বেশ কয়েকবছর আগে দূরদর্শনের একটি তথ্যচিত্রে প্রথম জেনেছিলাম জঞ্জিরা দুর্গের কথা। তারপর প্রায় বছর দশেক আগে গুজরাটে বেড়াতে গিয়ে গীর যাবার পথে দেখি কিছু অন্যরকম কালো মানুষ।
তাদের একেবারেই আমাদের দেশীয় আদিবাসী অথবা ট্যুরিস্ট বলে মনে হচ্ছিল না। আমাদের চালককে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল, এরা এখানকার স্থানীয় মানুষ, এরা সিদ্দি নামে পরিচিত। তথ্যচিত্রে দেখা জঞ্জিরার এবং সিদ্দিদের ইতিহাস মাথায় স্ট্রাইক করল সেই মুহূর্তে। তারপর থেকেই জঞ্জিরা ফোর্ট দেখার ইচ্ছেটা মনের মধ্যে বহুদিন লালন করেছিলাম। এতদিন পর বছরের শেষদিনে সুযোগ হল সে কৌতূহল নিরসনের। ঘুরে এলাম জঞ্জিরা ফোর্ট।
কোনো এককালে আমি ইতিহাসের এক ফাঁকিবাজ ছাত্রী ছিলাম বলে পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসের ইতিহাস সব ভুলে গেছি, কিন্তু অতীত সময়কে আঁকড়ে ধরে কল্পনার উড়ানে যেতে ভালোবাসি। আর এই সিদ্দি উপজাতি এবং জঞ্জিরার মত যোগসূত্র যখন মিলে গেল তখন কেমন করে না জানি ইতিহাস আবার সামনে এসে গেল!
জঞ্জিরা প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরনো একটি অত্যাশ্চর্য জলদুর্গ। এই শক্তিশালী সামুদ্রিক দুর্গটি কোন বহিঃশত্রু কোনদিন জয় করতে পারেনি। মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলায় মুরুদ একটি ছোট্ট জনপদ, সেখানকার রাজাপুরী ফেরীঘাট থেকে নৌকায় যেতে হয় আরবসাগরের বুকে একখানি দ্বীপের মধ্যে গড়ে ওঠা এই দুর্গদর্শনে। দুর্গটির কিছু অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে।
২০ ফুট শক্ত ভিতের ওপরে নীল জলের আরব সাগরের সমুদ্রতল থেকে ৯০ ফুট উচ্চতার এই পাথুরে দুর্গ বিস্মিত করে সর্বসাধারণকে।
সমুদ্রের নোনাজলে দুর্গটির প্রাচীর বিন্দুমাত্র নষ্ট হয় নি।চুন, গুড়, সীসা, নুড়ি পাথরের মিশ্রণ ছাড়াও মনে করা হয় কোন বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ দুর্গের শক্তপোক্ত দেওয়াল অক্ষত রেখেছে। সে যুগের ঐ স্থাপত্য একালের মানুষের মনে বিস্ময় জাগায়।
দুর্গটির প্রবেশদ্বারটি মাত্র বারো মিটার কাছ থেকেই দেখা যায় তাই দূর থেকে কোন বহিঃশত্রুর অনুমান করা অসম্ভব দুর্গের প্রবেশপথ।
উপবৃত্তাকার ২২ একর জমিতে ২২ বছর ধরে ২২টি সৈন্য ঘাঁটি নিয়ে তৈরি দুর্ভেদ্য জঞ্জিরা দুর্গকে ইংরেজ, পর্তুগিজ তো বটেই, দুর্ধর্ষ শিবাজি, কনৌজি আংরে, চিমাজি আপ্পা ও শিবাজি-পুত্র শম্ভাজি পর্যন্ত করায়ত্ব করতে পারেননি। শোনা যায় শিবাজি তেরোবার এই দুর্গ আক্রমণ করেছিলেন। সৈকত থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে দুর্গ প্রবেশের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল তাঁর।
এই দুর্গের আসল হকদার অবশ্য ছিলেন সিদ্দি উপজাতিরা। আদতে দক্ষিণপূর্ব আফ্রিকার অ্যাবিসিনিয়ার বাসিন্দা ছিলেন এরা। এদেরকে হাবশি বলা হত। এরা ভারতে আসেন ব্যবসার সূত্রে। মোঘল সেনাবাহিনীর সৈনিক হিসেবে অথবা দাস হয়ে। একসময় সিদ্দিরা গুজরাট, মহারাষ্ট্রের কিছু কিছু অঞ্চলে খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। এরকমই একজন ছিলেন মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরের সুলতানের অ্যাবিসিনিয়ান মন্ত্রী মালিক অম্বার। তিনিই সপ্তদশ শতকে এই জলদুর্গটি তৈরি করেন। তারপর থেকে সিদ্দিরাই ছিলেন এই কেল্লার মালিক।
দুর্গের প্রবেশপথের ভাস্কর্যে খোদিত আছে ছটি হাতিকে পর্যুদস্ত করছে একটিমাত্র সিংহ। জঞ্জিরার অধিবাসীদের কাছে ছিল এটি সাহসিকতার প্রতীক। দুর্গের প্রাচীরের ফাঁকে তিনটি বিশাল কামান দুর্গ রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হত। সেগুলি আজও অক্ষত।
এক সময় এই দুর্গের মধ্যে নাকি ৫৫০টি পরিবার বাস করত। তাই দুর্গের ভিতরে আছে প্রাসাদ, দরবার, মসজিদ, শস্যাগার, স্কুল এবং অদ্ভূতভাবে চারপাশের নোনা জলের মধ্যে দুটি মিষ্টি পানীয় জলের বিশাল জলাশয়। যদিও এগুলি বেশিরভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত, একমাত্র পুকুরগুলি ছাড়া।
জঞ্জিরা দুর্গকে পাঁচ পীর পাঞ্জাতন শাহ্ বাবা যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে আসছেন, এমনই বিশ্বাস স্থানীয় মানুষের। দুর্গের ভেতরে আছে সেই শাহ্ বাবার সমাধি সৌধ। আরবিতে জঞ্জিরার অর্থ দ্বীপ। সেই দ্বীপে দৈত্যাকৃতি জলযানের মত এই জঞ্জিরা দুর্গ আরবি ভাষায় ‘অজিনক্যা’ অর্থাৎ অজেয়।
ভারতের ইতিহাসে এই ‘অজিনক্যা’ নৌসেনা ঘাঁটি নিজ মহিমায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। সমুদ্রের বুকে নিশ্চল ভাবে দাঁড়িয়ে এর গঠনশৈলী, ইতিহাস আকর্ষণ করছে পর্যটকদের। বছর শেষের দিনটিতে তাই জনস্রোত ছিল জঞ্জিরায়। মানুষের পাদস্পর্শে, কলকাকলিতে আবার যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা আপাত নীরব এই জলদুর্গের অভ্যন্তর।
Fabulous, I didn’t know this details. I have seen Siddhi community many times during my twelve years stay in Gujarat; but I had no idea that there was a connection with Janzira castle. Thanks to the contributor.
Thank you very much for your comment.Janjira is very common place to the Mumbaikars and Punekars but rest of them it’s mostly unknown..
Excellent experience shared with us.
Your style of writing makes the history of ‘Janjira’ vivid.
Thank you Didi 😊 🙏
Thanks a lot 😊