বুধবার | ২৩শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১২:৪৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
সই বা বন্ধুত্ব স্থাপনের উৎসব সয়লা : রিঙ্কি সামন্ত প্রথম পাঠ — “নিশিপালনের প্রহরে” নিয়ে, দুয়েকটি কথা : সোনালি চন্দ বৃহন্নলার অন্তরসত্তা : নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী দুই দশক : শৈলেন মান্না ভরা বর্ষায় জলপ্রপাতের মুখোমুখি… : বিদিশি বসু দামোদর মাউজো-এর অনুবাদ গল্প ‘হরতাল’ বঙ্গে কুবেরের পূজা : অসিত দাস বাংলা সাহিত্যের দেবতারদের দেখা মেলে ওই ঘরেই : অশোক মজুমদার মালবাণকে ছুঁয়ে রূপোলী সমুদ্রসৈকতে : নন্দিনী অধিকরী মার্ক্সবাদ, মনোবিশ্লেষণ এবং বাস্তবতা : এরিক ফ্রম, অনুবাদ ফাতিন ইশরাক সাহিত্যের প্রাণপ্রবাহে নদী : মিল্টন বিশ্বাস এবার দুর্গা পুজোকেও ছাপিয়ে গেল রানাবাঁধের লক্ষ্মীপুজো : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় দেড় হাজার বছর প্রাচীন ঘোষগ্রামের লক্ষীকথা : রিঙ্কি সমন্ত হুতোমের সময় কলকাতার দুর্গোৎসব : অসিত দাস নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘বৈতালিক’ কোজাগরীর প্রার্থনা, বাঙালির লক্ষ্মীলাভ হোক : সন্দীপন বিশ্বাস তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর রেল প্রকল্পের কাজ ভাবাদিঘিতে ফের জোর করে বন্ধ করা হলো : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর — অনেক বিদ্যাসাগর মাঝে তিনি একক : প্রলয় চক্রবর্তী আমেরিকা-ইসরায়েল সম্পর্কের শেকড় অনুবাদ ফাতিন ইশরাক নিয়ম নীতি আচারে লক্ষ্মী পূজার তোড়জোড় : রিঙ্কি সামন্ত আমার প্রথম বই — ঘুণপোকা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘কে জাগ রে’ জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন একটি বিপ্রলম্ভের কবিতা : প্রসেনজিৎ দাস আন্দোলন ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই : তপন মল্লিক চৌধুরী রেখা দাঁ ও বিজ্ঞান আন্দোলন : দীপাঞ্জন দে বাংলা উপন্যাসে নিম্নবর্গ : মিল্টন বিশ্বাস বদলে যাওয়ার অসুখ : বিষ্ণু সরকার বিবেকের মুখ : পার্থ রায় কল্লোলের কাল : তপন মল্লিক চৌধুরী দশমীর বিকেল, জলঙ্গী নদীতীরে মেলবন্ধনের আনন্দমুখর ছবি : অমৃতাভ দে
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই মহাঅষ্টমীর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘বৈতালিক’

নন্দিনী অধিকারী / ২৩৮ জন পড়েছেন
আপডেট বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৪

অনন্ত অসীম আকাশ থেকে পৃথিবীর আলো চিনে চিনে নেমে আসবে বিদেহীরা। বড় মায়াময় এই পৃথিবী। এখান ছেড়ে ছেড়ে চলে গেলেও সারা জীবনে জমানো স্মৃতির বাক্সটি তাদের এখানেই রয়ে যায়। তারই টানে হয়তো ক্ষণিক ফিরে আসা। ছাদের উত্তর বা পুব কোণে তাদেরই জন্যে কারা যেন জ্বালিয়েছে নীল, সবুজ, হলুদ আকাশপ্রদীপ! ঝুপ করে নেমে আসা হেমন্তের সন্ধ্যেয় শাঁখ বেজে উঠছে ঘরে ঘরে। ছাতিম গন্ধে ভারি হয়েছে বাতাস। হালকা কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে আমার ছোটো মফস্বলী শহর। আমি হাঁটছি। রাস্তায় কোনো টোটো নেই। পুজোক্লান্ত টোটোওলারা কি সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে! আমাকে ওষুধের দোকানে যেতে হবে। চৌরাস্তার মোড়ের ওষুধের দোকানটায় অনেকটা ছাড় দেয়।

আজকাল গোটা শীতে নাছোড়বান্দা সর্দিকাশি বড় জ্বালায়। মহামায়া মেডিক্যাল স্টোর্সের অতুলবাবু বলেছিলেন, “মা দুগ্গা জলে পড়লেই বাতাসে হিম ধরে। একাদশীর দিন থেকেই রাতে একটা করে অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ট্যাবলেট খেয়ো মা। শীতকালটায় ভালো থাকবে।”

বেশ কয়েক পা হেঁটে একটা টোটো পেলাম। চশমা পরা টোটো চালক অন্যদের মত নেহাত ছেলেছোকরা নয়। বয়স হয়েছে। তার টোটোর ভেতর সীটগুলো হালকা নীল রঙের মায়াবী আলোয় ভাসছে। মৃদু ভলুমে গান বাজছে সেখানে। কোনো সাধারণ হিন্দি বা বাংলা চটুল গান নয়। পদাবলী কীর্তন। কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম, গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার দাদু আর ঠাকুমার বড় পছন্দের কীর্তনিয়া ছিলেন। রেডিওতে, বাবার গ্রামোফোনে প্রায়ই বাজত ওঁনার গান।

“না পোড়াইবি রাধা অঙ্গ, না ভাসাইবি জলে….” কতদিন পরে এ গান শুনলাম! রাধারাণীর মাথুর বিরহের আকুলতা কোথাও মিলে যাচ্ছে উৎসব শেষের বিষণ্ণতায়।

আমার আশ্চর্য লাগল। টোটোচালককে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না,

— দাদা আপনার বুঝি কীর্তন শুনতে ভালো লাগে? ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তন!

— হ্যাঁ দিদিমণি। ছোটো থেকেই ভজনকীর্তনের মধ্যেই বড় হয়েছি যে।

— আমার আরো অবাক হবার পালা,

— তার মানে! কীর্তন শিখতেন আপনি?

— না আলাদা করে শিখতে হয় নি। আমরা হলাম গিয়ে গোঁসাই। বোষ্টম। আমার বাপ ঠাকুদ্দা নাম সংকীর্তন করতেন আসরে, মন্দিরে, শ্রাদ্ধবাসরে, শবযাত্রায়। আমার বাবার বড় দরদী কন্ঠস্বর ছিল। এই শহরের পুরনো লোকেরা ওঁকে অনেকেই চেনে।

— নাম কি আপনার বাবার?

— আজ্ঞে নিমাই চরণ বৈরাগী।

নামটা যেন চেনা চেনা লাগছে! আমাদের ঠাকুরবাড়িতে এক বোষ্টম বাবাজী রাধাকান্তর সন্ধ্যারতির পর কীর্তন গাইতেন। তাঁর নাকে রসকলি। গলায় তুলসীর মালা। শ্রীখোল, মন্দিরা আর বাঁশি বাজত। আমি মাঝে মাঝে পড়ায় ফাঁকি দিয়ে রাধাকান্তর প্রসাদী দানাদারের লোভে সেখানে উপস্থিত হতাম। সেই বাবাজীর নাম কি নিমাই চরণ ছিল? কি জানি! মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ঠাকুর ঘরের শেল্ফে রাখা বিবর্ণ সে খোল এখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। বাঁশির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধুলো জমে আর সুর তোলে না। মন্দিরাও কালের স্রোতে তাল হারিয়েছে।

আমি আবার প্রশ্নে ফিরি।

— আপনিও গাইতেন তাই না দাদা?

— গাইতে ভালোবাসতাম। মা রাজি হতেন না। বোষ্টমের নিত্য অভাবের সংসার। মা চাইতেন না আমি এই পেশায় আসি। তবু আমি গাইতাম। কখন জানেন?

— কখন?

— এই নিয়ম-সেবার মাসে। নিয়ম-সেবার মাস কাকে বলে জানেন?

— হ্যাঁ একটু একটু জানি।

মনে মনে বললাম জানিনা আবার! দুগ্গা ঠাকুর বিসর্জনের পরের দিন থেকেই একমাস ভোররাতে পথে পথে কীর্তন গেয়ে বেড়াত বাবাজী। কোনোদিন তাকে দেখিনি। তার কীর্তনে দোহারকি দিত একটি কিশোর কণ্ঠ, “গোঁসাই নিয়ম করে সদাই বলে জয় রাধে গোবিন্দ”। ঐ সময়টায় ঠিক ঘুম ভেঙে যেত। একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত যেন বয়ে যেত শরীরের ভেতর দিয়ে। স্কুল খুললেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা। অথচ কালি পুজো, ভাইফোঁটা এখনো সব বাকি। পড়াশোনাটা হবে কি করে! এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চাদরটা গায়ে টেনে নিয়ে আবার একপ্রস্থ ভোরের ঘুম।

টোটোচালক বলে চলেছে, —

“ঐ নিয়ম সেবার মাসকে আমরা বোষ্টমরা বলি দামোদর সেবার মাস। অনেক নিয়মকানুন, কৃচ্ছসাধন সেইসময়ে। বিজয়া দশমীর পরের একাদশী থেকে আমাদের বৈতালিক শুরু হয়। শেষ হয় কার্তিকের উত্থান একাদশীতে।

সেইসময় ভোররাতে আমি বাবার সঙ্গে নাম সংকীর্তনে বেরিয়ে পড়তাম। মা ঘুমোতেন। জানতে পারতেন না ।বাবার কীর্তনে আমি দোহারকি দিতাম।”

তাহলে কি সেদিনের সেই কিশোর কণ্ঠের অদেখা মানুষটিই এই? প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে দাঁড়িয়ে লীলা কীর্তনের রসধারায় যার নিত্য অবগাহন। হতেও পারে আবার নাও তো হতে পারে! মফস্বলের ছোটো শহরে কি একটিই কীর্তনের দল থাকে!

চৌরাস্তার মোড় এসে গেল। আমি টোটো থেকে নেমে বললাম —

— একটু দাঁড়াবেন দাদা? আমি ঐ দোকান থেকে ওষুধটা কিনব আর চলে আসব। আজ রাস্তায় গাড়িঘোড়া বিশেষ নেই। আপনার গাড়িতেই ফিরব।

— ঠিক আছে আসুন।

অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ট্যাবলেট খাওয়ার প্রথম দু-একদিন ঘোরের মধ্যে থাকি। সেই আচ্ছন্ন ভাবের মধ্যেই যেন শুনলাম কতদিন পর আবার অন্ধকার থাকতে বৈতালিকের দল নাম সংকীর্তনে বেরিয়ে পড়েছে।আমি তাদের অনুসরণ করলাম। তারা গাইছে শ্রীদামোদরষ্টকম্। সঙ্গে বাজছে শ্রীখোল আর মন্দিরা। ধুয়ো তুলছে একটি কিশোর কণ্ঠ, “গোঁসাই নিয়ম করে সদাই বলে জয় রাধে গোবিন্দ”।

অন্ধকার ঝোপঝাড়ে জোনাকি জ্বলছে। সন্ধ্যের কুয়াশা ভোররাতে আরো গাঢ় হয়ে আলিঙ্গন করে আছে প্রকৃতিকে। দু-একটা কুকুর খানিকক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে থেমে গেল। নিস্তব্ধ পথে ঈশ্বরের নামগান ছড়িয়ে পড়ছে। সারারাত সুগন্ধ বিলিয়ে ক্লান্ত ছাতিম ফুল ঝ’রে পড়েছে গাছের তলায়। ঐ বুঝি শুকতারা দেখা দিল আকাশের পূবদিকে!

আমি কীর্তনীয়াদের মুখ দেখতে পাচ্ছি না কেন! ঐ কিশোর কণ্ঠের মালিকটিই বা কই! কোথায় চলেছি আমি এদের সঙ্গে!কেনই বা চলেছি! তারা ধীরে গাইতে গাইতে চলেছে অথচ আমি ছুটছি আর ছুটছি। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে একসময় আমি বসে পড়লাম। আলোআঁধারিতে দেখতে পেলাম একটা গোলাপিরঙা ফ্রকের প্রান্ত নাচতে নাচতে ওদের সঙ্গে ঘন কুয়াশায় মিলিয়ে গেল।

সে কি আমার কিশোরবেলা! কে জানে! গানের ধুয়ো তখনো ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে,

“গোঁসাই নিয়ম করে সদাই বলে জয় রাধেগোবিন্দ….”।


আপনার মতামত লিখুন :

8 responses to “নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘বৈতালিক’”

  1. মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য says:

    লেখাটা ছোটবেলার স্মৃতি উসকে দিল। নিয়ম সেবার মাস সম্পর্কে জানলাম। এক অন‍্যরকম ভালোলাগায় মন জড়ালো।

  2. Amit Sarkar says:

    খুব ভাল লাগল, গল্পের বিষয় এবং উপস্থাপন প্রশংসনিয়।

  3. দেবাশীষ রায় দা says:

    খুবই সুন্দর লেখা,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন