তন্দ্রার কনেসাজা ছবিটা সাদাকালো। অনাদরে আর সময়ের চাপে ছবিটা হলদেটে হয়ে গেছে। ছবিটা কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়, তন্দ্রা একসময় সুন্দরী ছিল। ঠাকুমা ছড়া কাটত, নাক ডুবুডুবু চোখ ভাসা/সেই মেয়েকে দেখতে খাসা।
তন্দ্রার প্রাইভেট টিউটর হেমন্ত বলেছিল, তোমার মুমতাজের মত টিল্টেড নাক। হেমন্তই ছিল তন্দ্রার প্রথম প্রেমিক।
তন্দ্রা সেই প্রথম টিল্টেড শব্দটা শুনল। হিরোইনের সঙ্গে তুলনায় তার মনে তখন খুশির খই ফুটছে। বন্ধুদের বারবার জিজ্ঞেস করত, মুমতাজকে তোদের কেমন লাগে রে? আমার সঙ্গে কি কোনো মিল আছে? বন্ধুদের ঠোঁট বাঁকানো উত্তর অবশ্য খুব একটা মনে ধরেনি তন্দ্রার।
নিজেকে অন্যের চোখের আয়নায় তন্দ্রা প্রথম ভালো করে দেখল দিদির বিয়ের সময়। তন্দ্রার একমাত্র দিদি চন্দ্রা। বাসর রাতে জামাইবাবু, তাদের বন্ধুরা তন্দ্রাকে নিয়ে বেশ মাতামাতি করেছিল। বরের বন্ধু বরুণদা তো ফিল্মি কায়দায় হাত বাড়িয়ে গেয়েই উঠল, কে তুমি তন্দ্রাহরণীইইই।
তারপর থেকেই তন্দ্রা নিজের রূপে ডগমগ। তার কলেজ যাওয়া শুরু হতেই বাড়ল সাজগোজ। চুলের কাঁটার ডগায় কাজল দিয়ে চোখ আঁকত। কৌটোভরা টিপের রঙ দিয়ে কত কারিকুরি। রাস্তার ধাপি থেকে ছোকরাদের টুকরো উড়ে আসা মন্তব্য, সিটি মন্দ লাগতনা।
দিদির বিয়ের পর তন্দ্রার নিজের বিয়ের ইচ্ছেটা যেন প্রবল হল। দিদির বিয়ের শোলার সিঁথিমৌর একবছর ধ’রে ঘরে রয়ে গেছে। সবার চোখের আড়ালে তন্দ্রা সে মুকুট মাথায় দিয়ে আয়নায় একবারটি নিজেকে দেখে নেয়।
চন্দ্রা আর তন্দ্রা প্রায় পিঠোপিঠি। বাড়িতে অবশ্য তন্দ্রার বিয়ে নিয়ে তখনো কোনো কথাবার্তাই শুরু হয় নি। বড় মেয়ের চন্দ্রার বিয়ের খরচের ধাক্কা সামলে উঠতে পারে নি তাদের মা-বাপ। ইস্কুলের পাঠ চুকে যাবার পর প্রাইভেট টিউটরের সঙ্গে তন্দ্রার গোপন প্রেমটাও কেঁচে গেছে। বিয়ের রঙিন স্বপ্ন যদিও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তন্দ্রাকে। মনের মধ্যে লালিত হচ্ছে একটি সুপ্ত ইচ্ছে।
অঞ্জনাবৌদিকে বললে কেমন হয়? পাশের বাড়ির অঞ্জনা বৌদির সঙ্গে তন্দ্রার খুব ভাব। ওরা একসঙ্গে ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা যায়। বিয়েবাড়ি গেলে তন্দ্রা বৌদির শাড়ি, ইমিটেশন গয়না ধার নেয়। অঞ্জনাবৌদির কাছে তার দাম্পত্যের রসালো গল্প মন দিয়ে শোনে তন্দ্রা। এক নিষিদ্ধ জগতের অজানা দরজা খুলে যায় তার কাছে। সে জগতে যাবার একমাত্র উপায় বোধহয় বিয়ে!
অঞ্জনার কাছে তন্দ্রা একদিন মনের কথাটা পেড়েই ফেলল। অঞ্জনাতো হেসেই খুন। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
— বিয়ে না করেই কনে সেজে ছবি তুলবে? এমন কথা জম্মে শুনিনি বাপু।
— কে জানে বৌদি আমার কবে বিয়ে হবে? আদৌ কি হবে? মা-বাবা তো আমার বিয়ে নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করে না।
— হবে হবে। এত উতলা হচ্ছ কেন তন্দ্রা? বিয়ের ফুল ফুটলে ঠিকই হবে।
— না বৌদি আমার খুব ইচ্ছে করছে। তোমার বাড়িতেই দুপুরবেলা ফোটো তুলব। তুমিই সাজিয়ে দিও আমায়। কেউ যেন জানতে না পারে। আমি দিদির বিয়ের ফোটোগ্রাফারকে বলে রাখব।
একদিন নিঝুম দুপুর তন্দ্রা সেজে উঠল বিয়ের সাজে। তার মস্ত খোঁপা সাজানো হল দিদির বিয়ের লালফিতে-জরির কুঁচি দিয়ে। পরনে বৌদির বেনারসি-গয়না। কপালে পাউডার গুলে কনেচন্দন। মাথায় সেই সিঁথিমৌর। অঞ্জনা বলল,
— ফুলের মালা পরবে না তন্দ্রা? — রজনীগন্ধার গোড়ের মালার বড্ড দাম বৌদি। আমি দর করেছিলাম। পয়সায় কুলোবে না। বাসভাড়ার পয়সা বাঁচিয়ে ফোটোগ্রাফারকে টাকা দিতে হবে আমায়।
অঞ্জনা বাগানের টগরফুল দিয়ে একটি গোড়ের মালা গেঁথে সাজিয়ে দিল তন্দ্রাকে। তন্দ্রার ডাগর চোখে তখন জল।
— এমা, কাঁদছ কেন বোকা মেয়ে! একি সত্যি সত্যি বিয়ে হচ্ছে নাকি তোমার?
কান্না বড় ছোঁয়াচে। অঞ্জনার চোখেও কেন জানি জল ভরে এল। অঞ্জনা ভাবল, চোখের জলটা মেয়েদের বিয়ের সাজের এক অঙ্গ বোধহয়। ওটা ছাড়া কনেকে কি মানায়?
চিত্রা স্টুডিওর ফোটোগ্রাফার পরেশ তন্দ্রার দুটি ফোটো তুলল। একটি চেয়ারে বসে ক্লোজআপ। অন্যটি থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।
তন্দ্রা পরেশকে গুনে গুনে অ্যাডভান্স দিয়ে বলল,
— পরেশদা, ছবিগুলো আপনার স্টুডিও থেকে আমি নিজে নিয়ে নেব’খন। আপনাকে বাড়িতে এসে দিতে হবে না আর প্লীজ এ নিয়ে পাঁচ কান করবেন না।
একসপ্তাহ পরে সে ছবি দেখে অঞ্জনা আর তন্দ্রা হেসেই খুন।
— তোমাকে তো একদম আসলি কনের মত লাগছে গো! কি সুন্দর হয়েছে ফোটোদুটো।
— ও তোমার সাজানোর হাতযশ বৌদি।
নিজের ছবি বারবার দেখে আশ আর মেটেনা তন্দ্রার। পড়ার বইয়ের পাতার ভাঁজে লুকোনো রইল সে কনেসাজা ছবি!
এরপরে সত্যিকারের বিয়ে হলেও আশ মিটিয়ে কনে সাজা হয়নি তন্দ্রার। নমোনমো করে একটা বিয়ে হ’ল তার। কোনো ছবিই সে বিয়েতে তোলা হয় নি।
বাসে কলেজ যাওয়া আসার পথে ড্রাইভারের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল তন্দ্রার। বাসড্রাইভারের সঙ্গে বিয়ে কিছুতেই মেনে নেবে না বাড়িতে। তাই বাড়ি থেকে পালাল তন্দ্রা। যাবার আগে অঞ্জনাবৌদির গলা জড়িয়ে আর একবার কাঁদল। অঞ্জনা বলল,
— তুমি কি ঠিক করছ তন্দ্রা? আরেকটু ভেবে দেখতে পারতে।
— না বৌদি আর পেছোনো যাবে না। আসি কেমন?
বিয়ের নেশায় মশগুল তন্দ্রা কলেজ ছাড়ল। বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় কনেসাজা ছবিদুটো অবশ্য সঙ্গে নিতে ভোলে নি। মন্দিরে লুকিয়ে বিয়ে হল তন্দ্রার। তখন নতুন বিয়ের প্রেম। বর প্রদীপ তন্দ্রার কনেসাজা ক্লোজআপ ছবিটা বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছিল।
ধীরেধীরে নোনাধরা, ছ্যাতলা পড়া দেওয়ালে সে ছবি তির্যক ভাবে ঝুলে রইল। সোজা করতে ইচ্ছেও করে না কারোর। সংসারে তাদের নিত্য অভাব, প্রদীপের রোজকার মাতলামো, ঝগড়াঝাঁটি। কনেসাজা ছবিটার দিকে তাকিয়ে তন্দ্রার আজকাল দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
একদিন চূড়ান্ত মদ খেয়ে এসে প্রদীপ গালিগালাজ করেই যাচ্ছে। হঠাৎ তার চোখ আর রাগ গিয়ে পড়ল তন্দ্রার কনেসাজা ছবির ওপর। চিৎকার করে সে বলতে লাগল,
“হারামজাদী, কবে কোথায় বিয়ে করেছিলিস বল। এমনি এমনি কেউ কনে সেজে ছবি তোলে? তোর চরিত্র আমার জানা আছে। ঘাটে ঘাটে জল খেয়ে শেষে আমার গলায় ঝুলে পড়লি। মর শালী তুই।”
রেগেমেগে সজোরে লাঠির এক ঘা মারলো ছবিতে। ছবির কাঁচ ভেঙে খানখান হল। কাঁচের টুকরো ফুলের মত ছড়িয়ে গেল ঘরময়। রাগের মাথায় প্রদীপ সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, সারারাত আর ফিরে এল না।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল তন্দ্রা। ঘুম ভাঙতেই তার চোখ পড়ল কাঁচভাঙা ছবির কনেসাজা ঐ তন্দ্রার দিকে। তন্দ্রা চমকে গেল।
— ওরকম অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে কেন মেয়েটা আজ আমার দিকে? ওটা কি আমিই নাকি অন্য কেউ? কিছু কি বলতে চায় ও আমাকে! কি বলতে চায়? কি বলবে!
তন্দ্রা আর কিছু ভাবতে পারছে না। শরীর আর মন কোনোটাই যেন আর তার বশে নেই। পা থেকে মাথা অবধি তার টলমল করে উঠল।