হেলেনা ডেমুথ (Helene Demuth) (১৮২০-১৮৯০) ও ফ্রেডারিক ডেমুথ (Frederick Demuth) (১৮৫১-১৯২৯) // কার্ল মার্কসের পরিচারিকা ও তার ছেলে
সাংকি ওয়েন্ডেল অর্থাৎ আজকের সারল্যাণ্ডে এক কৃষক পরিবারে হেলেনা ডেমুথের জন্ম। হেলেনার দিদির নাম ক্যাথারিনা। দিদি এবং বোন দুজনেই পরিচারিকার কাজ করতেন ট্রিয়েরে। হেলেনা করতেন জেনির বাড়িতে, আর তার থেকে কিছুটা দূরে এক সাবান নির্মাতার বাড়িতে কাজ করতেন ক্যাথারিনা। বছরখানেক কাজ করেন তাঁরা। ক্যাথারিনা গর্ভবতী হলে দিদি আর বোন দুজনেই ফিরে যান সাংকি ওয়েণ্ডেলে।
১৮৪৫ সালে ব্রাসেলসে ছিলেন কার্ল মার্কস ও জেনি। সেই সময়ে জেনির মা হেলনাকে তাঁদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন গৃহকর্মে সাহায্যের জন্য। তাঁর ডাক নাম ছিল লিঞ্চেন বা নিম। সেই নামেই তিনি মার্কসের পরিবারে পরিচিত ছিলেন। এই পরিচারিকাই হয়ে ওঠেন মার্কস পরিবারের বন্ধু, রাজনৈতিক আন্দোলনে সাহায্যকারী। এক কথায় পরিবারেরই অঙ্গ হয়ে যান তিনি। জেনির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। মার্কস পরিবারের পাশেই যে হেলেনার কবর হবে, সে কথা বলে গিয়েছিলেন জেনিই।
১৮৫১ সালের ২৩ জুন অবিবাহিতা হেলেনা জন্ম দেন এক পুত্র সন্তানের। সন্তানের বাবা কে তা জানা যায় নি। সে সন্তানের জন্মের শংসাপত্রে বাবার নামের ঘর ফাঁকা ছিল।
১৮৮৩ সালের মার্চ মাসে কার্ল মার্কসের মৃত্যু হয়। তার আগেই মারা গেছেন জেনি মার্কস। মার্কসের মৃত্যুর পরে হেলেনা ফ্রেডারিখ এঙ্গেলেসের বাড়িতে কাজে যোগ দেন। মার্কসের বই প্রকাশের ব্যাপারে হেলেনা এঙ্গেলসকে সাহায্য করতেন বলে জানা যায়।
১৮৯০ সালের অক্টোবর মাসে ৬৯ বৎসর বয়েসে হেলেনা মারা যান। ক্যানসারে ভুগছিলেন তিনি। জেনির ইচ্ছে অনুযায়ী হাইগেট সেমেট্রিতে মার্কসের পরিবারের পাশেই কবর দেওয়া হয়। শোকবার্তায় এঙ্গেলস বলেন যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতারা হেলেনার বুদ্ধিমত্তা, সততা, বিশ্বস্ততা ও সহমর্মিতার (‘her strong common sense, her absolute rectitude of character, her ceaseless thoughtfulness for others, her reliability, and the essential truthfulness of her nature’ ) পরিচয় পেয়েছেন বার বার।
হেলেনার ছেলের নাম হেনরি ফ্রেডারিখ ডেমুথ।
কিন্তু কে তাঁর বাবা ? কার্ল মার্কস, না, তাঁর বন্ধু ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস?
এখানেই থেকে গেছে রহস্যের আবরণ। কার্ল মার্কসের শত্রুরা এই ‘কলঙ্ক’ মার্কসের ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছেন। কিন্তু টেরেল কার্ভার তাঁর বই ‘রিডিং মার্কস : ইজ লাইফ অ্যাণ্ড ওয়ার্কস’ বইতে বলেছেন যে যদিও ১৯৬২ সাল থেকে দাবি করা হচ্ছে যে মার্কসের ঔরসে ফ্রেডারিখ ডেমুথের জন্ম, তবু সে দাবির পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নেই ( — ‘this is not well founded on the documentary materials avilable’ )।
সে যাই হোক, ফ্রেডারিখ ডেমুথ কিন্তু হতভাগ্য মানুষ। পিতৃপরিচয় তিনি পান নি, পান নি মায়ের সান্নিধ্য। জন্মের পরে তাঁকে পূর্ব লণ্ডনের মিঃ লিউইস নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে তাঁকে রাখা হয়। সেখানে তিনি লেদ মেশিনের কাজ শেখেন।
মার্কসের মেয়ে এলেনরের সঙ্গে কিন্তু ফ্রেডির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এলেনর জানতেন, এঙ্গেলস ফ্রেডির বাবা ; তাই তিনি পিতা-পুত্রের মধ্যে সম্পর্কের সেতু গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। ১৮৯৬ সালে লণ্ডনের কুইন্স হলে আন্তর্জাতিকের ২য় কংগ্রেসে এলেনর ক্লারা জেটকিনের সঙ্গে ফ্রেডির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ‘হাফ ব্রাদার’ বলে। ফ্রেডি এলেনরের বিপদের সময় তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এলেনরের লেখা থেকে আমরা জানত পারি, হেলেনা যখন এঙ্গেলসের বাড়িতে থাকতেন, তখন মাঝে মাঝে ফ্রেডি আসতেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। এঙ্গেলসর ৭৪তম জন্মদিনে ফ্রেডিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে এঙ্গেলস যে ফ্রেডির প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না, সে কথাও এলেনর লিখেছেন।
ফ্রেডি সত্যই এক হতভাগ্য মানুষ। বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু সে বিয়ে সুখের হয় নি। ১৮৭৩ সালে মার্ফির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। হ্যারি নামে এক ছেলেও হয়। কিন্তু ১৮৯২ সালে মার্ফি টাকাকড়ি নিয়ে পালিয়ে যান এক সৈনিকের সঙ্গে।
মার্কস-এঙ্গেলসের মতাদর্শ ফ্রেডিকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি ‘দ্য ক্ল্যারিয়ন’ নামক সমাজতন্ত্রী পত্রিকা নিয়মিত পাঠ করতেন। হ্যাকনের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন তিনি। ক্ল্যাপটন পার্ক, ডিস্ট্রিক্ট কো-অপারেটিভ এবং ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তাঁর ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছিল মার্কস-এঙ্গেলসের ছবি। তাঁদের রচনা তিনি নিয়মিত পাঠ করতেন। (ক্রমশ)