তিনি সুচিত্রা সেন। তার নিভৃত জীবন যাপন মনে করায় হলিউড কিংবদন্তি গ্রেটা গার্বো’কে। জীবনের তিনদশকেরও বেশি সময় ধরে শহরের পোস্টার ও ফ্লিম পাবলিসিটি থেকে ছিলেন যোজন দূরে। নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন এক নিভৃত জীবন যাপনের মধ্যে। কিন্ত কেন? আজকের প্রতিবেদন তাঁকে নিয়েই।
বাংলাদেশের পাবনার এই মেয়েটির ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসার আগে নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায়। পরিচালক বিমান রায়কে মামা বলে ডাকতেন সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেন। সেই সুত্রেই ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি সুচিত্রা অভিনীত এই ছবিটি।
কিন্তু এরপর থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত যে ৬১টি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন তাতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার ছবি মহানায়িকা। সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব থেকে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। উত্তমকুমারের সঙ্গে তার কিংবদন্তি জুটির সাড়ে চুয়াত্তর থেকে ত্রিশটি ছবিতে কাজ করেছেন তারা। তাঁর বিপরীতে যে নায়কই থাকুন না কেন, চিত্রনাট্য নিয়ে তিনি ছিলেন বেজায় খুঁতখুঁতে। হাতে সময় না থাকার জন্য তিনি সত্যজিতের দেবী চৌধুরানীতে কাজ করতে পারেননি এবং শেষ পর্যন্ত ছবিটিও হয়নি।
সুচিত্রার স্বতন্ত্র স্টাইলে কথা বলা, চোখের চাহনি, শাড়ি পরা, হাসি, চলাফেরা, অসাধারণ অভিনয়শৈলী বাংলা চলচ্চিত্রে একচেটিয়া সাফল্য পাওয়ার পাশাপাশি বলিউডেও দখল করে নেয় মজবুত আসন। প্রথম হিন্দি ছবি দেবদাসের জন্যও শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান ।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গুলজারের অনুরোধে ১৯৭৫ সালে ‘আঁধি’ সিনেমায় আজাদীর ভূমিকা করেন। অনেকেই মনে করেন চরিত্রটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তুলনীয়। ‘দেবদাস’, ‘মমতা’র মতো ছবিতে তাঁর অভিনয় অগণিত দর্শককে মুগ্ধ করেছিল।
১৯৭৮ সালে প্রণয় পাশা ছবিতে তাঁর শেষ অবতরণ। ‘প্রণয় পাশা’ ছবিটি তৈরি হয়েছিল রেখার হিন্দি সিনেমা ‘খুন ভারি মাং’ ছবির মতো। ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ভিলেনের রোলে সেই সময় নায়িকা সুচিত্রার চেহারায় সামান্য মেদ চলে আসে কিন্তু অভিনয়ের দাপট ছিল সেই আগের মতই। ছবিটি ফ্লপ হয়। ৫০ থেকে ৭০ দশক যিনি টালিগঞ্জের বক্স অফিস মাত করিয়ে রাখতেন, হঠাৎ করেই এই নিরাশা মুহুর্তে ভেঙে দিয়েছিলো সুচিত্রাকে। এর পর থেকে জনসমক্ষে আসা তিনি ক্রমক্রমে কমিয়ে দিতে শুরু করলেন, নিলেন স্বেচ্ছায় নির্বাসন।
অর্থ যশের বিরাট মোহের হাতছানি উপেক্ষা করে কিভাবে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া যায় যায় তা সুচিত্রা সেনের কাছ থেকে ছিল শিক্ষনীয়। অনেকটা উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রিলিউড কাব্যগ্রন্থে নির্জন বাসের মতো। ১৯৭৮ সাল থেকে তার মৃত্যু ২০১৪ সাল অব্দি তিনি ছিলেন একেবারেই নিভৃতচারিণী।
মনকে শান্ত করতে ছুটে যান বেলুড় মঠের গুরু ভরত মহারাজের কাছে। মহারাজ শোনালেন সেই অমোঘ বাণী, ‘মা লোভ কোরো না।’ এই মন্ত্রই যেন সুচিত্রার জীবনের শেষ অব্দি চলার পাথেয় হয়ে ওঠে। সমস্ত কামনা বাসনা ত্যাগ করে নিজেকে ঘর বন্দী করে ফেললেন। এর পরে দক্ষিণেশ্বর বা বেলুড়ে কদাচিৎ যেতেন নিজের চেহারা আড়াল করে। সঙ্গে নিয়ে যেতেন দুই নাতনী রাইমা আর রিয়াকে। অধিকাংশ সময় নিজের চেহারা বোরখায় অথবা খুব বড় সানগ্লাস ও রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখতেন সর্বদা।
এরপর আবার জনসমক্ষে আসেন ১৯৮০ সালে ভোর রাতে মহানায়কের মৃত্যুর দিনে তার বাড়িতে। উত্তমকুমারের নিথর দেহে মালা পরিয়ে পাশে বসেন, মুখে একটাই কথা বললেন, ‘আমি হেরে গেলাম উত্তম’। কিন্তু সেখানেও সাংবাদিকদের ক্যামেরা ঝলকে উঠলো। সেই বছর তিনি বইমেলাতেও যান কিন্তু তাঁর আসার খবর রটে যাওয়ায় তিনি আর বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। ১৯৮২ সালে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে গোষ্ঠ কুমারের মেকআপে এসেছিলেন। ব্যস, এই শেষ। ১৯৯৫ সালে ভোটার কার্ডে ছবি তোলার জন্য একবার অন্তরাল ভেঙে বেড়িয়েছিলেন বটে কিন্তু ওই শেষ। ওই রহস্যে ঘেরা মায়াজাল ভাঙতে পারেননি সাধারণ।
ভোট দিতে যাওয়ার সময় ওর সমস্যা হয়, ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজেই ছিল তার বুথ। রাতে ঘাঁটি গেড়ে বসলেন সাংবাদিকরা। পরিচিত প্রিমিয়ার পদ্মিনী গাড়ি থেকে নামতেই শাটার পড়ল কয়েক হাজার। অসম্ভব সুন্দরী এবং স্মার্ট ছিলেন সেই ৬৫ বছর বয়সেও।
২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য সুচিত্রা সেন মনোনীত হন, কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতে দিল্লি যাওয়ায় আপত্তি জানানোর কারণে তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হয় নি।
তিনি সারাজীবন যোগাযোগ রাখেন সাংবাদিক গোপাল কৃষ্ণ রায়ের সঙ্গে, যিনি সংবাদ সংস্থা ইউএনআই-এর সাথে কাজ করতেন। গোপাল রায় সুচিত্রা সেনকে নিয়ে চারটি বই লিখেছেন। সাংবাদিক গোপালকৃষ্ণ রায়ের বইতে পাওয়া যায় এই তথ্য।
বাংলার গ্রেটা গার্বোর চরিত্রের আরেকটি দিক ছিল, তিনি খুব হাস্যরসিক ছিলেন। তার সম্পর্কে কয়েকটি গল্পর একটি বলি — একবার, মিসেস সেন রায়কে বলেন, তিনি একজন ডাক্তারকে (ইউরোলজিস্ট) দেখতে চান। তাই রায় কলকাতার সবচেয়ে পরিচিত ইউরোলজিস্টদের একজনকে তার বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাকে দেখে চলে যাওয়ার পরে, মিসেস সেন রায়কে বললেন, “আচ্ছা, আপনার ডাক্তার অন্তত ১০ মিনিটের জন্য আমার হাত ধরেছিলেন!” রায় উত্তর দিলেন, “তিনি নিশ্চয়ই আপনার নাড়ি পরীক্ষা করছেন। কিন্তু মিসেস সেন হেসে ফেললেন এবং বললেন, “এমনকি আমিও জানি কিভাবে নাড়ি দেখতে হয়। তিনি শুধু আমার নাড়ি পরীক্ষা করছেন না বলা কিন্ত বেশ মুস্কিল।”
আরেকটি ঘটনা বলি (রায়ের ভাষায়)। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সন্ধ্যার সময় হাঁটার অভ্যাস ছিল সুচিত্রা সেনের। একদিন রাত সাড়ে নয়টায় হঠাৎ করে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ভদ্রলোক তাকে চিনতে পারলেন এবং থামলেন এবং বললেন তিনি একটি অটোগ্রাফ চান। আমি জানতাম না মিসেস সেনের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। কিন্তু তিনি হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে। একটা কাগজ আর কলম দাও।’
লোকটি বলল তার কাছে কলম বা কাগজ নেই। তাই সে আমার দিকে ফিরে গেল। আমি বললাম আমার কাছে কলম আছে, কিন্তু কাগজ নেই। মিসেস সেন হঠাৎ নিচু হয়ে রাস্তা থেকে একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিলেন এবং সেটিকে ছিঁড়ে ফেললেন। খোলার উল্টো পরিচ্ছন্ন দিকে, তিনি তার অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন।
এই ঘটনা রায় যতবার স্মরণ করেছিলেন তিনি অবাক হয়েছিলেন। এতটাই অমায়িক মানুষ ছিলেন সুচিত্রা সেন।
খুব সাধারন সাদামাটা স্বল্পহারি জীবন যাপন করতেন নায়িকা। তার ঘরে সাধারণ তক্তপোষ দেখে গোপাল কৃষ্ণ রায় প্রশ্ন করেছিলেন। সুচিত্রা বলেছিলেন, এটাই তো হবে তার শেষ যাত্রার সঙ্গী। এটাই তো জীবনে বাস্তবতা।
শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ এবং মা সারদার ভক্ত মহানায়িকা প্রায় সাংবাদিকদের বলতেন, ঠাকুরের তিনি যা আশীর্বাদ পেয়েছেন তা তার কাছে অমৃতের সমান। আর অমৃত খাওয়ার পর কি কারো দোকানের লিকার চা পছন্দ হয়!! তাইতো সমস্ত কিছু লোভ মায়া মোহ ছেড়ে তিনি নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় নির্বাসন
মহানায়িকাকে নিয়ে লিখতে বসলে লেখা হয়তো শেষ হবেনা। আজ সুচিত্রা সেনের ৯৩ তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ সমৃদ্ধ হয়েছিল যার আগমনে, যার সম্মোহনী রসায়ন ছাড়া বাংলা চলচিত্র ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না, জন্মদিনে সেই মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে জানাই একরাশ শ্রদ্ধা।
very useful & informative.
keep it up.
Thank you for your unwavering support
স্বেচ্ছাবন্দি সুচিত্রায়ন লেখাটি পড়ে খুবই ভালো লাগলো। অনেক অজানা কিছু ঘটনা জানলাম।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
বাহ!
থ্যাঙ্ক ইউ