পন্ডিচেরী এতটাই ভাল লেগে গেল যে পরদিন ভোরে পন্ডিচেরী ত্যাগ করার কথা ভাবতে কষ্ট বোধ হচ্ছিল। বিকেল হলে পায়ে হেঁটে গভর্নরস বাংলো, Romain Rolland লাইব্রেরি আর মিউজিয়াম দেখে নেওয়া যায় খুব ভালভাবে। আর কিচ্ছু না থাকলে শুধু রক বীচে বসে থাকার আনন্দটুকু যেকোন স্বর্গীয় সুখের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাই পরদিন ভোরের ট্রেন হেলায় ত্যাগ করা গেল। ত্যাগ তো করা হল, কিন্তু এরপর মাদুরাইয়ের ট্রেনে উঠতে গেলে বিকেলের মধ্যে পন্ডিচেরী ছাড়তেই হবে। কারণ চেন্নাই এগমোর স্টেশন থেকে মাদুরাইয়ের ট্রেন রাত সাড়ে নটায়।
ঠিক হল দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ বাস ধরে চেন্নাই এগমোর চলে যাওয়া হবে। বাস নাকি তিন ঘণ্টার মধ্যে চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশন পৌঁছে দেয়, যেখান থেকে এগমোর মাত্র দু কিলোমিটার। আমরা সারাদিন পন্ডিচেরী ঘুরে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। পরপর বাস আসছে, যাচ্ছে। কিন্তু এখানে ভাষার সমস্যার জন্য ঠিকমতো বুঝতে পারছি না কোন বাস কোথায় যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় একটা এসি বাস এসে থামল আর কন্ডাকটার এসে তামিল হিন্দিতে হাঁকতে লাগল “চেন্নাই! চেন্নাই!” জিজ্ঞেস করলাম “চেন্নাই এগমোর যায়েগা?” উত্তর এল সঙ্গে সঙ্গে “হাঁ”। সুতরাং আর বসে থেকে লাভ নেই, বাসে উঠে বসলাম। সামনের দিকে সিটও পেলাম। আরও গুটিকয় যাত্রী ওঠার পরই বাস ছেড়ে দিল। সব সিট ভর্তি হল না। বাস যখন পন্ডিচেরী শহর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে তখন এক তামিল সহযাত্রী বললেন এ বাস তো চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশন যাবে না, যাবে সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড। যেখান থেকে এগমোর স্টেশন পনের কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। আর ওখান থেকে এত জ্যাম থাকে যে অটোতে করে এগমোর স্টেশনে পৌঁছে মাদুরাইয়ের ট্রেন ধরা স্বপ্নের ব্যাপার।
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। তারপর শুরু হল বাংলা, তামিল, হিন্দি, ইংরাজি মেশানো এক খিচুড়ি ভাষায় কথা কাটাকাটি। সে কন্ডাকটার তখন আর হিন্দিও বলে না, ইংরাজিও বলে না, বলে শুধু কটরমটর করে তামিল, তাও অত্যন্ত দ্রুতলয়ে। আমরা তখন টেনশনে চিৎকার করতে শুরু করেছি “আরে বাস থামাও! আমি নেমে যাবো। আমার টিকিট কাটা অনেক দূরের। এই! রোকো! রোকো!” কিন্তু সে ব্যাটা কন্ডাকটার শুনলে তো। কেবল বলে “আম্মা!” অর্থাৎ আমি খুব রেগে গেছি বলে “আম্মা” বলে আমায় তুষ্ট করার চেষ্টা। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাবো যাবো করার সময়ে আবার সেই তামিল সহযাত্রী ও আরও দু-একজন আমাদের শান্ত হতে বললেন। ওনারা বললেন যে কন্ডাকটার একটু বজ্জাতি করেছে ঠিক কথা, কিন্তু এভাবে মাঝ রাস্তায় নেমে গিয়ে আমরা আরও বিপদে পড়বো। তার থেকে ‘Potheri’ ওরা উচ্চারণ করেছিলেন যেন ‘পুত্তেরি’ স্টেশনে নেমে গিয়ে ওখান থেকে লোকাল ট্রেন ধরে চেন্নাই এগমোর স্টেশনে চলে যাওয়া যাবে। সেটা অনেক সহজ হবে।
ওদের কাছে যেটা সহজ মনে হচ্ছে সেটা আমাদের কাছে ওই তামিল ভাষার মতই লাগছে। তবু এটাই সহজ হবে মেনে বসলাম। বাস মাঝে থামল, সবাই চা খেতে নামল। আমার হাজবেন্ড আমার জন্যে চা এনে দিলেও আমি তা মুখে দিলাম না, সব রাগ ওর ওপরে তখন, কেন সে কন্ডাকটারের তামিল বুঝলে না। যাই হোক পুত্তেরি বা পঠেরিতে বাস নামিয়ে চলে গেল। আমরা তিনতলা ওভারব্রিজ ভেঙে যেই প্ল্যাটফর্মে পা দিলাম একটা লোকাল বেরিয়ে গেল। ঠিক হাওড়া থেকে অফিস ভাঙা ভীড়। এত ভীড়ে লটবহর নিয়ে ওঠা অসম্ভব মনে হতে লাগল। তবে বিপদের মধ্যেও ভাল কিছু থাকে। দুটি তামিল ছেলে, সম্ভবত কলেজে পড়ে, পরের ট্রেনে আমাদের উঠতে সাহায্য করল। বসতেও পেলাম। আমরা অবশ্য ভেন্ডারে উঠে পড়েছিলাম। তবে বেশ পরিষ্কার। ট্রেনে এক ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। নামার সময়ও এক ভদ্রলোক সাহায্য করলেন। মাদুরাইয়ের ট্রেন পান্ডিয়ান এক্সপ্রেস তখনও ছাড়তে এক ঘন্টা দেরি। আমরা ধীরে সুস্থে দোসা দিয়ে ডিনার সেরে ট্রেনে উঠতে পারলাম।
এই ট্রেনেও সামনের সহযাত্রিনী বাঙালি। প্রথমেই বেশ আলাপী। ওমা! খানিক কথা বলার পর বুঝলাম উনি আগাপাশতলা তামিল কন্যা। কিন্তু নিউ আলিপুরের দুই পুরুষের বাসিন্দা। কলকাতার স্কুলে পড়াশোনা। কলেজ পন্ডিচেরী। তারপর চাকরি এবং বৈবাহিক সূত্রে চেন্নাইবাসী। মাদুরাই এনার দেশের বাড়ি। তবে উনি এখন মাদুরাই যাচ্ছেন কলকাতার বাঙালি বান্ধবীদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে। এত সুন্দর বাঙলা বলেন যে একবারও কেউ বুঝতে পারবে না উনি বাঙালি নন। যাই হোক সারা বিকেল উদ্বেগে কাটলেও ট্রেনে ভাল সঙ্গী পেয়ে সময়টা পলকে কেটে গেল।
মাদুরাই কোন সময় ঘুমোয় না। তাই একে sleepless city (Thoonga Nagaram) বলা হয়। এখানে দিনে একটি বাজার বসে, তার নাম Naalangadi ও রাতে একটি বাজার বসে তার নাম Allangadi. এখানে সারারাত অটো ও অনান্য যানবাহন চলাচল করে। আমরা এটা জানতাম না, তাই ভোরে মাদুরাইতে নেমে ভাবছিলাম অটো বা গাড়ি পাব কিনা। কিন্তু স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অটো পেলাম। সারাদিন মাদুরাই ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে একটি প্রাণচঞ্চল শহরকে অনুভব করলাম বারে বারে।
পৃথিবীর অন্যতম সর্বপ্রাচীন নিরবচ্ছিন্ন বসতিপূর্ণ শহর এই মাদুরাই। এটি দুই সহস্রাব্দের বেশি পুরোনো শহর। জনসংখ্যার বিচারে এটি ভারতের ছাব্বিশতম বৃহত্তম ও তামিলনাড়ুর তৃতীয় বৃহত্তম মহানগর। আয়তনের পরিপ্রেক্ষিতে এটি তামিলনাড়ুর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। শহর চিরে বয়ে যাচ্ছে ভাইগাই নদী। যদিও নদীতে চড়া পড়েছে। এই শহরের স্কাইলাইনে মীনাক্ষী আম্মান টেম্পলের চোদ্দটি ঝলমলে রঙিন গোপুরম দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
গেস্ট হাউসে গিয়ে স্নান সেরে নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম মীনাক্ষী আম্মান টেম্পলের উদ্দেশ্যে। একদম হাঁটা পথে মন্দিরের দক্ষিণ গোপুরম। ১০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে আমরা মন্দিরে ঢুকলাম। ফ্রিতেও মন্দির দর্শন হয়। তবে আরও ভিড়। বিশাল মন্দির প্রাঙ্গণ। মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। তবে চলার পথ কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। বহু প্রাচীন মন্দির কোথাও কোথাও ভেঙে গেছে, রঙ গিয়েছে নষ্ট হয়ে। প্রধান আরাধ্যা মীনাক্ষী আম্মান হলেও সুন্দরেশ্বর নামে শিবের মন্দির আছে। এছাড়াও অজস্র দেবদেবীর অবস্থান এই মন্দিরে। মন্দিরের মধ্যে একটি গোল্ডেন পিলার আছে। তবে এই মন্দিরের ভিতরে অন্যতম আকর্ষণ ‘থাউজেন্ড পিলার মন্ডপম’। এখানে প্রবেশ করতে পাঁচ টাকার টিকিট কাটতে হয়। মন্দিরে পুজো দেবার জন্য একশো টাকার টিকিট কেটেও একঘন্টার ওপর লেগেছে দর্শন করতে।
প্রায় দুহাজার বছরের পুরোনো এই শহরে পান্ড্য, চোল এবং কলাভরাস বংশ বিভিন্ন সময়ে রাজত্ব করে গেছেন। সপ্তম শতকে পান্ড্য বংশের রাজত্বকালে সর্বপ্রথম মীনাক্ষী মন্দির স্থাপিত হয় এবং পরবর্তী কালে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে নায়েক (Naick) বংশের রাজত্বকালে এই মন্দিরটি বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করে। এই মন্দিরের পিছনে একটি কাহিনী শোনা যায়। মলয়ধ্বজ পান্ড্য ও তাঁর স্ত্রী কাঞ্চনমালার এক কন্যা ছিলেন মীনাক্ষী। রাজার কোন পুত্র সন্তান ছিল না। এই কন্যা পরবর্তী কালে সুশাসকরূপে রাজ্য শাসন করেন। উনি সুন্দরেশ্বর শিবের ভক্ত ছিলেন। তাঁর নামেই এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।
মন্দিরের উল্টোদিকে অজস্র খাবারের ও নানান জিনিসের দোকান। দক্ষিণ গোপুরমের রাস্তা ধরলে শুধু সোনার গয়নার দোকান চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এসবের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে ভীষণ ভাল লাগবে এই প্রাচীন অথচ ঝলমলে এই নগরীকে। মন্দির ছাড়া গান্ধী মেমোরিয়াল আর থিরুমালাই নায়েকার প্যালেস না দেখলে মাদুরাই দর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। থিরুমালাই নায়েকার প্যালেস ১৬৩৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান যেটুকু দেখা যায় তাতে থিরুমালাই বসবাস করতেন এবং তাঁর রাজসভা বসত এখানে। আসল যে প্রাসাদ ছিল সেটি এর চারগুণ বড় ছিল যা এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। এর মধ্যে ছিল স্বর্গবিলাসম ও রঙ্গবিলাসম। এছাড়াও একটি নাট্যশালা ছিল। এখন এখানে মিউজিয়াম রয়েছে। যেখানে প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত পাথরের তৈরি সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, বাসনকোসন ও দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। প্রাচীন এই প্রাসাদে চুপচাপ বসে থাকলে অপূর্ব এক অনুভব হয়… কিছুই থাকে না আবার না থেকেও কত কিছু যে থেকে যায়! [ক্রমশ]