জোসেফ ওয়েডেমিয়ার (Joseph Arnold Weydemeyer) (১৮১৮-১৮৬৬)
বার্লিন মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে শিক্ষালাভের পরে জোসেফ ওয়েডেমিয়ার প্রুশিয়ার সেনাবিভাগে নিযুক্ত হন। তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল ওয়েস্টফালিয়ান শহর মিনডেনে। সেখানে তিনি ও তাঁর চার বন্ধু — ফ্রিৎজ অ্যানেকে (Fritz Anneke), আগস্ট উইলখ (August Wilch), হেরম্যান ক্রফ (Hermann Kropf) ও ফ্রেডারিখ ভন বিউস্ট (Friedrich von Beust) কার্ল মার্কস সম্পাদিত ‘রাইনিশে সাইতুং’ পত্রিকা পড়ে প্রভাবিত হন।
মিনডেনে ছিল এক সমাজতান্ত্রিক চক্র। জোসেফ সেই চক্রে যোগ দিলেন। ‘রাইনিশে সাইতুং’ (Rheinische Zeitung) পত্রিকার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে লাগলেন। চাকরির দাসত্ব আর ভালো লাগল না। তিনি সৈন্য বিভাগ থেকে পদত্যাগ করলেন। নিজেই এক সংবাদপত্র প্রকাশ করলেন। ১৮৪৫ সালে প্যারিসে নির্বাসিত মার্কস-এঙ্গেলসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষৎ হল।
মার্কসের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীববার সাক্ষাৎ হল ব্রাসেলসে। ১৮৪৬ সালে। জার্মানিতে ফিরে জোসেফ ‘কমিউনিস্ট লিগ’এর কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। সমাজতান্ত্রিকমনোভাবাপন্ন প্রকাশক সি.ডব্লু. লেসকে তাঁকে ‘নিউ দেউসে সাইতুং’ পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালে তিনি সম্মত হন। কিন্তু সে পত্রিকা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ১৮৫০ সালে নিষিদ্ধ হয় পত্রিকাটি।
১৮৫১ সালে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তিনি জীবিকার সন্ধানে চলে আসেন সুইজারল্যাণ্ডে। কিন্তু কোন আলোর রেখা দেখতে পেলেন না। কার্ল মার্কসকে তিনি জানালেন যে তিনি আমেরিকা চলে যাবেন। তাঁর নিউইয়র্কে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন মার্কস। বলে দিলেন জোসেফ যেন সেখানে জার্মান ভাষায় বিপ্লবী পত্রিকা প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। ১৮৫১ সালে প্রকাশিত হল ‘ডাই রেভলিউশন’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় তিনি মুক্ত বাণিজ্য, বুর্জোয়া জাতীবতাবাদী আদর্শ, আমেরিকার শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। কার্ল মার্কসের ‘এইটিন্থ ব্রুমেয়ার অব লুই বোনাপার্ট’ এবং এঙ্গেলসের ‘দ্য পিজেন্ট ওয়ার ইন জার্মানি’ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘টার্ন সাইতুং’ পত্রিকাতেও জোসেফ নিয়মিত লিখতেন।
চার বন্ধুর সঙ্গে জোসেফ গড়ে তুললেন মার্কসবাদী সংগঠন। আমেরিকায় সেটাই প্রথম মার্কসবাদী সংগঠন। সেখানকার জার্মনভাষীদের আকৃষ্ট করেছিল সেই সংগঠন। তাঁর উদ্যোগে ১৮৫৩ সালের ২০ মার্চ গঠিত হল ‘আমেরিকান ওয়ার্কাস লিগ’। কিছুদিন পরে জোসেফ দেখলেন যে লিগের কিছু সদস্য গোপনে সামরিক সংগঠন তৈরি করার চেষ্টা করছে। তখন তিনি লিগ পরিত্যাগ করেন।
লিগ পরিত্যাগ করার পর তিনি মিডওয়েস্টে যান, সেখান থেকে যান মিশৌরী। এখানেই মাত্র ৪৮ বৎসর বয়েসে কলেরা রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
জোহান জর্জ একারিয়াস (Johann Georg Eccarius) (১৮১৮-১৮৮৯)
জোহানের জন্ম থুরিঞ্জিয়ায়। তিনি ছিলেন ‘লিগ অব দ্য জাস্ট’ ও ‘কমিউনিস্ট লিগে’র সদস্য। ১৮৬৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লণ্ডনের সেন্ট মার্টিন হলে ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিংমেনস অ্যাসোসিয়েশনে’র প্রথম সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। পরে এই সংগঠনের জেনারেল কাউন্সিলের সদস্য হন। ৮ বছর তিনি এই সংগঠনের সব সভা. সম্মেলন ও কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন।
১৮৬৭ সালের ৯ জুলাই ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিংমেনস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রবাট শ পদত্যাগ করলে জোহান জর্জ সাংবাদিক পেটার ফক্সের সুপারিশে সে পদ লাভ করেন। তিনি ‘ল্যাণ্ড অ্যাণ্ড লেবার লিগে’র কোযাধ্যক্ষ ছিলেন।
আরনেস্ট অ্যানড্রিজ ডোমিনিকাস ড্রোন্ক (Ernest Andries Dominicus drunk) (১৮২২-১৮৯১)
এই জার্মান লেখক ও সাংবাদিক বিশ্বাস করতেন যে তিনি একজন খাঁটি সমাজতন্ত্রী। পরে তিনি ‘কমিউনিস্ট লিগে’র সদস্য হন এবং ‘নিউ রাইনিশে সাইতুং’এর সম্পাদক হন। ১৮৪৮-৪৯ এর জার্মান বিপ্লবে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পরে তিনি ইংল্যাণ্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
মোজেস হেস (Moses (Moritz) Hess) (১৮১২-১৮৭৫)
মোজেস হেসের জন্ম বনে। তিনি বন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে পড়াশুনো করেন। তিনি সমাজতন্ত্রের প্রথম দিকের প্রচারক। ‘রাইনিশে সাইতুং’এর সাংবাদিক ছিলেন তিনি। সম্পাদক কার্ল মার্কসের সঙ্গে তাই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কারও কারও মতে হেসের কাছ থেকেই এঙ্গেলস কমিউনিজমের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হন।
১৮৪৫ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে মার্কস, এঙ্গেলস ও হেস আশ্রয় গ্রহণ করেন। একই রাস্তায় ছিল তাঁদের বাড়ি। পরে মার্কস-এঙ্গেলসের সঙ্গে তাঁর মতান্তর হয়। ‘জার্মান আইডিয়োলজি’ বইতে হেসের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন মার্কস ও এঙ্গেলস। ১৮৪৮ সালের বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার পরে তিনি সুইজারল্যাণ্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাজনীতি পরিত্যাগ করে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনোয় নিমগ্ন হন।
আগস্ট হেরম্যান ইয়ারবিক (August Hermann Ewerbeck) (১৮১৬-১৮৬০)
প্রুশিয়ার ডানজিগে হেরম্যানের জন্ম। তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেছেন। ১৮৩৯ সালে তাঁর যে গবেষণাপত্রটি স্বীকৃতি লাভ করে তা হল –‘সাবজেকটিভ ফেনোমেনা অব অপটিকস’।
হেরম্যান কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের প্রথম দিককার রাজনৈতিক বন্ধু। মার্কসের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। তিনি যোগ দেন ‘লিগ অব দ্যা জাস্টে’ এবং খুব তাড়াতাড়ি এই সংগঠনের নেতা হয়ে ওঠেন। ১৮৪৭ সালে তিনি এটিনি ক্যাবেটের সমাজতান্ত্রিক উপন্যাস ফরাসি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন ছদ্মনামে।
বিপ্লবী আন্দোলনের সমর্থক কিছু উৎসাহী মানুষের সঙ্গে তিনি এঙ্গেলসের পরিচয় করিয়ে দেন। এঙ্গেলস তাঁকে সদানন্দময়, বিশ্বস্ত ও উদ্যোগী মানুষ বলে মনে করেন এবং মার্কসকে জানান। কিন্তু অনতিবিলম্বে তাঁর সম্পর্কে বিরক্ত হয়ে ওঠেন এঙ্গেলস। তিনি দেখতে পান হেরম্যান পিয়েরি-জোসেপ প্রুঁধো ও অ্যানাস্টাটিয়াস গ্রুনের মতবাদ সঠিক বলে মনে করছেন। তাই এঙ্গেলস মার্কসকে এক চিঠিতে হরম্যান সম্বন্ধে লেখেন, ‘It is disgraceful that one should have to pit oneself against such barbaric nonsense’.
হেরম্যান ‘কমিউনিস্ট লিগের’ ও সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এঙ্গেলসকে সহ্য করতে পারতেন না। তাই তিনি মার্কসের থেকে এঙ্গেলসকে পৃথক করার জন্য ষড়যন্ত্র করেন। এই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন মোজেস হেস, কার্ল লুডউইগ জোহান ডি’ইস্টার। ওসকার জে. হ্যামেনের মতে এঙ্গেলস —‘wounded the sensibilities of other communists because he was likely to act as the hatchet-man for Marx. As a result he was sometimes impetuous, brusque and even brutal.’ কিন্তু এই প্রচেষ্টা আদৌ সফল হয় নি। এসব ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে মার্কস এঙ্গেলসে এক চিঠিতে লিখলেন, ‘That I would leave you in the lurch even for a moment is pure fantasy. You remain my intimate friend as I remain yours, let us hope.’ [ক্রমশ]