গীতা ঘটক। যার প্রথম পরিচয় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হিসাবে হলেও, শিল্পের অন্যান্য জগতেও ছিল তারা অনায়াস বিচরণ। আকুতোভয়, অসম্ভব ক্ষমতাধর এই সংগীতসাধিকা বহুদিন ধরেই ছিলেন উপেক্ষিতা, অবহেলিতা, বঞ্চিতা। গত ২৩শে জানুয়ারি ছিলো তাঁর জন্মদিবস। আজ তাঁকে নিয়েই নানা ঘটনার মধ্যে স্মৃতিচারন।
পিতা ড. কানাইলাল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। গীতা ঘটকের জন্ম রাজশাহীতে, এরপর চলে যান বার্লিন। সেখান থেকে লখনউ। তারপর শান্তিনিকেতনের পাঠভবন ও সঙ্গীতভবনে অধ্যয়ন।
বিবাহ করেন সাহিত্যিক মনীশ ঘটকের পুত্র অনীশ ঘটক’কে (মহাশ্বেতা দেবীর ভ্রাতা)। মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো ছিলেন অনীশ ঘটক কিন্তু ঘটক পরিবারের যে বিখ্যাত বদগুণ সেই মদ্যপানে আসক্তি ছিলেন অনীশ ঘটক পুরোমাত্রায়। তাই বিবাহিত জীবন খুব একটা সুখের ছিলনা গীতার।
অসাধারণ সুন্দরী আর স্টাইলিশ ছিলেন গীতা ঘটক, পরিপাটি হয়ে থাকতে পছন্দ করতেন সবসময়। কপালের একটা বড় টিপ নজর কাড়তো সকলের। মনের দিক থেকে ছিলেন অসম্ভব সরল এবং সোজা প্রকৃতির। কলকাতার অল ইন্ডিয়া রেডিওর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। কলকাতা সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন, যেখানে তিনি ইংরেজি গণিতের পাশাপাশি সঙ্গীত-সহ অন্যান্য সাবজেক্টও পড়াতেন।
গীতা ঘটকের গান গাওয়ার স্টাইল ছিল সবার থেকে আলাদা, রবীন্দ্রসঙ্গীতে একটি ক্লাসিক্যাল টাচ থাকতো। কারণ তিনি সঙ্গীত সাধনা শুরু করেছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়ে। কঠিন অভ্যাসের ফলে বন্ধুর পথ ধরে কত সহজেই রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করতেন। তাঁর গলা অতি সহজেই যে কোনো দুর্গম সুরশিখরে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারত। গীতবিতান ছিলো কণ্ঠস্থ। মঞ্চে স্বনির্বাচিত গান গাইতেন শুধু নয়, শ্রোতাদের তাত্ক্ষণিক অনুরোধে অজস্র গান গাইতেন বই না দেখে। গান গাইবার আনন্দ তার সর্বাঙ্গ দিয়ে ঝরে পড়তো।
রবীন্দ্র সংগীতের অধিকাংশ গায়িকারাই গান গাইবার সময় চোখ বন্ধ করে গান, শ্রোতাদের চোখে চোখ রেখে গান গান না। গীতা ঘটক গান গাইতেন কেবলমাত্র যেন শ্রোতাদের জন্য — তাদের চোখে চোখ রেখে, একমুখ হেসে, পিঠ সোজা করে, জোড়াসনে বসে, নাচের মুদ্রায় একটি হাত আন্দলিত করে অনায়াসে ছন্দের মতো। তার গান শুনে যেন মনে হতো রবীন্দ্রনাথ তার জন্যই বোধহয় লিখেছেন, ‘আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান।’
দুর্গাপূজো, কালীপুজো ফাংশন জলসা এমনকি শ্রাদ্ধবাসরেও রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন অর্থের বিনিময়ে। শান্তিনিকেতনের ছাত্রী হিসেবে এই প্রথা প্রথম তিনি চালু করেন। নিছক অর্থের প্রয়োজনে নয়, এটা ছিল গীতা ঘটকের প্রিন্সিপাল। এর আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ রবীন্দ্র সংগীতকে এভাবে আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেই পারতেন না।
যেকোনো পরিবেশেই তিনি সহজে খুব মানিয়ে নিতে পারতেন। বিয়ের পর স্বামীর চাকরি সূত্রে চলে যান মুম্বাই। সেখানে অনিশ ঘটকের ছোট কাকা ঋত্বিক ঘটক পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে তখন পড়াতেন। আইপিটি’র ব্যানারে ঋত্বিক ঘটক ‘বিসর্জন’ নাটক করালেন, তাতে গীতা ঘটক অপর্ণা সাজলেন। ঋত্বিক ঘটক খুব স্নেহ করতেন গীতাকে। কলকাতায় নিয়ে এলেন অভিনয় করানোর জন্য। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমায় ছোটবোনের ভূমিকায় অভিনয় করলেন গীতা ঘটক। তারপর প্রচুর অফার আসতে লাগলো কিন্তু অনীশ ঘটকের আপত্তি থাকায় অভিনয় করতে আর পা বাড়ালেন না। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, একটি নদীর নাম’ বলা যেতে পারে। মুম্বাইতে থাকার সময় ‘আমরা’ বলে একটি সংগঠন করেছিলেন, সেটাই পরে ইউথ কয়্যার হয়ে যায়।
অথচ এই গুণী শিল্পীর জীবনের ছন্দপতন ঘটতে শুরু করে তাঁর মৃত্যর বহু বছর আগে থেকেই, যখন সরকারি বেসরকারি সমস্ত সংস্থা তাকে গান গাওয়ার অনুষ্ঠানে ডাকা বন্ধ করে দিল। গীতা ঘটকের এত গুণমুগ্ধ ভক্ত, বন্ধু-বান্ধব কেউই তার খোঁজ নিতেন না। ব্যতিক্রম ছিল উত্তম কুমারের শিল্পী সংসদ যারা তাকে মাসে মাসে এক হাজার টাকা দিতেন। উত্তমকুমার নিজে ছিলেন গীতা ঘটকের গানের ভক্ত। দুজনে দুজনকার ভালো বন্ধুও ছিলেন। একটি ঘটনার কথা বলি…
কৃষ্ণচন্দ্র দের জন্মদিনে মান্না দে গান গাইবেন কলকাতার রবীন্দ্র সদনে। হল কানায় কানায় ভর্তি। মান্নাদের অনুরোধে অনুষ্ঠানে শুরুর দিকে কয়েকটি রবীন্দ্র সংগীত গাইলেন গীতা ঘটক। দর্শকেরা হয়তো গীতা ঘটকের গান শুনতে আগ্রহী ছিলেন না, তাই চার নম্বর গান গাওয়ার সময় জনকণ্ঠে প্রত্যাখ্যান ধ্বনিত হলো। ‘গুরুদেব মান্না দে, মান্না দে’ বলে হল্লায় ভরে গেল হল। হারমোনিয়াম দূরে ঠেলে কঠিন মুখে গীতা ঘটক দর্শকের উদ্দেশ্যে বললেন,’ এখানে গানের শ্রোতাও নেই, সামান্য সৌজন্যতা বোধটুকু অব্দি নেই।’
গীতা ঘটকের সাথে শেষ জীবনের মিল ছিলো দেবব্রত বিশ্বাসের। খুব স্নেহ করতেন জর্জ বিশ্বাস গীতা ঘটককে। রাসবিহারীর বাড়িতে এলেই বিড়িটিরি সব সরিয়ে ফেলতেন কারণ গীতা ঘটক একদম বিড়ি খাওয়া পছন্দ করতেন না। জর্জ বিশ্বাস গীতাকে বলতেন, ‘এই তুই আসছস তাই সিগারেট আনছি’। জর্জ বিশ্বাসকে যখন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে ডাকা হতোনা, শান্তিনিকেতনে তখন নিজের বাড়িতে জর্জ বিশ্বাসকে ডেকে গানের আসর বসাতেন গীতা ঘটক।
জর্জ বিশ্বাস বলতেন, ‘তুই আমার সঙ্গে গান গাস না। তোকেও বাদ দিয়ে দেবে’। গীতা বলতেন, ‘আমাকে বাদ দেবে, গাওয়া তো বন্ধ করতে পারবে না। গান গাওয়া তো আমার পেশা নয়, আমার পেশা পড়ানো। কাজেই আমাকে কেউ ভয় দেখাতে পারবে না।’
‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে..’ নিজের সবটুকু দিয়ে গান গাইতেন গীতা ঘটক। এই বাড়িতে সুরের সঙ্গ-সুধা-রেশ রেখে চলে যান গীতা ঘটক।
“যে দিন ফুটল কমল কিছুই জানি নাই
আমি ছিলেম অন্যমনে।
আমার সাজিয়ে সাজি তারে আনি নাই
সে যে রইল সংগোপনে।”
পরিবেশনে ত্রুটি নেই।খুব সুন্দর।
ধন্যবাদ