শনিবার | ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১১:০১
Logo
এই মুহূর্তে ::
সৌরভ হোসেন-এর ছোটগল্প ‘সালাম’ বঙ্গের শক্তি-পূজা : সুখেন্দু হীরা পুজোর পরিবর্তন, পরিবর্তনের পুজো : সন্দীপন বিশ্বাস পিতৃপক্ষের মধ্যে পালিত একাদশী — ইন্দিরা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত অরণ্যের অন্তরালে তাম্বদি সূরলা : নন্দিনী অধিকারী ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হীরালাল সেন : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্যাসাগরের অন্তরালে ঈশ্বরচন্দ্র, পূর্ব পুরুষের ভিটে আজও অবহেলিত : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব সুধীর চক্রবর্তী স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার : দীপাঞ্জন দে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে দুর্গা রূপে আরাধনা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালির নিজস্ব দুর্গা : শৌনক দত্ত সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার : দিলীপ মজুমদার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘প্রাতঃভ্রমণ’ বন্যায় পুনর্জীবন বেহুলার : রিঙ্কি সামন্ত গরানহাটা কি ছিল ভেড়ার হাট : অসিত দাস ডিভিসি-র ছাড়া জলে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ নাজেহাল, দায় কার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা : দীপাঞ্জন দে বোর্হেসের গোলকধাঁধা : অশ্রুকুমার সিকদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের দুর্গোৎসব : রিঙ্কি সামন্ত মর্ত্যে দুর্গাপূজার সেকাল ও একাল : অসিত দাস বই-বাই : নবনীতা দেব সেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘প্রবাসী’ ম্যান মেড নয় ডিভিসি-র পরিকল্পনা আর রূপায়নে গলদ : তপন মল্লিক চৌধুরী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে রাখাইনে সেইফ জোন তৈরি করা আবশ্যক : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ফলের নামটি পাকা কলা : রিঙ্কি সামন্ত বই-বাই : নবনীতা দেব সেন হেমচন্দ্র বাগচীর ১২০তম জন্মবর্ষ : দীপাঞ্জন দে নিম্ন চাপের অতিবৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত আরামবাগ : দেবাশিস শেঠ আরামবাগে ভয়াবহ বন্যা, দুর্যোগের পদধ্বনি, ক্ষোভ জনমানসে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মেয়েদের ক্ষমতায়নের পক্ষেও আওয়াজ তুলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সৌরভ হোসেন-এর ছোটগল্প ‘সালাম’

সৌরভ হোসেন / ২০ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

গোঁফ ছাটা মেহদি করা সুন্নত দাড়ি। দাড়ি ছুঁয়ে থাকা সুচালো জুলপি বেয়ে বাটুল মাথাটা ঢেকে আছে যে কোঁকড়ানো চুল সে চুলেও ‘বিসমিল্লাহ’ বলে বাজারের কালি ছোঁয়াইনি খতিব। নামলা বেটা প্রসব হওয়ার আগেরবার, যেবার সুবেহার পেটেই ন মাসের পুষ্ট বাচ্চাটা জল ভেঙে মারা গেল সেবার মাথার চুলে পাক ধরতে শুরু করলে খতিব মেহদি খেজাব (কলপ) করেছিল। চুল কালি করা হারাম, আল্লাহর সে বিধান যে তার জানা। এমনকি দাড়ির দু চারটে চুল বুন খটাশের লোমের মতো এদিক ওদিক ঝুল খেললেও কাঁচি-ব্লেড চালায়নি খতিব। খতিব জানে, মুমিনের একটি চুল সাদা হলে একটি গোনাহ ঝরে যায় এবং তার পরিবর্তে আল্লাহ একটি নেকি লিখেন (নাসাঈ, মিশকাতঃ ৪৪৫৮, সনদ হাসান)। অথচ ‘গোঁফের পানি’ মুখে ঢুকবে বলে হপ্তায় হপ্তায় নিয়ম করে খুঁট করে গোঁফ চেছেছে। যেদিন থেকে নামাজ ধরেছিল খতিব সেদিন থেকেই পায়ের গুল্লের ওপর লুঙ্গি পরে। সে ‘ইসমাইল লুঙ্গি’ কোমরে বেঁধে দিয়ে বাপ হৈতুল্লা বলে দিয়েছিল, গুল্লের ওপর কাপড় পরা সুন্নত। দেখিস বাপ, আল্লাহর নবীর সে সুন্নত যেন না ভাঙে। না সে সুন্নত এই তিন কুড়ি দু মাস তেরদিনের জীবনে আর কোনদিন ভাঙেনি। তবে হ্যাঁ, কাদা-জলে কাজ করতে গিয়ে পরনের সে লুঙ্গি হাঁটুর ওপরে উঠে অবশ্য ওজু ভেঙেছে অনেকবার। শুধু কি হাঁটু, কখনও কখনও লুঙ্গি নেংটি হয়ে পশ্চাদদেশ হাঁ হয়ে বেরিয়ে গেছে। সেসব তো আর ইচ্ছে করে নয়? পেটের খোরাক জোগাড় করতে গিয়ে। রহমানের রহিম আল্লাহ নিশ্চয় সে গুনাহকে মাপ করে দিয়েছেন। খতিব তখন বলে, কাপড়ের সুন্নত ভাঙলে কী হল মনের সুন্নত তো ভাঙেনি। এই সুন্নত আর ওজু ভাঙার ভয়-মহব্বত গোনাহ-নেকি চলতে থাকে জীবনের পরতে পরতে। সেসব খেয়াল রেখে চলে খতিব। ক-দিনের আর এই দুনিয়া। অনন্তকাল তো পরকাল। যা জমা সঞ্চয় করতে হবে সেই পরকালের জন্যে। সেসব তো ঠিকই আছে। সেসবে পান থেকে চুন না খসলেও হালের মুসিবত যে তাকে ঠ্যাঙের দড়ি গলায় পরিয়ে দিবে মনে হচ্ছে! আল্লাহর আলাম-কলামকে হাটের আলু-পটল বানিয়ে দিচ্ছে খতিব! ওর এত বুকের পাটা! বড় মসজিদের ইমাম মুখে আল্লাহর নাম নিয়ে কথাটা বলেছেন। সেই শুরু। তারপর থেকে খতিবের পেছনে আজাব-গজব দোজখ-কবর বিচুটি আর পানিকামড়ির মতো লেগে গেছে। পরকাল তো জাহান্নাম নিশ্চিত হচ্ছেই ইহকালও ‘ইয়া নাফসি’ ‘ইয়া নাফসি’ (আমার কী হবে!) অবস্থা! জাকিরুল্লাহ মলবি তো গলা খেঁকিয়ে বলেছেন, আমাদের নিজস্ব কিছু চিহ্ণোত থাকবে না? সবকিছুকেই উদুম করে দিতে হবে? কই, অন্য ধর্মের নিজস্ব চিহ্নোতগুলো তো বিধর্মীদের কাছে উন্মুক্ত হয়নি? তাছাড়া পাক নাপাকের তো একটা সুন্নত অসুন্নত আছে? খতিব যতই বলুক, ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্যে নয়, দুনিয়ার সব মানুষের জন্যে। দুনিয়ার সব মানুষই প্রথমে মুসলমান হয়ে জন্মায়। সে কথা না পাতে না ধোপে টিকছে। জাকিরুল্লাহ মুখের সুন্নত দাড়ি নাচিয়ে বলেছেন, ‘তাহলে আল্লাহ কেন সাতটা জাহান্নাম বানিয়েছেন? বিধর্মীদের জন্যেই তো নাকি?’

আজ পারাপার কম। খেয়া হাঁপ নিয়ে হাঁপ নিয়ে ছাড়ছে। গতকাল ওপারের হাট গেল। তাই লোকজনের আজ আর হুজ্জটি নেই। ওপারের জেটিতে পারাপারের নৌকোটা দাঁড়িয়ে আছে। গোটা পাঁচেক লোক সওয়ার হয়েছে। তারমধ্যে একজন মোটরসাইকেল আরোহি। একজন হরেকমালের হকার। আর একজন মেয়ে যার কোলে একটা আর হাতে একটা বাচ্চা। যে হাতে বাচ্চাটাকে ধরে আছে মেয়েটি সে হাতের ফাঁক গলে উঁকি মারছে পড়ন্ত বিকেলের লাল টুকটুকে সূর্য। সে সূর্যটা আবার ফজুর লগির মাথায় আটকে আসমানে থির হয়ে ঝুলছে। দিগন্ত ছড়িয়ে যাওয়া লাল-হলুদ আলো আসমানের নূর হয়ে মিশছে নদীর বুকে। খতিব এই আলো মাঝেমধ্যে গায়ে মাখে। তখন খতিব জামার বোতাম খুলে উন্মুক্ত শরীরে নৌকোর খোলে কেবলামুখ (পশ্চিম দিক) করে দাঁড়ায়। তারপর নাক মুখ দিয়ে শ্বাস নেয় আর ডুবন্ত সূর্যের শেষ আলো গায়ে-গতরে মাখে। খতিব বিশ্বাস করে, এ আলো বেহশতের আলো। আল্লাহ সে বেহেশতের পবিত্র আলো রোজ সন্ধ্যায় আসমান-জমিনে ছিটিয়ে দুনিয়াকে সাফসুতরো করেন। মাঝি ফজু লগি হাতে তার হাঁড়া গলায় একবার হাঁক ছাড়ল, “কেহু আছেন নাকি গো…ও…ও…দৌড়ে আসেন। খেয়া ছাড়ছে…এ…এ।“ তার সে হেঁড়ে ডাক ওপারের ফতাইপুরের বাঁশঝাড় আম-কাঁঠালের বাগান শিমুল বাবলার ডাল-মটকা ছুঁয়ে যেন ভগীরথপুরের জমিদারদের পরিত্যাক্ত বাড়ির ভাঙা দেওয়ালে পটবাড়ি খেল। খতিব আবার ঠাট্টা করে ফজুকে বলে, দেখিস তোর হাঁড়া গলার আওয়াজে যেন মরে ভূত হয়ে যাওয়া জমিদাররা আবার জেগে না ওঠেন! ফজু তখন তার খুঁটল চোখগুলো রসগোল্লার মতো করে বলে, ভালোই হবে, নুনের কারবারটা আবার শুরু হবে। আর আমরা নৌবহর নিয়ে পাড়ি দেব বেনারস এলাহাবাদ। তখন মুখ ভেংচে খতিব বলে, পাছায় পরনের কাপড় নেই আর মুখে জমিদারির ভড়ং! তুই শালা আবার কোন জমিদারের নাতি যে নৌকো করে নুনের কারবার করবি! ফজু তখন তার বিড়ি খাওয়া পুকড়ে লালচে কালো দাঁতগুলো বের করে খিলখিল করে হাসে।

খতিব হাতের খইনিটায় চুন মিশিয়ে ডলছে। এই একটা বদ নেশা এখনও ছাড়তে পারেনি সে। এটা অবশ্য তার জাত নেশা নয়। তার জাত নেশা ছিল বিড়ি। বুকের ব্যামুটা পাঁজরের হাড়ে কামড় দেওয়ায় সে নেশাকে হারাম করতে হয়েছে। আর সেই বিড়ির নেশাটা চাওর দিয়ে উঠলে তাকে ঠেকাতে এই খইনি ডলা। অবশ্য খতিব জানে, মুসলমানদের কোন মদ তামাকের নেশা থাকতে নেই নেশা থাকা উচিত একমাত্র নামাজ-রোজার। আল্লাহর আলাম-কলামের। তইজুল আবার জর্দা-সুপারি কিম্বা পান খাওয়ার দাওয়া বাতলেছিল। সেসব নাকি হাদিস-কোরানে হারাম নয়। জায়েজ না হলেও নাজায়েজও নয়। মলবি মওলানারা তো সেসব খেয়ে দাঁত ঠোঁট লাল করে ফেলেন। তইজুলের কথায় কিছুদিন পান খেলেও সে নেশা খতিবের কাছে পানসেই লেগেছিল। ভেতরের বিড়ির নেশার খুইখুইটাকে দমাতে পারেনি। সে খুইখুইকে দমাতে তাই লুকিয়েছুপিয়ে খুইনি খাওয়া। ডলা খইনিটা মুখে দিয়ে হাত ঝাড়ল খতিব। আর মনে মনে বলল, সবকিছুই যদি এভাবে গা থেকে ঝেড়ে ফেলা যেত তাহলে দুনিয়া এত ক্যাচাল হত না। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাঁশের বাতা দিয়ে বানানো বেঞ্চে যেই বসল খতিব অমনি সাইকেলের কচকচ শব্দ কানে লাগল। নদী এখন থির। স্রোত নেই। ফলে নদীর সে গ গ ডাকও নেই। কার্তিকের এই নদীকে বড় মায়াবী লাগে খতিবের। এইসময় নদী যেন দুঃখে কষ্টে কেমন চুপ মেরে যায়। আর মাসখানেক গেলে যে সে রূপ রস গন্ধহীন একটা খোলে পরিণত হয়ে যাবে! না থাকবে ঢল না থাকবে জল। জল না থাকা মানে তো সে একটা লাশ! নদী যখন ডাকে হাঁকে খলবল করে তখন খতিবও একটা অন্য ঘোরে থাকে। সেও নদীর সকুন পায়। নদীর নাচনে নাচে। তার নিজের কথায়, ‘নেত্ত করি আর গিত গাহাই’। এখন নদীর সে ডাক থাকলে সাইকেলটার কচকচ আওয়াজটা শোনা যেত না। নদী এখন যৌবন ফুরিয়ে বার্ধক্যে নামায় সাইকেলের কচকচ আওয়াজটা কানে বাজল। কানে আরও একটা জিনিস বাজে। সেটা নদীর ভাসানেও বাজে নদীর খরানিতেও বাজে। সেটা হল মসজিদের আজান। সেটা কানে না বাজলে যে দুনিয়াদারি হারাম হয়ে যাবে। ইহকালে সমাজের লাথি আর পরকালে খোদার লাঠি খেতে হবে। সাইকেলের আরোহি তইজুল। মাল সাজিয়ে ওপারে যাবে। সে জালসা মজলিশে ইসলামি জিনিস বিক্রি করে। আতর টুপি তসবিহ থেকে শুরু করে মেয়েদের হিজাব বোরখা। পুরুষদের পাগড়ি। কায়দা(আরবি বর্ণমালা) থেকে কোরান শরিফ। হাদিস, হাদিসের তর্জমা। অন্যান্য ইসলামিক জিনিসপত্তর। সাইকেল আরোহি যে তইজুল তা তার মুখ না দেখলেও খতিব বুঝতে পারে। তইজুল কিছুটা কাছে এলেই তার শরীর থেকে আতরের গন্ধ ম ম করে ছুটে। সে সুগন্ধ টের পেলেই খতিব ভেবেই নেয় তইজুল এসেছে। মাথায় ফেজ টুপি, পরনে আলখাল্লা, মুখের সুন্নত দাড়িতে অবশ্য আলাদা কিছু নেই। সেসব সব পরেশগার মুসলমানদেরই থাকে। তইজুলের আলাদা যেটা আছে সেটা হল তার ‘সালাম’ দেওয়ার কায়দা। একবার জোর টান দিয়ে পরে কন্ঠ মিহি করে লম্বা সুর টেনে কথাগুলো বলে। যেন তার সাইকেলের চাকার মতোই কথাগুলো গড়গড় করে গড়ায়। আজও সেই কায়দায় ‘সালাম’ দিল তইজুল। খতিব ‘সালাম’এর ‘প্রতি সালাম’ দিল। তারপর তইজুলকে কাছে পেয়েই মনের খেদটা বলল, “শান্তি আর বর্ষিত হচ্ছে কই! অশান্তিতে গা ডুবে যাচ্ছে।” সে ইঙ্গিতপূর্ণ কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তইজুল পাল্টা বলল, “তুমার পাকামুর লেগেই তো উসব হচ্ছে।” কথাটায় খতিব কেমন ভয় পেয়ে গেল। সুড়সুড় করে তইজুলের কাছে এগিয়ে এল। তারপর কন্ঠ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আচ্ছা তইজুল তুমি তো দশ জাগা যাও, বড় বড় জালসা মজলিশ শুনো, বড় বড় আলেম উলেমাদের কথা শুনো, তারা এ ব্যাপারে কী বুলেন?” প্রশ্নটা করেই আশ্বিনের নদীর মতো চুপ মেরে গেল খতিব। তইজুল বলল, “কড়া লিষেধ। ভুল করেও বুলা যাবে না।” কথাটা শুনে খতিব আরও গুটিয়ে গেল। যেন এখন সে আর থিতানো নদী নয়, মজা বিল। এবার চৈত্রের রোদ পড়লেই ফেটে চৌচির হয়ে যাবে! তার যে এখন ক্ষতবিক্ষত হওয়ারই দশা। জিনা হারাম হওয়ার দশা। শরিয়তকে অমান্য! সে কোন বাপের বেটা? তার হিম্মত দেখে সমাজের মোল্লাদের চক্ষু চড়কগাছ! অবশ্য সে আর কী হিম্মত দেখাবে। সে মুরোদও নেই সে মুন্সিয়ানাও নেই। সে হল ঘাটের মুনিশ। দিন খাটে দিন খায়। ঘাটওয়ালার অধীনে ঘাট পারানি নেওয়ার সামান্য রোজে। তার কী এমন হিম্মত আছে যে শরিয়তের বিরুদ্ধে পাঙ্গা নেয়। আসলে সে অত ধর্মের তলায় ভেতরে ঢোকেনি। সে মাথা মগজও তার নেই। তবে হ্যাঁ, বুকের পাটা একটা আছে। আর সেটা আছে বলেই, বড় মসজিদের ইমামকে মুখের ওপর বলে দিতে পেরেছে, ‘আপনাদের সব কিছুতে খুঁত খুঁজে বেড়ানো অভ্যাস।’ ব্যস, আর যায় কোথায়। গোটা সমাজ ফোঁস করে উঠেছে। একের পর এক দিতে শুরু করেছে ছোবল। যে সে ছোবল নয় শরিয়তের ছোবল। এ ছোবল যে দুনিয়ার দোজখ। দোজখের আযাব! তবুও কাত হয়ে ধপ করে পড়ে যায়নি খতিব। ল্যালপেলে দুই ঠ্যাঙে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। জানে না, আর ক-দিন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে! শরিয়তের শেষ কোপটা পড়লে যে দুই ঠ্যাঙে দাঁড়ানো দূরের কথা তার বেঁচে থাকাটাই হারাম হয়ে যাবে! তখন কবর তার পাশে এসে দাঁড়াবে! গলায় জড়িয়ে যাবে কবরের আজাবের সাপ। দোজখের আগুন তার গায়ে এসে ললকাবে! তইজুল বলল, “আল্লাহর আলাম-কালামের বিরুদ্ধে গিয়ে খামোখা খামোখা দুযকে যাবা খতিবভাই? তার চেহে বরং তওবা করে ল্যাও গা। ইহকাল পরকাল দুইকালই বাঁচবে।”

“আমি কী অ্যামুন পাপ করেছি যে তওবা করতে হবে?” আচমকা তল্লা বাঁশ ফাটার মতো বেজে উঠল খতিব। আর অমনি গেরামের ‘দশ’ (সমাজ)এর মাতব্বরদের ভেতরের কথাটা পাড়ল তইজুল, “দশের লোকজন কিন্তু ক্ষেপে আছে। আর বেশি বাড়াবাড়ি করো না। ত্যাখুন ঘাটও যাবে পাটও যাবে।” এক কথাতেই খতিবের সব হাম্বিতাম্বি থেমে গেল। কিন্তু পুরোপুরি গলে মোম হল না। কিছুটা কাঠি হয়েই থেকে গেল। চোখ পিটপিট করে বলল, “কিন্তু এতে খারাপের কী আছে আমাকে বুঝাতে হবে। হাদিসের কতি আঁচড় লাগছে আমাকে দ্যাখাতে হবে।“

“তুমার এই আস্পদ্দাই তুমার কাল হবে খতিব। অত বাড়তি ভালো না।” তইজুল সতর্ক করল খতিবকে। খতিব মনে মনে বলল, ‘বাড়তি’! আমি তো কোনও বাড়তি কিছু করছি নে। সব কিছুতে সুন্নত মেনে চলি। খাওয়া পরা শোয়া গোসুল করা এমনকি বউয়ের সঙ্গে সহবাসেও। হাদিসে নিষেধ আছে বলে, খতিব স্ত্রীর হায়েজ-নেফাসের (ঋতুকালীন) সময় সহবাস করে না। বীর্যপাতের সময় মনে মনে নির্ধারিত দোয়া পড়ে। এমনকি, সুন্নত ভেঙে যাবে বলে, ভরপেটে একদিনও সহবাস করেনি এবং সহবাসের সময় স্ত্রীর সঙ্গে কখনই বেশি কথা বলেনি। বিয়ের প্রথম দিকে একবার ভুল করে কেবলামুখি হয়ে সহবাস করেছিল বলে তার আফসোশের শেষ ছিল না। সে কতবার যে ‘তওবা’ ‘তওবা’ করেছিল তার ইয়াত্তা নেই। সুবেহাকেও ‘বেসান’ ‘বেহুঁশ’ বলে গালমন্দ করেছিল। সে পাপ থেকে বাঁচার জন্যে বড় মসজিদের ইমামের কাছে দোয়া-কালাম চেয়েছিল। খতিব আইবুড়োতে গলা ছেড়ে গান করত। তার সে দরাজ গলায় নাকি বেহাগের সুর ছিল। কিন্তু গান শরিয়তে নিষেধ বলে সে সুরকে বিয়ের আগেই কবর দিয়েছিল। তানাহলে সবাই বলতে শুরু করে দিয়েছিল, খতিব মারফতি লাইনে চলে যাচ্ছে। ওর মধ্যে বাউল ভর করছে। ও মরলে কেউ কবর দেবে না। সমাজের সে ফতোয়ার ভয়ে গান তো দূরের কথা সুর টেনে কথাও বলত না খতিব। সেই খতিবের কাছে ধর্মের শরিয়ত এখন তলোয়ার হয়ে উঠছে! কখন না গলার ফাঁস হয়ে তার দেহ থেকে রুহুটাই বের করে নেয়! তইজুল খতিবের এই আদবকায়দায় চালচলনে হাবেভাবে নাওয়া-খাওয়ায় কঠোরভাবে সুন্নত ফরজ মেনে চলার কথা জানে। তবুও খতিবের ‘সালাম’ দেওয়ার ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না। সে তো আর মুফতি মওলানা নয় সে হল এক মামুলি তসবিহ টুপি বেচনাওয়ালা। কপালে নামাজের ঘটা থাকলেও মগজে তো আর কোরান-হাদিস ঘাঁটা আলাম-এলেম নেই? জালসা মজলিসে যেটুকু শোনে সেটুকুরই আলেম। আলেম না বলে আলামের তালবিলিম (শিক্ষানবিশ) বলাই ভালো। সেই তইজুল তার কন্ঠ আরও কিছুটা কড়া করে বলল, “কী দরকার ছিল, অত জমিন আসমানের সব মানুষের ঠিকে ল্যাওয়ার?”

“ঠিকে আমি লিইনি। ঠিকে আল্লাই লিয়েছেন।” খাড়া হয়ে দাঁড়াল খতিব। তইজুল বলল, “তুমি কি জানো না, বিধর্মীরা সব জাহান্নামে যাবে?”

“তুমি ভুল বুলছ, তইজুল, কে জাহান্নামে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে না তা আল্লা ছাড়া জমিন-আসমানের কেহু জানে না। ও কথা বুলাও পাপ।”

“কিন্তু তুমি যেডা করছ সেডা যে আরও বড় পাপ। কাবিরা গুনাহ (বড় পাপ)।”

“ইসলাম কিন্তুক দাওয়াতের ধর্ম। আল্লা বুলেছেন, দুনিয়ার সব মানুষের কাছে আমার পয়গাম পৌছে দিতে। তাইলে আমার পাপটা কীসে?”

“আল্লার পয়গাম আর সালাম এক জিনিস হল? তুমার মাথাডা দেখছি গেলছে!”

“তাইলে কি আমি মানুষজনের সাথে দ্যাখা সাক্ষাৎ হলে তার মুন্দ চাহাব? সে ধ্বংস হয়ে যাক তাই চাহাব? তার ওপর আল্লার গজব নেমে আসুক, সেসব চাহাব?”

“ছিঃ ছিঃ তওবা তওবা, এসব কী মুনাফেক কথা বুলছ, খতিব! তুমি গুনাহই ঢেকে যাবা। জলদি জলদি ‘তওবা’ পড়। দুই কাঁধের ফেরেশতা সব লিখে লিলো! আল্লার সৃষ্টির মুন্দ চাহাতে হয় না কক্ষনও। আল্লা বিরাগ হন।” কথাটা বলেই মনে মনে কীসব দোয়া মিনমিন করল তইজুল। খতিবের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকেই একটা উঁচু ডিহির পাশে মাল বোঝাই সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। নৌকাটা পাড়ে ভিড়তে দেরি হবে বলে, হাত পা খালি করে কথা বলছে। তার মাথার ফেজ টুপিটার আড়াল দিয়ে নদীর যে পাড় দেখা যাচ্ছে সে ফতাইপুরের দিকের পাড়ের সাদা কাশফুলে লুকোচুরি খেলছে শেষ পড়নের সূর্য। পরনের আলখাল্লা ঝিরঝির করে নড়ছে নদীর বুক ছুঁয়ে উঠে আসা শেষ আশ্বিনের বাতাসে। আইঘোর হেমন্তের হিম একটু একটু করে আহ্বান করছে অন্ধকারকে। সূর্যটা অস্ত গেলেই হিম হাওয়া আর ক্ষয়াটে চাঁদের মিস্টি আলোয় ডুবে যাবে ভৈরব। তখন ভৈরবের থির মশমশে কালো জল যেন ঝলমলে রূপো। সে রুপোলি জলে লগি ঠেলবে ফজু। আর চোখ ফেড়ে নদীর সে মোহিনি রূপ দেখবে খতিব। যেন এত দেখেও তার পেট ভরে না। এই নদীই যে তার ধর্ম। তার ইহকাল পরকালের কিতাব। জমিন-আসমানের বেহেশত। নদীর কোন কালো-ধলো নেই। জাত-বেজাত নেই। ধর্মী-বিধর্মী নেই। কাফের মোনাফেক নেই। নদী আপনেরও আপন পরেরও আপন। নদীর এই ইমানই তো খতিবের ইমান। সেই ইমানে জমিনের কিছু মানুষ জোর করে চাপাতে চায়ছে বিভেদের ফতোয়া! ঘৃণার বিষ। আল্লাহ আর আল্লাহর নবী সেখানে ভেত্তু। দু পাতা আলাম-কলাম পড়া মানুষই যেন আসমান-জমিনের ঠিকেদার। জীবনের অন্যসব আমলনামায় ভুল না থাকলেও মানুষকে ‘সালাম’ দেওয়ার আমলনামায় বড় ভুল করে খতিব। খতিবের অপরাধ, সে বিধর্মী লোকদেরকেও ‘সালাম’ দেয়। কে হিন্দু কে মুসলমান সেসবে তার ভেদ নেই। কত জাত কত ধর্মের মানুষ নিত্যদিন ঘাট পারাপার করে। সবাইকেই সালাম দেয় খতিব। আর এখানেই চটেছে তার ধর্মের সমাজ। এ নাকি শরিয়ত বিরোধি কাজ। ধর্মে নাকি ঘা লাগছে। মোল্লা মওলবিদের সাফ কথা, বিধর্মী লোকদের সালাম দেওয়া জায়েজ নয়। মুসলমান শুধু মুসলমানদেরকেই সালাম দিতে পারবে। এ শুধু মুসলমান মুসলমানের সম্বোধন। পারস্পরিক কুশল বিনিময়। কিন্তু খতিব সমাজের সে কথা গেরাহ্য করেনি। সে হিন্দুদেরকেও সালাম দেয়। মোল্লারা তার একটা হেস্তনেস্ত চায়। নৌকোতে ওঠার আগে খতিবকে সে হুমকির কথাই শোনাল তইজুল, “বড় মসজিদে শুন্নু (শুনলাম), তুমার শালিসি বসাবে দশ।” ‘শালিসি!’ কথাটা মনের ভেতরে জলের ঘূর্ণির মতো পাক মারতে শুরু করল খতিবের। আর বেশি কিছু বলার আগেই নৌকোতে উঠে খড়বড় করে উঠে পড়ল তইজুল। খতিব তখন বাজপড়া তালগাছটার মতো ঠাই দাঁড়িয়ে থাকল। নৌকোয় যেতে যেতে তইজুল দেখল সুন্দলপুর ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা সে মুড়ে যাওয়া মানুষটা ধীরে ধীরে তালগাছ থেকে পাটকাঠি হয়ে যাচ্ছে! আর পিছনের কাশফুলে বাঁশঝাড়ে মিশে যাচ্ছে সে মানুষটার হিলহিলে শরীরটা! এক্ষুনি এই বাঁশঝাড় থেকে ঝুপ করে নামবে অন্ধকার। সে অন্ধকার হাতড়ে নবী রসুলের উম্মত খতিব খুঁজবে তার পিয়ারা নবী এবং তাঁর সুন্নতকে। যে সুন্নতকে কালি-ধুলি আঁচড়-পাঁচর করে নাপাক করে দিয়েছে কিছু মোল্লা মোড়ল।

দুই

হাওয়া থেকে জল শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে যাচ্ছে নদী। আর সে নদীর মতো শুকিয়ে হাড়গিলে হয়ে যাচ্ছে খতিব। সুন্দলপুর ঘাটের পারানি খতিব মিঞা। ভৈরবের বুকে এখন কার্তিকের হিম। সে হিম গায়ে বসে আছে খতিব। হপ্তা দুয়েক আগে বলে যাওয়ার পরে গতকালও ‘সালিশি’র কথাটা বলে গেছে তইজুল। জাকিরুল্লাহ মলবিও তলব করেছিলেন গত জুম্মায়। এক মসজিদ জামাতের সামনে তাকে ‘বেইজ্জত’ করা হয়েছে। শুধরানোর ‘মওকা’ দিয়েছেন। সঙ্গে ‘একঘরে’ করে দেওয়ার হুমকি। খতিবের হাঁড়া গলা ফাঁড়া গলা বাঁশ ফাটা তো দূরের কথা বিড়ালের মতো ‘মিউ’ করেও ওঠেনি। বউ সুবেহার পোঁটলার ন্যাকড়ার মতো গুটিয়ে ছিল। এক ঘর মুসল্লির সামনে ‘খ্যাঁক’ করে ওঠা ওর বাপ চোদ্দ গোষ্ঠিরও হিম্মত নেই। এমন তেমন করলে পিটিয়ে ওর গায়ের গোশত (মাংস) ছাড়িয়ে নেবে গাঁয়ের সমাজ। ছাল চামড়া বিনিয়ে নেবে। নাহ, সেসব না হলেও একটা জিনিস হয়েছে সেদিন, খতিবের হাড়-মাংসের ভেতরে যে আল্লাহ আর আল্লাহর নবীর দ্বীন, আলাম-কলাম এতদিন পাক পবিত্র ছিল তা কোথাও হলেও রক্তাক্ত হয়েছে। আহুত হয়েছে। সে আহতের কান্নাই এখন খতিবের চোখ দিয়ে ঝরছে। ‘একঘরে’ করে দেওয়ার কথাটা এখনও সুবেহার কানে যায়নি। সে কথা শুনলে তো সে মাতম গাহাবে। দিনে দুপুরে চোখে অন্ধকার দেখবে। সে জানে আসমান জমিন নদী পানি হাওয়া খাওয়া গাছ পাখি সবার বিরুদ্ধে কথা বলা যায় কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। ধর্ম হল জীবনেরও বাপ মরণেরও বাপ। দুনিয়াদারির শরীর আর শরীরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা রুহুর ঠিকেদার। লবণ খাবে না নুন খাবে, লুঙ্গি পরবে না ধুতি পরবে, জল বলবে না পানি বলবে, তার জিম্মাদার। হুকুমদার। সেই ধর্মের বিরুদ্ধে কথা তুলেছে তার হিলহিলে খিটখিটে খুঁটল চোখে স্বামী! পাছার কাপড় নেই মুখের ভাত নেই সে বলছে কি না শরিয়ত বিরোধি কথা! পুরো ব্যাপারটা শুনলে সুবেহা হয়ত পোঁটলা-পুঁটলি আঁচলা-পাচলা কুঠা-কুঠির ভেতর খতিবকে লুকিয়ে রাখবে। আর বলবে, আল্লাহ তুমি আমার নাদান স্বামীকে মাফ করো। ও যে নদীর সাথে থেকে থেকে নদীর মতোই নরম হয়ে গেছে। খতিব এখন ঠাহর করছে, নদীর পাড়ের মতো তার সংসারেও ভাঙন ধরতে পারে! হুড়মুড় করে ধসে যেতে পারে এতদিনের সুখ দুঃখের বাঁধন! সুবেহা হয়ত তাকে ছেড়ে যাবে না। কিন্তু সমাজ ‘একঘরে’ করে দিলে একসঙ্গে থেকেই বা কী করে বাঁচবে! দুনিয়াদারি যে জাহান্নাম হয়ে যাবে! তাই বলে সত্যটা বলব না? আসল সুন্নতটাকে গলা টিপে মেরে ফেলব? গলদটাকে গলার মালা করে নেব? মরার পর আল্লাহকে কী কৈফিয়ত দেব? তাঁর আসমানের মতো উদার ধর্মকে কিছু মোল্লা মাতব্বর কচার বিচি বানিয়ে দিচ্ছে! মনের ভেতরের এসব প্রতিবাদ সাহস তইজুলের হালের কথাটা শুনে হঠাৎ বেড়ে গেল খতিবের। গত পরশু শিবনগরের জালসা থেকে ফিরে তইজুল ফিসফিস করে ভেতর ফুঁসিয়ে দেওয়া কথাটা বলল। বর্ধমানের এক বড় আলেম মৌলানা হাদিস উল্লেখ করে বক্তৃতায় বলেছেন, সালাম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকেই দেওয়া যাবে। ব্যস আর যায় কোথায়। কথাটায় মনের ভেতরে আল্লাহর ঐহি পাওয়ার মতো পয়গাম পেল খতিব। আর সে পয়গাম তাকে ‘বদরের যুদ্ধের’ মতো আরও এক যুদ্ধে নামার সাহস জোগাল। মোল্লারা হুমকি দিয়েছে, ‘বেটা খতিব এবার দেখবে ভেল্কি কাকে বলে।‘ সে কথা শুনে খতিব বলেছে, ‘এই ষাট আমনে বয়সে কত ভেল্কি দেখলাম। ওরা আর নতুন কী ভেল্কি দেখাবে?‘ খতিব তার বয়সকে এভাবেই আমন ধানের হিসেবে হিসেব করে। এক বছর মানেই একবারের আমন ধান। ঘাটপাড়ানির সাথে সাথে খতিব গেরস্তদের জমিতে ভাগে ধান চাষ করে। সে ভাগচাষি ঘাটপাড়ানি খতিব মিঞাকে মসজিদের দশ তলব করেছে। তার সালিশি হবে। তইজুল দশের কাছে ক্ষমা চেয়ে ‘তওবা’ করার কথা বলেছিল। খতিব রাজি হয়নি। সে সাফ বলে দিয়েছে, সালিশির মুখোমুখি হব। তার এমন সাহস দেখে অবাক হয়েছে তইজুল। ‘লোকটা বলছে কী! শেষ অবধি এই শেষ বয়সে ‘মুশরিক’এর বদনাম নিয়ে দুনিয়া ছাড়বে! পারবে, পরকালে কবরের আজাব সহ্য করতে? দোজখের আগুন হজম করতে? সব কথা শুনে মাঝি ফজু তার ড্যাবডেবে চোখগুলো ঘুলঘুল করে উপায় বাতলেছিল, ‘থানায় যাও। সালিশি হলে থানায় হোক। তাতে করে আইনের বল তো পাবে?’ খতিব রাজি হয়নি। উল্টে বলেছিল, ‘আল্লা আর আল্লার নবীর কোরান-হাদিসের কথা থানার বিধর্মী অফিসাররা আর কী বুঝবেন? তারা কি আলেম উলেমা? এসব করেই তো এত বড় মহৎ ধর্মটাকে আমরা পথে নামিয়েছি।’ পার থেকে নদীর দিকে নামল খতিব। নদীর কিনারে উপুড় হয়ে বসল। তারপর হাত দিয়ে ছুঁল ভৈরবের নীল-কালো জল। যেন সন্ধ্যার নদীকে বলল, আমাকে শক্তি দিও আগামীকাল যেন তোমার মতোই নিজের ধর্মে অটল থাকি। নিজের পাক পবিত্র আমলনামায় কালি না লাগে।

তিন

প্রথম প্রশ্নটা করলেন জাকিরুল্লাহ মলবি, “তুমি কি মানছ খতিব, তুমি শরিয়ত বিরোধি কাজ করো?”

“না।” খতিবের এই ছোট্ট একটা উত্তরে সালিশ চত্বর মুহূর্তে কারবালা হয়ে উঠল। বড় মসজিদের ইমাম তবরেজ আলি ‘তওবা’ পড়তে পড়তে বললেন, “সবাই, নাউজবিল্লাহ (একটি দোয়া) পড়ুন, এখানে মুনাফেকের আগমন ঘটেছে।” তারপর গলায় একটা জোর খ্যাঁকানি দিয়ে বললেন, “আসমান-জমিনের কেউ আল্লাহর ফরমানকে একবিন্দু খন্ডাতে পারবে না, আর তুমি তো এক ইনসানের বাচ্চা! তুমি যে এতদিন গুনাহ করেছ, সে গুনাহের ক্ষমা নেই। তবুও আল্লাহ, ক্ষমাকারীকে হেদায়েত করেন। তুমি তোমার ভুলের তওবা করো।”

“আমি কুনু ভুল করিনি।” টিনের ওপর হাতুড়ি পড়ার মতো বেজে উঠল খতিব। তইজুল খতিবভাইয়ের এই হিম্মত দেখে বিস্মিত হল। আবার ভেতরে ভেতরে একটা ভয়ও তাকে নাড়া দিতে লাগল, খতিবভাইকে ‘একঘরে’ করে দেবে না তো! এবার উঠে দাঁড়াল খতিব। নৌকোর লগির মতো তার হিলহিলে শরীরটা আর হালছে না। নদীর ধারের সেই বাজপড়া তালগাছটার মতো নয়, খতিব এখন নদীর ওপর গড়ে ওঠা ইস্পাতের বিম। না ভাঙবে না মচকাবে। তার মুখের সুন্নত দাড়ি এই কদিনে পেকে আরও সাদা হয়ে গেছে। পরনের সাদা পাঞ্জাবি আর মাথার ফেজ টুপিতে তাকে আরও পরহেজগার মনে হচ্ছে। তবে কি খতিবের মধ্যে আল্লাহর ফেরেশতা ভর করে আছেন! কথাটা ভাবল তইজুল। তইজুল জানে, মুমিন (বিশ্বাসী) মানুষ এরকম মুসিবতের সম্মুখীন হলে আল্লাহর ফেরেশতারা সে মানুষের সহায় হন। তইজুল জানে, তার খতিবভাই একজন খাঁটি ইমানদার মুসলিম। আল্লাহর আলাম-কলাম নিয়েই থাকে। নামাজ-রোজা তো কাজা করেই না। উল্টে জমির ফসলের ফেতরা ছাড়াও ফকির মিসকিনকে দান খয়রাত করে দুহাত খুলে। মুখে আল্লাহ ও আল্লাহর নবীর নাম নিয়ে খতিব সরাসরি কোরান টেনে বলল, “সুরা মারইয়াম’এর ৪৭ নম্বর আয়াতে পষ্ট উল্লেখ আছে, ইব্রাহিম নবীকে য্যাখুন তাঁর আব্বা আজর তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন ত্যাখুন ইব্রাহিম নবী তাঁর মুশরিক পিতাকে বুলেছিলেন ‘আল্লাহর কাছে দুয়া করি আল্লাতালা য্যানে তুমার ক্ষমা করে দেন’। ইব্রাহিম নবীর আব্বা ছিলেন একজন অমুসলিম এবং মুশরিক। তাছাড়াও সুরা নিসা’র ৮৬ নম্বর আয়াতে আল্লা বুলেছেন, যদি কেউ তুমাদের অভিবাদন করে তবে তাদের প্রত্যত্তর জানাও আরও উত্তম ভাবে অথবা সেই অভিবাদনের অনুরূপ করে।” এবার গলা গমগম করে উঠল খতিবের, “সুরা তাহা’য় বর্ণিত আছে, নবী মুসা(আঃ) এবং হারুন(আঃ)কে আল্লাহ নির্দেশ করলেন, য্যাখুন বেধর্মী ফ্যারাও আর অন্যদের কাছে যাবেন ত্যাখুন তাদেরকে বুলবেন, শান্তি তাদের প্রতি যারা সৎ পথ অনুসরণ করে।” হঠাৎ জাকিরুল্লাহ মলবি ধমকে উঠলেন, “তুমি এসব কীসের ভিত্তিতে বুলছ? কিছু মুনাফেক লোকদের লেখা বই থেকে?” পাশ থেকে লুতফল মোড়ল খতিবকে বললেন, “তুমি জানো না, কোনও না-পাক মানুষকে আল্লাহর আলাম বলা যায় না? বেধর্মী লোকেরা কী পাক থাকে? মুতে (প্রসাবে) পানি লেয়? ওজু করে গোসুল (স্নান) করে?” আর যায় কোথায়। খতিব, গরগর করে সুরা মারিয়াম ও সুরা তাহা পাঠ করতে লাগল। আর তার পাঠ শেষ হলে তড়বড় করে তইজুল দাঁড়িয়ে সে পাঠের তফসির (ব্যাখা) করে দিল। মওলবি জাকিরুল্লাহ বড় মসজিদের ইমাম তবরেজ আলি মোড়ল লুতফল হক সবাই থ! সেই থ মুখের ওপর আরও একটা হাদিস শোনাল তইজুল, “নবী করিম হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) য্যাখুন কুনু শত্রু পক্ষের বিধর্মী মুশরিক রাজা বাদশাদের চিঠি লিখতেন, সে চিঠির প্রথমে সালাম দিতেন।” তইজুল কোরানের সুরা ফুরকান’এর ৬৩ নম্বর আয়াত উল্লেখ করে বলল, “আল্লা বুলছেন, তুমাদের সামনে যদি অজ্ঞ ব্যক্তিরা আসে তাদের বলো, আপনারা শান্তিতে থাকুন।” হঠাৎ বাইরে একটা গুঞ্জন উঠল। তালবিলিম সাইফুল খবর দিল, পুলিশ এসেছেন! সালিশিতে ঝামেলা হতে পারে বলে পুলিশ এসেছেন। তবে তারা সালিশিতে হস্তক্ষেপ করবেন না। সে এক্তিয়ার বা অধিকার তাদের নেই। প্রাইমারি স্কুলের মুল ফটকের দিকে চোখ ঘুরিয়ে খতিব দেখল, মেজবাবু চন্দ্রকান্ত বাড়ুজ্জে। তার আগে থেকেই পরিচিত। চোখাচোখি হতেই মিস্টি করে হাসল খতিব। তারপর উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে ‘সালাম’ দিলেন হিন্দু ব্রাহভভন চন্দ্রকান্তবাবু। তইজুল ধেই করে উঠল। খতিবেরও আগ্রহ তুঙ্গে, দেখি মোল্লা মওলবিরা কী উত্তর দেয়! প্রথম নীরবতা ভাঙলেন, বড় মসজিদের ইমাম তবরেজ আলি, ‘সালাম’এর ‘প্রতি-সালাম’ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কন্ঠ মেলাল তইজুল আর খতিব। ইমাম তবরেজ আলি বললেন, “কেউ কারোর ভালো চাহালে তারও ভালো চাহার কথা আল্লাহ বুলিছেন।“ ইমাম সাহেবের কথা শুনে খতিব চোখ তুলে আসমানের দিকে তাকাল। আর মনে মনে আরশে বসে থাকা আল্লাহকে বলল, ‘হাজার শুক্রিয়া তোমাকে।’

পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন