এরপর আমরা বিংশ শতকের ৮ এর দশকের পত্র পত্রিকাগুলিকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। এই দশকের গোড়াতেই করিমপুর এবং তৎসহ অন্যান্য অঞ্চলের বেশ কিছু ভালো পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হয়।১৯৮০ তে করিমপুর থেকে প্রকাশিত হয় পাক্ষিক ‘পল্লীর কণ্ঠস্বর’ পত্রিকা। এই পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন তমেশ পাল। উদ্যমী কিছু তরুণদের নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। বহু ভালো কাজ পাওয়া গেছে পত্রিকাটির হাত ধরে। ১৯৮০ তে এই করিমপুর থেকে মাসিক পত্রিকা ‘মাটির কথা’ প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া এই বছরই মাসিক ‘শঙ্খচূড়’ প্রকাশিত হয় অসিত বিশ্বাসের সম্পাদনায় করিমপুর থেকে।ওই একই বছরে করিমপুর থেকে প্রকাশিত হয় রঞ্জন গোলদার সম্পাদিত ‘দ্বৈরথ’ পত্রিকা। ৫-৬ টি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮১ সালে বেতাই থেকে প্রকাশিত হয় গৌরাঙ্গ দাস সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘বন্ধুবাণী’। এটি বেতাই শ্রী শ্রী বিশ্ববন্ধু সেবাশ্রমের মুখপত্র ছিল। বর্তমানে এটি প্রকাশিত হয় এস এম তাজিরুল ইসলামের সম্পাদনায়। নানা ধর্ম মূলক আখ্যান, প্রবন্ধ এতে প্রকাশিত হয়, তবে তা অনিয়মিত। ১৯৮৩ সালে করিমপুরের পার্শ্ববর্তী ধোঁড়াদহ থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক পত্রিকা ‘রাখী’। এর সম্পাদক ছিলেন দেবপ্রসাদ সান্যাল। ১৯৮৭ তে পলাশীপাড়া থেকে প্রকাশিত হয়েছিল অনুপ কুমার চন্দ্রের সম্পাদনায় ‘আজকের গান’ পত্রিকা। এটি ছিল বাৎসরিক পত্রিকা। এছাড়া ১৯৮৮ সালে করিমপুর থেকে অশোক সরকার সম্পাদিত পাক্ষিক পত্রিকা ‘নদীয়া থেকে’ প্রকাশিত হয়। তারপরের বছরই মহিষবাথান থেকে প্রকাশিত হয় তপন ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘কথা’ ও ‘পাবলিক লাইব্রেরী’ পত্রিকা। প্রথমটি ছিল ত্রৈমাসিক ও পরেরটা ছিল সাপ্তাহিক। এছাড়াও করিমপুর থেকে এই আটের দশকেই প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পত্র-পত্রিকা। যেমন — রমেশ পাল সম্পাদিত ‘মনন’, গৌতম ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘কথা’ (দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র প্রীতম ভট্টাচার্য আবার নতুন করে ‘কথা’ পত্রিকাটিকে বাঁচিয়ে তুলবার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি একটি সংখ্যাও প্রকাশ করেছেন।) এছাড়াও কাজী ফজলুর রহমান সম্পাদিত ‘ভৈরব’, প্রদীপ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘দিনযেমন’ পত্রিকা। আশি আর নব্বই এর দশকের আরো কিছু পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয় করিমপুর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে। শান্তনু চৌধুরী সম্পাদিত ‘মিত্রমহল’ পত্রিকা, প্রভাত ঘোষ ও কুমারেশ ঘোষের সম্পাদনায় ‘কালবেলা’ পত্রিকা ইত্যাদি লিট্ল ম্যাগাজিনগুলোও আলোচনার দাবি রাখে। এই দশকের মধ্যেই আরো কিছু পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৮২ তে তেহট্ট থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক পত্রিকা ‘সীমান্ত’, যার সম্পাদক ছিলেন দয়াল উদ্দিন শেখ। আবার তপন চক্রবর্তী সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘ব্রততী’। এটি ১৯৮৮ সালে করিমপুর থেকে প্রকাশিত হয়। তারপর ১৯৯২ সালে পাক্ষিক পত্রিকা ‘সংলাপী’। এর সম্পাদক ছিলেন শান্তনু চৌধুরী। এটি প্রকাশিত হয় করিমপুর থেকে। ১৯৯৩ এ আরো কিছু পত্রিকার জন্ম হয় তেহট্ট মহকুমায়। যেমন- পলাশীপাড়া থেকে মুকুল ঘোষাল সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘পলিমাটি’, পলাশীপাড়া থেকে মুকুল চ্যাটার্জি সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘জোয়ার’ পত্রিকা, এছাড়াও অমরেশ কর্মকার সম্পাদিত পাক্ষিক পত্রিকা ‘দেশকন্ঠ’।এছাড়াও দেয়াল পত্রিকা হিসাবে ‘আগামী’ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৪০০ বঙ্গাব্দে (ইং-১৯৯৩) অলোক মণ্ডল ও জয়সীমা বিশ্বাসের সম্পাদনায়। তবে বর্তমানে প্রসাদ নন্দী জীবানন্দ শীলের সম্পাদনায় শারদ সংখ্যা হিসাবে মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৬-এ করিমপুরের হরেকৃষ্ণপুর থেকে আরও একটি পত্রিকার জন্ম হয়। পত্রিকাটির নাম ‘আলপথ’। এটি একটি শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা। এর সম্পাদক বিমল চট্টোপাধ্যায় ও জয়সীমা বিশ্বাস। শারদ সংকলন হিসাবে প্রথম পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় ১৪০৩ বঙ্গাব্দে (ইং-১৯৯৬)। বর্তমানে জয়সীমা বিশ্বাসের একক সম্পাদনায় পত্রিকাটি শারদ সংখ্যা হিসাবে প্রকাশিত হয়। নদীয়ার একটা প্রত্যন্ত গ্রামে বসে সম্পাদক যে কাজ চালাচ্ছেন ও পত্রিকাটিকে টিকিয়ে রেখেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
একবিংশ শতকের প্রথম দশকেই করিমপুর তথা তেহট্ট মহকুমার সর্বত্রই লিটিল ম্যাগাজিনের ব্যাপক জোয়ার আসে। এই দশকও লিট্ল ম্যাগাজিনের আরেক স্বর্ণযুগ। এই পর্বে লিট্ল ম্যাগাজিনগুলি আগের দিক থেকে অনেকটাই ছিমছাম। উৎকৃষ্ট মানের লেখা, ভাব গম্ভীর সম্পাদনা, বহু বিশেষ সংখ্যার সমন্বয়ে এই দশক যেন আগের চেয়ে বেশ অনেকটা স্বতন্ত্র এবং পরিণত। ২০০০ সালে সাহেবনগর থেকে সতীনাথ বৈরাগ্যের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক পত্রিকা ‘কৃষ্টি’। প্রথমে এটি হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা ছিল। পরবর্তীকালে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়। এখনো বার্ষিক পত্রিকা হিসেবে ‘কৃষ্টি’ সাহেবনগরের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। ২০০০ সালেই আরও বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যেমন — পলাশীপাড়া থেকে এস এম তাজিরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘দিশা’ নামক বার্ষিক পত্রিকা। বর্তমানে এটি প্রকাশিত হয় না। এই বছরেই তপন কুমার বিশ্বাস তেহট্ট থেকে প্রকাশ করেন ‘সাহিত্য অঙ্গণ’ পত্রিকা। এটি প্রথম থেকে বার্ষিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখনো ‘সাহিত্য অঙ্গণ’ প্রকাশিত হয় এবং তেহট্টের কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে পত্রিকাটি বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছে।এই বছরই করিমপুর থেকে বোধায়ন বিশ্বাসের সম্পাদনায় বার্ষিক পত্রিকা ‘পানসি’, পীযূষ কান্তি বিশ্বাসের সম্পাদনায় বার্ষিক পত্রিকা ‘নব অঙ্কুর’, শোভনচন্দ্র বিশ্বাসের সম্পাদনায় ‘রুদ্ধশ্বাস’ পত্রিকা, শেখ নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় বার্ষিক পত্রিকা ‘সোনার বাংলা’, কবি দেবজ্যোতি কর্মকার সম্পাদিত বার্ষিক পত্রিকা ‘অবলোকন’, অমৃত বিশ্বাসের সম্পাদনায় বার্ষিক পত্রিকা ‘স্টেট রিপোর্টার’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সময়ের আরো একটি জনপ্রিয় পত্রিকা ‘খোলা বারান্দা’। এই পত্রিকাটি সম্পাদক ছিলেন কবি প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক দুর্বাদল দত্ত। পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০০ খ্রিস্টাব্দে করিমপুর থেকে।বছরে একটি করে সংখ্যা প্রকাশিত হতো। তবে তা ছিল অনিয়মিত। এই পত্রিকাটির হাত ধরেই প্রথম করিমপুরের বুকে এপার বাংলা ওপার বাংলা যৌথ লিটিল ম্যাগাজিনের সংকলন বেরিয়েছিল, যা তৎকালীন সময়ে বিশেষ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ২০১৭ এর পর আর নতুন কোনো সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি। সম্পাদকের মতে উপযুক্ত লেখা পাওয়া যায়নি তার জন্য পত্রিকাটি আর প্রকাশ করা যায়নি। তবে বেশ কিছু বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল পত্রিকাটির হাত ধরে। যেমন — আধুনিক বাংলা কবিতা সংখ্যা, অণুকবিতা সংখ্যা, পোস্ট মর্ডান সংখ্যা, অণুগল্প সংখ্যা, ইসমৎ চুকতাই (উর্দু লেখিকা) সংখ্যা, যা তৎকালীন সময় দাঁড়িয়ে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। ২০০১ সালে করিমপুর থেকে আরো একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় তার নাম ‘কচিপাতা’। এর সম্পাদক ছিলেন পলাশ সরকার এবং সহযোগী সম্পাদক ছিলেন কবি দেবজ্যোতি কর্মকার ও দীপঙ্কর নাগ। এই পত্রিকাটির একটিমাত্র সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল পরে আর কোন সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি। করিমপুর থেকে প্রকাশিত একটি মননশীল লিটল ম্যাগাজিন ‘দর্পণ… মুখের খোঁজে’। এর সম্পাদক কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক দেবজ্যোতি কর্মকার। ২০০৩ সাল থেকে এই পত্রিকার যাত্রা শুরু। সগৌরবে ২০ বছর অতিক্রান্ত হল এই ছোট্ট পত্রিকাটির পথ চলা। ২০০৮ সাল নাগাদ পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে গঠিত হল একটি সাহিত্যগোষ্ঠী। পত্রিকা গোষ্ঠীর সম্পাদক হলেন দেবজ্যোতি কর্মকার আর প্রথম সভাপতি হলেন অমল চন্দ। লিটল ম্যাগাজিন মানে একটা আন্দোলন।শিবনারায়ণ রায় এর মতে এর ভূমিকা হল ”পরীক্ষা-নিরীক্ষার’, পথ নির্মাণের, উদ্ভাবনের, আবিষ্কারের, বিদ্রোহের, যৌবনের, প্রতিষ্ঠান শাস্ত্র – পরম্পরা, লোকাচার ইত্যাদির চৌহদ্দি পেরিয়ে অভিযাত্রার।” [ক্রমশ]