গুজরাটে জাল ভেন্টিলেটর কেলেঙ্কারিতে ক্রমেই উঠে আসছে একের পর এক ভয়ঙ্কর তথ্য। গুজরাট সরকার নানা সময় বিবৃতি দিয়ে রাজ্যজুড়ে যে ভেন্টিলেটর বসানো হয়েছে বলে দাবি করে তা আসলে ভেন্টিলেটরই নয়। এমন দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণির রাজকোট নিবাসী বন্ধু পরাক্রমসিং জাদেজা, যাঁর জ্যোতি আইএনসি নামক সংস্থার তৈরি জাল ভেন্টিলেটর নিয়েই এখন গুজরাট সরকারের নতুন কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে।
কী বলছেন পরাক্রমসিং জাদেজা? তিনি যাতে মুখ খুলতে না পারেন তার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে আমেদাবাদ সিভিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জাদেজা বলেন, তাঁরা আগে ধামন-১ নামে মেকানাইজড অ্যাম্বু ব্যাগ তৈরি করেছেন। ধামন-২-তে ফ্লো সেন্সর লাগানো হবে, যাতে বোঝা যায় রোগীর দেহে কতটা অক্সিজেন যাচ্ছে। এখন ধামন-৩ নামে পুরোদস্তুর ভেন্টিলেটর তৈরির কাজ করছে তাঁর সংস্থা, যা প্রস্তুত হতে ৮-১০ দিন লাগবে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে গুজরাট সরকার যাকে ভেন্টিলেটর বলে চালাতে চাইছে তা ভেন্টিলেটরই না। আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, যে ৯০০টি জাল ভেন্টিলেটর বসানো হয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলিতে তার পুরোটাই হয়েছে বেআইনি পদ্ধতিতে। সে কথা জানানোর আগে আরও উদ্বেগের খবর হলো, ওই জাল ভেন্টিলেটরগুলিতে জোড়াতালি দিতে স্পেয়ার পার্টস কিনছে রূপাণি সরকার। এমনকী রূপাণির বন্ধুই জানিয়েছেন, সরকার ওই মেশিনগুলির জন্য হিউমিডিফায়ার কিনছে। ১.৩ কোটি টাকার টেন্ডার ডাকা হয়েছে রেসপিরেটরি হিউমিডিফায়ার ও হাই ফ্লো মিটার কেনার জন্য।
সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন, সরকারি হাসপাতালে যে জাল ভেন্টিলেটর বসেছে সেগুলি কি তৈরি হয়েছে নিয়ম মেনে? উত্তর ‘না’! মুখ্যমন্ত্রী রূপাণির বন্ধু স্বীকার করেছেন, সরকারি হাসপাতালে যে মেশিনগুলি বসেছে তার জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি অনুমোদন নেওয়া হয়নি। মেডিক্যাল ডিভাইসের সি ও ডি ক্যাটেগরিতে পড়ে ভেন্টিলেটর, এ জন্য ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার অনুমতি পেয়ে লাইসেন্স নিতে হয়। ধামন-১-এর ক্ষেত্রে তা নেওয়া হয়নি। সর্বোপরি এই অনুমতি দেয় কেন্দ্র, রাজ্যের কোনও ক্ষমতা নেই। এই মেশিনগুলি পরীক্ষা করার জন্য যে ট্রায়াল হওয়ার কথা তা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এথিক্যাল কমিটির সামনে হওয়ার কথা। নিয়ম অনুযায়ী সেই কমিটিতে রাখতে হবে একজন মেডিক্যাল কলেজের ডিরেক্টর বা সরকারি হাসপাতালের প্রধান, ওই বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ, একজন আইনজীবী, একজন সমাজকর্মী ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। কতজন রোগীর উপর ট্রায়াল হবে, কবে হবে, রোগীর শারীরিক অবস্থা, তাঁর অনুমতি-পত্র এই সব বিষয়টি একজন চিফ ইনভেস্টিগেটর ওই কমিটির সামনে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবেন, এটাই নিয়ম। যার কিছুই হয়নি গুজরাটে। নামমাত্র কমিটিতে বিশেষজ্ঞ দূরে থাক, একজন অ্যানাসথেটিস্ট আর একজন মেডিসিনের চিকিৎসককে রাখা হয়, যিনি ক্রিটিক্যাল কেয়ার এক্সপার্ট নন। তারপর জাদেজা নিজেই বলেছেন, এনএবিএল অনুমোদিত ল্যাবে মাত্র একজনের উপর ট্রায়াল হয়েছিল ওই মেশিন বা জাল ভেন্টিলেটরের। রাজ্যের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও গুজরাট সরকারের স্বাস্থ্য পরিবারকল্যাণ দফতরের সচিব জয়ন্তী রবি বলেন, রাজ্য সরকারের ইলেকট্রনিক্স ও কোয়ালিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ও সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ছাড়পত্র দেওয়ার পরেই ওই ‘ভেন্টিলেটর’গুলি বসানো হয়। কেলেঙ্কারি চাপতে রবি রবিবার ১৭ মে বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর বন্ধুর ওই সংস্থা বিনামূল্যে সরকারকে ১০০০টি ভেন্টিলেটর দিয়েছেন! সবচেয়ে বড়ো কথা, যাঁরা ওগুলি বানালেন তাঁরাই বলছেন সেগুলি ভেন্টিলেটর নয়। অথচ গুজরাট সরকার বারবার এগুলিকে ভেন্টিলেটর বলছে! প্রশ্ন উঠছে, কার নির্দেশে বেআইনি ওই ৯০০ মেশিন ভেন্টিলেটর বলে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে বসানো হলো? সবাই বুঝছে বন্ধুপ্রেম কার! মুখ্যমন্ত্রী নিজের রাজ্যের মানুষের জীবন নিয়ে খেলছেন!
তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কটাক্ষ করে লিখেছেন, নরেন্দ্র মোদীর ‘মিত্রোঁ’ বিবর্তিত হয়েছে ‘সাথীয়োঁ’তে। আর গুজরাট মডেল ‘ফেক নিউজ’ থেকে বিবর্তিত হয়েছে ‘ফেক ভেন্টিলেটর’-এ। আর এ সবটাই হচ্ছে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে! তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ আবার বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্যকে ঠুকে বলেছেন, ফেক নিউজ না ছড়িয়ে মানুষকে সাহায্য করায় মন দিন। জাল ভেন্টিলেটর মেনে নেওয়া যায় না। এ বিষয়টিতে আলোকপাত করবেন না?