ট্যাক্সিতে হেলান দিয়ে বসে সুরঞ্জন একটা বই পড়ছিল। বইটা এতই আকর্ষণীয় যে সারাদিন সে সেটাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে, একটু সময় পেলেই পড়ে নিচ্ছে কয়েক পাতা। এবং পড়তে শুরু করলেই গভীর মনোযোগ এসে যায়।
এখনও সে বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়ছিল, তবু যে কেন হঠাৎ চোখ তুলে জানলার বাইরে তাকাল—সে নিজেই জানে না। সম্ভবত পুলিশের হাতের সামনে ট্যাক্সিটা অনেকক্ষণ থেমে থাকায় একটু অস্বস্তি বোধ করছিল, কিংবা এমনিই মানুষের চোখ মাঝে-মাঝে রাস্তার দিকে যায়।
কাছেই বাস-স্টপে যে মেয়েটি পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে মনে হয় টুলটুলের সঙ্গে বেশ মিল আছে, সেই রকমই লম্বা, মুখের পাশটাও একরকম।
এমনসময় পুলিশের হাত নামল, ট্যাক্সিটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
সুরঞ্জন যে-বইটা পড়ছিল, সেটার কথা মাথার মধ্যে ঘুরছে, টুলটুলের মতন চেহারার মেয়েটিকে দেখে টুলটুলের কথাও মনে পড়ল—এই দুরকম ব্যাপার একসঙ্গে জট পাকিয়ে যাওয়ায় তার চিন্তা স্বচ্ছ হতে একটু দেরি লাগল।
ট্যাক্সিটা একটু দূরে এগিয়ে যাওয়ার পর বিদ্যুৎচমকের মতন তার মনে হল, যে মেয়েটিকে টুলটুলের মতো দেখতে—সে যদি সত্যিই আসলে টুলটুল হয়?
সঙ্গে-সঙ্গে সে ড্রাইভারকে বলল ট্যাক্সি ঘোরাতে। কিন্তু এসপ্ল্যানেডে অত সহজে ট্যাক্সি ঘোরানো যায় না। ড্রাইভার সেই মর্মে বিরক্তিসূচক কোনও মন্তব্য করায় সুরঞ্জন সেইখানেই ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল। তারপর দ্রুত হেঁটে ফিরে এল পেছন দিকে।
মেয়েটি এর মধ্যে বাসে উঠে চলে যেতে পারত, কিন্তু যায়নি। একটি লম্বা চুলওয়ালা খুব বুদ্ধিমান চেহারার যুবকের সঙ্গে কথা বলছে। যুবকটির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, সে যখন-তখন এই গোটা পৃথিবীটাকে কিনে আবার বিক্রি করে দিতে পারে।
কাছাকাছি এগিয়ে সুরঞ্জন বুঝতে পারল, মেয়েটি সত্যিই টুলটুল নয়, তার ছোটবোন তাতা।
এমনিতেই টুলটুল আর তাতার চেহারার কোনও মিল নেই। পাশাপাশি দাঁড়ালে মনে হবে দুটি আলাদা চেহারা ও চরিত্রের মেয়ে। টুলটুলের মুখখানা গোল ধাঁচের, তাতার মুখখানা লম্বাটে। কিন্তু এক মায়ের পেটের ভাইবোনদের চেহারার মধ্যে কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম মিল থেকে যায়—কোনও একটা বিশেষ অ্যাঙ্গেল থেকে হঠাৎ একরকম মনে হয়। ট্যাক্সির জানালা থেকে সুরঞ্জন যে মিলটা খুঁজে পেয়েছিল, এখন আর সেটা পাচ্ছে না।
এগিয়ে গিয়ে তাতার সঙ্গে কথা বলতে তার লজ্জা করে। তাতার সঙ্গে একজন বন্ধু রয়েছে। তাতার বন্ধুটি হাত-পা নেড়ে এমন ভাবে কথা বলছে যেন দুনিয়ার কারুকেই সে গ্রাহ্য করে না। ছেলেটি নিশ্চয়ই বেকার—তাই ওর চোখের সামনে এখনও অনেক স্বপ্ন আছে।
সুরঞ্জন তাতার কাছ থেকে টুলটুলের খবরটা জেনে যেতে চায়। টুলটুল তার স্বামীর বাড়ি থেকে রাগ করে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল, ফিরেছে কি? অবশ্য টুলটুলের ফেরা-না-ফেরায় সুরঞ্জনের কিছু যায় আসে না। টুলটুল এখন অন্য জগতের মানুষ। তবু পুরো ঘটনাটা জানার জন্য সবারই কৌতূহল থাকে।
সুরঞ্জনের তো হাতে কোনও কাজ নেই, সে তার হোটেলেই ফিরছিল—এখানে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে ক্ষতি কী?
সুরঞ্জনকে অবাক করে দিয়ে তাতার ছেলে-বন্ধুটি হঠাৎ দৌড়ে একটা বাসে উঠে পড়ল। ভিড়ের বাসের পা-দানিতে একলাফে উঠে হ্যান্ডেল ধরে আর-একটা হাত নেড়ে দিল তাতার দিকে। সুরঞ্জন ভেবেছিল, ওই ছেলেটিই তাতাকে আগে বাসে তুলে দেবে, কিংবা একসঙ্গেই দুজনে যাবে। তাদের বাল্যকালে কোনও ছেলে কোনও মেয়েকে একলা ফেলে রেখে নিজে আগে বাসে ওঠার নিয়ম ছিল না। এখন নিয়ম-কানুন অনেক বদলে গেছে।
সুরঞ্জন কাছে এগিয়ে এসে বলল, তাতা, তুমি এখানে?
তাতা সুরঞ্জনকে দেখে চমকাল না, খুশি হল না, বিব্রতও বোধ করল না। এত কম বয়সেই তাতা এমন একটা রহস্যময় ব্যক্তিত্ব অর্জন করে ফেলেছে যে সুরঞ্জনের কাছে ওকে খুব অপরিচিত মনে হয়। শেষবার কলকাতায় সুরঞ্জন তাতাকে দেখে গিয়েছিল একটি বারো বছরের ছটফটে মেয়ে—যেমন সরল, তেমনি দুরন্ত। সে এখন অনেক বদলে গেছে।
তাতা বলল, ইউনিভাসির্টি থেকে ফিরছি বাসে উঠব।
এদিক থেকে?
এদিকে আমার এক বন্ধুকে হাওড়ার বাসে তুলে দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। এবার ওদিকে যাব।
টুলটুলের খবর কী?
জানি না তো! এ ক’দিন আর অমিতদাদের বাড়িতে যাইনি।
ফিরে এসেছে কি না তাও জানো না?
হ্যাঁ, তা জানি। ফেরেনি।
কী নিশ্চিন্তভাবে কথা বলে তাতা। তার নিজের দিদি সম্পর্কেও একটুও চিন্তা নেই—এইটাই কি আজকালকার নিয়ম? বাবার অমতে বিয়ে করেছিল বলে টুলটুল আর বাপের বাড়িতে আসে না। এদিকে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে সে কোথায় চলে গেছে। দু-বাড়ির মধ্যে যোগসূত্র শুধু তাতা—কিন্তু এ ব্যাপারে সে যেন মাথাই ঘামাতে চায় না। তার দিদি নিরুদ্দেশ—অথচ সে এখানে তার ছেলে-বন্ধুর সঙ্গে হেসে-হেসে গল্প করছিল।
আগের দিন যখন তাতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখন তাতা বলেছিল, ছোড়দি নিশ্চয়ই যা ভালো বুঝেছে, তাই করেছে। ছোড়দি তো আর ছেলেমানুষ নয়।
কিন্তু মেয়েদের যা-খুশি করার স্বাধীনতার সঙ্গে-সঙ্গে যে একটা বিপদের আশঙ্কাও থাকে, তা কি ও বোঝে না?
সুরঞ্জন বলল, তাতা, তোমাকে কি এক্ষুণি বাড়ি ফিরতে হবে? কোথাও বসে একটু চা খেতাম।
তাতা একটুক্ষণ দ্বিধা করে। তারপর বলে, আচ্ছা চলুন।
স্পষ্টই বোঝা যায়, তাতার ইচ্ছে নেই। নিছক ভদ্রতার জন্যই সে প্রত্যাখান করল না। এ-ব্যাপারটা বুঝেও সুরঞ্জন তাতাকে ছাড়তে চাইল না। সন্ধ্যাবেলাটায় সে একেবারেই একা—কথা বলারও কেউ নেই।
কোন দোকানে যাওয়া যায় বলো তো? পার্ক স্ট্রিটে যাবে?
কেন, এই তো সামনেই দোকান আছে একটা।
অর্থাৎ তাতা ব্যাপারটা সংক্ষেপে সেরে ফেলতে চায়। পার্ক স্ট্রিটে যেতেও তো সময় লাগবে। আর, পার্ক স্ট্রিটের কোনও দোকানেই শুধু এক কাপ চা পাওয়া যায় না।
রাস্তা পেরিয়ে এসে ওরা একটা চায়ের দোকানে ঢুকল, বাইরে কিছু টেবিল রয়েছে, কয়েকটা পরদা-ঢাকা ক্যাবিন। সুরঞ্জনের সঙ্গে একটি মেয়ে রয়েছে বলেই বেয়ারারা একটা খালি ক্যাবিনের পর্দা তুলে ধরে বলল, আসুন, এখানে আসুন।
সুরঞ্জন একটু ইতস্তত করে তাতার মুখের দিকে তাকাল। তাতা বেশ সহজভাবেই বলল, বাইরেই বসি, ভেতরে বড্ড গরম।
সুরঞ্জন সঙ্গে-সঙ্গে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাইরেই ভালো।
কোণের একটা ফাঁকা টেবিলে বসল দুজনে। তাতা রুমাল দিয়ে মুখ মুছল। তাতার বাইশ বছরের সুশ্রী মুখখানি ঝকঝক করছে। সব সময়েই সে সপ্রতিভ। রেস্টুরেন্টে কোনও মেয়ে এসে বসলেই অন্যরা তার দিকে চোরা চোখে তাকায়। তাতা সে ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপও করে না।
মেনু কার্ডটা হাতে নিয়ে সুরঞ্জন জিগ্যেস করল, তুমি চা খাবে, না ঠান্ডা কিছু নেবে? এখানে আইসক্রিমও পাওয়া যায়।
শুধু চা।
সঙ্গে আর কিছু?
না।
সুরঞ্জনের মনে পড়ল, বাচ্চা বয়েসে তাতা আইসক্রিম খেতে দারুণ ভালোবাসতো। এখন কি সে-কথা ওকে মনে করিয়ে দেওয়া যায়? আরও অনেক কিছুই মনে করিয়ে দেওয়া যায় না—যেমন, তাতার হাত দিয়ে টুলটুলকে একটা বই পাঠানোর সময় সুরঞ্জন তার মধ্যে একটা চিঠি ভরে দিয়েছিল।
হঠাৎ বইটা খুলে চিঠিটা দেখেই বলেছিল, এটা কার চিঠি। সুরঞ্জন তো দারুণ লজ্জা পেয়েছিলই—ভয়ও পেয়েছিল পাছে অন্য কেউ শুনতে পায়। টুলটুলের সঙ্গে রোজ দেখা হলেও সুরঞ্জন তাকে মাঝে-মাঝে এরকম ভাবে চিঠি পাঠাত, এর একটা আলাদা রোমাঞ্চ আছে।
সুরঞ্জনকে ভয় পেতে দেখেই তাতা আরও মজা পেয়ে গিয়েছিল। ছেলেমানুষি করে বলেছিল, কার চিঠি? কার চিঠি?
সুরঞ্জন যতই কাকুতি মিনতি করেছে, তাতা তত বেশি জোরে-জোরে বলেছে।
দশ বছরে অনেক কিছুই বদলে যায়। তাতার কি মনে আছে সে কথা? এখন তার নির্লিপ্ত গম্ভীর মুখ দেখে কিছুই বোঝা যায় না। এখন টুলটুলও এক আর্টিস্টকে বিয়ে করে অন্যরকম হয়ে গেছে।
সুরঞ্জন নিজেও যে অনেক বদলে গেছে—সেটা তার মনে নেই। সে তাতাকে দেখছে কখনও ছেলেমানুষি চোখ দিয়ে—তাতার যে-কোনও ব্যবহার দেখেই তার তুলনা করতে ইচ্ছে করছে আগেকার দিনগুলোর সঙ্গে। কিন্তু তাতার জীবন এখন অন্যরকম—তার সঙ্গে আগেকার জীবনের কোনও যোগ নেই।
সুরঞ্জন কীভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। তাতা নিজেই জিগ্যেস করল, আপনি কি আরও কিছুদিন এখানে থাকবেন?
সুরঞ্জন বহুদিন কলকাতা-ছাড়া। অফিসের কাজে এখানে এসেছে।
তাতার প্রশ্ন শুনে তার মনে হল, সে তাড়াতাড়ি চলে গেলেই কি তাতা খুশি হয়? হঠাৎ একথা জিগ্যেস করছে কেন?
অবশ্য এরকম মনে করার কারণ নেই। তার থাকা-না-থাকায় তাতার কী আসে যায়? তবু যারা এরকম বড় শহরে একলা হোটেলে থাকে—তাদের মনের মধ্যে এরকম অভিমান জন্মাতেই পারে। বিশেষত, এককালে এই শহরে সুরঞ্জনের মা-বাবা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব অনেক ছিল, প্রেম ভালোবাসাও ছিল। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সব ছিন্ন হয়ে গেছে। সে বলল, আমার কালকেই চলে যাওয়ার কথা ছিল, অফিসের আর-একটা কাজের জন্য আর দু-দিন থেকে যেতে হচ্ছে। শনিবার ঠিক চলে যাব—টিকিট কাটা হয়ে গেছে প্লেনের।
তাতা চুপ করে রইল।
সুরঞ্জন আবার বলল, যাওয়ার আগে টুলটুলের খবরটা জেনে যেতে পারলে ভালো লাগত।
তাতা চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে বলল, আপনি ছোড়দির জন্য চিন্তা করবেন না।
চিন্তা করা আমার উচিত নয়। তবু মন মানে না। টুলটুল কি আগেও এরকম বাড়ি ছেড়ে গেছে?
না।
তবে? তোমাদের দুশ্চিন্তা হয় না?
ছোড়দি খুব শক্ত মেয়ে। ও নিজের ভালো-মন্দ বোঝে। টুলটুলের সঙ্গে সুরঞ্জন প্রায় শৈশব থেকে প্রথম যৌবন পর্যন্ত একসঙ্গে কাটিয়েছে। কত বই ওরা একসঙ্গে পড়েছে, কত স্বপ্ন-বিনিময় হয়েছে—সেই টুলটুল কীরকম মেয়ে, তা কি সুরঞ্জন জানবে না? তাতার কাছ থেকে শুনতে হবে? বোধহয় সুরঞ্জন সত্যিই তেমন ভাবে চেনে না টুলটুলকে। টুলটুল কারুকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে যাবে—এ কি সে ভাবতে পেরেছিল?
সুরঞ্জন তাতার চোখের দিকে চোখ চেয়ে জিগ্যেস করল, টুলটুল কোথায় আছে, তুমি সত্যি জানো না?
জানলে বলব না কেন? অমিতদা সব জায়গায় খুঁজে দেখেছেন!
আশ্চর্য! কী যে হল! সেরকম কিছু ঝগড়াও তো হয়নি শুনেছি।
তাতা হঠাৎ পালটা প্রশ্ন করল, ছোড়দি কোথায় থাকতে পারে, তা আপনিও সত্যি জানেন না?
সুরঞ্জন অবাক হয়ে বলল, আমি? আমি কী করে জানব?
তাহলে আপনি এতবার ছোড়দির কথা জিগ্যেস করছেন কেন? সুরঞ্জন একটু আহত বোধ করল। তাতার কথার মধ্যে একটা ঝাঁজ ফুটে বেরুচ্ছে। এরকম ভাবে সে কথা বলবে কেন? যাই হোক। তাতা ছেলেমানুষ, তার ওপর রাগ করা চলে না।
সুরঞ্জন পুরোনো চোখ দিয়ে তাতাকে এখনও ছেলেমানুষ ভাবছে। কিন্তু তাতা যে এখন একজন যুবতী, তার অন্যরকম জীবন আছে, আলাদা অহঙ্কার আছে—সেটা খেয়াল করছে না। সুরঞ্জন শান্ত গলায় বলল, তোমার ছোড়দির খোঁজখবর নেওয়া কি আমার পক্ষে অপরাধ?
আপনি বুঝতে পারছেন না, এটা আপনার পক্ষে অপমানজনক?
কেন?
ছোড়দির সঙ্গে আপনার আগে খুব ভাব ছিল। এতদিন পর আবার আপনাদের দেখা হয়েছে। এখন ছোড়দি হঠাৎ তার স্বামীর কাছ থেকে চলে গেলে সবাই ভাবতে পারে যে সে আপনার সঙ্গেই চলে গেছে কোথাও।
তুমি বিশ্বাস কর, সে আমাকে কিছুই বলেনি।
সেই কথাই তো বলছি। ছোড়দি আপনার সঙ্গে যায়নি, আপনাকেও কিছু বলেনি—তার মানে আপনার আর কোনও মূল্যই নেই ছোড়দির কাছে।
সুরঞ্জনের মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। তাতা একটা জিনিস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চায়। সুরঞ্জন ওদের আর কেউ না। টুলটুলও সুরঞ্জনকে কোনও গোপন কথা বলারও যোগ্য বলে মনে করে না।
সুরঞ্জন টেবিলে দাগ কাটতে-কাটতে বলল, তোমার ছোড়দি আমার সঙ্গে কোথাও যেতে চাইলেও আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতাম অমিতবাবুর কাছে। আমি তো তার জীবনের কোনও ক্ষতি করতে আসিনি।
ছোড়দির জীবনটাই আজ অন্যরকম। আপনি তো অনেকদিন কলকাতায় ছিলেন না।
সেই জন্যই আমি কিছু বুঝতে পারি না! কলকাতা শহর বাইরের লোককে কিছুতেই আর ভেতরে ঢুকতে দেয় না। চেনা মানুষরাও অচেনা হয়ে যায়। এইসময় অন্য টেবিল থেকে একটি ছেলে উঠে এসে তাতাকে বলল, এই প্রতীতি, তুমি কখন এসেছ? অরিন্দমের খবর শুনেছ তো? অরিন্দম দিল্লিতে।
ছেলেটি যে টেবিল থেকে উঠে এসেছে, সেই টেবিলে অনেক ছেলেমেয়ে বসে আছে। ছেলেটি এখানে এসে একটা চেয়ার টেনে অবলীলাক্রমে বসে পড়ল এবং সুরঞ্জনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাতার সঙ্গে কথা বলতে লাগল অনর্গল।
তাতার ভালো নাম যে প্রতীতি, তা মনেই ছিল না সুরঞ্জনের।
ছেলেটি ঝড়ের বেগে কথা বলা একটু থামাতেই তাতা বলল, আলাপ করিয়ে দিই, এর নাম সঞ্জয় মজুমদার—আমরা বি.এ. ক্লাসে একসঙ্গে পড়তাম। আর সঞ্জয়, ইনি হচ্ছেন—
তাতা একটু থামল, দু-এক মুহূর্তে ইতস্তত করে বলল, ইনি হচ্ছেন সুরঞ্জনদা, আমেদাবাদে থাকেন—
তাতা ঠিক কি পরিচয় দেবে বুঝতে পারছিল না। চায়ের দোকানে এক টেবিলে একটি পুরুষ আর নারী বসে থাকলে সকলেই প্রথমে ধরে নেয় ওরা প্রেমিক-প্রেমিকা। সেই ভুল ভাঙাবার জন্য তাতা কী বলবে? একথা তো বলতে পারে না যে ইনি এক সময় আমার ছোড়দিকে ভালোবাসতেন—এখন অবশ্য ছোড়দির বিয়ে হয়ে গেছে, এর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই—
সব ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক। এটা বুঝতে পেরে সুরঞ্জনের সঙ্গে-সঙ্গে হাসি পেল।
সঞ্জয় বলল, আপনারা আমাদের টেবিলে আসুন না। আমরা অনেকে আছি।
কলেজের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে আড্ডা দিতে বসে। ওদের একটা আলাদা জগৎ, আলাদা ধরনের কথাবার্তা, সেখানে সুরঞ্জন নিজেকে মানিয়ে নেবে কী করে? শুধু-শুধু তাতাকে অস্বস্তিতে ফেলা হবে।
সে তক্ষুনি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাতা, তুমি ওদের সঙ্গে বসো। আমাকে তো এখন চলে যেতে হবে—জরুরি কাজ আছে।
ওদের কোনও বাধা দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে সুরঞ্জন বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ল দোকান থেকে।
তারপর অনেকক্ষণ একা-একা হেঁটে বেড়ালো রাস্তায়-রাস্তায়। অন্ধকার ময়দানে। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এত বড় শহরে এত মানুষ—তবু এর মধ্যেও সে নিঃসঙ্গ। তার পকেটে টাকা আছে—এত ঝলমলে দোকানপাট—সে অনায়াসেই যে-কোনও একটাতে ঢুকে বসে থাকতে পারে কিন্তু কোথাও একজনও আপনজন পাবে না। পুরোনো সম্পর্ক ধরে যাদের সে খুঁজতে গিয়েছিল—দেখা গেল, সম্পর্কের সূত্রগুলো এতদিনে ছিঁড়ে গেছে।
মনে হয়, সবাই যেন বদলে গেছে এর মধ্যে। তার নিজের বদলটাও সে মেনে নিতে পারে না। ছেলেবেলার চোখ দিয়ে সে যে কলকাতাকে খুঁজতে এসেছে—সেই কলকাতা আর কোথাও নেই। তার নিজের ছেলেবেলাটাও তো সে আর ফিরে পাবে না।