১৯৬৮ সাল। নানা পরিস্থিতিতে তখন অস্থির তাঁর জীবন। নিজের দল এলটিজি থেকে তখন তিনি বিতাড়িত। আগের বছরেই তাঁকে রাজনৈতিক কারণে জেলে যেতে হয়েছিল। চারিদিকের চেনা মানুষগুলি কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠেছিল। তাঁর নাটক করার জায়গাটা তখন প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তিনি থেমে থাকার পাত্র নন। তাঁকে চলতেই হবে। তাই তিনি অভিনয়ের অন্য মাধ্যম খুঁজছিলেন। ছবিতে অভিনয় চলছিল। কিন্তু পাশাপাশি তিনি যাত্রার দিকে ঝুঁকলেন। খুব ইচ্ছে ছিল যাত্রার মাধ্যমটিকে নিয়ে কিছুটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা। বারবার বলতেন, ‘প্রকৃত, নিয়মনিষ্ঠ শিল্পী যদি খুঁজতেই হয়, তবে যাত্রায় যেতে হবে।’ ততদিনে দেখে ফেলেছেন ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ, পঞ্চু সেনের অভিনয়। তাঁদের বলিষ্ঠ অভিনয় দেখে ঠিক করলেন যাত্রার জন্য পালা লিখবেন, নির্দেশনা দেবেন। তিনি উৎপল দত্ত। শুধু চলচ্চিত্র বা বাংলা নাট্যমঞ্চেই তাঁর অবদান ছিল তা নয়। অনেকটা অবদান তাঁর যাত্রাতেও রয়েছে।
যোগাযোগ ঘটে গেল। ১৯৬৮ সালে যাত্রার জন্য প্রথম পালা লিখলেন ‘রাইফেল’। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পটভূমিকায় লেখা। নতুন নাটক নয়। তাঁর ‘টোটা’ নাটকটিকেই একটু অদল বদল করেছিলেন। নিউ আর্য অপেরায় সেই নাটক একদিন পড়া হল। কিন্তু পালা শুনেই পঞ্চু সেন বলে দিলেন, ‘এই নাটক যাত্রায় চলবে না। খুব কঠিন হয়ে গিয়েছে। গ্রাম বাংলার দর্শক এই নাটক নেবে না।’
পঞ্চু সেনকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন উৎপল দত্ত। তিনিও বুঝতে পারলেন, এই নাটক বদল করা দরকার। তিনি বললেন, ‘আমাকে সাতদিন সময় দিন, আমি একটা নতুন নাটক লিখে দেব।’ কিন্তু ততদিনে ‘রাইফেল’ নাটকের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। নাম আর বদল করা যাবে না। তাই নামটি একই রেখে লেখা হল নতুন নাটক। ১৯৩০ সালের স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে লিখলেন নতুন নাটক। এবার পঞ্চু সেন বললেন, ‘শেষ দৃশ্যটা অন্যরকম করা দরকার। ঠিক জমেনি।’ সেই পরামর্শ মেনে উৎপল আবার তাঁর পালার পরিবর্তন করলেন। সেই নাটকে পঞ্চু সেন করেছিলেন ‘রহমৎ’ চরিত্র। রিহার্সালের সময় উৎপল দত্ত সব শিল্পীকে নানা বিষয় নির্দেশ করলেও পঞ্চু সেনকে কিছুই বলছিলেন না। পঞ্চুবাবু তাঁর নিজের মতো করে রিহার্সাল দিচ্ছিলেন। একদিন পঞ্চুবাবু বললেন, ‘আপনি সবাইকে সবকিছু বলে দিচ্ছেন, আমাকে কিছু বলছেন না তো!’ সে কথা শুনে উৎপল দত্ত বললেন, ‘আমি আপনার অভিনয় দেখে কিছু শিখছি।’ এমনই ছিল তাঁর শ্রদ্ধাবোধ।
১৯৬৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে অভিনীত হল ‘রাইফেল’। সারা ফেলে দিল সেই পালা। কিন্তু সেবছরই দলের মালিকের সঙ্গে টাকা পয়সা নিয়ে এমন সব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল যে, উৎপল সিদ্ধান্ত নিলেন, যাত্রায় আর নাটক দেবেন না। স্থির হল নিজেরাই যাত্রা দল গড়ে গ্রামগঞ্জে অভিনয় করবেন। তৈরি হল বিবেক যাত্রা সমাজ। দুটি পালা ঠিক হল। একটি ‘রাইফেল’ এবং অন্যটি ‘শোনরে মালিক’। কিন্তু বিবেক যাত্রা সমাজ চালানো গেল না। এর মধ্যেই সত্যম্বর অপেরার শৈলেন মোহান্তি এলেন উৎপল দত্তের কাছে। নতুন নাটক চাই। উৎপল দত্ত রাজি নন। কিন্তু মত বদলাতে হল। লিখলেন ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’। সেই কুখ্যাত হত্যাণ্ডের ঘটনা নিয়ে নাটক। পেলেন একদল ভালো অভিনেতাকে। ভোলা পাল (ছোট), মনোরঞ্জন চক্রবর্তী, শিবদাস মুখোপাধ্যায়, তপনকুমার, মোহন চট্টোপাধ্যায়, জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়কে। রিহার্সালে এঁদের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন উৎপল।
পরের বছর পালা লিখলেন লোকনাট্যের জন্য। ‘দিল্লি চলো’। অসাধারণ হয়েছিল সেই পালা। সেখানে পেলেন শেখর গঙ্গোপাধ্যায়কে। সেই বছরেই লোকনাট্যে দিলেন আর একটি পালা ‘সমুদ্রশাসন’। সমুদ্রগুপ্তকে নিয়ে লেখা পালা। আরও দুটি পালা সে বছর হয়েছিল, একটি ‘নীলরক্ত’। অভিনীত হয়েছিল ভারতী অপেরায় এবং অন্যটি ‘ভুলি নাই প্রিয়া’। অভিনীত হয়েছিল শ্রীমা অপেরায়।
যাত্রায় আসার আগে পালার আঙ্গিক নিয়ে তিনি জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তখন শম্ভু বাগ, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ পালাকারের প্রকাশিত বেশ কয়েকটি যাত্রার বই পড়ে তিনি পথ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। জানলেন যাত্রা কী, কেমন তার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তিনি পুরোপুরি সেই পথ অনুসরণ করলেন না। তার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন নিজস্বতা। যাত্রার আঙ্গিকের মধ্যে মিশিয়ে দিলেন নাটকের কম্পোজিশন এবং অভিনয়। বাচিক অভিনয়কেও অনেকটা বদলে দিলেন। শহরকেন্দ্রিক এলাকায় সেই সব পালা তুমুল সাফল্য পেলেও গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে, তা অনেকটাই অধরা থেকে গিয়েছিল। তাই তাঁর সব পালাকে সেই অর্থে হিট বলা যায় না। অর্থাৎ ব্রজেন দের ‘সোনাই দীঘি’, শম্ভু বাগের ‘হিটলার’, ‘লেনিন’ বা ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একটি পয়সা’, ‘পাগলা গারদ’ বা ‘মা-মাটি-মানুষ’ যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, উৎপলের নাটক সেখানে পৌঁছতে পারেনি। এমনকী তরুণ অপেরায় শান্তিগোপাল তাঁর লেখা পালা ‘মাও সে তুং’ করেছিলেন, সেও বেশিদিন চলেনি। তার কারণ অবশ্য অন্য ছিল। উৎপল সেই নাটকে চিয়াং কাই শেকের চরিত্রটি দিয়েছিলেন গৌতম সাধুখাঁকে। কিন্তু সেটা মনঃপুত হয়নি শান্তিগোপালের। কেন না গৌতম তখন যাত্রায় নতুন। সুতরাং কয়েক পালার পর বন্ধ হয়ে যায় ‘মাও সে তুং’।
নির্দেশনার ক্ষেত্রে উৎপল দত্ত ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এটা অবশ্য বলাই যায় যে যাত্রায় তিনি এক ধরনের আধুনিকতার জন্ম দিয়েছিলেন। অবশ্য বিচার করলে বলতেই হয়, তিনি সময়ের চেয়ে একটু বেশি এগিয়ে ছিলেন। নাটকে যেমন একসময় নবনাট্য এসেছিল, চলচ্চিত্রে যেমন একটা নতুন ধারার ছবি তৈরির হাওয়া এসেছিল, উৎপল দত্তও যাত্রায় সেই নতুন যুগের হাওয়া আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। কেন না তাঁর মতো করে যাত্রাসৃষ্টি করার প্রতিভা পরবর্তীকালে পাওয়া যায়নি। তাই শুধু বাণিজ্যের নিরিখে তাঁর পালাকে মাপলে অনেকক্ষেত্রে ভুল হতে পারে।
অনেকে বলেন যাত্রায় রাজনৈতিক নাটকের তিনি ভগীরথ। কথাটা সর্বাংশে ঠিক নয়। তার আগেও যাত্রায় রাজনৈতিক নাটক হয়েছিল। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক নাটককে নতুন ভাষ্যে উপস্থাপিত করেছিলেন। বলিষ্ঠ কনটেন্ট আর ফর্মের মধ্য দিয়ে সে সব প্রযোজনা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যাত্রায় উৎপল দত্ত সব সময় পছন্দ করতেন শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, শিবদাস মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশেষ কয়েকজন শিল্পীকে। এছাড়া ছিলেন অনাদি চক্রবর্তী, ইন্দ্র লাহিড়ী, নিরঞ্জন ঘোষ, মুকুন্দ দাস, বীণা ঘোষ, বর্ণালী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। তরুণরা তাঁর ঘরানাতেই গড়ে উঠেছিলেন। আর প্রবীণরা পেয়েছিলেন অভিনয়ের পূর্ণতার স্বাদ। তৈরি হয়েছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধার একটা স্থান।
বিজন মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে তাঁর একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ‘দিল্লি চলো’ পালায় বিজনবাবু অভিনয় করতেন ইংরেজ কর্নেল ব্রেনানের ভূমিকায়। রিহার্সালের আগে উৎপল দত্ত যখন তাঁকে দেখেন তখন তিনি লুঙ্গি পরা। বিড়ি টানছিলেন। এই মানুষটি সাহেবের ভূমিকায় অভিনয় করবেন, ভাবতে কেমন সঙ্কোচ হচ্ছিল উৎপলের। কিন্তু মঞ্চে তাঁর অভিনয় দেখে তিনি চমকে গিয়েছিলেন। পরে তিনি বলেছিলেন, ‘ইংরেজের ভূমিকায় এত ভালো অভিনয় তিনি আগে দেখেননি।’ মঞ্চে একটা দৃশ্য ছিল ব্রেনান বিপ্লবী প্রদ্যোতের চোখ উপড়ে নিচ্ছে। প্রদ্যোতের ভূমিকায় ছিলেন শেখর গঙ্গোপাধ্যায়। সেই দৃশ্যে ব্রেনানের নিষ্ঠুরতার অভিনয় দেখে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে মঞ্চে উঠে পড়তেন ব্রেনানকে মারতে।
এরপর একে একে ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’, ‘ঝড়’, ‘বৈশাখী মেঘ’, ‘সীমান্ত’, ‘তুরুপের তাস’, ‘সাদা পোশাক’, ‘দামামা ঐ বাজে’ ইত্যাদি পালা অভিনীত হল। কুড়ি বছর তিনি যাত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে তিনি লিখেছিলেন বাইশটি পালা। সব পালা তেমন দাগ কাটেনি। হিট এবং ফ্লপ মিশিয়েই তিনি রাজত্ব করেছেন।
যাত্রায় উৎপল দত্তের কেরিয়ার নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যাত্রা গবেষক দিবাকর ভৌমিক বলেন, ‘উৎপল দত্ত মঞ্চরীতির একজন দক্ষ নির্দেশক। সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে পালাকার রূপে তাঁর সম্পর্কে অভিযোগ আছে, যা মামুলি নয়। যাত্রাপালার যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তা তাঁর কোনও পালাতেই নেই। সত্যি কথা বলতে কী এগুলিকে পালা না বলে নাটক বলাই শ্রেয়। তাঁর নাটকগুলির মধ্যে দু’চারটি জনসমাদর পেলেও কয়েকটি তো দারুণভাবে ব্যর্থ। গ্রামবাংলায় তাঁর নাটকগুলি জনপ্রিয়তায় ব্রাত্য।’
এই মত মেনে নিলেও বলতে হয়, উৎপল দত্ত যাত্রায় একটা যুগ। উৎপল দত্ত যাত্রায় এক নতুন ভাষ্যের রূপকার। অসীম শ্রদ্ধা ছিল তাঁর যাত্রার প্রতি। একবার তাঁর সঙ্গে একটি ছবির শ্যুটিংয়ের অবসরে নানা বিষয়ে কথা হয়েছিল। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে যাত্রা প্রসঙ্গও এসেছিল। সেদিনই বুঝেছিলাম যাত্রা এবং যাত্রাশিল্পীদের প্রতি কতটা তাঁর শ্রদ্ধাবোধ। বলেছিলেন, ‘যাত্রায় যুক্ত হয়ে বুঝেছি এখানে কত শক্তিশালী শিল্পীরা আছেন। প্রফেশনালিজম শিখতে হলে যাত্রার শিল্পীদের থেকেই শেখা উচিত। দেখেছি তাঁদের কাছে যাত্রা একটা ধর্মের মতো। শিল্পকে প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছে যাত্রা। সেটা নাটক পারেনি।’
উৎপল দত্তের যাত্রা পালা সঙ্কলনের ব ইয়ের pdf পাওয়া যাবে