মেয়েটা লোকটাকে শিস দিতে দিতে তার দিকে আসতে দেখল। সে তার সামনে এসে ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করল পপি স্ট্রিটে যাবার পথ বলতে পারেন কিনা। মেয়েটা এক মুহুর্তের জন্যও ভাবেননি যে লোকটা তার সোনার নেকলেসটি ছিনিয়ে নিয়ে চম্পট দিতে পারে। মেয়েটা রাস্তার যে পাশ দিয়ে হাঁটছিল লোকটাও সেই পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। মেয়েটা চিন্তামগ্ন ছিল।
লোকটার উপস্থিতিতে তার মোটেই সন্দেহের বা সাবধানতার প্রয়োজন আছে বলে সে মনে করেনি। বরং লোকটা কমনীয় চেহারা ও কথাবার্তায় তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে। মানসিক শান্তি জাগিয়ে তোলে। লোকটা তাকে সুস্থ থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। হঠাৎ সে তার ডান হাত দিয়ে তার বুকে আঘাত করলেব তার মনে হলো তার স্তনের নিচের হাড় আলগা হয়ে গেছে। এক মুহুর্তের জন্য মেয়েটা যেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়ল। কিন্তু পরক্ষণেই সে দ্রুততার সাত্থে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনলো। সে তার দিকে ফিরে গিয়ে, চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘চোর চোর! চোর থামো! আমার নেকলেস, আমার নেকলেস, আমার নেকলেস’ — মেয়েটা রাগে ফুসে ওঠে। সে কাঁদতে কাঁদতে তার পিছু ধাওয়া করে। লোকেজন দোকানপাঠ ও ওয়ার্কশপগুলো থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে হতাশ দৃষ্টিতে দৃশ্যটি দেখছিল।
কয়েকে মুহূর্তের মধ্যে সব রকমের বাধা অতিক্রম করে মেয়েটা চোরটাকে ধরে ফেললো। মেয়েটা তাকে ধরতে না পারে সে জন্য লোকটা এদিকে ওদিকে দৌড়ে চলছিল। চোরটা ভাবলো একটা মেয়ের পক্ষে তাকে ধরা সহজ নয়। সূর্য় মাথার ওপরে। চোরটা ঘেমে নেয়ে উঠেছে। মেয়েটি দেখলো,লোকটার আঙুলে জড়ানো তার নেকলেসটার ওপর সূর্যের আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে। মেয়েটা গয়নার প্রতি কোনদিনই আগ্রহী ছিল না। চোরটা তার গলা থেকে নেকলেসটা ছিনিয়ে নেওয়ায় তার অন্তরআত্মা যেন হাহাকার করে উঠলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে চোরটাকে পাকড়াও করলো। সে তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। চার পাশের লোকজন দল বেঁধে এগিয়ে এলেও কেউই মেয়েটাকে সাহায্য করতে সাহস করলো না। কেউই তাকে সাহায্য করতে না আসায় সে কেঁদে উঠে বললো, ‘চোরটা আমার নেকলেস ছিনিয়ে নিয়ে পালাচ্ছে। আপনারা আমাকে সাহায্য করেন দয়া করে।’
হঠাৎ করে চোরটা তার টাউজারের গোপন পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে মেয়েটার মুখের উপর ধরলো। মেয়েটা সচেতন হয়ে পিছিয়ে গেল। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুখ লোকগুলো আরো পিছিয়ে চিৎকার করে মেয়েটাকে সাবধান করে দিল।
‘পেছেনে ফেরেন, লোকটার হাতে অস্ত্র রয়েছে।’ একজন বলে উঠলো।’
‘বোকামি করবেন না। লোকটা কিন্তু আপনাকে ছুরি মেরে দেবে।’ আর একজন বললো। “আপনি একজন অবলা মেয়েছেলে, এত সাহস দেখাচ্ছেন কেন?’
‘এক গুঁয়ে মহিলা’
এতো কথা শোনার পরও মেয়েটার মুখমণ্ডল সাহসে দৃঢ় হয়ে উঠলো। শান্তশিষ্ট মেয়েটার মনে সাহস বেড়ে গেল।ভয়ভীতি তার মন থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে তার মনে হলো। সে ভাবলো কেউই তাকে পিছু হটাতে পারবেনা। যুবতী মেয়েটাকে পিছু হটার জন্য লোকগুলো বললেও সে কিন্তু সাহসী হয়ে উঠতে থাকলো। তাকে জ্ঞান দেবার পরির্বতে তাকে সাহায্যের প্রয়োজন বেশি। এবার লোকগুলো চোরটার উদ্দেশ্যে বললো, ‘তুমি কি মরতে চাও। এই একগুঁয়ে মেয়েটা থেকে দূরে সরে পড়। তা না হলে মেয়েটার কোন ক্ষতি হলে তুমি দায়ী হবে। মেয়েটা কিংবা অন্য কারো ক্ষতির জন্যও তুমি দায়ী থাকবে তাদের কণ্ঠের ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা মেয়েটাকে ভীত সন্ত্রস্ত করলো। এবার লোকগুলো বললো, ‘তাকে প্রতিরোধ করার উপায় নেই। কারণ লোকটার হাতে মারণাস্ত্র রয়েছে। ওই লোকটা একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে।’ ছুরিধারী চোরটার কাছে লোকগুলোর বশ্যতা স্বীকারের কথাবার্তা মেয়েটার মনে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল। সে আরো একগুঁয়ে হয়ে উঠলো। সে লোকগুলোর চারিদিকে ঘুরে কী য়েন খুঁজতে থাকলো। সে ছুরি উচিয়ে থাকা চোরটাকে মোকাবিলা করতে চায়। সে বললো, ‘ওই চোরটার কি পৃথিবীর তাবৎ অস্ত্র আছে? আমার নেকলেসটা আমাকে ফেরত দিতেই হবে ওকে।’ ওই মুহূর্তে চোরটা মেয়েটার উদ্বেগপূর্ণ চোখের দিকে বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালে মেয়েটা তার মুখটা চোরটার হলুদ চোখদুটো আর সাদা দাঁতের খিচুনি তার চোখের মাঝে প্রতিফলিত হতে দেখালো।
‘তোমার একগুঁয়েমি কী বর্বরতা প্রকাশ করছে না!’ চোরটা মেয়েটার মুখ ও কপালের দিকে বক্রচোখে তাকিয়ে বললো। চোরটার শ্লেষপূর্ণ কথা শুনে মেয়েটা অগ্নিশর্মা হয়ে চোরটার শার্টের কলার চেপে ধরলো। চোরটা জোরাজুরি করে নিজেকে তার হাত থেকে মুক্ত করলো। তারপর শুয়োরটা মেয়েটাকে একটার পর একটা লাথি মেরে এক দৌড় লাগালো। মেয়েটা তৎক্ষণাৎ মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চোরটার পিছু ধাওয়া করলো। তার চুলগুলো এলোমেলো, নাক রক্তে ভেজা, পরনে কাপড় ধুলোয় ভরা। সে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চোরটার পিছুপিছু দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘আমার নেকলেস!’ মেয়েটা চোরটার পিছু ধাওয়া করে যেখানে পৌঁছালো সেখানে একটা লোক মোটরবাইক নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। চোরটা অপেক্ষামান লোকটার মোটর বাইকে পেছনে চড়ে চম্পট দিল।মেয়েটা বুঝতে পারলো, সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক করা হয়েছে।
মেয়েটা যেন তার শরীরের বলবুদ্ধি হারিয়ে ফেলছে। সে চিৎকার করে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলো। সে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। তার মনে দাগ কাটলো তার প্রতিবেশীদের আচরণের কারণে বাইরের লোক তাদের রাস্তায় আগ্রাসী কাজ করতে সাহস পায়! সে দু:খ ভারাক্রান্ত মনে স্মরণ করলো কায়রোর একটা রাস্তায় একদল যুবকের দ্বারা মেয়েরা ধর্ষিতা হবার ঘটনাকে। তার মনে হলো একজন পথচারী দ্বারা মেয়েরা ধর্ষিত হয়নি। পথচারীর সাথে সংঘবদ্ধ দল জড়িত আছে। সে কল্পনায় অতীতকে দেখতে পেল। যখন একটা মাদী উটের কারণে দুটো আরব উপজাতির মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ চল্লিশ বছর স্থায়ী হয়েছিল। মেয়েটা অনুভব করলো মানুষের লজ্জা ও দীর্ঘশ্বাসকে। তার মনের গহীনে শৈত্য ও কাঠিন্য পীড়া দিচ্ছিল। মোয়াজ্জীনের কণ্ঠের আজানের ধ্বনি মেয়েটা হৃদয়ের গহীনে প্রবেশ করে আত্মায় পৌঁছে যায়। তার চার পাশে মানুষের জমায়েত তাকে আরাম দেয়। ‘যা ঘটেছিল তার জন্য দু:খিত।’
‘তোমার নিজেকে বিপদের মাঝে ফেলা উচিত নয়।’ ‘এধরনের দৃঢ় সংকল্পের দ্বারা তুমি কেমন করে নিজের ধংস খুঁজতে পার?’ ‘তুমি বিপদ থেকে মুক্ত থেকে নিরাপদ ও সুন্দর জীবনের আশা নিয়ে বাঁচবে।’ ‘তোমার উচিত হবে তোমার অধিকারকে গোপন রাখা ও তাকে প্রদর্শন না করা।’
‘তার বিপর্যস্ত গর্বকে সাথে করে মেয়েটা মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত এবং অনুভব করত তার ও তাদের মাঝে একটা দেওয়াল নিশ্চুপে যেন দাঁড়িয়ে ছিল।তারপর সে নিজেকে প্রকাশ করলো যে পর্যন্ত না যুদ্ধে নিশেষ হয়ে যায়। সে শান্ত অথচ কথা বলতে শুনলো। ‘লজ্জা করে না তোমার! তুমি তোমাকে হাস্যস্পদ করে তুলেছো।’ মেয়েটা চারিদিকে একটা পাক দিয়ে খুঁজতে থাকে কে কত্থাগুলো বলছিল। যারা উপদেশ বর্ষণ করছিল তাদের দেখতে পেয়ে সে তাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এক সময় চিৎকার দিয়ে বলে উঠে, ‘অথর্ব, মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষের দল! কখন থেকে তোমরা দাঁড়িয়ে আছো হাসাহাসি, ঠাট্টা তামাশা করার জন্য?’ যারা সেখানে উপস্থিত ছিল তাদের উদ্দেশ্যে মেয়েটি কর্কশ ও বেদনাদীর্ণ ভাষায় কথাগুলোর বললো। সে একাই রাস্তার শেষ প্রান্তে অবস্থিত তার বাবা মায়ের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলে চললো। তার মনে আবেগ অনুভূতি উদ্বেল হয়ে উঠলো।সে ধীরে ধীরে সূর্যের আলোর নিচে যাবার চেষ্টা করলো। মেঘের ঘোমটা খসে পরায় সূর্য আলো ছড়িয়েছে সবেমাত্র।
লেখক পরিচিতি : রচিদা এল-চার্নি (Rachida El-Charney) (জন্ম ১৯৬৭) একজন তিউনিসিয়ান লেখিকা। তিনি তিনটি ছোট গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছেন। তিনি আরব উইমেনস ক্রিয়েটিভ রাইটিং (শারজাহ), ২০২০, তার দ্বিতীয় গল্পের সংকলনের জন্যপ্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের আরব ওম্যান সেন্টার (তিউনিসিয়া), ১৯৯৭ সালে তার ছোট গল্পের প্রথম সংকলনের জন্য পুরস্কৃত হন। ইংরেজি ভাষায় লেখা তার ‘On the Way to poppy Street’ গল্পকে বাংলা ভাষায় ‘পপি স্ট্রিটে যাবার পথে’ নামে অনুবাদ কর হলো।)
মনোজিৎকুমার দাস, অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।