বিগত প্রায় দেড় বছর ধরে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মনিপুরে মেইতেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে খ্রিস্টান নাগা-কুকিদের মধ্যে সংঘর্শ লেগেই রয়েছে। নতুন করে সেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় গত ৭ নভেম্বর। তার জেরে পশ্চিম মণিপুরের জিরিবাম, মধ্য ও দক্ষিণ মণিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবল উত্তেজনা দেখা দেয়। ওই দিন রাতে জিরিবাম জেলায় এক স্কুলশিক্ষিকাকে ধর্ষণের পর জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। হামর গোষ্ঠীর অধিবাসী ওই শিক্ষিকা তিন সন্তানের মা ছিলেন। হামররা নাগা-কুকিদের জ্ঞাতিভাই। হামর ছাড়াও আরও কয়েকটি আদিবাসী গোষ্ঠীকে একত্রে ‘জো’ বলে ডাকা হয়। ওই ঘটনার পর গত ৯ নভেম্বর মধ্য মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলায় আরএক নারীকে গুলি করে হত্যা করে সন্দেহভাজন কুকিরা। পরপর মণিপুরের হিংসার ঘটনায় রাজ্য সরকার ইম্ফল পূর্ব, ইম্ফল পশ্চিম, বিষ্ণুপুর, থৌবল এবং কাখচিংসহ পাঁচটি জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাত জেলায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়ে সেনাবাহিনী ও আসাম রাইফেলস মোতায়েন করে।
তা স্বত্বেও গত ১১ নভেম্বর দক্ষিণ আসামঘেঁষা জিরিবাম জেলার বোড়োবেকরা এলাকায় সশস্ত্র কুকিরা একটি থানায় হামলা চালায়। এই থানায় কুকিরা অতীতেও বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়েছিল। থানায় হামলার পর সশস্ত্র কুকিরা জাকুরাদর কারং নামের একটি এলাকাতেও হামলা চালায়, বাড়িঘরে আগুন লাগায়, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। নিহত হয় ১০ সশস্ত্র কুকি। মৃত দেহ মিজোরামে নিতে চেয়ে কুকিরা শিলচরের হাসপাতালের মর্গ ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখায়। পরের দিন সকালে পুলিশ ১০ জনের মৃত দেহ নিয়ে কুকি অধ্যুষিত চুড়াচাঁদপুরের দিকে রওনা হলে তাদের ঘেরাও করে কুকিরা। বিক্ষোভ দমন করতে পুলিশ লাঠি চালায়। অভিযোগ ওঠে, সেই সময় একদল সশস্ত্র কুকি মেইতেই সম্প্রদায়ের তিন নারী ও তিন শিশুকে অপহরণ করে। পরে সেই ছ’জনের মরদেহ উদ্ধার ঘিরে শুরু হয় মেইতেইদের বিক্ষোভ। মেইতেই বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে এসে যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়। ইম্ফলে তিন মন্ত্রী ও ছয় বিধায়কের বাড়িতে হামলা চালায়। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের বাড়িতেও আগুন লাগায়।
কিন্তু কেন বারবার মণিপুরে এই সংঘর্ষের ঘটনা। দু-চার মাস ব্যবধানে মণিপুরে জাতিগত উত্তেজনা ফিরছে আর সংঘর্ষ হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত বছর মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুর রাজ্যের জাতিগোষ্ঠী মেইতেইদের ‘শিডিউল ট্রাইব’ বা তফসিলি গোত্র ঘোষণা করে। মণিপুর রাজ্যের একেবারে কেন্দ্রে প্রায় ১০ শতাংশ ভূমি নিয়ে অবস্থিত ইম্ফল উপত্যকায় বাস করে মেইতেইরা। এদের বড় অংশই হিন্দু। তবে মুসলমান ও বৌদ্ধও আছে। মেইতেইরা মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ। মণিপুর বিধানসভায় অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাও মেইতেইদের। অন্যদিকে ইম্ফল উপত্যকার আশেপাশের পাহাড়ে বাস করে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। কুকিদের বাস পাহাড়ি এলাকার দক্ষিণে আর উত্তর-পূর্বে বাস করে নাগারা। খ্রিস্টধর্ম অনুসারী কুকি ও নাগারা মণিপুরের ৩৫ লাখ মানুষের প্রায় ৪০ শতাংশ। তাদের বাস পাহাড়ে সংরক্ষিত এলাকায়। এই পাহাড়ি অঞ্চল মণিপুর ভূখণ্ডের ৯০ শতাংশ। মণিপুরের ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী, স্থানীয় জেলা পরিষদের অনুমতি ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় মেইতেইদের বাস করার অনুমতি ছিল না। কিন্তু কুকি ও নাগা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের উপত্যকা এলাকায় বাস করার ক্ষেত্রে কোনও বিধি-নিষেধ ছিল না। কিন্তু কেন্দ্র সরকার মেইতেইদের তফসিলি ঘোষণা করার পর মণিপুর রাজ্য সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই ও রাজ্যের কেন্দ্রে ইম্ফল উপত্যকার চারপাশের পাহাড়ি এলাকায় বাস করা নাগা ও কুকিদের মধ্যে জাতিগত সংঘাতের সৃষ্টি হয়। নাগা ও কুকিদের অভিযোগ, অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের মাধ্যমে মূলত তাদের ভূমি থেকে সরানো হচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০০-র বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ।
আসলে বিভাজনের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে ক্ষমতা লোভে বেপরোয়া হয়ে উঠলে তার পরিণতি যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে বিজেপি সরকারের জমানায় মণিপুর তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ক্ষমতায় টিকে থাকতে এই সরকারের প্রধান অবলম্বন ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিভাজন রাজনীতি। বেশ কয়েক বছর ধরে হিন্দুত্ববাদী এই দলটি কৌশলে মণিপুরে বিভাজনের উর্বর জমি তৈরি করে সেই জমিতে বিভেদের রাজনৈতিক বীজ রোপন করে মণিপুরে বিজেপি সরকার স্থাপন করেছে। জে সরকার মণিপুরের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান ও জনবিন্যাসকে দক্ষতার সঙ্গে ধ্বংসাত্মকভাবে কাজে লাগিয়ে হিন্দু সেইতেই আর খ্রিস্টান কুকিদের মধ্যে বিভেদ বিদ্বেষের সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছে। বর্তমানে দুই জাতি গোষ্ঠী পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে গিয়ে একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। গত ১৯ মাস ধরে দুই জাতি গোষ্ঠীর সংঘর্ষে জ্বলছে গোটা রাজ্য। সমতল থেকে কুকিরা যেমন উচ্ছেদ হয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। তেমনি পাহাড় ছেড়ে মেইতেইরা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে সমতলে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ভয়াবহ বিভাজন আর কোথাও কোনোদিন হয়েছে কী?