”ইন দ্য রেইন, ইন দ্য কোল্ড, ইন দ্য ডার্ক”— নিজের কথাগুলো বছর চারেক আগে আপনিই লিখেছিলেন পোর্টালে, আমি পড়েছিলাম তার কিছু সময় পর। আজ আবার পড়তে ইচ্ছা হলো, কিছু বলতেও ইচ্ছা হলো। ‘হারকিউলিস’ নামটা আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই। আপনি যখন রোজারিও সেন্ট্রালের হয়ে কোপা লিবার্তোদেরেস খেলতে কলম্বিয়া যাচ্ছিলেন, তখন বুয়েনস আয়ার্সে সম্ভবত কোনো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ছিলোনা। আপনাদের গন্তব্যস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো একটি কার্গো প্লেনে করে। এই ধরনের প্লেনের র্যাম্পটা বেশ বড়ো হয়। প্লেনের পিছনের অংশের একটা অন্ধকার কক্ষে কর্মীরা বিভিন্ন মালপত্র জড়ো করে রাখে। আপনারা যখন প্লেনটায় উঠলেন আপনাদের বলা হলো প্লেনের মূল কক্ষে আপনারা যেতে পারবেন না, আপনাদের যেতে হলে প্লেনের ওই পশ্চাদাংশের মালবোঝাই কক্ষটায় গুম করে রাখা ম্যাট্রেসগুলোর সাথে যেতে হবে। আপনারা লাগেজ-কেবিনে ঢোকালেন। দরজাটা বন্ধ হয়ে কেবিনটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো তারপর। আপনাদের বলা হলো কেবিনের লাল সুইচটা যেনো ভুলেও না টেপা হয়, একবার স্যুইচটা টিপলেই কক্ষের বাইরের দিকের দরজাটা তৎক্ষণাৎ খুলে যাবে আর আপনারাও হয়তো ভেসে যাবেন বিস্তীর্ণ মহাশূন্যে। আপনাদের একটা মিলিটারি হেডফোনও দেওয়া হয়েছিলো, ওটা প্লেনের গুদামঘরের কর্কশ আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা পাবার ন্যুনতম অস্ত্র মাত্র। আপনারা এভাবেই পৌঁছেছিলেন কলম্বিয়ায়…এভাবেই। আর ওই কার্গো প্লেনটার নাম ছিলো ‘হারকিউলিস’; মনে আছে নিশ্চয়ই?
আপনার ‘গ্রাসিয়েলা’র কথা মনে পড়ে? একটা ছোট্ট হলদেটে বাইসাইকেল এই গ্রাসিয়েলা। আপনার বাবা সাবানের কারবারি ছেড়ে দিয়ে কয়লাখনির কাজ নিয়েছিলেন। আপনাদের বাড়ির পিছনেই কয়লার কাজ চালাতেন আপনার পিতা। কয়লার ময়লাতে আপনাদের সাদারঙা বাড়িটা ধূসর হয়ে উঠেছিলো। আপনিও কয়লার বস্তা বইতেন মাঝে সাঝে। একদিন আপনি রোজারিও সেন্ট্রালের হয়ে খেলার ডাক পেলেন। ক্লাবটা আপনার বাড়ি থেকে নয় কিলোমিটার দূরে। আপনাদের গাড়ি ছিলোনা। আপনার মা এই হলদেটে বাইসাইকেলটায় করে আপনাকে ক্লাবে দিয়ে আসা নিয়ে যাওয়া করতেন। আপনি পিছনের কেরিয়ারে বসতেন, সাইকেলের পাশে লাগিয়ে দেওয়া কাঠের সিটে আপনার বোন বসতো, সামনের বাস্কেটে আপনার জুতো-কিটস থাকতো আর এতোকিছু নিয়ে বাইসাইকেলে করে ক্লাব-বাড়ি যাতায়াত করতেন আপনার মা। সেই বাইসাইকেল, সেই ‘গ্রাসিয়েলা’— আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই।
আমরা ভুলে গেলেও ভুলে যেতে পারি কিন্তু আপনি কখনোই ভুলবেন না ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের রাতটার কথা। কোয়ার্টারে আপনার পায়ের মাসেল ছিঁড়ে গিয়েছিলো। পেইনকিলার খেয়ে আপনি দৌড়োতেন, তবুও নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও আপনি প্রাণ দিয়ে ফাইনালটা খেলতে চেয়েছিলেন। আগের রাত্রে মাদ্রিদ থেকে আসা একটা চিঠি আপনাকে দেখানো হয়েছিলো। রিয়াল মাদ্রিদের তরফে সেই চিঠিতে জানানো হয়েছিলো আপনাকে ফাইনালে মাঠে না নামানোটাই শ্রেয় হবে। হতভম্ব আপনি রাগে-দুঃখে-জেদে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। কোচ সাবেল্লার কাছে অঝোরে কেঁদেছিলেন, চেয়েছিলেন ফাইনালে খেলার একটা সুযোগ। আপনাকে স্কোয়াডে রাখা হয়েছিলো, কিন্তু, অ্যাঞ্জেল, আপনি মাঠে নামেন নি। একশো তেরো মিনিটে মারিও গোৎসে নামের একজন জার্মান যখন এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে আর্জেন্তাইনদের স্বপ্ন, তারপরেও আপনাকে মাঠে নামানো হয়নি। অ্যাঞ্জেল, মনে আছে নিশ্চয়ই?
অ্যাঞ্জেল, আমার কাছে ‘গ্রাসিয়েলা’ নেই, ‘হারকিউলিস’-এও চাপবোনা কোনোদিন। আপনার মতো জীবন সংগ্রামী আমি নই। আজ আপনার ‘In the Rain, In the Cold, In the Dark’ আবার পড়লাম। আপাতত আমার বুক আর মাথাটা আপনার লেখা কথাগুলো দখল করে রেখেছে। সাইকেলে আসতে আসতে যতবার আপনার কথাগুলো ভাবছি ততবার প্যাডেলে চাপ পড়েছে জোরে, সাইকেল ছুটেছে হনহনিয়ে, এক লহমায় তছনছ করে দিতে চেয়েছে জগতের যান্ত্রিক সব নিয়ম — এগুলোকে নাকি রক্তক্ষরণ বলা হয়। আমি এখন বুঝতে পারছি, যে সংগ্রাম যে প্রত্যাখান যে আগুনের সামান্য আঁচের স্পর্শেই সহস্রমাইল দূরের এই বাঙালী তরুণের বুক ঝাঁঝড়া হয়ে যেতে পারে, সেই আগুনের উত্তাপ কতোটা তীব্রভাবে উপলব্ধ করছে আপনার বুক। এই আগুন তো আপনার বুকে এখন জ্বলন্ত!
শুনেছি বড়ো ম্যাচের আগে সমস্ত ক্রীড়াবহির্ভূত ভাবনাগুলো বর্জন করে মাঠে নামতে হয়, ওগুলো নিয়ে নামলে নাকি চাপ বাড়ে, খেলা আর মনের দূরত্ব বাড়ে। আজ আপনি মাঠে নামবেন কিনা আমি জানিনা কিন্তু অ্যাঞ্জেল, যদি মাঠে নামেন, আপনি আপনার নিজেরই বলা কথাগুলোকে বুকে নিয়েই মাঠে নামুন। হারাতে দেবেন না এই সত্যিগুলোকে আপনার মনন থেকে, প্রকাশও করবেন না কারও কাছে, অপ্রকাশিত হয়ে সুপ্ত থাক সেগুলো আপনার ভিতরেই, অনুরণন ঘটবে তাহলেই।
আমি এখনও বিশ্বাস করি আপনি খেললে মাঠের ডানদিকটা একরকম লাগে, না খেললে আরেকরকম লাগে। সাবেল্লার কাছে কেঁদে লুটিয়ে পড়া রাতটার কথা মনে রাখবেন, একশো তেরো মিনিটের মারিও গোৎসের কথা মনে রাখবেন, মাদ্রিদ থেকে আসা চিঠিটার কথা মনে রাখবেন, আর মনে রাখবেন ২০১৪-এর ফাইনালে রিজার্ভ বেঞ্চে ছটফট করতে থাকা একজন অ্যাঞ্জেল দি মারিয়ার কথা।
হিসাব শোধ করার এমন সুযোগ অনেকেই পায়না। অ্যাঞ্জেল, জ্বালিয়ে দিন, পুড়িয়ে দিন, শুধে দিন আজ সবকিছু।