বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার টঙ্গিবাড়ি উপজেলার সোনারঙ গ্রামের সোনারঙ জোড়া মন্দির অতীত ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে বিবেচিত। একটি বাঁধানো মঞ্চের উপর পাশাপাশি দুটি মন্দির অবস্থিত। মন্দিরে পাওয়া গেছে পাথরে বাঁধানো এক নামফলক। সেখান থেকে জানা যায়, রূপচন্দ্র নামের এক বণিক বাবা আর মায়ের স্মৃতিতে এই মন্দিরদুটো ধাপে ধাপে তৈরি করিয়েছিলেন। পাশাপাশি দুটি মন্দির হলেও একটি বড়ো ও আরেকটি সামান্য ছোট। বড়োটির উচ্চতা ১৫ মিটার। বড়োটি পশ্চিম পাশে এবং ছোটোটি রয়েছে তার পুব দিকে। বড়ো মন্দিরটির উপস্য দেবী কালী আর ছোটো মন্দিরের শিব। ১৮৪৩ সালে মাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে রূপচন্দ্র প্রথমে বড়ো মন্দিরটি বানিয়েছিলেন। তারপর বাবা মারা গেলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বানান আরেকটা মন্দির। সেটা ১৮৮৬ সাল। এখানকার মানুষ বিশ্বাস করেন, রূপচন্দ্র মারা গেলে তাঁর অন্ত্যেষ্টি হয়েছিল এখানেই।
চুন-সুড়কি আর ইট দিয়ে তৈরি এই সৌধ দুটিরই প্রধান নাটমন্দিরের সঙ্গে রয়েছে বারান্দা। জোড়া মন্দির হলেও দুটো মন্দিরের উচ্চতা আর কাঠামোতে পার্থক্য রয়েছে বেশ খানিকটা। মন্দিরের সামনে দক্ষিণ দিকে আছে বড়ো আকারের একটা পুকুর। তার ঘাট শান বাঁধানো। জনশ্রুতি আছে, বড়ো মন্দিরটি নির্মাণের সময় এই পুকুর খনন করা হয়েছিল। জোড়া মন্দিরের নিচের দিক থেকে সামান্য উঁচুতেই কারুকাজের মধ্যে তামার নানা ধরনের নকশা ছিল। ভেতরেও ছিল পাথরের মূর্তি। এখন সেগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই মন্দির দুটোর বাইরের দেয়ালে আছে অসংখ্য ফোকর। সেখানে নানান পাখির বাস। তাই জোড়া মন্দির দেখার সঙ্গে সঙ্গে এখানে নানান পাখিরও দেখা মিলবে। বিশেষ করে নজর কাড়বে টিয়া পাখির ঝাঁক। আছে ঘুঘু আর শালিখও। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আওয়াজ আর দুষ্টুমি ওখানে ঘুরতে যাওয়া লোকজনের মন জুড়িয়ে দেয়।
মঞ্চটি তিন দিকে পরিখা দ্বারা বেষ্টিত এবং এর পূর্বদিকে রয়েছে একটি প্রবেশপথ। মন্দির দুটির মধ্যে পশ্চিমেরটি কালী মন্দির এবং পূর্বদিকেরটি শিব মন্দির। পশ্চিমের মন্দিরটি পূর্বদিকেরটির তুলনায় উচ্চতর। বর্গাকার একটি স্থানের উপর অবস্থিত মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ১৫ মি। এর পরিমাপ ৫.৩৫ মিঊ৫.৩৫ মি। মন্দিরের সাথে ১.৯৪ মি প্রশস্তের একটি বারান্দা আছে। একটি নিচু গোলাকার গম্বুজ দ্বারা উপাসনালয়টি আচ্ছাদিত। এ গম্বুজের উপর স্থাপিত আছে একটি অষ্টকোণাকৃতি শিখর। শিখরের উপর আছে স্বাভাবিক কলসচূড়া। চূড়ার সাথে আছে লোহার দন্ডে সংযুক্ত একটি ত্রিশূল। বাইরে শিখরের বহিঃগাত্র আস্তরের সাহায্যে অর্ধগোলাকার খিলান নকশা অঙ্কন করা হয়েছে। শিখরের বহিঃগাত্রের অন্যদিকগুলিতেও একই নকশা অঙ্কন করা হয়েছে। প্রতিটি খিলান নকশার নিচে তিনটি খোপ নকশাসহ সম্পূর্ণ শিখরটি বিন্দু দ্বারা আবৃত করা হয়েছে।
প্রধান উপাসনালয়টির দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকে একটি করে মোট দুটি খিলানপথ আছে। উভয় দিকে খিলানপথের পার্শ্বে রয়েছে খিলান খোপ এবং অন্য দুপাশে আছে তিন খিলান নকশা। পশ্চিম দিকের প্রবেশপথ দ্বিকেন্দ্রিক খিলান নিয়ে গঠিত এবং খিলানপথের উপরাংশ বদ্ধ মারলোন নকশার সারি দিয়ে সজ্জিত। উপাসনালয়টির সম্মুখের বারান্দাটি স্তম্ভসারির উপর স্থাপিত সমতল ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত এবং দক্ষিণদিকে এর তিনটি এবং পূর্ব ও পশ্চিম দিকের প্রতিটিতে একটি করে খিলানপথ রয়েছে।
উপাসনালয় ও উঁচু শিখরের মধ্যবর্তী অষ্টভুজাকৃতির বহিঃগাত্র দুটি অংশে বিভক্ত। এর নিচের স্তরটি ছোট ছোট আয়তাকার খোপ নকশায় সজ্জিত এবং উপরের স্তরটি বড় বড় আয়তাকার খোপনকশার মধ্যে জানালা নকশাসহ আস্তর দিয়ে সজ্জিত এবং এর শীর্ষে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার খিলানসমূহ। মাঝের অষ্টাভুজাকৃতি এলাকার উপরে দুটি আলঙ্কারিক বন্ধনী আছে এবং বক্ররেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ শিখরটি নকশার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে অনুভূমিকভাবে উপরের দিকে উঠে গেছে। সুউচ্চ প্রধান শিখরটি ঘিরে বর্গাকার উপাসনালয়ের চার কোণায় চারটি ক্ষুদ্রাকৃতির শিখর আছে। বারান্দার উপর আরও চারটি শিখর আছে, যার মধ্যে দুটি বর্তমানে বিলুপ্ত।
পূর্বদিকের ছোট মন্দিরটি দেখতে আরও সুন্দর। এটি বর্গাকার একটি ইমারত। এর উপাসনা কক্ষের পরিমাপ প্রতিবাহু ৪ মি। উপাসনা কক্ষের চতুর্দিকে ১.৫ মি প্রশস্ত বারান্দা আছে। উপাসনা কক্ষটি একটি নিচু গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত, যা সরাসরি চার দেওয়াল এবং উপরস্থ কোণাগুলিতে স্কুইঞ্চগুলির উপর স্থাপিত এবং চারদিকের বারান্দা চারটি চৌচালা খিলান ছাদ এবং এর চার কোণার উপরস্থ চারটি ছোট খিলান ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত। বারান্দার প্রতিটি দিকে পাঁচটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। স্তম্ভগুলি হতে ত্রিপত্র খিলান বেরিয়ে এসেছে। প্রধান উপাসনালয়ের দক্ষিণ দিকে চুতুষ্কেন্দ্রিক খিলানপথ আছে এবং পূর্বদিকে দুটি দ্বিকেন্দ্রিক খিলান পথ আছে। পশ্চিম দেওয়ালের অভ্যন্তরে একটি বেদি এবং উত্তর দেওয়ালে তিনটি চোরকুঠরি রয়েছে। এটিও একটি নবরত্ন মন্দির। সুউচ্চ শিখর ঘিরে প্রধান উপাসনা কক্ষের উপর চারটি ছোট রত্ন এবং বারান্দার চার কোণার উপরে অন্য চারটি ছোট রত্ন স্থাপন করা হয়েছে।
পূর্বদিকের মন্দিরের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ও অলংকরণ পশ্চিম দিকের মন্দিরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। কিন্তু একটি পার্থক্য বিদ্যমান এবং তা হচ্ছে সম্পূর্ণ শিখরের বহিঃগাত্রে আস্তরকৃত খিলান নকশা। সম্প্রসারিত আঁকাবাঁকা হুড মোটিফের সাহায্যে সজ্জিত করা।
প্রচার, প্রসার ও সংরক্ষণের অভাবে সুউচ্চ শিখর বিশিষ্ট জোড় মন্দির লোকচক্ষু অন্তরালে হারিয়ে যাবে।
মনোজিৎকুমার দাস, লেখক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।