যাত্রা একসময় ছিল তাঁর কাছে স্বাধীনতার লড়াই। গ্রামে গ্রামে মানুষের কাছে গিয়ে অভিনয় করে তিনি চেয়েছিলেন লোকশিক্ষার মাধ্যমে জনজাগরণ ঘটাতে। তাই একদিন তিনি অ্যামেচার থেকে চলে এসেছিলেন পেশাদারী যাত্রায়। সেটা ১৯৪১ সাল। জাপানি বোমার ভয়ে তখন সবাই কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছেন। তখন যাত্রাদলে তৈরি হয় শূন্যতা। শিল্পীর অভাব। সেই অভাব মেটাতে শহরের অ্যামেচার শিল্পীদের ডাক পড়ে। এভাবেই তিনি যোগদান করলেন পেশাদারী যাত্রায়। ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর জন্ম। দীর্ঘ ৪৮ বছরের অভিনয় জীবন ছিল তাঁর। তিনি হলেন যাত্রার জনপ্রিয় অভিনেতা মোহিত বিশ্বাস। যিনি নিজেই ছিলেন একটা ঘরানা।
বাবা মারা যাওয়ার পর মোহিত বিশ্বাস মায়ের হাত ধরে মুর্শিদাবাদের সুজাপুর থেকে এই শহরে চলে আসেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র দশ বছর। শুরু হয় জীবনযাপনের লড়াই। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে যোগাযোগ ঘটে বিপ্লবী দলের সঙ্গে এবং পাশাপাশি শুরু হয় অ্যামেচার অভিনয়।
’৪২ এর আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। কলকাতায় গুলি চলল। অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। কিন্তু জখম হলেন। নবদ্বীপে গিয়ে আত্মগোপন করে চলল চিকিৎসা। সুস্থ হয়ে ’৪৩ সালে যোগ দিলেন রায় অপেরায়। পালা ছিল ‘আকালের দেশ’ এবং ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’।
১৯৪৬ সালে নবশক্তি অপেরায় মোহিত বিশ্বাস অভিনয় করলেন ‘ক্ষুদিরামের ফাঁসি’ পালায়। শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন রচয়িতা ও নির্দেশক। দলে ছিলেন পূর্ণেন্দুশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, নন্দদুলাল রায়চৌধুরী প্রমুখ। তখন দেশজুড়ে স্বাধীনতার আন্দোলন তুঙ্গে। মানুষের প্রাণে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রবলতর হয়ে উঠেছে। সুপারহিট হল পালা। সেই পালা চলল পরের বছরও। স্বাধীন ভারতের বুকে যেন বয়ে গেল এক আনন্দলহরী। খ্যাতির পথে চলা শুরু হল মোহিত বিশ্বাসের।
এরপর একে একে করলেন নন্দবাবুর ‘বিদ্রোহী সন্তান’ (রৌদ্রাসুর), ‘জরাসন্ধ বধ’ (কালযবন), সৌরীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভক্ত হরিদাস’ (গোরাই কাজী), ‘শুম্ভ-নিশুম্ভ’ (রক্তবীজ)। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পেতে লাগলেন। সেই সময় সহ অভিনেতা হিসাবে পেয়েছিলেন মহেন্দ্র গুপ্তকে। ‘পাঞ্জাব কেশরী রণজিৎ সিং’ পালায়। নীতীশ মুখোপাধ্যায়কেও তিনি পেয়েছিলন সহ অভিনেতা হিসাবে। ‘মিশরকুমারী’তে নীতীশবাবু করতেন আবন আর মোহিত বিশ্বাস খারেব। সহ অভিনেতা হিসাবে পেয়েছিলেন বড় ফণী, ছোট ফণীকেও।
ছয়ের দশকের অনেকটা সময় তিনি অভিনয় করেছিলেন গণেশ অপেরায়। সেখানে ‘মসনদ’, ‘অভিনয়’, ‘পরিচয়’, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘যাযাবর’, ‘পাপ ও পাপী’, ‘দেবী অষ্টভূজা’, ‘আগুন’, ‘সম্রাট নাদির শাহ’ প্রভৃতি বিখ্যাত পালায় অভিনয় করেছেন। সেই সময় সহ অভিনেতা হিসাবে পেয়েছিলেন গোপাল চট্টোপাধ্যায়, অনাদি চক্রবর্তী, গুরুদাস ধাড়া, গোরাশশী মণ্ডল, পশুপতি ঘোষ, রাধারমণ পাল, বীণা ঘোষ, বাবলী রানী, সন্তোষ রানী প্রমুখকে।
নাট্যভারতীতে তিনি গেলেন ১৯৬৮ সালে। এই সময় ‘বাঁশের কেল্লা’ পালাটি মানুষের কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠে। সেই পালায় ‘তিতুমির’ চরিত্রটি অভিনয় করে মোহিত বিশ্বাস প্রচুর খ্যাতি ও পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই পালায় অভিনয় চলাকালীন অসুস্থ হয়ে মারা যান ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ বা বড় ফণী। সেবার ‘বাঁশের কেল্লা’ পালার অভিনয় হয়েছিল বোম্বাইয়ে। ওখানে বাঙালিদের দুর্গাপুজোর মণ্ডপে। পুজোর পাঁচদিন অভিনয় হয়েছিল শিবাজি পার্ক এবং ক্রস ময়দানে। বোম্বাইয়ের বাঙালিরা সেই পালা দেখেছিলেন। বলিউডের বাঙালি অভিনেতারাও এসেছিলেন। তার মধ্যে ছিলেন অশোককুমার, তাঁর ভাই অনুপকুমার, বিপিন গুপ্ত, বেলা বোস, শশধর মুখার্জি সহ আরও অনেকেই। সেই অভিনয় দেখে তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। মোহিত বিশ্বাসকে জড়িয়ে ধরে অশোককুমার বলেছিলেন, ‘অসাধারণ। বাংলা যাত্রা এতো সমৃদ্ধ হয়েছে, তা জানতামই না।’ রুস্তম চরিত্রে প্রশংসা পেয়েছিলেন অসীমকুমারও।
এরপর মাধবী নাট্য কোম্পানি। সেখানে তাঁর অভিনীত বিখ্যাত পালাগুলি হল, ‘মার্ডার’, ‘হেডমাস্টার’, ‘রিকশওয়ালা’ প্রভৃতি। রিকশওয়ালায় ভজনের ভূমিকায় তিনি সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে মোহন চট্টোপাধ্যায় লিজ নেন গণেশ অপেরা। সেই সময় ওই দলের হিট পালাগুলি ছিল, ‘বামাক্ষ্যাপা’, ‘ভুলি নাই’, ‘ঘুমন্ত পৃথিবী’, ‘সন্তান’, ‘হাটে বাজারে’। এই পালাগুলিতে মোহিত বিশ্বাসের অভিনয় ছিল দাগকাটার মতো। তখন এই দলে ছিলেন গোপাল চট্টোপাধ্যায়, মোহন চট্টোপাধ্যায়, মিতা চট্টোপাধ্যায়, আনন্দময় বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এই গণেশ অপেরাতেই তিনি পরে করেছেন ‘পলাতক’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতীর মাঠ’, ‘কথার দাম’। সবকটিই হিট পালা। ১৯৮৩ সালে গণেশ অপেরায় তিনি অভিনয় করলেন ‘মহুয়া বসন্ত’ এবং ‘মন্দিরে আজান’ পালায়। নির্দেশনায় ছিলেন তিনিই।
১৯৭২ সালে মোহিত বিশ্বাস গেলেন প্রভাস অপেরায়। সেবার ওই দলের বিখ্যাত পালাগুলি ছিল ‘ভক্ত কবীর’, ‘বাঁচতে চাই’ এবং ‘মেজবৌ’। নাট্যপরিচালনা ছিল তাঁরই। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন শিবদাস মুখোপাধ্যায়, রাধারমণ পাল, বাবলু ভট্টাচার্য, প্রণয় কুমার, জয়শ্রী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
পরে এক বছর অভিনয় করেছিলেন সুশীল নাট্য কোম্পানিতে। সেখানে পালা ছিল ‘সুখের সন্ধানে’ ও ‘স্বর্ণলতা’। ১৯৮৬ সালে তিনি তপোবন নাট্য কোম্পানিতে ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ পালায় রাবণের চরিত্রে অভিনয় করলেন। রাম চরিত্রে ছিলেন মনোজকুমার, মন্দোদরীর ভূমিকায় ছিলেন গীতাঞ্জলি।
তখন পর্দায় শক্তি সামন্তের ‘অনুসন্ধান’ সুপারহিট ছবি। সেটা যাত্রায় হল। ভোলানাথ অপেরায়। শম্ভু সিনহা তখন মারা গিয়েছেন। তাঁর ভাই অশোক সিনহা যাত্রায় এলেন। অশোক করতেন অমিতাভ বচ্চনের চরিত্রটা এবং মোহিত বিশ্বাস করতেন আমজাদ খানের চরিত্রটা। কিছুদিন পরেই চরিত্র বদল করতে হল। মোহিত বিশ্বাস চলে গেলেন উৎপল দত্তের চরিত্রটায়। আমজাদের চরিত্রে স্টেজে মারামারির সময় খুব ডিগবাজি খেতে হতো, ছিটকে পড়তে হতো। ওই বয়সে আর সেই ধকল নিতে পারতেন না। মাঝে মাঝেই হাঁটুতে, কোমরে চোট লাগত। তাই উৎপল দত্তের চরিত্রে চলে গিয়েছিলেন।
অন্যান্য যেসব পালায় অভিনয় করে তিনি আনন্দ ও খ্যাতি পেয়েছিলেন সেগুলি হল, ‘ধর্মের বলি’ (মুর্শিদকুলি খাঁ), ‘দেবী চৌধুরানী’ (ব্রজেশ্বর), ‘অভিনয়’ (আকবর সর্দার), ‘হে অতীত কথা কও’ (রাজ্যবর্ধন), ‘হাটে-বাজারে’, ‘পলাতক’ (আংটি চাটুজ্জে), ‘কলিকালের বউ’, ইত্যাদি।
মোহিত বিশ্বাস শুধু একজন অভিনেতা বা নির্দেশক ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বড় নাট্য পরিচালক এবং শিক্ষকও। যাত্রাপ্রেমী প্রবীণ মানুষ স্বদেশ রায়। তাঁর মূল্যায়ণ, ‘মোহিত বিশ্বাস যত বড় শিল্পী, তার থেকেও বড় শিক্ষক। তাঁর হাত দিয়ে যে চিৎপুরের কত শিল্পীর সৃষ্টি হয়েছে এবং কত নাট্যকারের জন্ম হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তিনি নিজে যেমন অভিনয় করে গিয়েছেন, তেমনই প্রজন্মও তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁর মতো উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবেই আজ যাত্রার এই দুর্দশা’।
যাত্রা গবেষক দিবাকর ভৌমিক বলেছিলেন, ‘মোহিত বিশ্বাস এবং পঞ্চু সেন ছিলেন এক ঘরানার শিল্পী। বহুবার দেখা গিয়েছে পঞ্চু সেন দল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। পরের বছর মোহিত বিশ্বাস গিয়ে সেই চরিত্রে অভিনয় করতেন। যেমন বিনয় বাদল দীনেশ। সেখানে পঞ্চু সেন যে চরিত্র করেছিলেন, সেটাই মোহিত বিশ্বাস করেছিলেন। আবার উল্টো ঘটনাও আছে। কোনওবার হয়তো মোহিত বিশ্বাস অন্য দলে চলে গেলেন। সেবার পঞ্চু সেন এসে মোহিতবাবুর চরিত্রটা অভিনয় করতেন। আসলে পঞ্চু সেনের অভিনীত কোনও চরিত্রে রূপ দেওয়া অন্য কোনও শিল্পীর কাছে ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু মোহিতবাবুর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস থাকায় তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে সেই চরিত্রটিকে নতুনভাবে উপস্থাপিতও করতে পারতেন।’
মোহিত বিশ্বাসের সুযোগ্য শিষ্য অসীমকুমার আজও জীবিত। তিনি বলেছিলেন, ‘মোহিতদার কাছে অনেক কিছু শিখেছি। তাঁর কাছে যাত্রা ছিল ধর্মের মতো। তাই কোনও আপসেই তিনি যাত্রাধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। অসাধারণ সম্পাদনা করতে পারতেন। যে কোনও দুর্বল পালাকে ঠিক দাঁড় করিয়ে দিতেন।’
১৯৮৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রয়াত হন এই শিল্পী। অনেক কাছ থেকে দেখেছি তাঁর জীবন ও অভিনয়। তাঁর কাছে শুনেছি অনেক কথা। কেন না তিনি ছিলেন আমার বাবা।