শতবর্ষ পেরোলেও সেই সময়ের একই রীতিনীতি ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে চলে আসছে বেলুড় মঠের দুর্গাপুজো। বেলুড়মঠে স্বামীজীর এই দুর্গা পুজো শুরু করার কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়। প্রথমত, সেই সময় জাতিভেদ প্রথা মানা কলকাতার তথাকথিত গোঁড়া হিন্দু সমাজ বিবেকানন্দের পশ্চিমী দেশে যাত্রা ও সমস্ত বর্ণের মানুষের সাথে তার কোনো প্রকার দ্বিধাবোধ ছাড়াই মিশে যাওয়া ভালোভাবে মেনে নেয়নি। তাই সেই সময় স্বামীজি যে নতুন ভাবধারার প্রসারের জন্য অগ্রসর হয়েছিলেন তার জন্য গ্রহণযোগ্যতা অর্জন ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেলুড় মঠ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে সাহায্য করার জন্য শুরু করেন।
অন্য আরেকটি কারণ হলো স্বামীজী যখন পাশ্চাত্যের দেশে গিয়েছিলেন, তখন সেই দেশের অগ্রগতির কারণ হিসেবে তিনি দেখেছিলেন সেখানে নারীদের প্রতি সমাজের উদার ও আধুনিক মানসিকতা। তাই একইভাবে এই দেশেও সে সময়ে নারীদের প্রতি প্রাচীন মানসিকতা ও অবহেলা দূর করে তাদের প্রতি সম্মানজনক মনোভাব তৈরি করতে তিনি মায়ের পুজো বিশেষত কুমারি পুজোর সাহায্য নিয়েছিলেন। মঠে পুজো শুরু করার অপর একটি কারণ হিসেবে ১৯০১ সালে দুর্গাপুজোর কিছুদিন আগে স্বামীজী বেলুড় মঠে দুর্গাপুজা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
পাশাপাশি সেই সময়ে মঠের আরও এক-দু’জন মহারাজও বেলুড়মঠে মায়ের আগমন এর দৃশ্য দেখতে থাকেন। ব্যাস তার পরেই স্বামীজীর নির্দেশে শুরু হয় পুজোর প্রস্তুতি। কিন্তু পুজোর আর মাত্র কদিন বাকি থাকায় মূল সমস্যা হিসেবে দাড়ায় মায়ের একটি মূর্তি জোগাড় করা। যদিও শেষ পর্যন্ত কুমোরটুলি থেকেই একটি মা দুর্গার অসম্ভব সুন্দর মূর্তি কিনে আনা হয় বেলুড় মঠের পুজোর জন্য। তার পর থেকে প্রায় ১২০ বছর ধরে ওই একই ঐতিহ্য ও পরম্পরার সাথে চলে আসছে বেলুড় মঠের দুর্গাপুজো। প্রতিবছরই লক্ষ লক্ষ ভক্ত পুজোর দিনগুলিতে বেলুড় মঠ চত্বরে ভিড় করেন, মহা সাড়ম্বরে আয়োজিত এই পুজো দেখার জন্য। শুধু এদেশেরই নয় বিদেশ থেকেও বহু ভক্ত আসেন বেলুড় মঠে মা দুর্গার বোধন দেখার জন্য।
বেলুড় মঠের অষ্টমীর পুজোর অন্যতম আকর্ষণ হলো কুমারী পুজো। এর মাধ্যমে ওইদিন একটি অল্পবয়স্ক কন্যাকে দেবীরূপে গণ্য করা হয়। অষ্টমীর সকালে কুমারীকে গঙ্গাস্নান করিয়ে তাকে শুদ্ধ করে, লাল বেনারসী পরিয়ে, গায়ে গয়না ও পায়ে আলতা সহযোগে তাকে সাজানো হয়। দেবী দুর্গাকে দেওয়া একই ধরনের নৈবেদ্য ওইদিন কুমারীকে দিয়ে তাকে আরতি করা হয়। বেলুড় মঠের সমস্ত সাধুরাও সেই সময় ওই কুমারীর মধ্যে দেবী দুর্গাকে খুঁজে পান।
বেলুড় মঠের অষ্টমীর সন্ধিপুজাও পালিত হয় জাঁকজমকভাবে। ১৯০১ সালে যখন বেলুড় মঠে পুজো শুরু হয়, তখন স্বামীজী চেয়েছিলেন শুভ সন্ধিক্ষণে পশুবলি দিতে। কিন্তু মা সারদা পশুবলির প্রবল বিপক্ষে ছিলেন। অগত্যা মা সরদার আদেশে বেলুড় মঠে পশুবলি কখনও দেওয়া হয় না। পশুর বদলে ফল বলি দেওয়া হয় বেলুড় মঠে।
আজও সেই রীতিতে বেলুড় মঠে দুর্গা পুজো পালিত হচ্ছে।
সূত্রঃ বেলুড় মঠের দুর্গা পুজো, মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা