ট্রেড এন্ড কমার্সিয়াল অর্গানিজেশন ইন বেঙ্গল ১৬৫০-১৭২০, উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
ষষ্ঠ অধ্যায়
চিনি, সুতো এবং অন্যান্য রপ্তানি পণ্য
কোম্পানি বাংলার কাপড়ের বরাত বিশ্লেষণ করে জানা যাচ্ছে, কোম্পানির বাঙলার ব্যবসার প্রথম দিকে রেশম এবং সুতির টুকরো কাপড়ের পরিমান ছিল প্রায় শুন্য। ১৬৫১তে বাঙলার কুঠিয়ালদের হাতে অন্য পণ্যে বিনিয়োগ করার জন্যে খুব কম পরিমানই অর্থ থাকত, সেই কম পরিমানের একের ছয় ভাগ মাত্র তারা সানো এবং আলতাসি কেনার জন্যে ব্যয় করেছে (ওসি, ১৯ ফেবরুয়ারি ১৬৫১, ২২০৮, ২২ খণ্ড; ইএফআই, ১৬৫১-৫৪, ৪৫; ওসি ২৫ ফেবরুয়ারি ১৬৫১, ২২১০, ২২ খণ্ড, ইএফআই ১৬৫১-৫৪, ৪৭)। ইংলন্ড থেকে বাঙলার বস্ত্র শিল্পের প্রথম বড় বরাত আসে ১৬৭৫/৭৬এ ৯৮,০০০টি এবং ১৬৬৯/৭০-এ বরাত ছিল মাত্র ২৬,৮৫০টি। অন্যভাষায় বলতে গেলে মাত্র ছয় বছরের মধ্যে কোম্পানির ব্যবসা ছয়গুণ বেড়ে গেল। আরও বিপুলভাবে বাড়তে শুরু করে আটের দশক থেকে। ১৬৮০/৮১তে কোম্পানি ২,০৬,৪০০টি কাপড়ের বরাত দেয়, পরের বছর সেটি বেড়ে হয় ২,২৯,২০০টি, যা ১৬৮২/৮৩তে বেড়ে হয় ৬,৬২,৮০০টি এবং ১৬৮৩/৮৪তে আরও বেড়ে হয় ৬,৮২,৩০০টি।
এর পরেরে হঠাতই বরাতের পরিমান কমে যেতে থাকে। তবে নয়ের দশকের মাঝখান থেকে আবার বাংলা কুঠিয়ালদের কাছে বিপুল পরিমান বরাত আসতে থাকে। ১৬৯৫/৯৬তে কোম্পানি ৪,১৭,৫০০টি কাপড়ের বরাত দেয়। ১৭১৬/১৭ অবদি বরাতের পরিমান ছিল ২,৫০,০০০ থেকে ৩,০০,০০০টির মধ্যে। আবার ১৭১৭/১৮র পরে বরাত বেড়ে আকাশ ছোঁয়, ৪,১৫,০০০ থেকে শুরু হয়ে ১৭১৯/২০তে বরাতের পরিমান দাঁড়ায় ৪,৮০,০০০পিস। ডাচেদের বরাত বড় ছিল, অষ্টাদশ শতকের প্রথম দুদশকে বছরে আড়াই লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ পিসে ঘোরাফেরা করত।
এই তথ্য থেকে একটা অবশ্যম্ভাবী প্রশ্ন উঠে আসে সেই শতকের সাত এবং আটের দশকে কি ঘটল যার ফলে ইওরোপে বাঙলার কাপড়ের এই বিপুল চাহিদা তৈরি হল? একটা স্বাভাবিক উত্তর হতে পারে, ইওরোপে যে দামে তাঁতিরা কাপড় তৈরি করত, বাঙলার তাঁতিরা তার থেকে আবশ্যিকভাবে অনেক কম দামে টুকরো কাপড় তৈরি করে দিতে পারত। এবং বাংলার কাপড়ের গুণমানের ধাক্কায় আংশিকভাবে ইংলন্ডে এবং সামগ্রিক ইওরোপের ক্রেতাদের জামাকাপড় পরার স্বাদের পরিবর্তনও ঘটছিল। তবে সে সময় ইওরোপে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১৬৭৮ সালে ইংলন্ড ফরাসী রেশম, সুতি এবং একই সঙ্গে ফরাসী মদ্য, নুন এবং কাগজ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার ফলে ইংলন্ডে বাঙলার কাপড়ের প্রভূত চাহিদা তৈরি হয় (লিপসন, এন ইন্ট্রোডাকশন টু ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইংলন্ড, তৃতীয় খণ্ড, ১০৪)। যদিও ফরাসী এবং ইতালিয় রেশমের তুলনায় বাঙলার রেশম গুণমানে কিছুটা ন্যুন ছিল, কিন্তু ইওরোপিয় রেশমের তুলনায় বাঙলার রেশমের দাম ছিল অনেক অনেক কম, ফলে একই বিনিয়োগে তারা ইওরোপিয় কাপড়ের তুলনায় অনেক বেশি বাঙলার রেশম কিনতে পারত। এছাড়াও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাঙলার রেশম কাপড়ের বহিরঙ্গ ইতালিয় তাফেতার মত আকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৬৫৯ সালে লন্ডনের কর্তারা সিদ্ধান্ত নেন বাঙলার তাফেতাকে যদি ইংলন্ডে ঘসেমেজে নেওয়া যায় তাহলে সেগুলি অনেকটা ইতালিয় তাফেতার মত উজ্জ্বল রঙের চকচকে দেখতে হতে পারে (ডিবি, ২৮ জানু, ১৬৫৯, ৮৫ খণ্ড, ১৯৯; ইএফআই, ১৬৫৫-৬০, ২৭৫-৭৬)। ১৬৬৩-তে তারা বাঙলার কুঠিয়ালদের নির্দেশ দিয়ে জানায় যে তারা যেন বাঙলার তাফেতাগুলি ইতালিয় তাফেতার মত দেখিতে করে তৈরি করানোর উদ্যোগ নেয় (ডিবি, ২ জানু ১৬৬৩, ৮৬ খণ্ড, ২০২)।
ক্রেতার স্বাদ বদলের বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা যাক। এটা পরিষ্কার ১৬৮০র দশক থেকে ইওরোপে শুরু হয়ে যায় ইন্ডিয়ান কাপড়ের দুর্নিবার আকর্ষণ যা সপ্তদশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত চলতে থাকে (কে গ্ল্যানম্যান, প্রাগুক্ত, ১৪২)। এ প্রবণতাকে ফ্যাসান বলা ঠিক নয় (ফ্যাশন বিষয়ে জানতে সলোমন, বিজায়ার ডিজাইন্স ইন সিল্ক দেখুন), কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। ফ্যাশানটা কিভাবে প্রভাব ফেলেছিল, তার একটা উদাহরণ দিতে পারি ১৬৯৫ সালে লেখা জে কেরির রাজনৈতিক চটি থেকে, তিনি লিখছেন — ভয়ের কথা হল কুড়ি বছর ধরে যখন থেকে আমরা ক্যালিকো দিয়ে নানান ধরণের সাজসজ্জা বিখ্যাতদের সজ্জা (গ্রেটেস্ট গ্যালান্টস — সেগুলিকে মসলিন বা যে নামেই ডাকা হোক না কেন) গুলি দেখছি, তখন খুব বেশি এগুলি ব্যবহার হত না, খুব বেশি হলে মৃতের আচ্ছাদনের জন্যে কাজে লাগত অথবা গরীবেরা দামি লিনেন কিনতে না পারলেও ধনীদের নকল করতে চাইত (কিন্তু পারত না); এখন পুরুষ এবং মহিলারা ক্যালিকো কাপড়ের বসন পরে, ক্যালিকোর জামা, গলবন্ধ, কাফ পরে, পকেটে রুমাল নেয়, মাথা কাপড় দিয়ে সাজায়, রাতের বসন তৈরি করে, শিরস্ত্রাণ করে, হাতা সাজায়, এপ্রন তৈরি করে, গাউন বানায়, শায়া বানায় এবং ক্যালিকো দিয়ে কি না পরিধেয় বানায়, এমন কি পুরুষ-নারী উভয়েই ভারতীয় মোজা পরে (জে কেরি, আ ডিসকোর্স কন্সেন্ট্রেটিং দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া ট্রেড, ৪)।
১৬৯৬ সালে বোর্ড অব ট্রেডের সামনে পোলেক্সফেন, ১৬৮১তে ভারতীয় পণ্য কি পরিমানে প্রভাব ফেলেছিল সে বিষয়ে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে বলেন, ক্ষতিকর আগাছা যেমন কোনও সময় না দিয়েই বেড়ে উঠতে থাকে, ঠিক সেইভাবে ভারতে তৈরি পণ্যও অতি প্রখ্যাত থেকে রাঁধুনির অজানা অচেনা সাহায্যকারীও কোনও বাছ বিচার না করে ভারত থেকে আমদানি করা কাপড় পরে থাকে (ইন্ডিয়া অফিস ট্র্যাক্টস, খণ্ড ৮৩, ট্র্যাক্ট সংখ্যা ৭, ৫০)।
ক্রেতাদের স্বাদ আর অভ্যেসের পরিবর্তন আসছিল, ইংলন্ডের সওদাগর কোম্পানিও সেটা বিলক্ষণ টের পাচ্ছিল নিজের দেশে বসেই। ফলে তারা আরও দামি আরও নতুনত্ব আনার চেষ্টা করে চলতে থাকে। লন্ডনের কোম্পানির কর্তারা ১৬৮১তে লিখলেন, মাথায় রাখবে এটা ধ্রুব এবং সাধারণ সত্য নিয়ম, ব্রিটিশ মহিলাদের উদ্দেশ্যে তৈরি ফুলেল ছাপওয়ালা রেশম কাপড়ে প্রয়োজনে প্রত্যেক বছরই ফুলের আকারে, ফ্যাশানের পরিবর্তন হবে আনতেই হবে। ব্রিটিশ মহিলারা বলাবলি করে, ইওরোপে যে ফ্যাসান আসে নি, সেই ধরণের কাপড়ের ফ্যাসানে নতুনত্ব পাওয়ার জন্যে ফরাসী এবং অন্যান্য ইওরোপিয় মহিলা দ্বিগুণ অর্থ খরচ করছে (ডিবি, ২০ মে ১৬৮১, ৮৯ খণ্ড, ৩৫২)।
১৮৮২-র জুলাইতে কর্তারা আবার ফ্যাসানের পরিবর্তন বিষয়ে নজরটান দিয়ে লিখলেন, পাশের বাড়ির মহিলাদের ঈর্ষা উদ্রেককারী বিপুল বৈচিত্রের কাপড় আমাদের ক্রেতারা কিনতে চায় (ডিবি ৫ জুলাই, ১৬৮২, ৯০ খণ্ড, ৭)। (চলবে)