালে আলগা করে পরম মমতায় একটু চুমু খেল। যাক নিশ্চিন্দি। বেশ কেমন জ্যোছনা। ঠাণ্ডা মলয়-বাতাসটি। তালগাছের পাতা নড়ার শব্দ। টেবুর নরম শরীর। পৃথিবীটা এখন কত মধুর। কত শান্ত

আর যুদ্ধ হবে না। আর যুদ্ধ নেই কোথাও। যদিই বা হয় খুব অল্প সময়ের ব্যাপার। দগ্ধে দগ্ধে মরতে হবে না মানুষকে। মানুষ অমানুষ হয়ে উঠবে না। হিটলারের মতো উন্মাদ, আইখানের মতো নিষ্ঠুর! ফটিক সেই যুদ্ধহীন শান্তির কথা ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ছিল,— ঠিক তখনই হঠাৎ দুপ দুপ্ করে ওপরে উঠে এল বড়বউমা।

—কাকাবাবু, ছোটন এসে বলল, শুরকি ডাঙায় খুব গোলমাল হচ্ছে। মারামারি কাটাকাটি। ওখান দিয়েই তো আমাদের ও ডিউটি সেরে বাড়ি ফেরে— আপনি গেলেই ভালো। ছোটনকে ওই ডামাডোলে পাঠানো উচিত হবে কী? ফটিক উঠে পড়ল। তার বুকের ভিতর আর পাশে লোহার শলা বেঁধার মতো যন্ত্রণা ঠিক নয়। আশঙ্কা। ফটিক বলল,— বড়বউমা! খোকাটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে বরং নিয়ে নীচে রেখে আসি। টেবুকে বুকে করে নিয়ে ফটিক নীচে নামল। নিজের ঘরে শুইয়ে দিল। ওর পেছন পেছন বড়বউমা নামছিল। ফটিক বেরোবার আগে বলে গেল ছোটনকে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তে। আমিই যাচ্ছি। ছোটন বড়দার সব চেয়ে ছোট ছেলে। ওটা আবার পাড়ার সবচেয়ে ওঁচা ছেলেদের সঙ্গে আছে। ডকে যেসব চোরাচালানী হয়ে ছোটনের দল নাকি তার সার-সার এজেন্ট। খরিদ্দার জুটিয়ে কমিশন মারে। ছোটনের ঘর ফরেন জিনিশে ভরতি। তবে বড় রকম নয়, টুকিটাকি। শার্টটা গায়ে চড়িয়ে ফটিক সদর দরজা খুলে বেরোল। অন্ধকার গলি, গলির জাল পেরিয়ে এগোতে এগোতে ফটিক বুঝতে পারল সে ভয়ঙ্কর একটা কোলাহলের কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। ফটিক এ পাড়ারই ছেলে। এ পাড়ায় আধা সেঞ্চুরি হয়ে গেল তার। তার কুশ পায়ে অদ্ভুত চলার ভঙ্গি আর নিরীহ রিকেটি চেহারার জন্য তার তেমন কোনো শত্রু ছিল না বলেই তার ধারণা। তাই ফটিক মোটামুটি খানিকটা নির্ভয়ে এগোল। লোকের ভয়ার্ত ভীড় ছুটতে ছুটতে বিভিন্ন গলির শিরা উপশিরা বেয়ে ছুটে আসছে। ফটিক তাদের ধাক্কা খেতে খেতে এগোতে লাগল। লাঠি বর্শা চ্যালাকাঠ, যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ছুটেছে। কেন? গলির মুখে এসে ফটিক দেখল, হল্কা! আলো! আগুন জ্বলছে।

গোটা দুই ঠেলারিকশা জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কেউ। তার চারপাশে কালো কালো ছায়ামূর্তির মতো নাচছে একদল লোক।

ফটিক বাতাসে নিশ্বাস নিল। তার মানে হল পোড়া রবারের সঙ্গে মাংস আর চুল পোড়ার ভয়ঙ্কর গন্ধ কেমন যেন মিশে মিশে যাচ্ছে। ফটিক থরথর করে কাঁপতে লাগল এবার।

পাড়ার বিখ্যাত গুন্ডা কাল্লু হাতে একটা মাংস কাটা দা নিয়ে উন্মাদের মতো ঝাঁপ খাচ্ছিল। ফটিকের দিকে এবার এগিয়ে এল সে। বিরাট বারকোষের মতো কালো গোল মুখ। গালের টোলা হয়ে ওঠা মাংসের আলো চকচক করছে। হাসছে লোকটা। তার দাঁতগুলো লাল। ঠিক যেন পাজির ছবিতে দেখা রাহুর কাটা মুণ্ডের মতো। মস্ত ভারী মাথা। তেলতেলে আবলুশ চামড়া আগুনের হলকায় চকচক করছে। ফটিকের মনে হতে লাগল সে একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে গেছে। যেখানে আইন নেই, কানুন নেই। ন্যায় নেই, নীতি নেই, সম্পর্ক নেই, বাছবিচার নেই। যেখানে কেবল উন্মত্ততা। কেবল ভয়ঙ্কর আস্ফালন। কাল্লু ফটিককে দেখে ছুটে এল।

—কি করছ এখানে, শালা? চোরের মতন?

ফটিক তোতলাতে তোতলাতে বলল— গো-গোবিন্দ, মা-মানে আমার বড় ভাইপো, এখনো… বা বাড়িতে ফেরে নি কিনা?— তাই খুঁ— মা— মানে খুঁজতে এসেছি—

—মিথ্যেবাদী শালা। খোচর শালা যা ঘর যা, নাইলে ওই যে দেখছিস? ওর দশা হবে! ফটিক এবার ঠাহর করে দেখল। বুঝতেও পারল যে ঠাহর না করলে ওই হাত পা মুণ্ডু না থাকা কেবল ধড়টাকে মানুষের বলে চেনা কতখানি অসম্ভব। চট করে ওই মাংসের তালটাকে কি করে মানুষ মনে হতে পারে তার?

হঠাৎ ফটিক দেহটার পাশে তাল-পাকানো ছিটের শার্টটা পরিষ্কার দেখতে পেল। দেখতে পেয়ে আর একটা ভয়ঙ্কর ভোল্টের আঘাত পেল।

শার্টের ছিটটা তার বড় বেশি পরিচিত। ওটা তো গোবিন্দর একটা বাতিল শার্ট। আজ সকালেই মুচিপাড়া থেকে এসেছিল তাদের বহুদিনের পুরোনো ঠিকে ঝি কালীর মা-র বুড়ির ভবঘুরে আধপাগলা ছেলেটা। তাকে বড়বউমা ওই ছেঁড়া শার্টটা দিল।

ফটিক থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে খুব চেষ্টা করেও তার কাঁপুনি রোধ করতে পারছিল না।— শাল্লা— খোচর।

কাল্লু একটা পিচ কাটল। ফটিক পেছু হটতে লাগল ক্রমশ। ভবঘুরেটা কি তাহলে সত্যিই পুলিশের চর ছিল? হবেও বা। ওরা তো সব আদত খবর রাখে। শরীরটা ঘুলিয়ে এল তার। পোড়া মাংসের দুর্গন্ধে চারিদিক ভরে উঠছিল ক্রমশ। সে একটা রকের ওপর অবশ হয়ে বসে পড়তে যাচ্ছিল— কাল্লুর তাড়ায় সেই অবস্থাতেই ছুটতে আরম্ভ করল।

কাল্লুও তার পিছন পিছন খানিকটা ছুটে গেল। তারপর চ্যাচাতে লাগল,— তুমিও শালা কম নও— তোমাকেও একদিন দেখে লিব!

বাড়ি ফিরে ফটিক দেখল গোবিন্দ খেতে বসেছে। সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বড়বউমা এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। লোডশেডিং, একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন জ্বলছে। তার আলোয় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে সবকিছু। ফটিক বলল,— তুই এসেছিস, যাক! হাঁফ ছেড়ে একটা টুলে বসে পড়ে ফটিক বলল,— ওঃ, কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য যে দেখলাম রে। তোর একটা শার্ট— তোরই তো সেটা—লোকটা পুড়ছে— কাশীর মা বুড়ির সেই ছেলেটা।— আধ পাগলটা। বড়বউমা লাফিয়ে উঠে আর্তনাদ করে বলল,— কি— কি বলছেন কাকাবাবু আবোল তাবোল কি বলছেন। বসুন। জিরোন। ভালো করে বলুন।

ফটিক রুদ্ধ গলায় বলল,— নাঃ, ওরা বোধহয়, কালীর বুড়ির ছেলেটাকে মেরে দিল। গোবিন্দ অদ্ভুত একজোড়া চতুর অথচ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বলল— সে কী? তুমি কি করে জানলে?— হাত পা মুণ্ডু কেটে পোড়াচ্ছে ছেলেটাকে!

বড়বউমা বলল, না না ওই যে শার্টের কথাটা কি বলছিলেন?

—ওই তো গোবিন্দর সেই ছেঁড়া শার্টটা, যেটা তুমি আজ সকালে ওকে দিলে, সেটা দেখেই তো চিনলুম! কেমন অদ্ভুত ধরণের একটা দৃষ্টি বিনিময় হল ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। বড়বউমা বলল,— বলি না তাড়াতাড়ি ফিরবে। এ পাড়ায় তোমায় চেনেই-বা কজন? অচেনা মুখ দেখলেই নাকি ওরা—চলো বাবা পাড়া ছেড়ে পালাই।

গোবিন্দ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,— আর তা ছাড়া ঘরশত্রু বিভীষণ আছে না?

বড়দার মেজছেলে গোপাল ঘুম চোখে উঠে এসেছিল।— কি হয়েছে দাদা?— তোমাদের কলকলানিতে ঘুম ছুটে গেল।

গোবিন্দ ভেংচে উঠেছিল— কি হয়েছে দাদা। বাবু জানেন না। ছোটন, ছোটন, তোমার আদরের ছোটভাই! ফরেন রিস্ট ওয়াচ পরে ঘুরতে তো খুব মজা লাগে!

তারপর দড়াম করে দরজা ফেঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল ছোটন,— আর তোমার কাজ কী? না এ সব কথা নিয়ে খোচরগিরি তাই তো। আমি বলে দিলুম বড়দা, সিধে চলে যাও পাড়া ছেড়ে। তা নাহলে কিন্তু— তারপর তিন ভাই আর দুই বউ মিলে বাড়ি লঙ্কাকাণ্ড।

ফটিক সেখান থেকে সরে গিয়ে নিজের একানে ঘরটার দরজা বন্ধ করে টেবুকে হাওয়া করতে লাগল। লোডশেডিং। সে চায় না যে টেবু বাড়ির এই ঝগড়ার মধ্যে জেগে যায়। আর কুশ্রী অসুন্দরতাকে আরো বেশি করে ছুঁয়ে ফেলে।

শেষ রাতে ঘুমের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে ফটিকের মনে হয়েছিল যে পৃথিবীর উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে এমন একটা জায়গায় চলে এসেছে যে যার পর আর কিছু নেই। খালি শূন্য। যেন আর একটা পা বাড়ালেই সে অনন্ত বেয়ে পড়তেই থাকবে। পড়তেই থাকবে।

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল ফটিকের। টেবুর মুখের দিকে তাকাল সে। ভগবানের মুখ কেমন সে জানে না। বোধহয় এই রকমই হবে। তার ছোট্ট বুকটা ধুক ধুক করে নিশ্বাস নিচ্ছে। এই পৃথিবীতে টেবুকে আনা হল কেন?— এই পৃথিবীতে তাকে রেখেই-বা যাওয়া হবে কি করে? তার চেয়ে গলা টিপে ছেলেটাকে… নিজের শিরা ওঠা তেঁতুলের ছড়ার মতো আঙুলওয়ালা করতল, টেবুর নরম কচি গলার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে থেমে গেল ফটিক। কালীর মা বুড়ি— এসে গেছে। ঘ ঘ ঘষ ঘষ তার বাসন ঘষার শব্দ। তার মানে কালীর মা বুড়ি— এখনো জানে না তার কি সর্বনাশ হয়ে গেছে।

সর্বনাশ ফটিকেরও হয়ে গেছে। কাল রাতে ঝগড়ার মধ্যে যা শুনল ফটিক, তাতে দাদার তিন ছেলের, এ বাড়িতে, এ পাড়ায়, এ রাজ্যে, এ দেশে, এ পৃথিবীতে যে কি ভূমিকা তা এখন ফটিককে কাপাচ্ছে। কাল রাতে যখন টেবুকে হাওয়া করছিল ফটিক, তখন ঘুমের মধ্যেই টেবু বলেছিল— ও দাদু, যুদ্ধের গল্প বলো!

—যুদ্ধের গল্প যে আর নেই দাদু, যুদ্ধ তো কবে শেষ হয়ে গেছে!

—না দাদু, তুমি জানো না। যুদ্ধ আছে। হচ্ছে— বলো দাদু যুদ্ধের গল্প বলো!

টেবু ঘুমের মধ্যেই বলেছিল কাল। দৈববাণীর মতো বলেছিল।

টেবু তো পবিত্র। মেরী মায়ের কোলে যে শিশুটির ছবি থাকে, ঠিক তার মতো। হুবহু। টেবু ঠিকই বলেছে। যুদ্ধ তো আছে। চলছে। নাহলে একই বাড়িতে তিনটে অমানুষ কি করে জন্মায়। একটা বিভীষণ, একটা চোরাচালানী আর একটা হিজড়ের অধম? ছিঃ।

স্বামীরা যে কি তা জেনেশুনেও বড়বউমা মেজবউমা কি করে হাসে, সাজে, সিনেমায় যায়? ফটিক বিছানায় শুয়ে শুয়েই শুনতে পেল বড়বউমা কালীর মা বুড়ির সঙ্গে কথা বলছে।— বলি হ্যাঁগো কালীর মা। রাতে তোমার ছেলে ঘরে ফিরেছিল?

ফটিক চমকে উঠল। বড়বউমা এ সব কি কথা বলছে?

ফটিক আবার শুনতে পেল,— হ্যাঁগো ! কাকাবাবু নিজে দেখেছে,— নিজের চোখে— ফটিক মরমে মরে গেল। ছি ছি বড়বউমা কি? বড়বউমা না ছেলের মা?

ফটিক টের পেল বাসনটাসন ফেলে ছুটে আসছে কালীর মা বুড়ি। বুড়িটা তার ছাই মাখা হাতে ফটিকের ঘরের দরজার দুপাশ ধরে দাঁড়াল।

বুড়িটা যেমনি কালো তেমনি বীভৎস। রুক্ষু শনের দড়ি চুল। মুখের ভিতর গোটা দুই নড়া দাঁত।— বাবা, হ্যাঁ বাবা! বউমা যা বলছে তা সত্যি গো বাবা? ওরা আমার ছেলেকে কেটে কেটে, কুপিয়ে, কুপিয়ে, কষ্ট দিয়ে দিয়ে—

ফটিক একবার বলতে গেল চুপ চুপ আমার টেবুসোনা উঠে পড়বে! তারপর বুঝতে পারল এসব সাবধানতা আতুপুতুর কোনো মানেই হয় না। সে তার একটা করতল বাড়িয়ে দিয়ে বলল, না, না, বড়বউমা জানে না। আমি জানি। আমি সব দেখেছি।

—কি দেখেছ বাবা তুমি? বলো কি দেখেছ ?

—ওরা তোমার ছেলেকে হয়তো ভুল করে মেরে দিয়েছিল। ও সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে পড়ে গেল। হয়তো একটা গুলি ছুটে গিয়েছিল—

কালীর মা বুড়ির চোখ দুটো ধ্বক ধ্বক করে জ্বলল কিছুক্ষণ। সে বলল,— তুমি তাকে মরতে দেখলে, আর নিজে বেঁচে ফিরে এলে? সে চলে গেল আর তুমি ফিরে এলে? তারপর ছাইমাখা হাত দুটো তুলে হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল সে। বড়বউমা তাকে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গি করে ধরে নিয়ে গেল কোথাও। ফটিক ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আস্তে আস্তে ছাদে গেল। ওপরে আকাশের রং এখনো কচিছেলের মেঘলা গায়ের মতো। তাল পাতায় চিকন সবুজের তৈলাক্ত আভা। কেমন একটা শান্তির ঢেউ খেলছে চারিদিকে। নীচে দূরে, নিবারণদের বাড়ির পোড়ো দিকটার লুকোনো জমিতে সবুজ ঘাসের মখমলের মধ্যে থেকে দুটো হলুদ প্রজাপতি পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে উড়ে চলে গেল। নীচের গলি দিয়ে দুধের প্যাকেট নিয়ে ফিরছে অফিসের বাবু মোহন আঢ্যি। কে বলবে কাল রাতে এই পাড়ারই শেষ প্রান্তে মানুষের ভিতর জেগে উঠেছিল অমানুষ। কেবল মারা নয়, কুপিয়ে কুপিয়ে, একটু একটু করে মারা।

হঠাৎ টনক নড়ে গেল ফটিকের। যুদ্ধ কি সত্যিই এখনো থামে নি? যুদ্ধ আছে?

যুদ্ধের সময় যা যা হয়,— সব, সবই তো ঘটছে। কোনটা নয়? তাহলে কি কেবল তার মনের ভিতরের গভীর অন্ধকারেই নয়— আরো অনেক অনেক মানুষের মনের ভিতরের গভীর অন্ধকারে যুদ্ধ সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে! চোরাচালানের মতো চারিয়ে যাচ্ছে, রক্তের মধ্য দিয়ে। শুক্রের মধ্য দিয়ে। টেবু কি তাহলে ঠিকই বুঝেছে যে যুদ্ধ আছে। যুদ্ধটা যায় নি কোথাও।

হঠাৎ ফটিকের মনে হল, একটা পরখ করা যাক। যুদ্ধ থেমেছে? না যুদ্ধ থামে নি? যুদ্ধই যদি থামে নি, তাহলে আজ ফটিক নীচে নেমে যাবে। আজই সেইদিন। সেই যাচাই করার দিন। আকাশে এখনো নীল পদ্মের আভা। ছন্দে ছন্দে উড়ছে শা-নওয়াজের ছেলের শাদা পায়রাগুলো। একটা ভোরের রাগিনী বাজছে রেড়িওতে। কালকের রাত্রিটা মুছে গেছে এ গলি থেকে। শান্তি আর পরিতোষে ভরে আছে সকালটা। কালীর মা বুড়ির কান্নাটা আর শোনা যাচ্ছে না।

ঠিক এখনই ফটিক হেঁটে যাবে। যেভাবে পল গিয়েছিল। গিয়ে বসেছিল পশ্চিম রণাঙ্গনে। তারপর আবিষ্কৃত হয়েছিল নিশব্দ একটা সপ্লিন্টারের আঘাত লাগা তার মৃতদেহ।

ফটিকও যাবে। সে গিয়ে দাঁড়াবে কালকের অকুস্থলে। সেখানে এখন কালকের আর কেউ নেই। সেখানে যদি জীবন্ত পৌঁছে যায় ফটিক। সেখানে গিয়েও যদি জীবন্ত থাকে সে, তাহলে জানবে যুদ্ধ মারা গেছে। কিন্তু সে যদি মরে যায় তাহলে?—

—ফটিক এগোল। পা ফেলতে ফেলতে, বাঁচতে বাঁচতে, ক্রমশ সে নির্ভয় হয়ে উঠল। সে মরে নি। সে বেঁচে আছে। এখনো বেঁচে আছে। আর তার বেঁচে থাকা মানেই এ পৃথিবীতে আর কোথাও যুদ্ধ নেই। গলি দিয়ে চলতে লাগল ফটিক। তার বিশ্বাস ক্রমশ বাড়তে লাগল। তার কুশপায়ের হাঁটার ভঙ্গি ক্রমশ ক্রমশ সাহসী হয়ে উঠতে লাগল।

নাঃ। এ পৃথিবীতে আর যুদ্ধ নেই। যুদ্ধ হবে না। আর কালো ঠুলি পরবে না আলো। জানালার কাচে লাগাতে হবে না শাদা কাপড়ের ফালি। মানুষ ক্রমশ সভ্য হচ্ছে। ভদ্র হচ্ছে। হিটলার, আইখমান— এরা সব— ভাবতে না ভাবতেই অকুস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে গেল ফটিক। হঠাৎ নিঃশব্দে একটা কি যেন, তার পিঠ বিধে বুকের পাশ দিয়ে খানিকটা রক্ত উপচে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মাটিতে বসে পড়ল ফটিক। আকাশে তখন নীল রঙের ক্যামোফ্লাজ। হলুদ প্রজাপতি দুটো চুলোচুলি করতে করতে উড়ে গেল তার পাশ দিয়ে। মরার জন্য, পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার জন্য ফটিকের যত না কষ্ট হল তার চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট হল তার টেবুর কথা মনে করে।

টেবুকে সে কোন পৃথিবীতে রেখে চলে যাচ্ছে!

কোন পৃথিবীতে?


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন