একবার নয়, বারবার বামেরা ভুল দিশার দিকে ছুটে গেল।
ইতিমধ্যে ২০২০ সালের গোঁড়াতেই লকডাউন বিরোধীরা রাস্তায় নেমে যখন প্রতিবাদ শুরু করছেন তখন থেকেই তাদের নানাভাবে নির্যাতন করা, এমনকি আটক করা হচ্ছিল।
এই প্রতিবাদ গুলির যথেষ্ট রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল, তবু বামেদের কাছে এসব দৃশ্যমান হচ্ছিল না। উপরন্ত ,২০২০ সালের গ্রীষ্মকালে যখন এই আন্দোলন গুলোতে ব্যাপক জনতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেল তখন উদাসীনতার বদলে বামেরা কুৎসার আশ্রয় নিল। তার ই সাক্ষ্য বহন করছে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে বামপন্থী পত্রিকা সোশালিস্ট ওয়ার্কারে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে। বুদ্ধিজীবী সুলভ লেখনীতে বাস্তবের বিকৃত চিত্রায়ন ছিল এই নিবন্ধ। ‘ভ্যাকসিন বিরোধীদের পদযাত্রা – দক্ষিণপন্থী বিপদের ইঙ্গিত’- এই শিরোনামে তারা লিখেছিল যে “এন এইচ এস এর ১০০ কোটি ভ্যাকসিন ডোজের প্রচারকে বিভিন্ন ছদ্মবেশী চরম দক্ষিণ পন্থী সংগঠন কাজে লাগাচ্ছে এবং চক্রান্ততত্ত্বের ভিত্তিতে তারা এমন একটি আন্দোলনকে বৈধতা দিচ্ছে যার শিকড় আসলে রয়েছে “ইহুদি বিদ্বেষী ভাবনার মধ্যে”।
দা মর্নিং স্টারের প্রতিবেদক ভ্যাকসিন বিরোধীদের গোঁড়া রোমান ক্যাথলিকদের দলভুক্ত বলে দেগে দিয়েছিল এবং ফ্যাসিবাদী মনস্তত্ত্ববিদ উইল হেল্ম রাইখ এর তত্ত্ব অনুযায়ী তাদের ফ্যাসিবাদের কাঁচামাল বলে অভিহিত করেছিল।
বিচিত্র বাইনারি : বাম অথবা ডান, ঠিক অথবা ভুল
‘সরল বিশ্বাসী জনগণের অভাব এবং অভিযোগ কে কাজে লাগিয়ে তাদের পথভ্রষ্ট করে চরম দক্ষিণ পন্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি শয়তানী প্রচেষ্টা চলছে’। – এটাই ছিল বামেদের বাঁধা বুলি। সমস্ত লকডাউন বিরোধী এবং ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনকে তারা এই ভাষাতেই খারিজ করে দিত।
তাদের এই বক্তব্যই প্রমাণ করছিল যে, বামপন্থার পরিচিত আঙ্গিকের বাইরে গিয়ে এক নতুন ধরনের সামাজিক আন্দোলন বিকশিত হবার স্পর্ধা দেখাচ্ছে – এই সত্যকে স্বীকার করতে তাদের অনীহা রয়েছে।
প্রতিদিনকার বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা এবং বৌদ্ধিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে যারা এই সময়ের সত্যের অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে বামেদের অপরিসীম অবজ্ঞা ফুটে উঠছিল।
এইভাবে যা কিছু তাদের ধারণার সঙ্গে খাপ খায় না তাকেই দক্ষিণপন্থী বলে দাগিয়ে দেওয়ার কুৎসিত অভ্যাস, তাদের জন্য এমন একটি বর্ম তৈরি করল যার আড়ালে থেকে তারা আধুনিক কালের সর্ববৃহৎ গণ আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে পারলেন।
যা কিছু বাম ঐক্যমত্যের বিরোধী , সেটাই নাকি দক্ষিণ পন্থা। যে বৈজ্ঞানিক মতবাদ সমস্ত সন্দেহ এবং প্রশ্নের উর্ধ্বে বলে নিজেকে দাবী করে- তাকে বিরোধিতা করা দক্ষিণ পন্থা। লকডাউনের যুক্তি এবং বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা মানেই দক্ষিণ পন্থা। পরীক্ষামূলক জিন টিকা নিতে অস্বীকার করা মানেই দক্ষিণ পন্থা। এসবের কোন একটি বিরোধী অবস্থান মানে দক্ষিণ পন্থা। লন্ডনে লক্ষ লক্ষ লোকের মিছিলে হাঁটা দক্ষিণ পন্থা। কানাডায় ট্রাক চালকদের কনভয় এবং নিউজিল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী দের জমায়েত দক্ষিণ পন্থা। জবরদস্তি ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে নার্সদের প্রতিবাদ আন্দোলন- সবই দক্ষিণ পন্থা!
শাসকের অনুগত এই বাম মনোভাবে যা কিছু রাষ্ট্র এবং মিডিয়া পরিচালিত কোভিড আখ্যানের বিরুদ্ধে যায়, সেটাই ছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দক্ষিণ পন্থা।
এসব সত্ত্বেও আমাদের অনেকেই এই বাম বনাম ডান – নির্ধারক তত্ত্বের বাইরে গিয়ে সমস্ত বিষয়কে খোলা চোখে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। ভ্যাকসিন বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে দক্ষিণপন্থী ভাবনার অনেক মানুষ ছিলেন- এ কথা সত্য। তা সত্ত্বেও এটা ছিল জনপ্রিয় গণ-আন্দোলনের এক সুবিশাল এবং নজিরবিহীন রূপ। যদি স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনকারীরা দক্ষিণ পন্থী নাও হয়ে থাকেন, বামেরা নিশ্চিত ভাবেই ছিল চরমতম ভুল পথের পথিক।
বাস্তবত: ইতালি, কানাডা , ব্রিটেন , নিউজিল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে যে জনতার অভুত্থান দেখা গিয়েছিল তাতে একটা জিনিস প্রমাণিত হয়েছিল, দারিদ্র, অবিচার, জাতিবিদ্বেষ এবং যুদ্ধ ছাড়া আরেকটি জিনিসকে বামপন্থীরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে। সেটা হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী যখন রাজনৈতিক সমাধানের ভার নিজের হাতে তুলে নেয়, তাদের সেই স্পর্ধিত প্রকাশভঙ্গি।
কোভিড কালে বামপন্থী রাজনৈতিক সক্রিয়তার সঙ্গে বাস্তব ক্ষেত্রে জন আন্দোলনের যে বিরাট ফারাক সৃষ্টি হচ্ছিল, এটা আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠলো ২০২১ এ লন্ডনে অনুষ্ঠিত স্বাধীনতার মিছিলে। একই সময়ে পিপলস এসেম্বলি, কিল দা বিল এবং এক্সটিংশন রেবেলিয়ন- এইরকম বামপন্থী সংগঠনগুলো রাস্তায় নেমেছিল। স্বাধীনতাকামী মিছিলে লোকের সংখ্যা ছিল তাদের তুলনায় প্রায় ৭০ গুণ বেশি। শুধু তাই নয় বামেদের ম্যার-মেরে প্রচার অভিযানের তুলনায় স্বাধীনতাকামী দের মিছিল ছিল অনেক বেশি বর্ণময় এবং উৎসাহ উদ্দীপনা ও বক্তব্যের বৈচিত্র্যে অনেক বেশি প্রানচঞ্চল। স্বাধীনতার মিছিল ছিল প্রকৃত অর্থেই জনগণের উৎসব। সেখানে অনুভূত হচ্ছিল বিচিত্র-মুখী জীবনের স্পন্দন। উদ্বেলিত জনতার মধ্যে কোন কিছু আড়াল করার ভান ছিল না। এটাই হওয়া উচিত কোন গণআন্দোলনের মুক্ত এবং কাঙ্খিত অভিব্যক্তি।
বাম বিশ্ববীক্ষা: বাস্তব থেকে ক্রমশ দূরে
বামেরা শুধু সক্রিয় হতেই ব্যর্থ হয়নি। তারা ব্যর্থ হয়েছে কৌতুহলী এবং অনুসন্ধানী হতে। তারা ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবাদী আখ্যানকে বুঝতে। তারা ব্যর্থ হয়েছে তাদের অনুসন্ধানী বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগাতে। কোভিড সম্পর্কে ক্ষমতার আখ্যানে যা বলা হয়েছে সেটাকে তারা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছে।
বামেরা কখনো প্রশ্ন তোলেনি কোভিড সংক্রমনে আসলে মৃত্যুহার কত? কত সাইকেল থ্রেশল্ড হলে পি-সি-আর পরীক্ষা গ্রহণযোগ্য হয়? যেভাবে কোভিড মৃত্যু গণনা করা হচ্ছে, তা কতটা সঠিক? কোভিড হলে, শুরুতেই যে সাধারণ চিকিৎসা হওয়া সম্ভব সেটাকে কেন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে? যেভাবে পরীক্ষার নামে জবরদস্তি করে নাকের ভেতরে একটি শলাকা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে- তাতে আপত্তি থাকাটা কি অস্বাভাবিক? গণ-হারে বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহারের পিছনে কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে কি? যেভাবে বিদ্যুৎগতিতে ভ্যাকসিন বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হল তাতে সন্দেহ প্রকাশ করা কি অযৌক্তিক? এই জাতীয় কোন প্রশ্ন তোলা দূরে থাকুক, রাষ্ট্র এবং মিডিয়া চালিত আখ্যানের প্রতিটি শব্দকেই বামেরা নির্বিকার চিত্তে মেনে নিয়েছিল।
বামেরা কখনো প্রশ্ন তোলেনি কোভিড প্রকল্প এবং তার প্রচারে বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, দা ওয়েলকাম ট্রাস্ট, ইকো health এলায়েন্স এবং গাভী (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন্স এন্ড ইমিউনাইজেশন) এইসব শক্তিশালী ও সরকারি সংস্থাগুলির ভূমিকা কি?
তারা কখনো ইভেন্ট ২০১ বিশ্লেষণ করে ভেবে দেখার কথা ভাবতেই পারে না। নীল ফার্গুসনের কম্পিউটার মডেলে যে বিরাট অসঙ্গতি এবং উদ্ভট তথ্য রয়েছে সেগুলি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে এই বামেদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। জন মাগুফুলির মত কোভিড আখ্যান কে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন যে সমস্ত আফ্রিকান রাষ্ট্র নেতারা তাদের রহস্যজনক মৃত্যু বিষয়ে তারা অদ্ভুতভাবে নীরব।
সমাজ মাধ্যমে যেভাবে যেকোনো প্রতিবাদী ভাষ্যকেই সেন্সর করা হচ্ছে এবং মুছে দেওয়া হচ্ছে তাতে বামপন্থীরা মোটেই বিচলিত নয় কারণ তারা ধরেই নিয়েছেন যাদের এভাবে সেন্সর করা হচ্ছে সেই সমস্ত লেখক, বিজ্ঞানী এবং সমালোচকরা সকলেই দক্ষিণপন্থী। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এটা যে মুক্ত চিন্তার বিরোধী এই সমস্ত ধরনের কর্তৃত্ববাদ বামেদের চর্চার বিষয় বলে গণ্য হচ্ছে না।
বর্তমানে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের কুপ্রভাবে যতই জনসাস্থ্যের ক্ষতিকর এবং বিপর্যয় প্রতিীয়মান হচ্ছে, অনেক চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞ যারা আগে ভ্যাকসিনের পক্ষে গোঁড়া অবস্থান নিয়েছিলেন তারা এখন অনেকেই তাদের মত বদল করছেন। ভ্যাকসিন পরবর্তী মৃত্যুর আধিক্য, ভ্যাকসিনের অকার্যকারিতা এবং অল্পবয়সী ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের মধ্যে বেড়ে চলা মায়োকার্ডাইটিস ( হৃদ যন্ত্রের প্রদাহ) – এসব বিষয়ে যে সমস্ত তথ্য প্রমাণ উঠে আসছে সেগুলো সম্পর্কে বামেদের জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ডক্টর অসীম মালহোত্রা এবং অধ্যাপক ডলগেইস যে সমস্ত সত্য উদঘাটন করছেন তাতে কান দেবার কোন ফুরসৎ বামেদের নেই। ভ্যাকসিন নেবার পর যে হাজার হাজার মানুষ চরম ক্ষতির শিকার হয়েছেন সেইসব মৃত অথবা জীবিত মানুষদের পক্ষে বিন্দুমাত্র সহমর্মিতা দেখাতে এই বামেরা ব্যর্থ হয়েছেন। (চলবে)
অসাধারণ লেখা।