প্রশ্নহীন আনুগত্য ও বোধহীন সমাজ
পাঠক ভাবছেন এ আবার কেমন কথা! সবুজ বিপ্লবের সাথে খাদ্য রাজনীতি? হ্যাঁ, আসলে আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছি। আমরা নেতাজির মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। কিন্তু কোভিডের লকডাউন, অপরিক্ষিত পরীক্ষামূলক ক্যান্ডিডেট ভ্যাকসিন নিয়ে প্রশ্ন মনে জাগেনি। ভ্যাকসিনের এর উপাদান, ট্রায়াল, কোম্পানীর নিজের ওয়েবসাইটে পিঠ বাঁচানোর ঘোষনা (ডিসক্লেমার) নিয়েও ভাবে সোচ্চার হইনি। ভয় মানুষকে গ্রাস করেছিল। প্রচলিত সংবাদ মাধ্যমের প্রচারই একটা বড় কারন। অনেক নিরপেক্ষ যুক্তিগ্রাহ্য মতামত চেপে যাওয়া হয়েছিল। সত্যি কথাও প্রশ্নহীন আনুগত্য সম্পন্ন নিয়ামকদের রুষ্ট করবে। মনে রাখতে হবে সংখ্যাধিক্যের জোরে বা বারংবার মিথ্যা প্রচারে সত্য প্রমান করা যায় না। মিডিয়াকে দিয়ে তাই করানো হয়েছিল। পৃথিবীর অনেক দেশেই এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। লকডাউনের বিরুদ্ধে ইউরোপ, কানাডা ও আমেরিকায় রাস্তায় মিছিল হয়েছে। ধর্মীয় অন্ধতার মত বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও অন্ধ আনুগত্য জন্মেছে। চালু গন মাধ্যম, এক শ্রেনীর করপোরেট চিকিৎসা ব্যবসায়ী এর জন্য দায়ী। দেবাশিস লাহা তাঁর অমৃতস্য পুত্রা: গ্রন্থে এই সব নানা বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আজ বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলতে কিছু নেই। সবটাই বিজ্ঞানের মোড়কে রাজনীতি ও অর্থনীতি। মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে করে খাওয়ার জায়গা। আমরা কেউ কেউ তথাকথিত উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন করছি। পাহাড়ি অঞ্চলের বড় গাছ কেটে, সমতলের শাল জঙ্গল ধ্বংস করে বড় বড় ইমারত ও রাস্তা চওড়া করার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করেছি। বিশ্ব উষ্য়ায়ন নিয়ে অনেক আলোচনা করছি। কিন্ত ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীটাকে বাঁচানোর এতটুকুও স্বার্থত্যাগ করব না। আমরা এসি গাড়ি চড়ব, বাড়িতে এসি লাগাবো, গাছ কাটবো, অট্টালিকা বানবো আর পশুপালক ও কৃষকদের দোষ দেব বিশ্ব উষ্নায়নের জন্য। বন্য জঙ্গল ধ্বংস করে খনি হাতিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধেও অনেক প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। জঙ্গলের মধ্যে হোটেল তৈরীতেও আইন হল ২০২৩এ। আবার ২০২০ সালে তিনটি কৃষক আইন নিয়ে হাজার হাজার কৃষক একত্রিত হয়ে ওই কালা আইন রদ করার দাবি তুলেছেন। কৃষকের আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত সেটা রদ করা হয়। ইদানীং আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা শুনলেই অনেকের জ্বিব দিয়ে জল পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে কব্জা করে বেশ কিছু মানসিক বিকারগ্রস্ত শয়তান ভয় দেখিয়ে তথাকথিত অপরীক্ষিত ক্যান্ডিডেট ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে মানুষকে গিনিপিগ করেছে, সব কিছু বায়োমেট্রিক করা হচ্ছে। এমনটা যেন কোন দেশে চিকিৎসক নেই থাকলেও তাঁরা কিছু বোঝেন না। রোগ তৈরী করা হচ্ছে। নতুন প্যানডেমিক ট্রিটি ২০২৫ আরো এক শয়তানি। আগেই এই পোর্টালে ড. গৌতম দাস লিখেছেন। মানুষকে এক একটা সংখ্যায় পরিনত করা চক্রান্ত আমরা এখনো ধরতে পারছি না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা আমরা ভাবতে ভুলে গিয়েছি অবশ্য যাতে ভাবতে ভুলে যাই সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। কবি সুকান্তের কবিতার লাইন নব জাতকের কাছে বাসযোগ্য করে রাখার অঙ্গীকার কবিতাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
সবুজ বিপ্লব
কিন্তু সবুজ বিপ্লব? একইভাবে দুর্ভিক্ষের ভয় দেখানোর গল্প দিয়ে শুরু হয়েছিল। সেটা তো মানুষকে খাওয়ানোর জন্য হয়েছিল। তা না হলে মানুষ অভুক্ত থেকে যাবে, খাদ্য সংকটের নিরসন হবে কি করে? তাই দ্রুত খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিদেশী পাশ্চাত্য প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক কৃষি অবলম্বন করতে হবে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও তথাকথিত উন্নতমানের বীজ ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষির সব উপকরন আগে কৃষকের কাছে থাকত। সেটা ব্যবসায়ীদের কাছে না পসন্দ। এখন বীজ থেকে শুরু করে সব কিছু বাজার থেকে কিনতে হবে। ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের পরে আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছে, যাহাই পাশ্চাত্য তাই উৎকৃষ্ট। আর খবরের কাগজে ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিয়ে যখন লিখিত ভাবে ছাপা হচ্ছে তখন তা কি আর খারাপ হতে পারে? সুতরাং সবুজ বিপ্লব নিয়ে আমরা মেতে উঠলাম। স্কুলের পাঠ্য পুস্তকেও ঠাঁই পেল। মানুষের মনেও বধ্যমূল ধারণা তৈরী হয়ে গেল- সবুজ বিপ্লব না হলে ভারতীয়রা খেতেই পেত না। অনেক কৃষক জমিতে কারখানায় তৈরী বিষাক্ত জিনিস দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁরা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ওই সব বিষ প্রয়োগের ফলে খাবারে বিষ চলে যাবে কিনা, জমির, মাছের এর কোন ক্ষতি হবে কিনা, গবাদি পশু, বন্ধুপোকা ও প্রানীকূলের কোন ক্ষতি হবে কিনা। তাঁরা উত্তর পান নি। কারন স্বপক্ষে দেওয়ার মত উত্তর ছিল না। বিষ প্রয়োগ করলে তাংক্ষনিক লাভ হলেও আখেরে ক্ষতিই হবে। এ সাধারন জ্ঞানের কথা। তাঁদের প্রতিবাদী কন্ঠ কৃষির মূল স্রোতে প্রতিফলিত না হওয়াই স্বাভাবিক। রাতের অন্ধকারে কৃষকের জমিতে ইউরিয়া ছেটানো হয়েছে, লবন বিনামুল্যে ইউরিয়ার সাথে বিতরন করা হয়েছে। তৎকালীন কৃষি সম্প্রসারন আধিকারীকদেরও কিছু করার ছিল না কারন তাঁরাও চাকরি করেন। ঔপনিবেশিক আইনে চাকুরিগত সমস্যা হবে। গন মাধ্যমের দৌলতে স্বামীনাথন মহাশয়ের নাম সবাই জানেন। কিন্ত ড. রাধেলাল হরেলাল রিচারিয়ার নাম? আগে শোনা যায় নি তো! ঠিকই ধরেছেন। তিনি প্রচারের আলোয় আসতে পারে নি, বিজ্ঞান রাজনীতিও করতে জানতেন না। কটকের কেন্দ্রীয় ধান গবেষনা কেন্দ্রের অধিকর্তা ছিলেন ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। তিনি প্রায় ১০০০০ দেশী ধান নিয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি সতর্ক করেছিলেন নিয়মকানুন না মেনে, বেঁটে জাতের জাপানি ধানের (জ্যাপোনিকা প্রজাতি) বীজ রোগ পোকা মুক্ত কিনা যাচাই করা (Plant Quarantine) ভারতে চাষ শুরু হলে এদেশেও খোলা পচা, বাদামী দাগের মত রোগ ও পোকা ছড়িয়ে পড়বে। সময় দিলে কটকের ধান গবেষনা কেন্দ্রও বেশী ফলনের ধান নির্বাচিত করতে পারবে। আজ কিন্ত ধানে ওই সব রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি অন্যায় কিছু বলেছেন কি? কিন্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেওয়া হল। তাঁর অপরাধ! তিনি ওই পদে থাকলে সবুজ বিপ্লবের রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও বীজের ব্যবসার অসুবিধা হবে। তিনি ভারতীয় কৃষি অনুষন্ধানের অধিকর্তা হলে ভারতে কৃষির ধরনটাই হয়ত পাল্টে যেত। তাঁর নির্বাচিত বেশী ফলনের ধানগুলোর বিভিন্ন রাজ্যে আজ পর্যন্ত ট্রায়াল হল না। পাছে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ে?
রিচারিয়া
যে সমস্ত কৃষকরা ওই সব রাসায়নিক সার ও বিষের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদেরও দেগে দিয়ে বলা হয়ে ছিল অপ্রগতিশীল, ইংরিজিতে ল্যাগার্ড। এটা আবার কৃষি সম্পসারনের পাঠ্য পুস্তকে পড়ানো হয়। বলা হয়েছিল তাঁরা নাকি প্রগতি বিরোধী। কৃষকরা এখন বলছেন সার না দিলে নাকি চাষই সম্ভব নয়। এটাই তো কোম্পানীরা চেয়েছিল। রাষ্ট্র যেটা ঠিক বলবে সেটাই ঠিক বলে মানতে হবে। জেদের বসে সেটা অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা বা নদীর উপর বড় বাঁধ নির্মান বা পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন বা ১৫০ বছরের পুরোনো গাছ কেটে রাস্তা, অট্টালিকা নির্মান বা বলপর্বক অপরীক্ষিত টিকা প্রদানও হতে পারে। কোন প্রশ্নও তোলা যাবে না। জিনশস্য নিয়ে দিল্লীর কৃষি অনুষন্ধান পরিষদের চাকরিরত বিজ্ঞানী বা কোন প্রাক্তন বিজ্ঞানীরাও কোন কথা বলতে পারবেন না। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে এই স্বৈরাচারী আদেশনামা জারি করা হয়। তাহলে বুঝতে পারছেন বিজ্ঞান নিয়ে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। মধ্যযুগীয় বর্বরতায় আক্রান্ত জিওর্দানো ব্রুনো ও গ্যাললিওর কথা মনে করতে পারেন। আজ বিজ্ঞান কাদের কব্জায়? রাষ্ট্র নিজে চালিত হয় কি? না অন্য কেউ চালনা করে? ভুলে যেতে হয় এটা একবিংশ শতাব্দী, মধ্যযুগ নয়। এই দ্বিচারিতার কথা ভেবে দেখুন। অনেক যুক্তিবাদী জিন পরিবর্তিত জিন শস্যের বিরোধিতা করছেন কিন্ত নিজের শরীরে দেওয়া হবে এমন জিন পরিবর্তিত পরীক্ষামূলক এম আর এন এ ক্যান্ডিডেট ভ্যাকশিনের বিরোধিতা করছেন না। তাঁরা পরমানু বোমার বিরোধিতা করছেন কিন্ত পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে নয়। [ক্রমশ]
লেখক প্রাক্তন কৃষি অধিকারিক, জৈবকৃষি ও দেশজ ফসলের গবেষক ও লেখক