প্রতি বছর ২৫শে মে ওয়াইন প্রেমীরা ‘জাতীয় ওয়াইন দিবস’ উদযাপন করে। এই দিবসটি উদযাপনের জন্য সর্বত্র ওয়াইনপ্রেমীরা তাদের প্রিয় রেড ওয়াইন, হোয়াইট ওয়াইন অথবা ব্লাশ গ্লাসে ঢেলে নেন। আজ সারা বিশ্বে গ্লাসের “ক্লিঙ্কিং” শব্দ শোনা যায়।
প্রথম লাইন দুটো পড়ে পাঠকগণ যদি নাক সিঁটকোন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, ভারতীয় জীবনে সুরাপন নিয়ে বাড়াবাড়ি নব কথা নয়। সমুদ্র মন্থনের সময় বারুণী নামে সুরার দেবীকে পাওয়া গিয়েছিল। সোমরসের উল্লেখও পাওয়া যায় বিভিন্ন পুরাণে। মহাভারতে যাদবদের গৃহযুদ্ধের কারণ হিসেবে মদ্যপানকে দায়ী করা হয়েছিল। শোনা যায় চিরকুমার সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, —
‘অভয় দাও তো
বলি আমার wish কী —
একটি ছটাক সোডার জলে
পাকি তিন পোয়া হুইস্কি।’
আর কালিপুজো বা দোলের আগের দিন বিপিনবাবুর দোকানের সামনে লম্বা লাইনের দিকে বঙ্কিম নয়নে তাকিয়ে ‘দখিন দুয়ার খোলা’ এ হেন বাঁকা মন্তব্যের সঙ্গে পরিচিতি বেশ পুরোনো। প্রেমিক সমাজে তো শরৎচন্দ্রের দেবদাস একপ্রকার গৌরবান্বিত।
যাইহোক, ওয়াইন (wine) হলো আঙ্গুরের রস গাঁজন করে তৈরি একটি অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়। এটি সাধারণত আঙ্গুর থেকে তৈরি করা হলেও, অন্য ফল থেকেও ওয়াইন তৈরি করা যায়। গাঁজন প্রক্রিয়ায় খামির (yeast) আঙ্গুরের রসের শর্করাকে ইথানল এবং কার্বন ডাই অক্সাইডে রূপান্তর করে। ওয়াইনের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, যেমন রেড ওয়াইন (লাল আঙ্গুর থেকে তৈরি), হোয়াইট ওয়াইন (সাদা বা হালকা রঙের আঙ্গুর থেকে তৈরি), এবং রোজ ওয়াইন (গোলাপি রঙের আঙ্গুর থেকে তৈরি) ইত্যাদি।
ওয়াইনের অন্যতম প্রধান উপাদান হল রেসভেরাট্রল নামক পলিফেনল, যা আঙ্গুরের খোসায় পাওয়া যায়। গবেষণায় জানা গেছে, রেসভেরাট্রলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যে হৃদরোগ এবং কিছু নির্দিষ্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সাহায্য করতে পারে। অতিরিক্তভাবে, ওয়াইনে ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে, যার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রভাবও কার্যকরী। পাশাপাশি এতে পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন-সি সহ বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে।
ওয়াইন সৃষ্টির দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। ওয়াইন উৎপাদনের প্রাচীনতম প্রমাণ জর্জিয়ায় প্রায় ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, ইরানে প্রায় ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, গ্রিসে প্রায় ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, আর্মেনিয়ায় প্রায় ৪১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এবং সিসিলিতে প্রায় ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাওয়া যায়। চীনে, ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চাল, মধু এবং ফল ব্যবহার করে তৈরি একটি গাঁজানো অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ইতিহাস জুড়ে ওয়াইন ধর্মীয় অনুশীলনের সাথে যুক্ত, কারণ প্রাচীন যুগে গ্রীক এবং রোমানরা ডায়োনিসাস এবং ব্যাচাসের মতো দেবতাদের পূজা করতো ওয়াইনের সাথে। এছাড়াও, প্রাচীন কাল থেকেই ইহুদি ঐতিহ্যে মিষ্টি ওয়াইন ধর্মীয়ভাবে ব্যবহৃত হত এবং খ্রিস্টধর্মে যীশুর শেষ নৈশভোজের সময় ওয়াইন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
ইসলামে ওয়াইনের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, সেই সময়ে আলকেমিস্টরা ওয়াইন-ভিত্তিক ওষুধ এবং সুগন্ধি তৈরির জন্য পাতন ব্যবহার করতেন।
সবচেয়ে পুরনো ওয়াইন ভান্ডারটি আসলে বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিকের মধ্যেই অবস্থিত। আপনি ভাবছেন আরে টাইটানিকতো ডুবে গিয়েছিল! এর সন্ধান পাওয়া যায়, ডুবুরিরা যখন ধ্বংসস্তূপের কাছে নেমে আসে। তারা অবাক হয়ে দেখে যে বেশিরভাগ ওয়াইনের বোতল তখনও অক্ষত ছিল।
দিবসটি পালনের উৎপত্তি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি, যদিও দিবসটির প্রথম উল্লেখ ২০০৯ সালে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক সূত্রগুলি খ্রিস্টপূর্ব ১৩ শতকে ভারতে ওয়াইনের প্রচলন খুঁজে পেতে পারে, তবে সমসাময়িক ভারতীয় ওয়াইন শিল্পের উৎপত্তি ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন দুই অগ্রণী শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ী শ্যামারাও চৌগুলে এবং কানওয়াল গ্রোভার, ভারতীয় মাটিতে তাদের নিজস্ব ওয়াইন উৎপাদনের কাজ শুরু করেন। ২০০০ সালে বাজারে আজকের বৃহত্তম ভারতীয় ওয়াইন উৎপাদনকারী সুলা ভাইনইয়ার্ডসের প্রবেশ সেই সময়ের আশাবাদের প্রতীক। ২০০১ সালে ভারতে ওয়াইন নীতি চালু করে মহারাষ্ট্রই প্রথম রাজ্য, যার ফলে বিপুল সংখ্যক নতুন ওয়াইনারি প্রতিষ্ঠিত হয়। আরও তিনটি রাজ্য ওয়াইন নীতি চালু করে — ২০০৬ সালে মধ্যপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ু এবং ২০০৭ সালে কর্ণাটক।
পরিমিত পরিমাণে ওয়াইন খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা এখানে দেওয়া হল :
হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে : পরিমিত ওয়াইন সেবন হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। ওয়াইনে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, বিশেষ করে রেসভেরাট্রল এবং ফ্ল্যাভোনয়েড, রক্তপ্রবাহ উন্নত করতে, প্রদাহ কমাতে এবং রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে, যা সবই হৃদরোগের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, ওয়াইন এইচডিএল (ভালো) কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে এবং এলডিএল (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে পারে।
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য উন্নত করে : পরিমিত পরিমাণে ওয়াইন সেবন করলে আলঝাইমার এবং পার্কিনসন রোগের মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়। ওয়াইনে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের কারণে মস্তিষ্কের কোষগুলিকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে, একই সাথে মস্তিষ্কে সুস্থ রক্তপ্রবাহকেও উৎসাহিত করে।
পরিমিত পরিমাণে এক গ্লাস ওয়াইন পান করলে মানসিক চাপ কমতে পারে।
বিপাকীয় স্বাস্থ্যকে সমর্থন করে : পরিমিত ওয়াইন সেবন, বিশেষ করে রেড ওয়াইন, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করে এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে দেখা গেছে।
অন্ত্রের কার্যকারিতায় সহায়তা করে : ওয়াইনে থাকা পলিফেনল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার সুস্থ ভারসাম্য বজায় রাখতে, হজমের স্বাস্থ্যকে সমর্থন করতে এবং প্রদাহজনক অন্ত্রের রোগ এবং খিটখিটে অন্ত্রের সিন্ড্রোমের মতো গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ব্যাধির ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
দীর্ঘজীবী হোন : গবেষণায় দেখা গেছে যে পরিমিত ওয়াইন সেবন দীর্ঘজীবী হওয়ার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। ওয়াইনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য, হৃদপিণ্ড এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য এর সম্ভাব্য উপকারিতা সহ, আপনার সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ুতে অবদান রাখে।
যদিও পরিমিত পরিমাণে ওয়াইন সেবন সম্ভাব্য স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদান করতে পারে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। অ্যালকোহল সেবন এবং আপনার স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে আপনার যদি কোনও উদ্বেগ থাকে তবে একজন চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া অপরিহার্য। শুধু তাই নয় ওয়াইন খেতে হলে কখনোই খালি পেটে খাবেন না, এতে গ্যাস অম্বলের সমস্যা বাড়ে। প্রচুর পরিমাণ জল খাবেন এবং সঙ্গে কখনোই মিষ্টি জাতীয় কোন খাবার খাবেন না। ওয়াইন কথার ইতি টানি একটি গল্প দিয়ে —
বাংলা নাট্য জগৎকে জাতে উঠিয়ে ছিলেন বাগবাজারের সিংহ গিরিশ ঘোষ। দুর্দান্ত অভিনয়, স্ক্রিপ্ট রাইটিং …. এক বিরল প্রতিভার অধিকারী এই ব্যক্তি বিখ্যাতও ছিলেন তার মাতলামির জন্য। ঘোর নাস্তিক এই মানুষটির নবজন্ম হয় শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ দেবের সংস্পর্শে আসার পর। মদ খেয়ে টং হয়ে যাবার পর মনে পড়তো একজনের কথা। যাঁর কাছে তাঁর জন্য কোনোদিন দরজা বন্ধ হতো না। শ্রীরামকৃষ্ণ কখনো বলতেন না মদ খেও না। শুধু বলতেন খাওয়ার আগে মাকে নিবেদন করে খেতে। কিন্তু মদ মাকে কেমন করে দেবেন! পরে দেখা গেলো গিরিশচন্দ্র মদ স্পর্শ করতে পারছেন না। ঠাকুর যে জয়কালীর সুধা ঢেলে দিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্রের মনে।
শ্রীরামকৃষ্ণর দংশন যে এমনই। গিরিশ ঘোষের জীবনের চেতনার চৈতন্য জাগিয়ে তুলেছিলেন ঠাকুর। আজো এই চৈতন্যের বড্ড প্রয়োজন, তবেই ধ্বংসের দিকে ছুটে চলা থামবে।
অপূর্ব উপস্থাপনা।
অনেক ধন্যবাদ
খুব সুন্দর লিখেছেন👍,,,,অনেক তথ্য জানা গেলো।
থ্যাঙ্ক ইউ 🌹
Khub bhalo laglo
যদিও আমি সেবন করিনা।