রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের মৃণাল তার স্বামীকে পত্র লিখে গৃহত্যাগ করেছিল প্রচন্ড ক্ষোভে, অভিমানে, নারীত্বের অপমানে। তার মধ্যেই সে খুঁজেছিল মুক্তির স্বাদ। পুরুষশাসিত সমাজের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত, নিপীড়িত, পদদলিত নারী জাতির প্রতিনিধি হয়ে সমাজের সকল অন্যায় এবং অশোভন আচরণগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সে, ঘোষিত হয়েছিল নারীত্বের জয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর নারী জাগরণের যে ইঙ্গিত মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের বীরাঙ্গনাদের লিখিত পত্রের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন, তাইই যেন রবীন্দ্রনাথ পুনরাবিষ্কার করলেন ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের ‘মৃণাল’ চরিত্রটির মাধ্যমে। বীরঙ্গনার নায়িকারা তাদের প্রিয়তমের কাছে পত্র লিখেছেন কখনও অভিযোগে, কখনও অনুযোগে আবার কখনো প্রেম নিবেদন করে। তাদের না বলা কথা তারা প্রকাশ করেছে। ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রে হতভাগিনী জনা রাজা নীলধ্বজকে মনের সমস্ত রাগ, অভিমান পত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। পুত্রহন্তার সঙ্গে সন্ধি করে তাঁকে সিংহাসনে এনে বসানোই জনার সঙ্গে রাজা নীলধ্বজের বিরোধ বাধে। জনার মাতৃসত্ত্বা কেঁদে উঠেছে। তাই সে জাহ্নবীর জলে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে পোড়া মনের বাঞ্ছা মেটাতে চেয়েছেন। এরকমই ‘সোমের প্রতি তারা’, ‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’, ‘লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পনখা’ — প্রতিটি পত্রেই উনিশ শতকের নারীজাগৃতির রূপরেখা পাওয়া যায়। দীর্ঘদিনের অবিচার, লাঞ্ছনা, অনাচার, হৃদয়হীনতা, প্রেমহীনতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে অনেক নারী হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। মৃণাল কিন্তু বিন্দুর মতো আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়নি। সে চেয়েছিল বাঁচতে, দমবন্ধ হওয়া পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে। মৃণালের এই বাঁচার লড়াই — সে কিন্তু একদিনে অর্জন করেনি। বরং তা অর্জিত হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে পুরুষশাসিত সমাজের শোষণযন্ত্রে নিষ্পেষিত হতে হতে। মৃনালকে কেউ বোঝেনি। লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখা — এই ঘটনাটিকে তার শ্বশুরবাড়ির কেউ ভালো চোখে দেখেনি। তাই মৃণাল বলেছে —
“আমি যে কবি সে এই পনেরো বছরেও
তোমাদের কাছে ধরা পড়েনি।”
অভিমানে, ক্ষোভে সে ফেটে পড়েছিল। অনেক কথা বলতে চেয়েছিল মৃণাল।কিন্তু কেউ শোনেনি তার কথা।
নারীরা চিরকালই এরকম অসহায়। পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা আজও ব্রাত্য, অবহেলিত। অনেক কথার ভিড়ে কিছু না বলা কথা থাকে, যে গুলো সবাই প্রকাশ করতে পারে না। তাদের চাওয়া-পাওয়া, সখ-আহ্লাদের খবরাখবর পুরুষ শাসিত সমাজ নেয় না। সংসারের সাঁড়াশি চাপে মেয়েদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।তাদের কথা তুলে ধরতেই অনেক লেখককে কলমকলম তুলে নিতে হয় হাতে। শরৎচন্দ্রও এই বঞ্চিতদের হয়েই কলম তুলে নিয়েছিলেন — “সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা বঞ্চিত, দুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের কোন হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেলে না, সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই — এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে।”
একটা সময় নারীকে কেবল একটা পণ্য হিসাবেই দেখত পুরুষশাসিত সমাজ। মনে করা হত তারা শৈশবে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। সুতরাং পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের ভূমিকা ছিল গৌণ। ঘর-সংসার সামলানো, পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়া আর পুরুষের যৌন লালসা মেটানো — এই ছিল নারীর পরিসর। তারা ছিল কূপমণ্ডুক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গানে পাই —
“খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার
এই তোমাদের পৃথিবী
এর বাইরে জগৎ আছে
তোমরা জানো না….…”
সংসারের ঘানি টানতে টানতে তাদের স্বাদ-আহ্লাদ সব হারিয়ে যায়, জীবনের সব রং নিভে যায়। ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের মৃণালের লেখিকা সত্তাকে কি বলী দিতে হয়েছিল সংসারের কিছু বাহ্যিক বিধি নিষেধের বেড়াজালে। আবার পণপ্রথার নিদারুণ কষাঘাতে নিরুপমার মত মেয়েদেরও বলী হতে হয়, শ্বশুর বাড়ি তাদের কাছে হয়ে ওঠে শরশয্যা। নিরুপমার মুখ দিয়ে তখন বেরিয়ে আসে কঠোর অথচ বাস্তব সত্য —
“আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষন টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম।”
অথচ এই কঠোর বাস্তব সত্যটাকে আমরা অস্বীকার করি, ভুলে যাই নারীর অধিকার, তাদের মর্যাদার কথা। অনেক না বলা কথার পাহাড় তাদের বুকে চেপে থাকে জগদ্দল পাথরের মতো। আজ আর নয়। সময় হয়েছে আরো একবার জেগে ওঠার। তাই তো রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে আমরা শুনি —
“নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা।”
বস্তুত মৃণাল বা জনাদের মতো নারীরা চিরকাল মুখ বন্ধ করে সব কিছু সহ্য করে না। তাদের না বলা কথা একদিন ভাষা খুঁজে পায়,বিদ্রোহিনী হয়ে ওঠে তারা; নিজের অধিকার বুঝে নেয় চোখে চোখ রেখে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গণ্ডী পেরিয়ে তারা ভেঙে ফেলে সমস্ত বৈষম্যের প্রাচীর। তখনই ঘুম ভাঙে সমাজের। আসলে সমাজের কিছু বিধিনিষেধ, নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ নারীসমাজ। যেটা পুরুষ পারে সেটা নারী পারে না বলে অপপ্রচার চালানো হয়। জন্মের পর মেয়েদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় তুমি নারী, তুমি অবলা। রাতের বেলা তুমি একা একা বেরোতে পারো না, কোথাও একা একা তোমার যাওয়া সাজে না, যেমন খুশি পোশাক পরে তুমি বাইরে যেতে পারো না, তোমার বরং পুতুল খেলাই শ্রেয়, ক্রিকেট, ফুটবল তো একেবারে নয়। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে। স্বামী বিবেকানন্দের কথার রেশ ধরেই বলতে হয়-আমাদের সমাজ একটা পাখির মত, তার একটা ডানা নারী; আরেকটা পুরুষ। একটা ডানা কেটে ফেললে পাখি যেমন উড়তে পারে না। তেমনই একজনকে বাদ দিলেই সমাজ অচল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আজকের সমাজব্যবস্থায় নারীদের প্রতি এই অবহেলা ও সামাজিক অসম্মান, ধর্ষনের মতো নিকৃষ্ট পাশবিক ঘটনা দিনদিন বেড়েই চলেছে। তাদের প্রতি এই অবহেলা, নারীত্বের অপমান,তাদের ‘মাল’ বলে সম্বোধন করার পরেও এ সমাজ নির্বিকার।এ কোন সমাজ? যে সমাজে নারীর আত্মমর্যাদা ভূলুন্ঠিত হয়, অপমানিত হতে হয় সেখানে ‘যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যতে রম্যতে তত্র দেবতা’ — মতো স্তোত্রবাক্য উচ্চারণ করা আকাশ কুসুম কল্পনামাত্র।
যাইহোক পৃথিবীর আপামর নারীজাতি জেগে উঠুক, বুঝে নিক তাদের অধিকার, আগ্নেয়গিরির লাভার মতো দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা কথার পাহাড়গুলো প্রতিবাদের ভাষা হয়ে জ্বলে উঠুক বারুদের মতো, তারা বুঝিয়ে দিক তারা আর ‘অবলা’ নয়। তাই মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের বীরঙ্গনাদের মতোই আবারও দরকার একটা নারী জাগরণের। তারা যেন সগর্বে মাথা উঁচু করে বলতে পারে —
‘আমরা নারী — আমরাও পারি।’
প্রসেনজিৎ দাস, বেতাই, নদিয়া