বৃহস্পতিবার | ১০ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১০:৫২
Logo
এই মুহূর্তে ::
মা দুর্গার মহাস্নান পর্ব : রিঙ্কি সামন্ত কোষ্টিয়া গ্রামের শীট বাড়ির দুর্গাপুজো : কমল ব্যানার্জী অয়দিপাউস : রিমি মুৎসুদ্দি পোড়খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনকথা : হরিশংকর জলদাস সাজসজ্জার পুজো : নন্দিনী অধিকারী আঠেরো শতকে কলকাতার ভেড়া যেত অস্ট্রেলিয়ায় : অসিত দাস জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (অষ্টম পর্ব) : বিজয়া দেব হরিয়ানায় হ্যাট্রিক করলেও উপত্যকার মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ে গান্ধী জয়ন্তী : দীপাঞ্জন দে পটের পাড়ায় মাজরামুড়ায় : রঞ্জন সেন একটি ড্যান্স হাঙ্গামা : শৈলেন সরকার গুণের রাজা পানিফল, দুর্গা পুজোর নৈবেদ্যে অপরিহার্য : রিঙ্কি সামন্ত স্কুল পালিয়ে কী রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায়? : সাইফুর রহমান পুজোয় বন্যা বিধ্বস্ত এলাকায় পরিষেবার মান উন্নত করতে বিদ্যুৎ দপ্তরের তৎপরতা তুঙ্গে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় গানের ভিতর দিয়ে দেখা পুজোর ভুবনখানি : সন্দীপন বিশ্বাস নবদুর্গা নবরাত্রি : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী সাদা কালোয় কুমোরটুলি : বিজয় চৌধুরী জেল খাটাদের পুজো, মাইক আসছে মাইক, ছুটছে গ্রাম : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কাশ্মীর নির্বাচনে বিপুল সাড়ার নেপথ্যে কি ৩৭০ বিলোপের জবাব : তপন মল্লিক চৌধুরী তর্পণের তাৎপর্য : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় মহালয়ার চন্ডীপাঠ মন্ত্র, মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্র : বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৪ সুকুমার রায় মানেই শৈশব ও কৈশোর : রিঙ্কি সামন্ত অমৃতা প্রীতম-এর অনুবাদ গল্প ‘বুনোফুল’ মিল অমিলের মানিক ও মার্কেজ : রাজু আলাউদ্দিন কলকাতা ছিল একসময় ভেড়াদের শহর : অসিত দাস নিরাপদর পদযাত্রা ও শিমূলগাছ : বিজয়া দেব তোলা বন্দ্যো মা : নন্দিনী অধিকারী বাংলার নবজাগরণ ও মুসলমান সমাজ : দেবাশিস শেঠ সৌরভ হোসেন-এর ছোটগল্প ‘সালাম’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই মহাষষ্ঠীর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

অয়দিপাউস : রিমি মুৎসুদ্দি

রিমি মুৎসুদ্দি / ২৪ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৪

সেদিন সাঁঝাল দিতে গিয়ে তরুবালা খড়কাটার কুঠুরিতে একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেল। খড়ের গাদায় কোনও একটা জন্তুর নাড়াচাড়া যেন! বড় শেয়ালের কথাটাই মনে এল ওর। বুকটা কেঁপে উঠল।

—জয় বাবা দক্ষিণরায়, জয় মা বনবিবি। পুজো দেবো আমি। রক্ষে করো।

তাড়াতাড়ি গোয়ালের হুড়কোটা টেনে প্রায় লাফ দিয়ে ঘরের চৌকাঠে পা দিয়ে হাঁপাতে থাকল। বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শীতল ঘুমাচ্ছে। লুঙ্গিখানা হাঁটুর উপড়ে উঠে গেছে। তরুবালা শীতলের পায়ের মাংসপেশীর দিকে তাকিয়ে দেখল, বেশ শক্তপোক্ত জোয়ান হয়েছে ছেলেটা। কিন্তু ওই বড়ো শেয়ালের সঙ্গে কী করে পারবে? নির্ঘাত মারা পড়বে। তরুবালা নিজেও বাঁচবে না। এখনও কানু ফেরেনি। কী যেন বস্ত্র ওষুধ বিলি হচ্ছে, সেই ত্রাণের দলের নেতা সে। বেশ কিছু মাল ঘরে আমদানি হবে বলে গেছে। এই অবস্থায় ঘরের খিলটা আগে দেবে না চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবে? এমন ভাবতে ভাবতেই গলার স্বর শুনে কেঁপে উঠল।

-আরে ও শীতল, আরে ও ভাতারখাকীর বেটা। পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস নাকি? দুটো বস্তা এনেছি। মালগুলো খড়কাটার ঘরে তুলতে হবে। আয়, শিগগির। হাত লাগা বাপ!

তরুবালার অন্তর কেঁপে ওঠে। ওই ঘরে একটু আগে স্পষ্টই কিছু একটা নাড়াচাড়া করার আওয়াজ পেয়েছে ও। সর্বনাশ হতে তো তাহলে আর বাকি নেই! হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠল,

—ওগো বড় শেয়াল এয়েচে! যেওনি ওই ধারে। কে আছো বাঁচাও!

তরুবালার চিৎকারে কানাই দু’পা পিছিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আবার ভ্যানের ওপর চড়ে বসল। আবার মনে হল, এরকম অকারণ ভয় তো তরু হরদমই পায়। সেই সেবার তরুর চিৎকারে আলাদের বাড়ির সক্কলে ছুটে এসেছিল, টিন, লোহা, লন্ঠন, কেরাচিনির ডিবি হাতে। তারপর, সব হেসে খুন। কমলের খোঁড়া ছাগলটা এসে সেঁধিয়েছিল ওই ঘরে। তরুর বুদ্ধিতে আবার চ্যাঁচামেচি করে লোক জড়ো করলে বড় হেনস্থা হতে হবে। আর তাছাড়া, কানু মণ্ডল এখন পার্টির গ্রামপঞ্চায়েতের মেম্বার। ওর এখন একটা ইজ্জৎ আছে এই গ্রামে। বুড়ো বয়সে ঝোকের মাথায় বিয়ে করা ইস্তক তরুবালার জন্য এমনিতেই সব জলাঞ্জলি যেতে বসেছে। তায়, আবার বউয়ের মিথ্যে ভয়কে বেশী আশকারা দিলে লোকে কী বলবে? কিন্তু যদি সত্যি হয়? কানু এগোবে না পিছোবে ভেবে পেলো না। একবার ভাবল, যাইহোক, মাস্টারের বাড়ি তো কাছেই। ওখানেই চলে যাই। মাস্টারকে গিয়ে বলি। উনি ন্যায্য বিবেচনার কথাই বলবেন। কিন্তু তরুর কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো বড় বিপদ। ধবল গাইটার সবে বাছুর হয়েছে। এখনই তো দুধের সময়। আর জানোয়ারটা যদি ঢুকেই থাকে, তাহলে কি গোহালের একটা প্রাণীকেও আস্ত রাখবে? তরুকে নিয়ে অত চিন্তা নেই কানুর। কিন্তু শীতল?

তরুর চিৎকারে শীতলের ঘুম ভাঙতেই মেজাজ গরম হয়ে গেল। আজ মাঠে সব পরিশ্রম ওর একার। বাবা তো পার্টির নেতা হয়ে ইস্তক সব কাজের ভার ওর ওপর দিয়ে নিচ্চিন্তে সারা বৎসর পার্টি পঞ্চায়েত করে চলেছে। অবশ্য এতে আমদানিও কম হয় না। এটুকু প্রয়োজন। নাহলে এতদিন তো মন্টুবাবাবুদের ঝাণ্ডার ভয়েতেই মুখ বুজে কত অত্যাচারই না সহ্য করেছে ওরা। তা সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর সবে একটু গড়িয়েছে। না, কোনও কাজ নেই, কাম নেই, এক কাপ চা দেওয়ার নাম নেই মাগী চিৎকারে পাড়া মাথায় করছে।

—উফ! চুপ কর। বড় শেয়ালের পেটে যা তুই।

অন্যসময় হলে চ্যালাকাঠ ছুঁড়ে মারত তরু শীতলকে। কিন্তু এখন বড্ড ভয় পেয়েছে। তাই পায়ের কাছে এসে বলে,

—যা না বাপ! যা আমার মানিক। একটা লাঠি নিয়ে গিয়ে দেখ? আমি নিজের কানে একটা আওয়াজ শুনেছি।

—কিসের আওয়াজ! গজ্জন?

—লিচ্চয় শুনেছি বাপ।

—তুই গজ্জন শুনলি আর আমি শুনলাম না?

—মরার মতো ঘুমালে আর শুনবি কী করে?

শীতল দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে খিল টেনে দিয়েছে তরু। চোখ সরু করে তরুর দিকে তাকায়। তারপর একমুখ হাসি নিয়ে বলে,

—বাপ এয়েছে ফিরে?

—এয়েছিল তো। তারপর আমি চিল্লালাম। আর সে ভ্যান ঘুরিয়ে চলে গেল।

শীতল তরুকে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিল।

—সেদিন কী বলেছিলি মনে আছে?

তরু ভয়ে ভয়ে বলে,

—এখন কি ইসবের সময় বাপ? যা না, দেখ না উদিকে পুরো গোহাল চিবিয়ে সে এখন মস্ত ঢেকুর তুলছে।

তরুকে ছেড়ে দিয়ে লুঙ্গীর খোঁটাটা শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে শীতল বলে,

—যাবো। তার আগে তুই বনবিবির কিরা কেটে বল, বাপরে যা দিস, আমারেও দিবি? রোজ? আগে কিরা কাট?

—বনবিবির নামে যখন তখন কিরা কাটতে আছে বাপ? এখন চারদিকে কী সব অসুখ? এখন ঘোর কলি। এখন সব পাপ পুণ্যের হিসাব হবে বাপ। এখন ইসব করতে নাই।

—বটে! এই রইল তোর লাঠি।

দরজার কোণে হেলানো লাঠিটা এমনভাবে তরুবালার দিকে ছুঁড়ে দিল যে আরেকটুর জন্য তরুর মাথাটা বেঁচে গেলো। তরু মনে মনে বলল,

—এই ছেলেটারে বড় শেয়ালে নিলে ভালো হত। জ্বালিয়ে খাচ্ছে বিয়ে হয়ে এসে ইস্তক। তবে বাপটা বুড়া। এই ছেলেটাই যা একটু সুখ দেয় তরুকে। যা বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছে এবার না পাড়ায় ছিছিকার পড়ে যায়!

হাতের লাঠিটা নিয়ে শীতলের দিকে এগিয়ে যায়। শীতল হাসে,

—দিবি নাকি দু ঘা?

—সেই কপাল কি আর করে জন্মেছি? ছেলেপুলের মুখ দেখব? আদর করব আবার দু’এক ঘা দুমদাম দিয়েও দেবো?

—তোরে কে মাথার দিব্যি দিছিল? বুড়াকে বিয়ে করতে? পয়সার লোভেই তো এলি আমাদের ঘরে।

তরুর মুখে গালাগাল চলে আসছিল। কিন্তু এখন এই দামাল ছেলেটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাইরে বার করতে হবে। বাইরে বিপদ। এই বিপদের হাত থেকে রক্ষে পেতে হবে আগে। আর বড় শেয়াল যদি এই শয়তানটাকে নিয়ে যায়, তাহলে আমি পুজো দেবো। এই ছেলেটাই দিন দিন সবথেকে বড় আপদ হয়ে উঠছে। কোনোদিন নিজের বাপের মাথায় দু’ঘা বসিয়ে দিয়ে তরুকেও খুন করে ফেলে!

লাঠি হাতে শীতল শেষ পর্যন্ত বেরোয়। প্রথমে গোয়ালে উঁকি দিয়ে দেখে। গরুগুলো সব অক্ষত আছে। মনে মনে বলে,

—মাগী অকারণ ঘুম ভাঙাল। ঘরে গিয়ে আজ চুলের মুঠি ধরে ক’ঘা যদি না দিই? বাপও পারবে না আজ ও মাগীকে বাঁচাতে।

তারপর নিজের বাবাকেই গালাগাল দিতে দিতে ঘরে ফিরে আসছিল। মনে পড়ল, একবার খড়কাটার ঘরটা তো দেখি নাই?

হুড়কোটা খুলে হাত টর্চের আলোটা খড়ের গাদায় ফেলে দেখল। কিছুই নেই। যদিও ও জানে সে যদি এসেও থাকে, টেরটি পাবে না কেউ। তার মতো চতুর প্রাণী কি আর এ তল্লাটে আছে একটা? কিন্তু এই ভাটির দেশে জন্মেছে বলেই বোধহয় শীতল বুঝতে পারে। কোথায় বড় শেয়ালের ভয় আছে, কোথায় নেই। সেই সেবার নৌকা করে মাস্টারের সঙ্গে শহর থেকে আসা ছেলেমেয়েদের নিয়ে নতুন দ্বীপ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। পরিত্যক্ত গ্রামটা ঘুরে দেখার জন্য কতই না আকুলি বিকুলি শহরের ছেলেমেয়েগুলানের। শীতল কিন্তু পায়ের ছাপ দেখেই মাস্টার মামাকে বলেছিল,

—মামা, তিনি কিন্তু কাছেই আছেন কোথাও। ওই দেখেন পায়ের ছাপ।

ওই গ্রুপের মধ্যে জিনসের প্যান্ট পরা লম্বা চুলের যে মেয়েটাকে শীতলের সবথেকে ভালো লেগেছিল, সে তো জোরজবদস্তি করেই চলেছিল।

—কিচ্ছু হবে না। আমরা সবাই একসঙ্গে দলে থাকলে এত লোক দেখে যেকোনো জানোয়ারই ভয় পাবে।

অন্য সময় হলে শীতল বীরত্ব দেখাতে চাইত মেয়েটার সামনে। কিন্তু ওই পায়ের দাগ, থাবার আঁচড় যে ভয়ঙ্কর রকম চেনা ওর। তাই কিছুতেই রাজী হল না। তখন মাস্টার মামাই বুঝিয়ে বললে,

—আরে ও কিন্তু একজনকে টার্গেট করে নেবে। আর যতই দলবদ্ধভাবেই থাকো না কেন, ও ঠিক ওর টার্গেটের যেকোনো এক দুর্বল মুহূর্তে কীভাবে যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নিয়ে যাবে টেরটিও পাবে না। খুব স্যাড একটা ইনসিডেন্টের মুখে জেনেবুঝে পড়ার থেকে ফিরে যাওয়াই ভালো।

টুসী না কি যেন মেয়েটার নাম। কিছুতেই ফিরতে চাইছিল না। ওই থাবা আর নখের দাগ না দেখলে শীতল ঠিক নিয়ে যেতো ওদের।

এক হাতে টর্চ একহাতে লাঠি নিয়ে খুব সাবধানে ভালো করে দেখল। খড়েরগাদার নীচে একগোছা চুল দেখতে পেল। এবার আর একটুও ভয় পেলো না। এ যে মেয়েমানুষের চুল!

একঝটকায় খড়গুলো সরিয়ে দেখল একটা মেয়েমানুষের মুখ। আরেকটু এগোতেই আস্ত মানুষটাকেই দেখতে পেলো। সারামুখে কালিঝুলি, পা দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। কোথাও কেটে টেটে গেছে। মুখ দেখে বয়স ঠাহর করতে পারল না। তবুও শীতল বেশ বুঝল ওই কালিঝুলির আড়ালে একটা মিষ্টি মুখ।

বাপ বিয়া করার পর থেকেই ওর এমন হয়েছে। আগে এমন ছিল না ও। মেয়েমানুষের মধ্যে যে অমন একটা টান আছে তা এর আগে ও টেরই পেতো না। এখন টের পেয়েও খুব যে ভালো লাগে তা নয়। মনে মনে নিজেকে ও গালাগাল দেয়।

—আমারে একটু আশ্রয় দিবা বাপ? অনেক দূর থেকে এয়েচি।

খুব ক্ষীণ কন্ঠে খড়ের গাদা থেকে ভেসে হল শব্দ ক’খানা।

—তুমি কে? কোত্থেকে এয়চ? এখানে ঢুকলেই বা কী করে?

—সে অনেক দূর বাবা। বলব সব। আগে একগ্লাস জল দাও আমারে? আর তোমার বাপ বাড়ি আছে?

—বাপ? বাপের লগে কি কাম? আর কোন দূর দেশ থেকে এয়েচ তুমি? শুনি?

—দিল্লি। আমি তোমার মায়ের মতো বাপ। তুমি তোমার বাপেরে একটু ডেকে দাও কেনে?

শীতলের ভেতর যেন আগুন জ্বলে উঠল।

—মায়ের মতো? তা মা তো নও? মা হলে এতক্ষণে আর কথা কইতে না আমার লগে। এক কোপে গলা খান নামায়ে দিতাম।

খড়ের ভেতর থেকে মানুষটা কেঁপে উঠল।

—তা বাবা, মায়ের ওপর তোমার কি কুনো মায়া নাই? অমন কথা কইতে আছে?

—মা? যে মাগী তার আড়াইবছরের বাচ্চারে ছাইড়্যা পরপুরষের লোভে পালায় সে মা নয়। রাক্ষসী।

—না না বাপ। আমি তোমার মা নই। আমারে একটু জল আর চারটি ভাত খেতে দিবা? আমি আজ আঠারোদিন ভাত খাই নি।

—ভাত খাও নাই? তাহলে কী খেয়েছ?

—ওই মুড়ি আরেকটু গুড় নিয়ে যাত্রা করলাম দিল্লি থেকে। আমার সঙ্গের লোকটা তো টেরেনে চাপা পড়ে মারাই গেল। আমি ভাগ্যিস ওই রেললাইনে শুইনি! একটু দূরেই তো শুয়েছিলাম। রেলগাড়ির কি বিকট শব্দে ঘুম ভাঙলে চমকে উঠলাম! আসফাক আর তার বাপে যে ওই রেললাইনের পরেই শুয়ে ছিল।

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা। শীতল দেখল বিপদ। এখুনি ঘর থেকে তরু চলে এলে হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দেবে। এমনিতেই শীতলকে বাপের চোখে বিষ করে দিয়ে ঘর থেকে তাড়াতে যে চায় তা ও বেশ বুঝতে পারে। নেহাত চাষের সবকাজই ও করে। আর পাড়ায় বাপ এখন পার্টির নেতা তাই শীতলকে তাড়ায় না।

—চুপ। একদম চুপ মাগী। তুমি সোয়ামী ছাওয়ালের জন্য কাঁদতে আমাদের বাড়িটাকেই বেছে নিলে কেন?

—বাপ, এরপর তো মরে যেতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু জানটা বড় শক্ত আমার। হাঁটতে হাঁটতে ইখানে এলাম। আর হাঁটার শক্তি নেই একদম।

ঘরের ভেতর তরু বেশ ভয়ে বসে আছে। কী হয় কী হয় ভাব। একটা সাড়াও তো পাচ্ছে না শীতলের। তাহলে কি সত্যিই বড় শেয়াল! দরজার খিলটা শক্ত করে লাগানো কিনা একবার পরখ করে দেখল। এইবার খুবই ভয় পাচ্ছে ও। চিৎকার করতে চাইল কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। তবুও কোনও মতে গলায় জোর এনে শীতলকে ডাকল। অন্যসময় হলে এক ডাকে কেন, বারবার ডাকলেও শীতল সাড়া দেয় না। আজ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল

—আরে শুধুমুধু চেঁচাস কেনে? একটা পাতি শিয়াল মাত্র। তাড়ায়ে দিছি। কিছু নাই এখন। তু রাঁধ কেনে? খিদা পাইছে খুব। আর এখনি বাপ আসতাছে। রান্না হয়নি দেখলে তোর আজ ডাণ্ডার বাড়ি কপালে।

অন্য সময় হলে তরুও এর একটা কড়া জবাব দিত। আজ বেশ ভয় পেয়েছিল ও। আর এই ভয়ের থেকে নিষ্কৃতি পেয়েই শান্তমনে রাঁধতে গেল।

শীতল এক গ্লাস জল এনে মেয়েটার সামনে ধরল।

—কী নাম বটে? মোসলমান তুমি? কনে বাড়ি?

গ্লাসের জলটা খেয়ে মেয়েটা এমনভাবে জিভ চাটছে যেন আরও তৃষ্ণা আছে। শীতল প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে রইল।

—আমিনা। সেই কোন ছোটোবেলায় আসফাকের বাপের সঙ্গে ই গাঁ ছেড়েছি। তারপর কত্ত জায়গায় ঘুরলাম। কত্ত কাজ। কনটারকটরি কাজ সব। রাজমিস্ত্রির যোগাড়ে। কোথাও গতর খাটিয়ে ঝিয়ের কাজও করেছি। অথচ গাঁয়ে এত কষ্ট ছিল না। হয়ত রোজ টাকার মুখ দেখতাম না। ভাতেরও অভাব। তবুও এত কষ্ট পাইনি।

—তা কষ্ট যখন, আগে আসো নাই কেনে? এই রোগব্যধির মধ্যে হেঁটে আইতে গেলে কেনে?

—কি করুম বাপ? কাজ বন্ধ। মালিক বুললে, এখন পয়সা দিতে পারবে না। কবে ই রোগ সারবে কবে কারখানা খুলবে তবে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পাবো। তার আগে খাবো কী? বাড়িওয়ালা উঠায়ে দিল। বললে, ‘যা কেনে। রাস্তা খোলা। সবাই হাঁটছে। তুরাও হাঁট কেনে বাড়ির দিকে?

—তা বাড়ি না গিয়ে ই বাড়ি এলে কেনে? ই কি তুয়ার ঘর? না তুয়ার শ্বশুর ঘর?

মেয়েটা ঝিমিয়ে পড়েছে দেখে শীতল আবার গলা খাঁকরি দিয়ে বলে,

—ই খানে এলে কেনে?

—কনে যাবো? বাপ মা ছোটোবেলাতেই নাই। মামার ঘরে মানুষ। বিয়া দিলে বাঁচে ওরা। আসফাকের বাপরে মনে ধরল। পলাইলাম উহার সনে। আসফাকের বাড়িতেও তো মেনে নেয়নি। আমারে ছাড়াই বাপ বেটা গাঁয়ে আসত। ই রোগখানার জন্যই সব কামকাজ বন্ধ হল। আর আসফাকের বাপ আমাদের নিয়া বাড়ির দিকে হাঁটছিল। তা দিল্লি কি ইখানে? কত- দূ- র! ক-ত হেঁটে হেঁটে…

আর কথা বলতে পারল না আমিনা। নেতিয়ে পড়ল খড়ের গাদার ওপর।

ওদিকে শীতলের বাপ কানু মোড়ল ঘরে ফিরে এসে হাঁকাহাঁকি করছে। মাস্টার ও পাড়ার আরও কয়েকজন সঙ্গে এসেছে। শীতল সবাইকে আশ্বস্ত করল। ও কিছু না। সৎ মা’টা বড্ড ভীতু। একটা পাতি শেয়াল মাত্র। দরজা খুলতেই ভয়ে দে দৌঁড়। হো হো করে হাসতে লাগল শীতল। ওর হাসির উচ্চরবে নবজাত বাছুরটাও কেপে উঠল।

—থাক আর হাসতে হবে নি। গোহালটা দেখে আয় একবার। আর হাঁসমুরগিগুলোও দেখে আয়। সব ঠিক আছে কিনা? তরু, মাস্টারকে চা দে।

কানু মোড়ল নিজে ঘর থেকে মোড়া এনে মাস্টারকে বসতে দিল। বাকি সবাইকে বসার জন্য একটা গোলপাতার মাদুর বিছিয়ে দিল। তরু সবার জন্যই চা নিয়ে এল। রিলিফের বিলিবন্টন নিয়ে অনেকক্ষণ ওদের মধ্যে কথা হল। শীতলের এসব কথায় কোনও আগ্রহ নেই। কিন্তু একটা আলোচনা কানে আসতেই ও সজাগ হয়ে পড়ল। মাস্টারই কথাটা বলেছে।

—আমাদের খুব সজাগ থাকতে হবে। গাঁয়ে বাইরের লোক এলেই যেন নিজেদের ঘরে যেতে না পারে। ইস্কুলবাড়িতেই তো রাখতাম। কিন্তু রিলিফের জিনিষপত্র সব ওখানে রাখতে হচ্ছে। এখন আমাদের অন্য জায়গা ভাবতে হবে। যেখানে ১৪ দিন বাইরে থাকা আসা লোকেদের রাখা যায়। এর মধ্যে যদি জ্বর সর্দি কাশি না হয়, সুস্থ থাকে তাহলে গাঁয়ের ভেতর যার যার ঘরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।

—আর চোদ্দদিন বাদে যদি জ্বরটর হয়?

মধু আলটপকা জিজ্ঞেস করলে কানু থামিয়ে দিল।

—তখন দেখা যাবে। এই চোদ্দ দিন অশৌচ কীভাবে পালন করাব ওদের? এটাই এখন ভাবার।

আসাদ একটা সমাধান দিল,

—কেন? কোনও গাছের ওপর তো থাকতে পারে ওরা। গাঁয়ের মানুষই তো। শহরে গেলেও গাছে চড়তে কি ভুলে গেছে? নীচ থেকে খাওয়ার, জল দড়ি বেঁধে দেওয়া হবে। গাছের তো আর এই অসুখটা ধরবে না। আর চোদ্দদিন বাদে ওরা যদি সুস্থ থাকে তাহলে স্নান সেরে পরিষ্কার হয়ে গাঁয়ে ঢুকুক?

—আর গাছের ওপর থাকতে গিয়ে লতায় কাটলে?

পানু হালদার জিজ্ঞেস করল।

এই বনবাদাড়ের জায়গায় সাপখোপ কম নেই। তাছাড়া জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ। গাছের ওপর থাকার কথাটা কারোরই মনঃপূত হলো না। বেশীরভাগেরই বাড়ির কেউ না দূরে কোনও শহরে কাজ করতে গেছে। কারো ছেলে, কারো মেয়ে জামাই, কারো ভাই। সবাই নিজের নিজের ঘরের মানুষের কথা ভেবে বেশ চিন্তিত ও শঙ্কিত। হাসপাতাল একটা মাত্র আছে। অত লোক ওখানে ধরবেও না। সবার মধ্যেই বেশ একটা উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে।

মিটিং সেভাবে জমল না। যে যার ঘরে চলে গেলে। ওদের রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হল। তরু আর কানু শুতে গেলেও শীতল বসে রইল। একটা ছোটো লন্ঠ দাওয়ায় জ্বলছে। তরু একবার ডেকেছিল ওকে।

—তোর বাপ তো এখুনি পড়বে আর ঘুমাবে। বাইরে বসে আছিস কেন?

শীতলের চোখে যেন আগুন জ্বলছে। তরু ভয় পেলো। আর ঘাঁটাল না ওকে। রাত গভীর হলে শীতল আবার খড় বিচালির স্তূপ থেকে আমিনাকে বার করল। মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিল। আমিনা চোখ খুলেই জল খেতে চাইল। এইবার আমিনার মুখের দিকে তাকিয়ে শীতল দেখল মেয়েটার বয়স তরুর থেকেও কিছু বেশীই হবে।

—একটু ভাত হবে বাবা? কতদিন যে ভাত খাইনি?

—এই রাতবিরেতে ভাত কোথা পাবো?

মুখে একথা বললেও রান্নাঘরের এককোণে পান্তার জন্য রাখা জলে ভেজানো ভাত থেকে কিছুটা তুলে আনল। ঝুড়ি চাপা দেওয়া একটু তরকারিও আনল। ভাতের থালাটা দেখেই মেয়েটা কেমন অস্থির হয়ে পড়ল। এতক্ষণ ঝিমিয়ে থাকা এই মেয়েটার গায়ে যে একটা পুরুষের শক্তি আছে তা শীতল টের পেল। প্রায় ছিনিয়ে নিল ভাতের থালাটা। তারপর গোগ্রাসে এমনভাবে খেতে লাগল যে শীতলের বিশ্রী লাগল। বাইরে বেরিয়ে এল ও। ওই খাওয়ার কথা মনে পড়লেই বাবার নতুন বিয়ে করা বউ তরুবালার ওকে ঘরের ভেতর ডাকার কথাটা মনে পড়ল। মাথার ভেতর আগুন চাড়া দিয়ে উঠছে।

ঘরের ভেতরের গিয়ে দেখল। থালায় একটা ভাতও নেই। আমিনার চুলে মুখে খড়ের টুকরো লেগে। খড়শুদ্ধ ভাত খেল নাকি? শীতল বেশী ভাবতে পারল না আর। একটা শয়তান যেন মাথার ভেতর বাড়ছে ক্রমে। একটাই কথা বলল শুধু,

—চ্যাঁচাবি না। চ্যাঁচালে গলা টিপে মেরে ফেলব।

যাওয়ার সময় বলে গেল,

—কেউ যদি টের পায় তোকে কুমীরে খাওয়াব।

দরজা খুলে দিয়েই এল। মেয়েটা যেখানে ইচ্ছে চলে যায় যাক। শীতলের আর কোনও আগ্রহই নেই।

ঘরের ভেতর এসে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন সকালে তরুর চিৎকার আর গালাগালিতে ঘুম ভাঙল। বাইরে বেরিয়ে নিজের বাবার মুখ দেখে অবাক হয়ে গেল। চোরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। শীতলের মনে দ্রুত যে প্রশ্নটা চিড়িক দিল,

—তাহলে কি মেয়েটা যায়নি এখনও? বাবাও সকালে খড়কাটার ঘরে গিয়ে ওর মতোই?

তরুকে জিজ্ঞেস করল,

—কী হয়েছে খুলে বলবি তো?

তরু কান্না জড়ানো গলায় প্রায় চিৎকার করেই বলল,

—তুই মিথ্যা বলেছিলি কেনে? শিয়াল কেনে শিয়ালের বাপও আসে নাই। তুর বাপের বিয়া করা বউ এয়েছে।

মুখের ভঙ্গি বিকৃত করে তরু বেশ জোরে সকলকে শুনিয়ে বলল,

—তোর মা বটে। তুকে ছেড়ে আবিদ মাঝির সনে ভেগেছিল শহরে। এখন এই জ্বরব্যধির দিনে আগের সোয়ামীর ঘরে ফিরেছে। তোর মা রে। তুই তো চিনেছিলি। তাই কাল মিথ্যা বললি সবার সামনে?

শীতলের কানে যেন কোনও কথাই ঢুকছে না। মাথার মধ্যে প্রতিধ্বনি হচ্ছে,

—কে? কে বটে? ওই মিয়াছিলা টা আমার মা?

আর কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করে শীতল ছুটল। নদীর দিকে কোথায় যে ছুটে গেল কেউ বুঝতে পারল না। পেছনে কারো ডাকও ও আর শুনতে পারল না। শীতলকে এরপর আর কেউ কোনোদিন দেখেনি। অনেকেই ওকে এক অস্বাভাবিক গতিতে নদীর দিকে ছুটতে দেখেছিল সেদিন। আর নদীর চরে যে কুমীরটা রোদ পোহায় তাকেও শান্তভাবে সেদিন ওই একই জায়গায় বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল।

পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন